0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





তুত্তি ফ্রুত্তি, ফিশ ফিঙ্গার আর চিজ চেরি পাইন্যাপল 

‘ডেসার্ট’, এই শব্দটির কোনও বাংলা প্রতিরূপ হয় কি? আর হলেও তার পক্ষে কি একই অভিঘাত তৈরি করা সম্ভব? সম্ভবত না। আর এই ডেসার্ট প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবে এসে পড়বে দক্ষিণ ইউরোপের ’বুট’ আকৃতির একটি দেশের কথা। ইতালি। চোখ বন্ধ করে যদি আমাদের মধ্যে কেউ দশটা ডেসার্ট এর নাম কল্পনা করার চেষ্টা করি, একথা আনায়াসে বলা যায়, তার অধিকাংশেরই জন্মস্থান হবে অপূর্ব সুন্দর এই দেশটি। এমনকি নতুন কোনও পদ সৃষ্টির সময়েও অবচেতনে কাজ করে এই ইতালিয়ান অনুসঙ্গ।। তুত্তি ফ্রুত্তি ও তাই। রয় মাদারহেড নামক এক মার্কিনী গত শতকের চল্লিশের দশকে এই ডেসার্টটি (যার অর্থ ফলের সমাহার) আবিষ্কার করার কৃতিত্ব দাবি করলেও প্রকৃতপক্ষে এ’র দু’দশক আগেই মারি জেন্তিলের লেখা The Italian Cookbook এ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় এই ডেসার্টটি, যে মার্কিনী গায়ক লিটল রিচার্ডস ‘তুত্তি ফ্রুত্তি’ নিয়ে গানও লিখে ফেলেন। 

আমরা কৈশোরে, বলাই বাহুল্য, এসবের কিছুই জানতাম না। তখনও আমারা মফঃস্বল শহরের বাসিন্দা। এই বস্তুটিকে সম্বোধন করি ‘টুটি ফুটি’ বলে। সুযোগ হলেই দুই ভাইবোন কোনও এক কাকা বা দাদার সঙ্গে ট্রেনে করে চলে আসতাম কলকাতায়, মির্জা গলিব স্ট্রিটে, বাবার অফিসে। সেখানে রিসেপশানিস্ট মিসেস স্কট-এর জিম্মায় থাকতাম আমরা, যতক্ষণ না বাবার ছুটি হয়। সন্ধেবেলা বাবার অফিসের পর অনেক সময়েই বাবা আমাদের নিয়ে যেতেন ওয়াটারলু স্ট্রিটের একটি রেস্তরাঁয়। সেখানেই এই বস্তুটির সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ এবং প্রেম। আরও দুটি খাদ্যবস্তুর সঙ্গে আমাদের ভাব ভালোবাসার সূত্রপাতও এখানেই। ‘ফিশ ফিঙ্গার’ আর ‘চিজ চেরি পাইন্যাপল’। এর মধ্যে প্রথমজন খাঁটি সাহেব। একশ বছর আগেকার রান্নার বইতেও এর রেসিপি পাওয়া যায় এবং যে ব্রিটিশ পদগুলি পৃথিবী-বিখ্যাত, সেই তালিকায় ওপরের দিকেই থাকবে এটি। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে ফিশ ফিঙ্গারকে আম জনতার নাগালের মধ্যে পৌঁছে দিলো কোনও ব্রিটিশ নয়, একটি মার্কিন কোম্পানি, Gorton-Pew Fisheries বা Gorton’s, ততদিনে সে দেশে ফিশ ফিঙ্গার পরিচিত হয়েছে ফিশ স্টিক বলে। কিন্তু নামে কি আর আসে যায়? আঙুলের আকারে কাটা সাদা, প্রায় কাঁটাহীন মাছ যখন লেবুর রস, লাল লঙ্কা গুঁড়ো, কালো মরিচ গুঁড়ো আর নুনের মিশ্রণে কিছু সময় কাটিয়ে ময়দা, ডিম আর বিস্কুটের গুঁড়োয় মাখামাখি হয়ে ফুটন্ত তেলে নিমজ্জিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত এক অপরূপ সোনালী-বাদামী-বরণ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, যেকোনও খাদ্যরসিকের কাছেই তার আকর্ষণ হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সঙ্গে যদি টারটার সসের যোগ্য সঙ্গত থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। সে এক অকল্পনীয় যুগলবন্দী! যাকে রাজযোটকও বলা যেতে পারে। ইংরেজ ফিশ ফিঙ্গারের সঙ্গে ফরাসী টারটার সসের মিলন। অন্যান্য ক্ষেত্রে যতই দ্বৈরথ থাকুক না কেন। ফিশ ফিঙ্গারের শ্রেষ্ঠ আস্বাদন-স্তরে পৌঁছতে হলে এই টারটার সসের ভূমিকা কিন্তু বিরাট। আমাদের অতি আপন কাসুন্দিও অবশ্য খুব একটা পিছিয়ে থাকবে না। অনেক তথাকথিত ভালো রেস্তরাঁয় বা নেমন্তন্ন বাড়িতে টাটকা ভেটকির চমৎকার ফিশ ফিঙ্গারকে অনেক সময়েই ম্লান হয়ে যেতে দেখেছি খারাপ সসের জন্য। সে আরেক প্রসঙ্গ। আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন আমি নিতান্তই এক বালক, এই খাদ্যবস্তুগুলির গুণাগুণ বিশ্লেষণ করা তখন অসম্ভব ছিল। তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তখনও চিকেন রোলের মধ্যে টোম্যাটো সস বা চাউমিন এ শশাকুচির আগ্রাসন আরম্ভ হয়নি এবং সৌভাগ্যবশত আমার তখনকার অপরিণত জিভ শহরের অন্যতম সেরা কয়েকটি রান্নাঘরের সংস্পর্শে যেতে পেরেছিল। ফলত পরবর্তীকালে খারাপ, ভাল আর মাঝারির মধ্যে প্রভেদ করতে অসুবিধা হয়নি কখনও, নিজে হাতে রান্না শুরু করার অনেক আগেও। 

আমাদের ছোটবেলায় কলকাতার কয়েকটি খাওয়ার জায়গা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। এটি যে অতিশয়োক্তি নয় তা এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল সবাই জানেন। যেমন পার্ক স্ট্রিটে স্কাইরুম, চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যু অঞ্চলে চাং ওয়া, ইউ চু বা উত্তর কলকাতায় অ্যালেন বা মিত্র ক্যাফে বা চিৎপুরের রয়্যাল বা সেই মধ্য কলকাতারই সাবির, নিজাম বা আমাদের সে সময়ের অতি প্রিয় অনাদি কেবিন। এদের প্রত্যেকেই আলাদা আলদা রন্ধনশৈলীর কারণে খাদ্যপ্রেমিদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। শোনা যায়, ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এলে স্কাইরুম-এর একটি রান্না তাঁর খাবার টেবিলে পৌঁছতই। তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ ছিল একটু পিছিয়ে। সেকথায় পরে আসব। এই প্রসঙ্গের অবতারণা এই জন্যই, যে রেস্তোরাঁটির কয়েকটি খাবার নিয়ে এই লেখাটি শুরু করেছিলাম, সেই অ্যাম্বার (Amber) ও নিশ্চিতভাবে এই গোত্রভুক্ত হওয়া উচিত। শুধু এই তিনটি পদের কারণে নয়, অন্য অনেক রান্নার জন্যই। কি সেই বিশেষত্ব, যে কারণে আমরা বারবার সেখানে যেতাম? আর অন্যান্য সব কিছু ছেড়ে আমি এগুলিরই উল্লেখ করলাম কেন? 

প্রথমত টাটকা উপকরণের ব্যাবহার। ঠাণ্ডা কনকনে তুত্তি ফ্রুত্তি আইসক্রিম-এর গ্লাসটা আমাদের সামনে হাজির হতো উপচে পড়া নানারকমের ফল আর আইসক্রিম-এর সুবাস নিয়ে। গ্লাসের মধ্যে থাকত একটা লম্বা চামচ আর একেবারে ওপরে আইসক্রিম চূড়ায় থাকত একটা লাল টুকটুকে চেরি। সেই চেরি সুন্দরীকে প্রথমেই গলাধঃকরণ করতে কেমন যেন আসুবিধা হতো আমাদের। বরং লম্বা সেই চামচটাকে গ্লাসের একেবারে গভীরে পৌঁছে দিয়ে তুলে আনতাম পছন্দসই কোনও একটি ফলের টুকরো আর চামচটি গ্লাস থেকে বের করার ঠিক আগের মুহূর্তে তাতে লেগে যেত আইসক্রিম-এর ছোঁয়া। অনির্বচনীয় সেই স্বাদ ভুলতে পারিনি আজও। ফিশ ফিঙ্গার প্রসঙ্গে তো আগেই লিখেছি। একটু লক্ষ্য করলে পাঠক অবাক হতে পারেন, এই তিন পদের ক্রমপর্যায় বিন্যাসে। কারণ ফিশ ফিঙ্গার মাঝখানে অবস্থান করলেও তুত্তি ফ্রুত্তি ডেসার্ট হিসাবে খাওয়ার কথা শেষে আর চীজ চেরি পাইন্যাপল ভক্ষণ করার দস্তুর একেবারে শুরুতে। কিন্তু নিয়মভাঙা এই খেলাতেই কেন জানি না অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। 

এই ত্রয়ীর শেষতম যিনি, সেই চিজ চেরি পাইন্যাপল জন্মরহস্য নিয়ে নানান তথ্য পাওয়া যায়। তবে মনে হয় এক সময়ের বিখ্যাত মার্কিনী ডেসার্ট, ক্যান্ডল স্যালাড (Candle Salad) -এর সঙ্গে এর ক্ষীণ যোগসূত্র থাকা অসম্ভব নয়। অবশ্যই অনেক বিবর্তনের পথ পেরিয়েই এটি আজকের চেহারা পেয়েছে। কিন্তু এখানে আবার সেই ব্রিটিশ উপস্থিতি। ঠিকঠাক চেডার চিজ ছাড়া এ বস্তুটি তার কৌলীন্য পায় না যে! এবং নিশ্চয়ই চাই রসাল, মিষ্টি আনারস এবং আসল চেরি, লাল রঙা করমচা নয়। অ্যাম্বার-কে এই সব কটি বিভাগেই দশে দশ দেওয়া যেত। অতএব টেবিলে অন্যান্য খাদ্য এবং পানীয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি সত্বেও আমরা বেছে নিতাম এই তিনজনকে। মা-বাবার মুখে আলো-আঁধারির মধ্যে দেখতে পেতাম একধরণের হাসি। এক পারিবারিক ফ্রেমের মধ্যে আটকে যেত সেই মুহূর্তটি, যার সঠিক ক্যাপশান দিতে হলে এই তিন মূর্তির শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায়ন্তর নেই।

0 comments: