0

গল্প - অমিত রায়

Posted in


দিনকয়েক ধরেই বড়ো ভাবনায় পড়েছেন দীপঙ্কর। দীপঙ্কর বসু। বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে যাঁর সুনাম রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য জীবনে কখনো ক্ষমতায় আসা হয়নি তাঁর। কিন্তু চিরকালই ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর বিচরণ। ৬৫ বছরের দীপঙ্করকে কিং-মেকার বলা যাবেনা ঠিকই, কিন্তু প্রভাবে তিনি হিমালয়ের মতো। সততা, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেম দিয়ে তাঁর ভাবমূর্তি আবর্তিত হয়। স্ত্রী মাধুরী, বয়স ৫৯ বছর। শান্ত গৃহবধূ। স্বামীর সুখেই তাঁর সুখ। একমাত্র পুত্র রূপঙ্কর শহরতলীর উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক। বয়স ৩২ বছর। এছাড়া প্রচুর টিউশনি করে সে। এখনো বিয়ে করেনি। চাকরিটা সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় পেয়েছে সে। বাবার সুপারিশ লাগেনি‌। অবশ্য সুপারিশের প্রয়োজন হলেও দীপঙ্কর তা করতেন না। 

চিরকালই দীপঙ্কর বিরোধী দলে ছিলেন। প্রথম দিকে সাধারণ সদস্য, পরের দিকে অর্থাৎ শেষ কুড়ি বছর তিনি বিরোধী দলনেতা। কোনো সুযোগ সুবিধা নেন নি তিনি। তাঁর কোনো সিকিউরিটিও নেই। একটা দু-কামরার ফ্ল্যাটেই কাটিয়ে দিলেন এতগুলো বছর। সপরিবারে। দেশের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার মালতিপুরে। সেখানে তাঁর খুড়তুতো দাদা থাকেন সপরিবারে। তাঁর বাড়ি তাঁরাই দেখাশোনা করেন। বছরে একবার করে দেশের বাড়িতে যান দীপঙ্কর। সপরিবারে। 

বছর খানেক ধরেই তিনি অনুভব করছেন যে দলে তাঁর নিরঙ্কুশ আধিপত্যটা বোধ হয় আর নেই। নতুন ছেলেমেয়েরা উঠে আসছে। তিনিও চাইছেন নবীনের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে অবসরের গ্রহে পদার্পণ করবেন। কিন্তু এমন যোগ্য কাউকে চোখে পড়ছে না, যার হাতে নিশ্চিন্তে তিনি তুলে দিতে পারেন প্রধানত নিজের হাতে তিল তিল করে গড়ে তোলা সন্তানসম দলটাকে। বছর খানেক আগে বিপুল দত্ত, তাঁর দলের উঠতি নেতা সভাপতি হয়েছে। তিনিই ছেড়ে দিয়েছেন পদটি। বছর পঞ্চাশের বিপুল এখন বিরোধী দলনেতার পদটি চাইছে। অবশ্য সরাসরি নয়, মনে মনে। হাবেভাবে, আভাসে, ইঙ্গিতে সে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে এবার দীপঙ্করের আলবিদা বলার সময় এসে গেছে। 

সম্প্রতি রাজ্য সরকার একটা বিল আনতে চাইছেন। সেটাই দীপঙ্করের ভাবনার কারণ। সরকার চাইছেন এমন একটি বিল আনতে যার বিষয়বস্তু স্কুলের শিক্ষকরা টিউশনি করতে পারবেন না। সেই ব্যাপারে দলের মতামত নিতে বিধায়কদের সাথে বসেছিলেন দীপঙ্কর। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কখনো তাঁর পছন্দ দলের উপর চাপিয়ে দেন না। দলের পছন্দই তাঁর পছন্দ। আজ দলের মতিগতি বুঝতে চাইছিলেন তিনি। 

সেই ব্যাপারে বিধায়করা মত বিনিময় করছিলেন। এই দলের অলিখিত নিয়ম হলো সবার শেষে বলেন দীপঙ্কর। সবার কথা শুনে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের মতামত দেন তিনি। দলের বেশির ভাগ বিধায়ক বিলের স্বপক্ষে মতামত দিচ্ছিলেন। দলের বেশির ভাগের সাথে তাঁর মতামত মিলছিল না আজ। এটাই তাঁর উদ্বেগের কারণ। তাঁর ঠিক আগের বক্তা বিপুল উচ্ছসিত কন্ঠে বিলটিকে সমর্থন করেছে। দলের বেশ কয়েকজন টেবিল চাপড়ে সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছে। 

দেওয়াল লিখনটা পড়তে পারছিলেন দীপঙ্কর। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে এর পর আর কিছুই করার নেই। কারণ চতুর বিপুল বলেই দিয়েছে - সবাই তো প্রায় এই প্রস্তাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাই আমার মনে হয় দীপঙ্করদাও এই প্রস্তাবের পক্ষে বলবেন। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিলে কিছু সমস্যা হবেই। নির্বাচন আসছে। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে মত দিলে বিরাট সংক্ষক প্রাইভেট টিউটরের ভোট সরকারপক্ষে চলে যাবে। আর আমরা যদি উচ্ছসিত ভাবে এই বিলটিকে সমর্থন করি, তবে সরকারপক্ষ এককভাবে সব ভোট নিজেদের বাক্সে নিয়ে যেতে পারবে না। ভোট ভাগাভাগি হবেই। আর সেটাই আমাদের লাভ। 

শেষ পর্যন্ত দীপঙ্কর বলতে উঠলেন। সবাইকে হতচকিত করে তিনি বললেন - আমি সবার মতামত বুঝতে পেরেছি। এই বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে বলে নিই - কুড়ি বছর ধরে এই দলের ক্ষমতায় আমি আছি। এবার আমার সরবার সময় এসে গেছে। দলে নতুন ভাবনা, নতুন রক্ত দরকার। তাই আমি এই বিরোধী দলনেতার পদ থেকে সরে দাঁড়াতে চাই। দল এখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী। হয়তো আসছে নির্বাচনেই আমাদের এই জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় আসতে চলেছে। তাই আমি মনে করি এটাই আমার সরে যাবার সেরা সময়। 

হতচকিত নেতারা বুঝতে পারছিলেন না এখন কী করা উচিত। আর তারপরেই বিপুল ও তার বশংবদরা টেবিল চাপড়ে দীপঙ্করের ইচ্ছাকে সমর্থন করে। 

দীপঙ্কর বলতে থাকেন - আগামী রবিবার আমরা বিরোধী দলনেতা হিসাবে আমাদের মধ্যে কাউকে বেছে নেব। 

এবার সবাই টেবিল চাপড়ে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। দীপঙ্কর বলে চলেন - এবার আসি আজকের প্রসঙ্গে। আমি সরকারের এই প্রস্তাব মানতে পারছি না। একেবারেই যে মানতে পারছি না, তা নয়, তবে সেটা আংশিক। আমি মনে করি এই বিল বিশেষ করে গ্রাম বাংলার সর্বনাশ ডেকে আনবে। এই বিল শহরের পক্ষে উপযুক্ত। আমার বাড়ি গ্রামে। এখানে অনেকের চাইতে আমি গ্রামকে ভালো চিনি। গ্রামে সেই পরিকাঠামো নেই। বিশেষ করে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে। আর আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে গ্রাম বাংলাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমার মনে হয় গ্রাম বাংলায় আগে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে, তারপর তার প্রয়োগ করতে হবে। না হলে গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই আমি মনে করি যে এই বিল শহরের পক্ষে উপযুক্ত হলেও গ্রামের পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত নয়। 

দীপঙ্কর বসে পড়তেই উঠে দাঁড়ালো বিপুল। বলে - এটা আপনার ব্যক্তিগত মত। কিন্তু দুঃখিত, আমি তা মানতে পারছি না। এই বিল সমর্থন না করলে নির্বাচনে আমাদের ভরাডুবি হবে তা নিশ্চিত। কেন হবে তা আগে বলেছি। তার আর পুনরাবৃত্তির দরকার দেখছি না। এই বিল সমর্থন না করলে আগামী পঞ্চাশ বছর আমরা ক্ষমতায় আসতে পারব না। আর কতদিন আমরা বিরোধী পক্ষে থাকব? আর একটা কথা হলো, মুখে আপনি নিজেকে যতই গ্রামের ছেলে হিসাবে দেখাবার চেষ্টা করুন না কেন, গ্রামে কিন্তু আপনি যান বছরে একবার। তাই হঠাৎ আপনার এই গ্রাম প্রীতি আমাকে বিস্মিত করছে দীপঙ্করদা। আমার মনে হয় দলের সবাই বা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আমার মতামত মেনে নেবে। আপনারা কী বলেন? একথা বলে বিপুল নাটকীয়ভাবে দলের অন্যদের দিকে তাকায়। বিধায়করা সম্ভবত এমন পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। অবশেষে প্রায় সবাই বিপুলের পক্ষে মত দেন। 

বিপুল বলে - দেখুন দীপঙ্করদা। দলের মত। দিন বদলের ডাক এসেছে। ঐ বস্তাপচা ধ্যানধারণা আর চলবে না। আপনার কথা ধার করেই বলি - দলে নতুন রক্তের প্রয়োজন। 

ভাবতেই পারছিলেন না দীপঙ্কর। প্রায় একার হাতে গড়ে তোলা দলটা এতটা পাল্টে গেল! মনের মধ্যে উথালপাথাল হচ্ছিল। এতদিন যাদের নিয়ে দল করেছেন, যাদের বিপদে আপদে বুক দিয়ে আগলেছেন, তারা এতটা বদলে গেল! ভাবতেই পারছিলেন না দীপঙ্কর বসু। এদিকে হাতে সময়ও নেই। পরশু বিধান সভায় বিল নিয়ে আলোচনা। বড়জোর হাতে রয়েছে একটা দিন। 

উঠে দাঁড়ালেন দীপঙ্কর। টেনে নিলেন মাইক্রোফোনটা। চশমার কাঁচটা মুছে নিলেন পাঞ্জাবীর প্রান্ত দিয়ে। ঘরে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সবাই অপেক্ষায়। কী বলবেন দীপঙ্কর! অপেক্ষারত বিপুল ও তার দলবল। 

- আমি কখনো আমার মতামত জোর করে দলের ঘাড়ে চাপাইনি। এবারও তা করব না। আজ পর্যন্ত দলের সব সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী হয়েছে। এবারও তার অন্যথা হবে না। শুধু এ ক্ষেত্রে আমি আপনাদের কাছ থেকে সামান্য সময় চাইছি। আগামীকাল সকাল বারোটার মধ্যে আমি আমার মতামত জানিয়ে দেব। এইটুকু সময় আপনারা আমাকে ভিক্ষা দিন। 

আবার উঠে দাঁড়ালো বিপুল - নিশ্চই । আপনি আমাদের দলের প্রাণপুরুষ। দল এই সময়টা আপনাকে দিচ্ছে। তবে হাতে তো সময় নেই। আগামীকাল সকাল দশটার মধ্যে আপনার মত আমাদের জানাবেন। না হলে আমাদের আর কিছু করবার থাকবে না। 

দীপঙ্কর বেরিয়ে আসেন। খুব যে ভেঙে পড়েছেন, তা কিন্তু মনে হচ্ছিল না। সামান্য গম্ভীর মাত্র। বাড়ির দিকে যাত্রা করেন। 

বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে বসতে মাধুরী চা-জলখাবার নিয়ে আসেন। রূপঙ্কর স্কুল থেকে ফিরে চা খাচ্ছিল। স্বামীকে একটু বিষণ্ণ আর আনমনা লাগছিল মাধুরীর। জিজ্ঞাসা করেন - কী গো, কী হয়েছে? এত চুপচাপ কেন? কোনো সমস্যা? 

- না, সেরকম কিছু নয়। তোমাদের সাথে একটা পরামর্শ আছে। তোমাদের মতামতটা আমার জানা দরকার। 

রূপঙ্কর বলে - কী হয়েছে বাবা? 

দীপঙ্কর বলতে থাকেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। খুঁটিনাটি সব। রূপঙ্কর-মাধুরী বাকরুদ্ধ! একসময় বলা শেষ হয়। সমস্ত ঘরে একটা থমথমে স্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে। 

নীরবতা ভাঙে রূপঙ্কর - একটা কথা বলি বাবা। আমার জন্য চিন্তা কোরো না। নতুন করে শুরু করতে আমার সমস্যা নেই। হয়তো নতুন করেই সব শুরু করব আমি। আজ পর্যন্ত আমাদের সব ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত তুমি নিয়েছ। তাতে তো কোনো ক্ষতি হয়নি। তুমি যে সিদ্ধান্ত নেবে, তাতে আমার সম্পূর্ণ সহমত থাকবে। আমাদের জাহাজটা চলবে বাবা। আর তুমি তো জান যে একটা জাহাজ কী ভাবে চলবে, কোথা দিয়ে চলবে, তা ঠিক করেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। তুমিই তো আমাদের ক্যাপ্টেন, বাবা। 

ধীরে ধীরে বাইরে চলে যায় রূপঙ্কর। নিজের জায়গা থেকে সরে এসে মাধুরী চলে যান স্বামীর কাছে। পরম মমতায় হাত বোলাতে থাকেন দীপঙ্করের কমে আসা সাদা চুলে। মুখ তুলে তাকান দীপঙ্কর। শুধান - তুমি কী বলো? 

- আমি কী বলব বল তো? আজ এতগুলো বছর ধরে আমি কী কখনো কিছু বলেছি? তা হলে এত বছর পরে সে নিয়ম ভাঙব কেন বল তো? আমি জানি তুমি বরাবরের মতই সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে। তবু একান্তই যদি কিছু বলতে বলো, তবে বলি - তুমি তাই কর, তোমার বিবেক যা বলে। 

একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে দীপঙ্করের চোখেমুখে। ভরসার হাসি, বিশ্বাসের হাসি। স্ত্রীর হাতে অল্প একটু চাপ দিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করেন দীপঙ্কর বসু। ডায়াল করেন। - হ্যালো! প্রেস ক্লাব... 

পরদিন সকাল দশটা। দীপঙ্কর বসুর ফ্ল্যাটে তিলমাত্র জায়গা নেই। কী একটা বিশেষ ঘোষণা করবেন তিনি সাংবাদিকদের সামনে। চায়ের কাপ হাতে সবাই অপেক্ষায়। দুধ সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে ওয়েল শেভড দীপঙ্কর নেমে আসেন। বেশ তরতাজা দেখাচ্ছিল তাঁকে। আত্মবিশ্বাসী। 

মাইক্রোফোনটা টেনে নেন দীপঙ্কর - নমস্কার! আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। এই শেষ বার আপনাদের বিরক্ত করছি। দুটি কথা বলব বলে এই সাংবাদিক সম্মেলন। প্রথমটি হলো - একান্তই ব্যক্তিগত কারণে বিরোধী দলনেতার পদ থেকে আমি পদত্যাগ করেছি। মাননীয় রাজ্যপাল মহাশয় আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণও করেছেন কিছুক্ষণ আগে। এখনি রাজভবন থেকে প্রেস রিলিজ আসছে। 

ঘরের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়। এমনটা যে হতে পারে তা কেউ আন্দাজ করতে পারেননি। একটাই প্রশ্ন সাংবাদিকদের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে - কেন? হঠাৎ কী হলো? দীপঙ্কর দুই হাত তুলে সবাইকে শান্ত করেন। আবার মাইক্রোফোনটা টেনে নেন। সবাই উৎকর্ণ! 

- দ্বিতীয় কথাটা হলো, একই কারণে জাতীয়তাবাদী দলের সাধারণ সদস্যপদও আমি ছেড়ে দিয়েছি। আমার পদত্যাগপত্র ইতিমধ্যেই আমার দলের সভাপতি মাননীয় বিপুল দত্তের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছি, এবং তা গৃহীত হয়েছে। 

এবার কিন্তু বেশ শোরগোল হলো। কেউই এতটা আশা করতে পারেন নি। একজন অভিজ্ঞ সাংবাদিক প্রশ্ন করেন - কিন্তু হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত দাদা? এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত! কোনো সমস্যা হয়েছে কী? দলে কী আপনি কোনঠাসা হয়ে পড়েছিলেন? 

স্মিত হেসে দীপঙ্কর বলেন - না, না, তেমন কিছু নয়। আসল কথা হলো বয়স। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার। আর সামলানো যাচ্ছিল না। কুড়ি বছর এই পদে ছিলাম। এবার নতুন কারোর আসা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তাই ছাড়লাম। আর তা ছাড়া, সব পেশাতেই অবসর আছে। অবশ্য আমাদের দেশে এই পেশাতে কেউ অবসর নেন না সচরাচর। আমিই না হয় শুরু করলাম। 

একজন সাংবাদিক বলেন - কিন্তু দল কেন ছাড়লেন দাদা? 

- ঐ যে বললাম, দলে নতুন রক্ত দরকার হয়ে পড়েছিল। 

আর একজন সাংবাদিক বলেন - আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা যদি বলেন! 

- শুধুই অবসর আপাতত। পঁয়তাল্লিশ বছর রাজনীতি করেছি। আজ বড়ো ক্লান্ত আমি। কিছুদিন পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে দিন। তারপর ভাবা যাবে। 

প্রথম সাংবাদিক আবার বলেন - এই বিদায়ের দিনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চান? 

- একটাই কথা বলব। শুধু নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখার জন্য রাজনীতি করবেন না। অনুগ্রহ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভাবুন। 'এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি / নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার' - এই হোক সমস্ত রাজনৈতিক দলের মিশন। ধন্যবাদ। 

সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হলো। সবাই শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিলেন। কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন। সবাই বেরিয়ে গেলেন। দীপঙ্কর চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন। এমন সময় মাধুরী এসে কাঁধে হাত রাখলেন। সম্বিত ফেরে দীপঙ্করের। 

মাধুরী বলেন - কি গো, মন কেমন করছে নাকি ফেলে আসা জীবনের জন্য? 

- না, একটু স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম মাত্র। একটা চমৎকার রাজনৈতিক জীবন কাটালাম। কোনো অনুশোচনা নেই আমার। জীবনে যা বিশ্বাস করেছি, তাই করেছি চিরকাল। আজ জীবনের এই শেষ বেলায় এসে তার অন্যথা করি কী করে বলো? 

এমন সময় রূপঙ্কর প্রবেশ করে। একটু উত্তেজিত। বলে - এটা তুমি কী করলে বাবা? 

- কেন রে, আমি আবার কী করলাম? 

- এইভাবে পালিয়ে যাবে তুমি? হারজিত জীবনের অঙ্গ। তুমি লড়াই না করে হার স্বীকার করবে? তুমি যে আমার জীবনের আদর্শ পুরুষ বাবা! 

- লড়াই করব বলেই তো কত অনায়াসে, অবলীলায় ছেড়ে দিতে পারলাম। 

- কিন্তু দলীয় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে কীভাবে লড়াই করবে বাবা? 

- সারা জীবন রাজনীতি করলাম। জীবনের শেষ কটা বছর রাজনীতি না হয় নাই থাকল। 

- ঠিক কী করতে চাইছ তুমি? 

- তুই এই ফ্ল্যাটে থাকবি। এবার তোর বিয়ে দেব। তোরা সুখে সংসার কর। আর আমি তোর মাকে নিয়ে মালতিপুরে চলে যাব। দেখ, আমি আর তোর মা দুজনেই সায়েন্স গ্রাজুয়েট। অবশ্য চর্চা নেই দীর্ঘকাল। কিন্তু সব তো ভুলে যাইনি। মালতিপুরে জীবনের বাকি কটা দিন কাটাব। ওখানে অনেক সম্ভাবনা আছে। এই শেষ বেলায় ওখানকার কয়েকটা কুঁড়িকে আমি আর তোর মা মিলে যদি ফুলে পরিণত করতে পারি, তবেই বুঝব প্রকৃত অর্থে দেশের জন্য কিছু করতে পারলাম। 

তারপর মাধুরীর দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করেন - কী গো, নেবে নাকি চ্যালেঞ্জটা? আমার সাথে? 

মাধুরী বলেন - তুমি আমার সব ইচ্ছেগুলো কী করে আগেই জানতে পেরে যাও বলতো? তাই আমার কিছু বলার থাকে না। এবারও আমার একেবারে মনের কথাটা তুমি বলেছ। কাজেই আমি নিচ্ছি চ্যালেঞ্জটা। আমরা। 

রূপঙ্কর বলে - তোমাদের এই লড়াইতে আমাকেও শরিক করে নাও। আমিও তোমাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই লড়াইটা লড়তে চাই। 

মাধুরী বলেন - তা কী করে হবে? তোর চাকরিটার কী হবে? সেটা তো এখানে থেকে হবে না। আমরা জীবনের প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। তোর জীবনটা তো ভালো করে শুরুই হয়নি। এই বয়সে এসে আমরা যে ঝুঁকি নিতে পারি, এত অল্প বয়সে তুই তা নিতে পারিস না। 

- আমাকে বাধা দিও না মা, বাবা। আমি তো তোমাদেরই ছেলে। বিবেকের নির্দেশ ছাড়া কাজ করে স্বস্তি পাই না আমি। এ তো তোমরাই শিখিয়েছ। একটা কাজ করা যাক। এই ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দাও। তাতে যে টাকা পাওয়া যাবে, সেটা ব্যাঙ্কে রাখলে তোমাদের জীবনটা রাজার হালে না চললেও মোটামুটি চলে যাবে। আর এই দশ-বারো বছরে আমিও খুব একটা খারাপ জমাই নি। আর আমার বয়স অনেক কম। খাটার ক্ষমতা আছে। তাহলে কিসের সমস্যা? এই সুযোগটা আমাকে দেবে না মা? বাবা? 

নিজের এলোমেলো চুল ঠিক করতে করতে দীপঙ্কর বলেন - জীবনটা তোর। তাই সিদ্ধান্তও তোর। তুই যদি স্বেচ্ছায় এই নিতান্তই অসম লড়াইটা চালাতে চাস, তাতে আমি আপত্তি করব না। তবে তোর সামনে রয়েছে দীর্ঘ দিন। লড়াই করতে গিয়ে কখনো হাল ছেড়ে দিবি না তো? 

- আমি যে তোমাদের হাতে গড়া বাবা! লড়াই যে আমার রক্তে! আজকের শিশুকে এই পৃথিবীর জন্য আরো একটু উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে আমার সর্বস্ব আমি উজাড় করে দেব। 

- বেশ। তবে শুরু হোক নতুন লড়াই। হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই। তোমরা তৈরি হও। 

রূপঙ্কর এগিয়ে এসে মাধুরী আর দীপঙ্কর কে প্রণাম করে। 

- কী হলো? হঠাৎ প্রণাম কেন? মাধুরী আর দীপঙ্কর বিস্মিত হন। 

দীপঙ্কর এর পায়ের কাছে বসে পড়ে রূপঙ্কর - আমাকে ক্ষমা কর বাবা। আমি খণ্ড মুহূর্তের জন্য হলেও তোমার উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছিলাম। 

দীপঙ্কর ঝুঁকে পড়ে ছেলেকে তোলেন। মাধুরী এগিয়ে আসেন। তিন জোড়া মুষ্টিবদ্ধ হাত পরম মমতায়, বিশ্বাসে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে।

0 comments: