3

গল্প - রজত ভট্টাচার্য

Posted in

ট্রেন থেকে নেমে তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগালুম। ছোটমাসি এসেছে। রাতে লুচি-আলুরদম বাঁধা। সবে গেট পেরুচ্ছি, দেখি মেসো লগি হাতে উঠোনের পেঁপে গাছটাকে খুঁচোচ্ছে। আমায় দেখে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে বলল "কাল ঘ্যাচাং-এর জন্মদিন, সে খেয়াল আছে? একটু যে নেমন্তন্ন করে রাখবি, তাও করিসনি। তুই একটা...!" আমি মন খারাপ করে বললাম "বনানীদি হোঁচট খেয়ে লেংচু। তাই ফষ্টি আর নষ্টিও আসবে না। তা'লে মন্টুর মা'কেই ডাকি?" মেসো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল "তোর মাসি রাগ করবে। তার'চে বরং নিরিমিষ্যি খেয়েই এবার কাটাব। তুই বরং রহমতের দোকান থেকে কচি দেখে দেশী মুরগী কিনে আনিস।"

তা ভাল। রহমতিয়া আজকাল বাপের দোকানের খাজাঞ্চি। তাই নান্টু কোলে রোজ রহমতের দোকানে চা খেতে আসে। দেখা হলে টিভি সারানোর কথা মনে করিয়ে দেব। ঘরে ঢুকে সব্বে মাত্র বসেছি, ঘ্যাচাংবাবু এসে পেট আর কান একসাথে চুলকোতে চুলকোতে বলল "বলো। " তাই বললুম "সোনা পিসির বাড়ির পাশে ঝুপসি গাছে যে ভুতুমটা আছে, সেটা কুটুমবাড়ি গেছে কদিন হল। দেখা হচ্ছে না। তাই গপ্প নেই।" ঘ্যাচাং শুনে বলল "তাপ্পর?"

"তাপ্পর এখন মুড়ি আর চা, রাতে লুচি।"

মুড়ির সাথে কাঁচালঙ্কা না খেলে ঠাকুর পাপ দেয়। তাই বারান্দার পাশের লঙ্কা গাছটা থেকে একটা কালচে মতন লঙ্কা তুলে সব্বে ছোট করে কামড়েছি, ছোট মাসি পিছন থেকে বলল "দিলি এঁটো করে, এখন মঙ্গলবারে আমি কি দিয়ে ঘি-ভাত খাব? কত্তবার বলেছি, না নেয়ে গাছ ছুঁবি না। এখন কি হবে?" আমি ভেবে চিন্তে বললুম, "কাল গাছটাকে ভাল করে নাইয়ে দেব’খন, আর এঁটো থাকবেনা।" ছোট মাসি ভীষন বিরক্ত হয়ে বলল "তোর মুন্ডু। তোর বুদ্ধি আর হলোনা। এখন মিনু রাজি হলে হয়। যা নাক উঁচু মেয়ে, বাব্বাঃ!" আমি খানিক অবাক হয়ে বললুম, "মিনু, মানে তোমার ননদ? সে এখানে এসে ঘি ভাত খেতে যাবে কেন? তা যদি আসে আমি না হয় বাজার থেকে লঙ্কা এনে দেব’খন। তা সেও বুঝি ব্রত রেখেছে? ও, বুঝিছি... আগের বার নিয়ে তিন বার আটকালো তো, তাই এবার একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। সে ভাল। ওতেই হবে। তবে সাথে ভাল মাস্টার একটা রাখলে পারতে। উচ্চমাধ্যমিক বলে কথা!" ছোট মাসি এই অবধি শুনেই কেন কে জানে "দিদি, দিদি" বলে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।

আজকে আমি মার সাথে শোব। কি জানি কি হয়েছে, ছোট মাসি রাগ করে লুচি-আলুর দম খায়নি। খালি চারটে মর্তমান কলা, একবাটি দুধ আর দুটো আম খেয়ে উপোস দিয়েছে। তাতে অবিশ্যি লোকসান হয়নি। আমি আর মেসো মিলে ওর ভাগের লুচি খেয়ে নিয়েছি। ঘুম পেলে আমার খালি ঘুমোতেই ইচ্ছা করে। মা মশারি টাঙাতে টাঙাতে কি যে গুনগুন করে বলছিল কানে ভাল ঢোকেনি। তাই সক্কালবেলা মা যখন সাজি নিয়ে ফুল তুলছে তখন গিয়ে বললুম "এবেরে বলো।" মা বলল "খপরদার, ছুঁসনে যেন, নাই দিয়ে দিয়ে তুমি মাথায় উঠেছ!" আমি বললুম "বুঝলুম, কিন্তু তুমি রাগ করেছ... কিন্তু কেন সেইটে তো বলো।"

"তরুকে তুই কি বলেছিস? মেয়েটা খেলেনা অবধি..."

"মিনু, ওর ননদ গো, সে ব্রত রেখেছে পরীক্ষায় পাশ করবে বলে। আমি বললুম ব্রত যা রেখেছে, রেখেছে। তার সাথে একটি মাস্টারও রাখতে পারত। তাই শুনে ছোট মাসি রাগ করল। সে নাকি ঘি-ভাত খেতে এখানেই আসছে। তার খুব নাক উঁচু, এখন রাজি হলেই হয়।"

মা আমার কথা শুনে কেমন যেন থমকে গেল। তাপ্পর বলল, "তুই বাজারে যা, আমি ফর্দ বলে দিচ্ছি। আজ বাড়িতে নিরিমিষ।"

মা'র কথার ওপর কথা চলেনা। তাই সোজা খালপাড়ের সবজি বাজারেই গেলাম। বাজার জুড়ে খালি পটল আর ঝিঙে। তাই কিনলুম, আর দুটো বড় দেখে মোচা। হারানদা'র দৈব মূল আর শিকড়ের দোকান খাল পাড়ের একবারে শেষে। একটু ঘুরপথ হয় বটে, তাও রোজই আসি। হারানদা টিনের চালের ছোট্ট দোকানে বসে কি সব হাবিজাবি গাছপালা কাটাকাটি করে লাল নীল সুতোয় বেঁধে বিক্রি করে। ওতে নাকি কপাল ফেরে। তা সে নিজের কপাল ফিরিয়ে নিচ্ছেনা কেন সেইটে জিজ্ঞেস করা হয়নি। হারানদার খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়িওয়ালা শুকনো মুখ আর এইব্বড় কণ্ঠার হাড়টা দেখলেই বুঝি, কপাল এখন গ্যাঁট হয়ে বসে রয়েছে দশ স্টেশন দুরে, ফেরার ট্রেন ধরার কোন ইচ্ছা তার নেই। হারানদা ভাল ফুটবল খেলত। কি সব ট্রেনিং নিয়ে চটকলে ফিটারের কাজ করত। ভালোই ছিল। আমি তখন সমিকে পড়াতুম। একদিন ট্রেন থেকে নামতে গিয়ে স্টেশনে পড়ে গেল আর মাজায় কি রকম চোট পেল। তাপ্পর থেকে আর হাঁটতে পারেনা। কোনরকমে উঠে দাঁড়ায় আর ঘষটে ঘষটে এক আধটু চলতে পারে। চাকরিটা গেল। তাপ্পর এই দোকান। সমি মাধ্যমিকের পর আর এগোয়নি। বাপকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে দোকানে পৌঁছে দিয়ে যায়, আবার ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আমি আউনতি-জাউনতি একবার করে ঢুঁ মেরে যাই।

নরুর দোকানে হাঁক দিয়ে দুটো চা আর বিস্কুট বলে দিয়ে মাথা হেঁট করে দোকানের ছাউনির তলায় ঢুকে দেখি, ও মা, আজ সমি বসেছে হারানদার জায়গায়। আমায় দেখে আরেকটু জড়সড় হয়ে বসে সে একমনে ছুরি দিয়ে একটা সাদামত শিকড় চাঁছতে লাগল।

"কি রে, তুই? হারানদা কোথায়?"

"বাবার শরীর খারাপ, জ্বর কাল রাত থেকে।"

"ও, তা ডাক্তার-ওষুধ কিছু হয়েছে?" এই কথা শুনে সমি খুব মন দিয়ে একটা নীল সুতো নিয়ে গিঁট পাকাতে লাগল।

আমি বললুম, "খেয়েছিস কিছু সকাল থেকে না কি...?" ওমনি গাল বেয়ে মুক্তোর দল টুপুসটাপুস করে নীল সুতোতে গাঁথা হচ্ছে দেখে আমি আর কিছু বললুম না। এর মধ্যে চা আর বিস্কুট নিয়ে ফজলু হাজির। চা আর কাগজে মোড়া বিস্কুট নিতে নিতে আমি বললুম "হ্যাঁরে ফজলু, বয়ামে করে যে কেকগুনো রেখেছিস, তার থেকে চারটি আনত ভাই, বড্ড খিদে পেয়েছে। " ফজলু কেক আনতে গেল আর আমি চায়ের ভাঁড় আর বিস্কুট টিনের ইস্কুল বাক্সের ওপর রেখে বললুম, "খেয়ে নে। বিস্কুটগুনো চায়ে ভিজিয়ে খেয়ে দেখ, মনে হবে দুগ্গাপূজো এসে গেছে।" সমি আমার কথা শুনে বিস্কুটের কোণা চায়ে ভিজিয়ে পুরো বিস্কুটটাই একবারে মুখে দিয়ে দিল। তাপ্পর হাতের উল্টো দিকে দিয়ে চোখ মুছে, নাক টেনে মাথা নিচু করে বসে একমনে চা খেতে লাগল। আমি আমার বিস্কুটটা ওর দিকে একটু এগিয়ে দিয়ে বললুম, "ইদিকে সমস্যা হচ্ছে নিলয় ডাক্তার আবার বাড়ি আসতে চায়নে। তা তুই এক কাজ কর। এবেলা দোকানের ঝাঁপ ফেল, তাপ্পর হারানদাকে নিয়ে মণ্ডল মেডিক্যালে আয়। আমি মণ্ডলের সাথে কথা কয়ে হারানদার নামটা আগে লিখিয়ে দিচ্ছি। আমি থাকবখন। চিন্তা করিস না।" সমি মাথা নেড়ে জিনিসপত্র গোছাতে আরম্ভ করল। আমি দোকানের ছাউনির বাইরে এসে দেখি ফজলু কাগজে মুড়ে কেক নিয়ে হাজির হয়েছে, সাথে নান্টু কোলে। নান্টু আজকাল রঙ্গীন স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরে সবসময়। আজও একটা লাল স্যান্ডো গেঞ্জি, তার ওপর সাদা দিয়ে ইংরেজি হরফে লেখা 'মহাকাল', আর একটা সবজে হাফ প্যান্ট পরে রয়েছে। ফজলুর টাকা মেটাতে মেটাতে দরকারি কথাটা মনে পড়ে গেল। আমি বললুম "নান্টুদা, টিভিটা বেগড়বাই কচ্ছে, সব কিছুই কেমন লাল লাল দেখাচ্ছে, একবার সময় করে এসে দেখে দিও।"

নান্টু কেন জানিনা আমায় আগাপাশতলা দেখে নিয়ে বলল "আমি আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করিনে, দোকানে টিভি দিয়ে যাস। দেখে রাখব।" তাপ্পর আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে সমিকে বলল "সমি, কি ব্যাপার, হারানদা কোথায়? তুমি একা দোকানে? কি পবলেম?" সমি দোকানের ঝাঁপ ফেলতে ফেলতে, নান্টুর দিকে একটুও না তাকিয়ে বলল, "বাবার শরীর খারাপ, তাই আসেনে।" নান্টু বলল "ও, তা আমায় একটা খবর দেবে তো! শোনো, ডাক্তার-ফাকতর যা লাগবে আমায় বলবে। আমার ফোন নম্বর হারানদার কাছে আছে। রাত হোক, দিন হোক, একটা মিস কল দেবে। বাকি আমি বুঝে নেব। আমি ওবেলা একবার যাব’খন হারানদাকে দেখতে। বৌদিকে বলো কিচ্ছু চিন্তার নেই। এ সব ভাইরাল ফিভার। খুব হচ্ছে।" সমি কোনও কথা না বলে দোকানের গায়ে হেলান দেয়া সাইকেলটা সোজা করে চেপে বসল। তারপর জোরে প্যাডেল করে সোজা চলে গেল। আমার যেন মনে হল ও খুব রাগ করেছে, চোয়ালটা কেমন যেন শক্ত দেখলুম।

নিলয় ডাক্তার গুটি চারেক পরীক্ষা লিখে দিয়েছে। মণ্ডলের দোকানে সব রকম ব্যবস্থা আছে, এইটেই বাঁচোয়া। রক্ত, থুতু, সব পরীক্ষার জন্য দিয়ে হারানদাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে দিতে বেলা বারোটা। দেখি হারান বৌদি মুখ শুকনো করে দরজায় দাঁড়িয়ে। হারানদাকে খাটে শোয়ানোর পর বৌদি জিজ্ঞেসা করল কি হয়েছে। আমি আর সমি জানি হারানদার টিবি হয়েছে, ডাক্তার আড়ালে আমাদের বলে দিয়েছে। সমি চুপ করে আছে দেখে আমি বললুম, "রক্ত পরীক্ষা করতে দিয়েছে, রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে। এখন ক’দিন বিশ্রাম আর বেশি বেশি খাওয়া দাওয়া। যে কটি ওষুধ দিয়েছে, আমি নিয়ে এসেছি। খাওয়ার নিয়ম সমি জানে। " এই বলে বৌদির হাতে ওষুধের খাম ধরিয়ে দিয়ে আমি বললুম "বৌদি, আজ আর রান্নার দিকে যাবেন না। বাড়িতে ছোলার ডাল আর মোচাঘন্ট হয়েছে। সমিকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আমি, পাঠিয়ে দোব। সমি, আমার সঙ্গে আয়।"

হারানদার বাড়ি থেকে আমার বাড়ি হেঁটে দশ মিনিট। সমি পাশে পাশে সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলছে। মাথা নিচু। আমি বললুম "এবার বল তো দেখি, এই অবস্থা কদ্দিন চলছে?" সমি মাথা নিচু করেই জবাব দিল "অনেকদিন, দোকানের বিক্রি প্রায় নেই, মা দুবাড়ি রান্না করে, তাই দিয়ে চলছিল। এক বাড়ির লোকেরা না করে দিয়েছে। তাপ্পর..." আমি বললুম "বুজিছি, বৌদির কাজ আরেকটা জুটে যাবে, সে আমি বন্দোবস্ত করে দেব। আর তুই সকালে নান্টুকে দেখে অমন রেগে গেলি কেন রে?"

সমি চট করে আমার দিকে একবার তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিল। তারপর প্রায় শোনা যায়না এমন করে বলল "বাবা নান্টুর কাছ থেকে টাকা ধার করেছে। শোধ দিতে পারেনি। নান্টু রোজই আসে তাগাদা দিতে। বাবাকে ঠারেঠোরে বলেছে আমাকে ওর খুব পছন্দ। রাস্তায় যখনই দেখবে তখনই কিছু না কিছু বলে দাঁড় করিয়ে বাজে বকবে। না কত্তে পারিনা। যদি আবার কিছু ঝামেলা করে!" আমি বললুম "সে তো ভাল কথা। নান্টুর রোজগারপাতি ভালোই। নিজের বাড়ি, মোটরবাইক, টিভি সারাইয়ের দোকান। মল্লিকদের পুকুর ইজারা নিয়েছে এবার, বোধহয় মাছের ব্যবসায় নামবে। ওর ভগ্নীপতি পঞ্চায়েতের মাথা। এলাকায় দাপট আছে ভালোই। বিয়ে করলে তো তুই সুখে থাকবি রে।"

ক্যাঁচ করে ব্রেক টেপার শব্দ করে সাইকেল আর সমি এক সাথে থেমে গেল। বাপরে! এ যে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে কি চাউনি! চোখ দুটো ঝকমক করছে, নাকের পাটা দুটো ফুলে উঠেছে, দু ভুরুর মাঝে তিন তিনটে ভাঁজ, চোয়াল শক্ত, রোগা রোগা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রয়েছে সাইকেলের হ্যান্ডেল। আমি মনে মনে ভাবছি, এ মেয়েকে তো আগে দেখিনি। মিন মিন করে বললুম "থামলি কেন, ওদিকে মোচার ঘন্ট যে জুড়িয়ে যাবে, তাপ্পর ছোলার ডাল..." এই অবধি বলেছি কি বলিনি, অমনি সে সাইকেল ঘুরিয়ে লাফ দিয়ে চড়ে বসল আর প্যাডেল ঘুরিয়ে প্রাণপনে উল্টোবাগে ছুট দিল। খাটনি বাড়ল। কি আর করা। বাড়ি ফিরে টিপিনকারি নিয়ে আবার আসতে হবে।

বাড়ি ফিরে দেখি বিরাট ব্যাপার। বনানীদি এসেছে, সাথে ফষ্টি আর নষ্টি। ওদের আসল নাম অবিশ্যি রুমকি আর চুমকি। বনানীদিকে মেসো নিজে গিয়ে নেমতন্ন করে এসেছে। সে এখন পায়ের গোড়ালিতে গোলাপি ব্যান্ডেজ বেঁধে জমিয়ে বসেছে উঠোনের ওপর। ছোটমাসি মুখ গোমড়া করে খুঁটোয় হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। মেসো উঠোনের কোণে বসে হাসি হাসি মুখ করে একবার বনানীদির দিকে আরেকবার ছোটমাসির দিকে তাকাচ্ছে। আমায় দেখে মেসো বলল "এই যে রণে এয়েচে এতক্ষণে, কোথায় ছিলি? এদিকে লোকজন সব এসে পড়েছে।" আমি কিছু বলার আগেই ছোট মাসি বলল "রণে চান করে আয়। তুই এলে সবাই খেতে বসবে। " বনানীদি অমনি পাশ থেকে বলল "একটু বসে যাক, ঘেমে নেয়ে এয়েচে, জিরোতে দাও।" শুনেই ছোটমাসি মুখ কালো করে বলল "রণে, এখুনি চানে যাবি। এক্ষুনি!" আমি সবে বলতে যাচ্ছিলাম আমি এখন চানে যাবোনা, হারানদার বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়ে তাপ্পর যাব, কিন্তু সাহস পেলুম না। তাড়াতাড়ি উঠে ঘরে ঢুকে পড়লুম। মা'র ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলুম ঘ্যাচাংকে মা খাইয়ে দিচ্ছে, ফষ্টি আর নষ্টি পাশাপাশি বসে খাচ্ছে। আমি মাকে বললুম "চট করে টিপিনকারিতে ভাত, ছোলার ডাল আর মোচার ঘন্ট ভরে দাও। হারানদার অসুখ। বাড়িতে হেঁশেল বন্ধ। আমি নিয়ে গেলে তবে ওরা খাবে।" মা বলল "সে কি রে! হারানের আবার কি হল? বড্ড দুর্ভোগের কপাল ছেলেটার। তুই দাঁড়া এখেনে, আমি এখুনি টিপিনকারি ভরে আনছি।"

বাড়ি থেকে বেরোনো সে এক পর্ব। উঠোনে নেমে দেখি বনানীদি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। মুখ চোখ লাল। মোটাসোটা গোলগাল চেহারা নিয়ে একপায়ে উঠে দাঁড়ানো মোটে সোজা কাজ নয়। চেষ্টার চোটে শাড়িটারি এলোমেলো হয়ে গেছে। মেসো একটু তেরচা করে দাঁড়িয়ে "আমি ধরব? আমি ধরব?" কচ্ছে, কিন্তু ধরতে সাহস পাচ্ছে না। ছোটোমাসি একটু দূরে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে মেসোকে দেখছে আর হাতের মুঠোয় শাড়ির আঁচল পাকাচ্ছে। বুঝলুম এই ফাঁকে বেশ একটু চব্য হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে হাত ধরতে বনানীদি হাঁচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়িয়ে খুব হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে লাগল "ছেড়ে দে আমায় রণে, ছেড়ে দে।" আমি তো অনেক আগেই হাত ছেড়ে দিয়েছি, তাই ফিরে আর কিচ্ছুই বললাম না। বনানীদি আর কিছু বলার আগেই মা দরজা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল "এদিকে আয় তোরা সব, ভাত বেড়িছি।" আমিও অমনি আর দেরি না করে জোরসে হাঁটা লাগালুম।

টিপিনকারি নিয়ে পৌঁছতে প্রায় একটা বেজে গেল। গিয়ে দেখি বৌদি হারানদার মাথায় জল ঢালছে আর সমি পাশে বসে মাথায় হাত বুলোচ্ছে। আমি চুপিচুপি টিপিনকারি একপাশে নামিয়ে রেখে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, বৌদি বলল "রণে, একটু দাঁড়িয়ে যাও।" তারপর সমির হাতে ঘটি ধরিয়ে দিয়ে উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়ে বলল "সবই তো শুনেছ সমির কাছে। একটু দেখো যাতে একটা কাজ পাই। আর সমির জন্যও কিছু একটা ভেবো। বসে থাকলে তো চলবে না।" আমি তাড়াতাড়ি বললুম "কিছু ভাববেন না, আমি চেষ্টা করছি।" এই বলে আড়চোখে একটি বার তাকিয়ে দেখলাম সমি একমনে বাবার মাথায় জল ঢেলে যাচ্ছে, ভুরুর মাঝখানে এখনও ঠিক তিনটে ভাঁজ। এই মেয়েটাকে আমি পড়াতুম! ধমকাতুম! বিশ্বেস হয়নে। এ যেন অন্য একটা মেয়ে।

এবেলা আর খাওয়া হলো না। এখনই একটু পরামর্শ না করলে চলছেনে। ফোনে এসব কথা হয় না। তাই দুটো পাঁচের লোকাল ধরে সোজা ইস্কুলে চলে গেলুম। টীচার্স রুমে ঢুকে কুঁজো থেকে এক গেলাস জল গড়িয়ে খেয়েই কার্তিকদাকে খুঁজতে বেরলুম। দু'তলায় নগেন সাঁপুই ক্লাস টেন বি'র সার্থক তপাদারকে দেয়ালে ঠেসে ধরে "কি আছে পকেটে বার কর, বার কর..." বলে ভয়ানক চেঁচামেচি কচ্ছিল, আমায় দেখে বলল "কি রে, কি হল, বলা নেই কওয়া নেই, ওবেলা এলি না যে? সব ঠিক আছে তো?" এর মধ্যে যে সার্থক পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বার করে মোজার ভিতর গুঁজে নিয়েছে, এটা তার আর চোখে পড়ল না। ছেলেটা দেখেছে যে আমি খেয়াল করেছি। কিন্তু বেচারার মুখের দিকে চেয়ে আমি আর কিছু বললুম না। আমি বললুম "সব ঠিক আছে, বাড়িতে কুটুম এসেচে, তাই... কাত্তিকদা কোথায় গো?"

"তোর ক্লাসে স্টপ গ্যাপ নিচ্ছে, সেভেন-এ। " নগেন সাঁপুই ঘুরে আবার সার্থককে চেপে ধরতেই আমি আর কথা না বাড়িয়ে তিন তলায় চললুম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দায় পা রাখতেই কাত্তিকদার গলা পেলুম। ছেলেদের শ্রুতিলিখন দিচ্ছে। 'পৌরাণিক কাহিনী সমগ্র' কাত্তিকদার প্রিয় বই, তাই থেকে। আমাকেও পড়িয়েছে। "যযাতির পুত্র..." তারপর সব চুপচাপ। উঁকি দিয়ে দেখলুম যা ভেবেছি তাই। যযাতির পুত্র অবধি বলে 'তূর্বসু' বলতে গিয়ে ঠোঁট ছুঁচোল, চোখ বন্ধ করে কাত্তিকদা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঠোঁট আর চোখের পাতা কাঁপছে, রগের কাছের শিরা ফুলে উঠেছে। লোকটার এই এক ব্যামো। কথা আটকে যায়। ইতিহাসে এম এ, অ্যাসিস্টেন্ট হেড মাস্টার এই স্কুলের, তবু কোথাও কল্কে পায় না।

আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে "কাত্তিকদা, আসব?" বলতেই ফোঁস করে একটা নিশ্বেস ছেড়ে আমার দিকে ফিরে বলল "আয়।" এর মধ্যে ঘন্টা পরে যেতে আমায় আর যেতে হলো না। কাত্তিকদা নিজেই বেরিয়ে এলো। টীচার্স রুমে ঢুকতেই আমি নিজেই এক গেলাস জল গড়িয়ে হাতে দিলুম। জল খাওয়া হতে বুঝলুম দাদা একটু ঠান্ডা হয়েছেন। তাই হারানদার ব্যাপারটা পুরোটা বললুম। অবিশ্যি সমির সঙ্গে যে কথা কটা হয়েছে, ওটুকু বাদ দিয়ে। বললুম "তোমার তো অনেক চেনা-জানা, দাও না একটা ব্যবস্থা করে।" কাত্তিকদা খানিক ভেবে বলল "অসুবিধা নেই, মনোর মা ছুটিতে গেছে, এমনিও অনেক বয়স ওর, পেরে উঠছে না। আমি হেডস্যারকে বলে দিচ্ছি, কাল থেকে স্কুলের মিড ডে মিলের রান্না ওই করুক। বেতন, যা সরকারী রেট, তাই পাবে।"

আজ আর ক্লাস নিইনি। স্কুল ছুটির পর কাত্তিকদার সাথেই স্টেশনে এসে পাঁচটা পাঁচ ধরে ফিরে এলুম। খাওয়া হয়নে সারা দিন। পেটের ভিতর চনচন কচ্ছে। তাও ভাবলুম হারানবৌদিকে খবরটা দিয়েই আসি। হারানদার বাড়ি পৌঁছে দেখি নান্টু কোলে আগেভিতে পৌঁছে ফটক আগলে দাঁড়িয়ে। সেই মহাকাল লেখা লাল গেঞ্জী আর জংলা ছোপ হাফ প্যান্ট পরে রয়েছে। পায়ের গোছের কাছটা কালো হয়ে রয়েছে মশায়। একটা হাত মাজায়, আরেকটা হাত দরজার খুঁটোয় আড় করে রেখে বলছে "কিছু চিন্তা নেই বৌদি, দরকার পড়লে কলকাতায় নিয়ে যাব, মেডিক্যালে আমার চেনা ছেলে আছে। সব ফিট করে দেব। ডাক্তার-ফাকতর সব..." এই অবধি বলে নান্টুর নজর পড়ল আমার ওপর। মশার কামড়ও বোধহয় একই সাথে টের পেল। এক পা দিয়ে আরেক পা চুলকোতে চুলকোতে বলল "কি রে, তুই? কি ব্যাপার?" আমি বললুম "হারানদাকে দেখতে এসেছি। বৌদি, কেমন আছে হারানদা?"

এতক্ষণে আমার চোখে পড়ল হারান বৌদির পিছনে সমিও দাঁড়িয়ে আছে। তাই বলি মশার কামড়ে গেরাহ্যি নেই কেন! এই প্রথম বেজায় রাগ হলো আমার। আমি বলে না নেয়ে, না খেয়ে দৌড়াচ্ছি, আমার বেলায় ভিরকুটি আর নান্টুর কথা হাঁ করে গিলতে হবে! নান্টুর আড় হয়ে থাকা হাতটা ঠেলে সরিয়ে সোজা ঢুকে পড়লুম। নান্টু এক পা দিয়ে আরেক পা চুলকোচ্ছিল, হাতের ঠেকনা সরে যেতে দুম করে পড়ে গেল। যাকগে। সমি হাঁ করে আমার দিকে দেখছিল, আমি বললুম "টিপিনকারিটা নিয়ে আয় এখুনি, আমায় বাড়ি ফিরতে হবে।" তাপ্পর "হারানদা, কেমন আছ?" বলে ঘরের ভিতর চেয়ার টেনে বসে পড়লুম। আমি বেশ বুঝতে পারছিলুম, আমার পিছনের তিনজন খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। হারানদার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শুনতে পেলুম বৌদি বলছে, "ভাই নান্টু, রাগ করোনা। রণে আসলে বুজতে পারেনি...।" আমার ভারী বয়েই গেচে বুঝতে।

বাড়ি ফিরে দেখি ছোট মাসি উঠোনে বসে রয়েছে আর ঘ্যাচাং মশা তাড়ানোর ব্যাট নিয়ে ঘুরে ঘুরে মশা শিকার কচ্ছে। আমায় দেখে ছোটমাসি "এই যে এয়েচে, বলিহারি যাই বাপু, একটা ফোন অবধি কত্তে নেই, এদিকে দিদি..."

আমি কোনো জবাব না দিয়ে দড়ি থেকে গামছা পেড়ে নিয়ে সোজা কলঘরে ঢুকে পড়লুম। কলঘর থেকেই হাঁক দিলুম, "মা ভাত বাড়ো। বড্ড খিদে পেয়েচে।" রাতে আর বিশেষ কথা হয়নে। মা বোধহয় ছোটমাসিকে কিছু বলেছে, তাই সেও দেখলুম চুপ মেরেছে। মেসো কি যেন কাজে বাড়ি ফিরে গেছে। গোগ্রাসে গিলে খাটে শোয়ামাত্র ঘুম চলে এল।

ঘুম ভাঙতে দেখি সবে আলো ফুটচে। মা মশারির ভিতর বসেই বিজবিজ করে জপ করচে, চোখ বন্ধ। হাত-মুখ ধুয়ে আসতে দেখি মা'র মশারি পাট করা হয়ে গেছে, এখন বিছানা ঝাড়া চলছে। আমায় একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে মা বলল, "এ বার সব গুছিয়ে বল, বাদ দিবিনে কিচু। " কালকের সব কিছুই বললাম, কিছুই বাদ দিলুম না। মা খানিক চুপ থেকে বলল "হারানের মেয়েটার বয়স কত রে?"

আমি বললুম "দু হাজার চোদ্দতে মাধ্যমিক হলে এখন এই একুশ কি বাইশ।" মা খানিক চুপ থেকে বলল "একবার দেখা কত্তে বলিস তো।"

ইস্কুলে পৌঁছে দেখি হারান বৌদি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে কাত্তিকদার কাছে গেলাম। কাত্তিকদা খানিক কথাবার্তা বলে কাজ বুঝিয়ে দিল। টিফিনবেলায় গিয়ে দেখি বৌদি রান্না-বান্না সব করেছে ঠিকঠাক। আজকে হয়েছে ভাত, কুমড়োর ঘন্ট, ডাল আর ডিম সেদ্ধ। নগেন সাঁপুই চেখে বলল ভালোই হয়েছে। তা'লে আর ঝামেলা নেই। পাঁচটা পাঁচের লোকাল ধরে বাড়ি পৌঁছতে বাজল ছটা। বাড়ি ঢোকার আগেই যেন কার কার গলার আওয়াজ পেলুম। দেখি উঠোনে মাদুর পেতে বসে রয়েছে মেসো, ছোট মাসি আর মিনু। তা'লে ছোট মেসো ওকে আনতেই গিয়েছিল। মিনুকে বছর পাঁচেক আগে দেখেছিলুম। এখন দেখি বেশ বদলে গেচে। আগেও বেশ ফর্সাই ছিল, এখন বেশ একটু ভারিক্কি হয়েছে। আমায় দেখে ওই আগে বলল "এই যে মাস্টারমশাই এয়েচেন, এখুন পড়তে বসো সবাই।" বলে হেসে এক্কেরে গড়িয়ে পড়ল। বাকিরাও দেখি খুব হাসছে। কেন হাসছে বুঝতে না পেরে আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি, মা'র গলা পেলুম, "কে? রণে এলি, এদিকে শুনে যা একবারটি।"

তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দেখি মা মোড়া পেতে বসে হাতে থালা ভর্তি চাল নিয়ে বাচছে। আমায় দেখে গলা নামিয়ে বলল "কুটুম এয়েচে। চট করে বাজারে যা দেকি, দিশি মুরগী নিয়ে আয়, আর একটু মিষ্টি নিয়ে আসিস।" আমি আর কথা না বাড়িয়ে ঝোলা নিয়ে বেরুব, মিনু হঠাৎ পোঁ ধরল সেও যাবে। মাসি আর মেসো দু'জনেই বলল যাক না সাথে, বেশ ঘোরা হবে। বলেই তিনজন মিলে খুব হাসতে লাগল। বাড়ি থেকে বাজার প্রায় দেড় কিলোমিটার। দু মিনিট হেঁটেই মিনু বলে "এত জোরে হাঁটছ কেন? একটু রয়ে বসে গেলে বাজার কি উঠে যাবে নাকি? আমি এত হাঁটতে পারিনে বাপু।" অগত্যা গুটুরগুটুর করে চলা আরম্ভ করলুম। মিনু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল "এর পর থেকে হপ্তায় একদিন করে বাজারে যাবে, সব নিয়ে ফিরবে রিসকা করে। আমি সব ফর্দ করে দেব’খন, তুমি গুচিয়ে খালি নে আসবে।" আমি শুনে সেই যে চুপ হলুম, মুখ খুললুম রহমতের মুরগির দোকানে এসে। মিনুর এই সব কাটাকাটি দেখলে গা গুলোয়, তাই সে একটু দূরে নরুর দোকানে বসে চা খাচ্ছে। কেনাকাটা শেষ করে নরুর দোকানে গিয়ে দেকি মিনু বেশ জমিয়ে গপ্প জুড়েছে ফজলু আর নরুর সাথে। আমায় দেখে বলল "এবার একটা রিসকা ডাক, আমি আবার অদ্দূর হাঁটতে পারবনি।" আমার তখনও মিষ্টি কেনা বাকি, তাই বললুম "তুমি বসো, আমি আসছি পাঁচ মিনিটে, তাপ্পর রিসকা করব।"

মোড়ের মাথায় দুলালদার মিষ্টির দোকান। দোকানে ঢুকে সবে কুড়িটা রসগোল্লার অর্ডার দিয়েছি, কে যেন পিছন থেকে টোকা দিয়ে ডাকল। ঘুরে দেখি নান্টু। এই ভর সন্ধ্যেতেও কায়দা করে একটা সানগ্লাস কপালের ওপর বসিয়ে রেখেছে। ডানহাতের বালাটা বাঁ হাত দিয়ে একবার উঠিয়ে নামিয়ে নান্টু বলল "বাইরে আয়, কথা আছে।" তাকিয়ে দেখি বিশু আর পাপন, দু জনেই নান্টুর দোকানে কাজ করে, মোটরবাইকে বসে আছে। বেশ বুঝলুম আজ কপালে দুঃখ আছে। জীবনে কখনো মারামারি করিনি, মার খাইনি। আজ সব উসুল হবে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, জিভ আর মুখের ভিতরটা শুকিয়ে আসচে, হাঁটুতে কেমন যেন জোর পাচ্ছিনা। বুদ্ধিভ্রংশের মত হাতে রসগোল্লার ভাঁড় নিয়ে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালুম। নান্টু দু পা এগিয়ে এসে কলার চেপে ধরতে যাবে অমনি পাশ থেকে কে যেন বলল "স্যার, ভাল আছেন? আপনি এখেন থেকে বাজার করেন?" তাকিয়ে দেখি সার্থক তপাদার, টেন বি, দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সার্থক একা নেই। তার সাথে মোটরবাইকে আরও দুটো ছেলে। প্রত্যেকের চেহারাতেই বখাটে ভাব পাকাপাকি ছাপ মেরে দিয়েছে। জিভ সরছিল না, তাই কোনোরকমে বললুম "হুঁ।" নান্টু এরমধ্যে হাত দুটো হাফ প্যান্টের পকেটে ভরে নিয়েচে। সার্থক আবার দাঁত খিঁচোলো, "আমার বাবা স্যার সাধন তপাদার, অঞ্চল প্রধান। কোনো পবলেম হলে বলবেন স্যার।"

বুক ধড়ফড়ানি একটু কমেছে, হাঁটু দুটো আর তেমন কাঁপছেনা, ঢোঁক গিলে দেখলুম জিভ আর তালুর সাথে সেঁটে নেই। তাই একপা এগিয়ে গিয়ে বললুম "নান্টু, কি যেন বলবে বলছিলে?" নান্টু কোন কথা না বলে পিছিয়ে গিয়ে মোটরবাইকে উঠে বসল। ঠিক এই সময়েই হাঁফাতে হাঁফাতে মিনু হাজির। এসেই বলল "কতক্ষণ লাগে মিষ্টি কিনতে? আমার বসে বসে মাজা ব্যাথা হয়ে গেল।" তাপ্পর নান্টুর দিকে তাকিয়ে বলল "দাদা, বলুন তো একটা মোটরবাইক কিনতে আপনার মত। কেমন লোক বাবা! সব জায়গায় হেঁটে হেঁটে যায়। আমি কিন্তু ফেরার সময় আর হাঁটতে পারবনি। তুমি রিসকা দেখ..." বলে নান্টুর দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। দেখলুম নান্টু এরমধ্যেই কখন সানগ্লাসটা চোখের ওপর নামিয়ে নিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি বললুম "মিনু, আমার ছোট মাসির ননদ। বেড়াতে এয়েচে। আচ্ছা আমি দেখছি রিসকা কোথায় পাই।" সার্থক বলল "এখন আর রিসকা পাবেন না স্যার। সব কটা স্টেশনে লাইন দিয়েছে। আটটা আট আর আটটা বাইশ ছেড়ে গেলে তাপ্পর আবার পাবেন।"

আমি আর কিছু বলার আগেই নান্টু বলল "ছোট মাসি, মানে তরুদির ননদ... ও... তা আমি না হয় বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি বাইকে করে, দু মিনিটের তো রাস্তা।" এই বলে সানগ্লাসটা কপালে তুলে দিয়ে আমার দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে রইল। মিনু অমনি বলল "সেই ভাল, তুমি বরঞ্চ আস্তে আস্তে এস।" আমি আর কিছু বলার আগেই সে নান্টুর বাইকে চড়ে বসল আর নান্টুও ভোঁ করে বেরিয়ে গেল। আমি পড়িমরি করে পা চালালুম বাড়ির দিকে। ছোটমাসি নির্ঘাত দু কথা শোনাবে।

গলদঘর্ম হয়ে বাড়ি পৌঁছে দেখি গেটের সামনে জটলা করে নান্টু, মেসো, ছোট মাসি আর মিনু দাঁড়িয়ে রয়েছে। নান্টুর গলা পেলুম, বলছে, "মল্লিকদের পুকুরটা এবার লিজ নিয়েছি, লাখ খানেক ঢেলেছি, কম করে তিন তুলব। আমার সঙ্গে মাছের আড়তদারদের কথা হয়ে গেছে। এছাড়া টিভি সারাইয়ের সাথে কিছু মোবাইল রাখব ঠিক করেছি। এ লাইনে পয়সা আছে।" আমি দেখলাম মেসো খুব মন দিয়ে শুনছে আর ভুঁড়ি চুলকোচ্ছে। পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকব, দেখি দরজায় মা ঘ্যাচাংয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখ খুব গম্ভীর। নান্টু পিছন থেকে বলল "মাসিমাকে বলে দিস কাল এসে টিভি সারিয়ে দোব। তোকে আর কষ্ট করে নিয়ে যেতে হবেনে।"

রাতে মশারি টাঙাতে টাঙাতে মা বলল "তোকে যে বললুম হারানের মেয়েটাকে দেখা করতে বলবি, সে বলেচিস?"

"না, ভুলে গেচি। কাল বলব।"

মা বলল "হারানের বউকে বলবি মেয়েকে নিয়ে যেন অবশ্যই দেখা করে।"

স্টেশনের সামনেতে পাইপ বসাবে বলে খুঁড়েছে। তাই রিসকা পুরোটা যাচ্ছেনা। তার ওপর কাল রাতে বৃষ্টি হয়ে কাদা হয়েছে খুব। রিসকা থেকে নেমে পাতা ইঁটের ওপর পা রেখে যেতে হচ্ছে। মা আর সমি আগেই পেরিয়ে গেছে। আমি সুটকেস দুটো নিয়ে কোনো রকমে পেরিয়ে এলুম। মিনু পিছনের রিসকায় ছিল, এখনও নামতে পারেনি। একপা ইঁটের ওপর দিয়েচে কিন্তু আরেকপা রিসকা থেকে নামায়নে। একহাতে শাড়ির গোছ আরেক হাতে নান্টুর হাত শক্ত করে ধরে রয়েছে আর বলছে "ছাড়বেনে, খপরদার বলচি ছাড়বেনে!"

নান্টু কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রানপনে মিনুকে নামানোর চেষ্টা করছে। আমি, মা আর সমি বেড়াতে যাচ্ছি হরিদ্বার, দিল্লী, আগ্রা। তাই সবাই স্টেশনে এসেচে আমাদের বিদায় জানাতে। সমির মা, আজকাল আর হারান বৌদি বলিনা, আগেই স্টেশনে এসে বসে আছে। মা এই নিয়ে অন্তত বার কুড়ি তাকে বলেছে তুলসী মঞ্চে যেন জল দেওয়া হয়। আমি সমির কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললুম "দেকেছিস, নান্টু আজকেই ফুল প্যান্ট পরেছে।" সমি ফিক করে হেসে বলল "বেচারা!"

3 comments:

  1. khub sundar galpo .....gramer gandho pelam jeno ! Amar Lila majumdarer lekhar katha mane porchilo, ami onar lekhar vakta

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত গল্প!রজত ভট্টাচার্য্যের আরো গল্প পড়তে চাই

    ReplyDelete