ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়
Posted in ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনিজিয়া কে আম
নেতারা টাকা খেতে ভালোবাসেন। কোনো কোনো নেতা আম খেতেও ভালোবাসেন। কেটে, চুষে, খোসা ছাড়িয়ে... আম আর আমজনতার যাবতীয় রস তাঁরা আস্বাদন করেন। জনতার রসাস্বাদন করা নেতার উদাহরণ ভূরি ভূরি, আমি নাহয় আম–খোর নেতা নিয়ে গল্পটা বলি। জিয়া–উল–হক, নাম তো সুনা হি হোগা।
পাকিস্তানের মাটিতে সবথেকে দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্কণ্টক রাজত্ব করে যাওয়া মিলিটারি শাসক জিয়ার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ পাকিস্তানের প্রথম মিলিটারি রুলার আইয়ুব খানের একেবারে বিপরীত ছিল। আইয়ুব যা যা বানিয়েছেন, জিয়া তা-ই তা-ই নষ্ট করেছেন। আইয়ুবের জন্ম খাইবার পাখতুনবাহ এলাকার একটি ফৌজি পরিবারে। ফৌজি বলতে ব্রিটিশ আর্মির অধীনে চাকরি করত। আইয়ুব নিজে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া সেরে আর্মি জয়েন করেন। অত্যন্ত ট্যালেন্টেড হওয়ার ফলে আইয়ুব সিনিয়রদের নজর কাড়েন। তাঁকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এই জায়গাটাকে পৃথিবীর মিলিটারি সার্ভিসের কেমব্রিজ বলা চলে। কোর্স কমপ্লিট করে ফিরে আসার পরে ভারতের ব্রিটিশ ফৌজের একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক রূপে অধিষ্ঠিত হন আইয়ুব খান। এরপর পাকিস্তানের জন্ম হল। আইয়ুব নিজের জন্য বেছে নিলেন পাক আর্মির অপশন। সেখানকার টপ জেনারেল হয়ে গেলেন।
জিন্নাহ সাহেবের মৃত্যুর পরে লিয়াকত আলিই হলেন হর্তাকর্তাবিধাতা। তিনি আইয়ুব খানকে নিজের সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্ব দিলেন। লিয়াকত আলিকে হত্যা করা হল। তখন পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মুখ কই? আইয়ুব খান নিজের ক্ষমতায় সরকার দখল করলেন। পাকিস্তানে উন্নয়নের জোয়ার এল। পাশপাশি কোল্ড ওয়ার চলছিল। আইয়ুব খান আমেরিকার পক্ষ নিলেন। আমেরিকাও নিজের ঝুলি উপুড় করে ঢেলে দিল অঢেল টাকা, অস্ত্র, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প। রাস্তাঘাট, বন্দর, স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, বাঁধ, ক্যানাল ইত্যাদি তৈরি হল। পাকিস্তানে স্বাধীন কসমোপলিটান সোসাইটির জন্ম আইয়ুব খানের সময়েই হয়েছিল।
এরপর ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ, ইস্ট বেঙ্গল হাতছাড়া হয়ে যাওয়া, ফাতিমা জিন্নাহর প্রেসিডেন্সিয়াল ইলেকশনে ঠগবাজি করে জেতার মতো পর পর আঘাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আইয়ুব খান নিজের চামচা জেনারেল ইয়াহা খানকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করতে বাধ্য হলেন। তিনিও হেরে গেলেন একাত্তর সালে, ক্ষমতায় এবার জুলফিকার আলি ভুট্টো।
এই ভুট্টো সাহেব একবার মুলতানে গেলেন। তা, সেবারে ওখানে যে স্যুটটা পরছিলেন, সেটার ফিটিংস খুব একটা ভালো ছিল না। মুলতানের এক সেনা অফিসার নিজে সেই স্যুটটাকে ঠিক করানোর দায়িত্ব নিলেন। ভুট্টোকে ট্যাঙ্কের ভেতরে বসিয়ে ঘোরালেন। কামান দেগে দেখালেন। এহেন খাতির পেয়ে ভুট্টো ভারী খুশি হলেন। মাত্র একবছরের মধ্যেই ওই সেনাধিকারিক অন্য সাতজন সিনিয়র জেনারেলকে টপকে পাকিস্তানের সেনাধ্যক্ষ রূপে পোস্টিং পেলেন। এই নতুন সেনাধ্যক্ষর নাম - জিয়া উল হক। সেই মুহূর্তে জুলফিকারের কাছে জিয়ার মতো বিশ্বস্ত আর কেউ ছিলেন না। যাই হোক, বিশ্বস্ত ব্যক্তির বিশ্বস্ততা এমন পর্যায়ের ছিল যে, পরের দুবছরের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টো কবরে চলে গেলেন, আর জিয়া গিয়ে বসলেন ওঁর চেয়ারে।
একজন পঞ্জাবি মিলিটারি ক্লার্ক তথা মৌলবির ছেলে জিয়া দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে বি.এ. পাস করে আর্মি জয়েন করেছিলেন। নিজের ধর্মীয় মতবাদ নিয়ে এতটাই গোঁড়া ছিলেন যে, একবার ইংরেজ অফিসারদের সঙ্গে ধার্মিক সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পরে পাক আর্মিতে চলে যান। আর বাকি সব কিছু তো লিখেইছি।
আজকের এই দক্ষিণপন্থী আবহে যে যাই বলুন না কেন, জিন্নাহ সাহেবের মধ্যে কিন্তু এতটুকু ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না। আদবানিজি এই নিয়ে মুখ খোলায় বিতর্ক হয়েছিল বটে, কিন্তু ইহাই সত্য। জিন্নাহ সাহেব হিন্দু-মুসলমান নিয়ে যা যা করেছিলেন, তা ছিল তাঁর রাজনীতি। জিন্নাহ নিজের প্রথম বক্তৃতায় একটি সেকুলার দেশের কল্পনা করেছিলেন। ‘হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই, পাকিস্তান মে মস্ত রহো ভাই...’। জিন্নাহ রিপাবলিক অব পাকিস্তানের আইডিয়া দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর বছর দশেক পরে পাকিস্তানের অফিশিয়াল নাম হয় ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান। তারপর শুরু হয়ে গেল কাউকে কম মুসলমান, কম দেশভক্ত, কম বুদ্ধিমান বলার ইঁদুরদৌড়। সুন্নীরা হলেন টপ ক্লাস। শিয়ারা নীচু। আহমেদিয়াদের বলে দেওয়া হল নন-মুসলিম। ধর্ম এমন একটি বিষয় যে সবসময়েই বড় নাজুক, সব সময়েই বড় বিপদ অনুভব করে। তাই যখন জিয়া এলেন, তখন তিনি ধর্মের পালে হাওয়া তুলে ইসলামকে রক্ষা করার এজেন্ডা নিলেন। সেটাও বাকি সব এজেন্ডার ওপরে রইল।
শরিয়া কানুন লাগু হল। ব্লাসফেমিতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করল পাকিস্তান। কিছু বলেছ কী ধর্মের মাথারা ব্লাসফেমির দোহাই দিয়ে তোমার মাথাটি কেটে নিয়ে গেণ্ডুক খেলবে। হুদুদ অর্ডিন্যান্স এল। হুদুদ মানে? অ-ইসলামিক আচরণ করলে সাজা পেতে হবে। চাবুক পড়বে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে। তারপর এসে গেল প্রেস সেন্সরশিপ। জিয়া বললেন, আমি অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখি। ব্যাস, করো, মুজাহিদিনদের সাপোর্ট করো। মাদ্রাসা খোলা হতে থাকল। পরে সেখান থেকে কী শিক্ষার জন্ম পাকিস্তান দিতে পেরেছে, তা বিশ্ববাসীর কাছে অজানা নয়। ধর্মের নাম করে দেশের যুবকদের একটা নতুন আইডিয়োলজি দিল পাকিস্তান, আর দিল অস্ত্র — যাও, সন্ত্রাস চালাও!
আই এস আই-এর ক্ষমতা ক্রমশঃ বাড়ছিল। যে যত জো হুজুর বলবে, সে-ই সংসদে পৌঁছবে। কারা সংসদে যাওয়ার টিকিট পেল? ধর্মগুরুরা। রাষ্ট্রের সমস্ত বিষয়কে এবার ধর্মের চশমায় দেখা হতে লাগল। সবকিছুর সমাধানের জন্য ব্যবহার করা হতে লাগল শরিয়া কানুন। ভাবটা এমন যে, এইসব করলেই ধর্মরক্ষা হবে।
আর এইসব কিছুর মাঝে একদিন আম ফাটল। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন পাঠকবন্ধু — বোমা নয়, আম ফাটল। ঘটনাটাও ভারী অদ্ভুত। একবার একটি ফৌজি মহড়া দেখার জন্য জিয়া বহাবলপুর গিয়েছিলেন। যেহেতু জিয়া আম খেতে ভালোবাসতেন, সেখানে কেউ বা কারা তাঁকে আম উপহার দেয়। আমের ঝুড়ি কে দিয়েছিল কেউ জানে না। সেই ঝুড়ি তাঁর প্লেনে রাখা হয়। প্লেন যখন মাঝ আকাশে, তখন সেই আমগুলোর মধ্যে থাকা বোমায় বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯৮৮ সালের ১৭ই আগস্ট জিয়া উল হকের মৃত্যু হয়।
প্রচুর কন্সপিরেসি থিওরি চলে। আমের মধ্যে থাকা বোমার কথাটা আগেই লিখেছি। জিয়ার ভক্তবৃন্দ নারা তুলল — ‘জব তক সুরজ চান্দ রহেগা, জিয়া তেরা নাম রহেগা...’। কিন্তু এ ভাই পাকিস্তান, এখানে লোকে করোনা আসার আগে থেকেই হাতে ধুয়ে ফেলার অভ্যেস জারি রেখেছে। ২০১০ সালের অষ্টাদশ সংবিধান সংশোধন দ্বারা পাকিস্তানের সংবিধান থেকে তাঁর নাম মুছে দেওয়া হয়।
কিন্তু জিয়ার নাম সবার মনে রয়ে গেছে। আজও যখন পাকিস্তানের চারজন বুদ্ধিজীবী টিভি চ্যানেলে বসে পাকিস্তানের দুর্দশা নিয়ে কথা বলেন, তখন জিয়াকেই গালিগালাজ করেন। অবশ্য এই মিডিয়াই একদা জিয়াকে মাস্টার টেকনিশিয়ান কিংবা রিংমাস্টার অভিধায় ভূষিত করত।
0 comments: