0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


সাল ১৯৯৫, ২৫ আগষ্ট, কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তকে নিয়ে একটি সাম্মানিক প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয় হলদিয়া, মেদিনীপুর থেকে শ্রদ্ধেয় নিমাই মাইতির সম্পাদনায়। লক্ষ্য করা যায়, এই সময়টি তাঁর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণে যে, এ সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর "অন্ধকার অন্ধ নয়" কাব্যগ্রন্থখানি। যেখানে তাঁর নিজেকে অতিক্রমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছিল আবহমান বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠ, তাঁর "বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা" শীর্ষক প্রবন্ধ গ্রন্থখানি। যেখানে রয়েছে প্রথাপ্রচল রীতির বাইরে কবিতার ইতিহাসকে নতুনভাবে তুলে ধরার এক সচেতন প্রয়াস। কারণ এর আগে কোনও সাহিত্য গবেষক কবিতার বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণে তরুণ থেকে তরুণতম কবিদের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করার চেষ্টাই করেননি।

আমরা প্রথমে নিমাই মাইতি সম্পাদিত "প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত" গ্রন্থটি নিয়ে বসি। সেখানে সামান্য পরিসরে ব্যক্তি মঞ্জুষকে নিয়ে সাতটি নিবন্ধ রয়েছে। অন্যান্য লেখালেখি নিয়ে বারোটি গদ্য এবং কিছু চিঠিপত্র। সব মিলিয়ে ১২৮ পাতার একটি গ্রন্থ। আমরা ব্যক্তি মানুষটিকে নিয়ে এখনও বলতে বসলে দেখা যাবে স্মৃতির পাতা ভরে উঠছে অসংখ্য অক্ষরে। তাঁর ব্যক্তিগত মেলামেশার স্তর, মানুষের প্রতি তাঁর সহৃদয়তা এবং সর্বোপরি তরুণ কবিদের প্রতি স্নেহের যে স্পর্শ লেগে রয়েছে, সে সংখ্যাটিও অগণন। মহানুভব স্পর্শকাতর মানুষটি অবশ্য জীবনে যত ভালোবাসা বিলিয়ে গেছেন, বিনিময়ে সমান প্রতিদান পেয়েছেন, তেমনটা বোধহয় জোর করে বলা যাবে না। কারণ আমাদের স্বাভাবিক প্রবণতায় ঈর্ষা একটি মহৎ গুণ। তিনি অবশ্য শত্রু জেনেও বুকে টেনে নিতে কখনও দ্বিধা করেননি। নিজের মহত্ব থেকে একচুল সরে আসার আদর্শ তিনি গ্রহণই করেননি।

শুধু ব্যক্তি মঞ্জুষ সম্পর্কে বললে কিন্তু কবি মঞ্জুষ, প্রাবন্ধিক মঞ্জুষ, সম্পাদক মঞ্জুষ, অনুবাদক মঞ্জুষ, তথা ঔপন্যাসিক মঞ্জুষ, ছড়াকার মঞ্জুষ অনেকটাই ঢাকা পড়ে যায়। তাই আমরা এই অদলীয় সৃষ্টিশীল মানুষটিকে বহুভাবে বহুবার ধরার চেষ্টা করেছি। তাঁকে নিয়ে যখনই কোনও লেখার কথা, পত্রিকার কথা ভেবেছি সবার আগে তাঁর লেখকসত্তাকেই প্রাধান্য দিতে চেয়েছি। তাঁকে নিয়ে যখনই কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তখনই আমরা তাঁর লেখালেখির উপরই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। তবু সেই ব্যক্তি মানুষটি ঘুরে ফিরে আসে, এসে যায়। বাংলা সাহিত্যে অনেক অনেক কবি-লেখক এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে আড্ডা হয়তো ইতিহাস হয়ে গেছে। এখনও অনেক কবি-লেখকের সাহচর্য পেতে তাঁর বাড়িতে লেখক সমাবেশের অন্ত নেই। যার মধ্যে অনেক স্তাবকতা, অনেকাংশে আত্মপ্রচারের লোভ – যা অস্বীকার্য নয়। কবি মঞ্জুষ চাকরি জীবনে তাঁর অফিসঘরটিকে যখন সাহিত্যের আড্ডা হিসাবে গড়ে তোলেন তখন আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় যে, একজন মানুষ ভেতরে ও বাইরে কতটা কবিসত্তাকে যাপন করতে ভালোবাসেন। আমরা তাঁর যাপনে তাড়িত হই, নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হই। কবিতার বাইরে তাঁর যেন কোনও জীবন নেই। প্রত্যেকের ব্যক্তি জীবনের নানা খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিতে নিতেই তিনি কবিতায় ফিরে আসেন। আজকের যাঁরা পাঠক, এই মানুষটিকে যাঁরা সামনে থেকে পাননি, তাঁরা এই অনন্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আর এখন আমাদেরও পক্ষেও সম্ভব নয় একটা লেখার মধ্যে সেই মানুষটিকে তুলে ধরা। তবু আমাদের স্মৃতিতে তিনি আজও একটি মহীরুহর ছায়া, তিনি একান্ত আশ্রয়।

তাঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে অগ্রজ কবি-প্রাবন্ধিক মাননীয় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, "মঞ্জুষ কারও ঘেরতায় না ঢুকে কেবল আপন চিত্ত আর আপন রচনার চর্চা করেছে বলে তার সঙ্গে একটা সহজ সম্বন্ধ টের পাই বরাবর। দেখতে পাই সবার সঙ্গে মেশার সময়েই সে সাদামাঠা ভাবেই বেশ মিশতে পারে, সে যে লিখিয়ে এবং অমুক বড়ো দলের একজন এই তাচ্ছিল্য বা কৃপামুখটুকু তার নেই।" (প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, পৃ : ১১)

এই ছিলেন ষাট দশকের হাংগ্রি, শ্রুতি, ধ্বংসকালীন, শাস্ত্রবিরোধী দলের বাইরে এক অদলীয় ব্যক্তিত্ব কবি মঞ্জুষ। তবে পরবর্তীতে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, "পৃথিবীর সমস্ত শিল্প আন্দোলনগুলি কখনও না কখনও আমাকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু কবিতা লেখার সময় কোনও একটি শিল্পতত্ত্বকে আশ্রয় করে লেখার কথা ভাবিনি। যখন যেমন এসেছে তেমন লিখেছি।" (ফিনিক্স, সঃ গৌতম সাহা, বইমেলা ২০০১)

দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পার, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ২০০৩-এর ১৯ জানুয়ারি। কিন্তু মনে হয় আজও স্বার্থশূন্য একটা ভালোবাসার টান বুকে এসে লাগছে। তাঁর ওম্ পাই, গন্ধ পাই। ত্রিকাল পাখির গল্প শেষ হবার নয়। সে সব দেখে। শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে ভেসে উঠছে সময়, সময়কে পেরিয়ে একটি সম্ভাবনা। যা আগামীর গল্প, আগামীর গান হয়ে যায়। লিখতে বসলে ছায়া এসে জড়িয়ে ধরে কলমটিকে, ছায়া অক্ষরে বেজে ওঠে আমার ভাঙা ভায়োলিন। তাঁর সুর, তাঁর অব্যক্ত ধ্বনিগুলো। সে কথা শুধু অহল্যা পাথর জানে।

দশক বিচারে কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্তর আবির্ভাব ষাটের শুরুতেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রথম দিনের সূর্য" প্রকাশ পায় ২৫ জুন ১৯৬২তে। কবি অমিত ব্রহ্মর সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে। এক্ষেত্রে বলার, আমাদের দুর্ভাগ্য কবি অমিত ব্রহ্ম সম্পর্কে আমরা আর বিশেষ কিছু জানতে পারি না। পরবর্তীতে তাঁর কবিতাপাঠের তেমন সুযোগও ঘটেনি। এই কবি সম্পর্কে বিশেষ আলোচনাও নজরে আসেনি। অবশ্য আমরাও কখনও কবি মঞ্জুষের কাছে এ বিষয়ে প্রশ্ন করিনি। এই লেখা লিখতে বসে কথাটা খুব মনে পড়ছে। এটা আমাদেরই ভুল।

যাহোক "প্রথম দিনের সূর্য" থেকেই তাঁর কবিতায় নিজস্ব একটা চলন সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। প্রেমকে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর অব্যক্ত আনন্দলোকের শুভবোধ দিয়ে। সেই অনুভূতিকে আমরা এভাবেই পাই –

রক্তাক্ত করেছে মেয়ে শঙ্খসাদা আমার হৃদয়
কেড়ে নিল তপস্যার গিনিগলা সোনালী সময়
জ্বেলে দিল দীপ্তদীপ– সে আগুনে সব কিছু ছাই,
তবু হায় শক্তি নেই তাকে ছেড়ে সুদূরে পালাই।

(বিজয়িনী/ প্রথম দিনের সূর্য)

তাঁর ভাষায় ভেসে যাওয়া একটা সুদূরের টান থাকলেও পলাতক হয়ে ওঠার কোনও যাযাবরী মনোবৃত্তি ছিল না। একটু সুধীন্দ্রনাথের প্রতি ঝুঁকে পড়া অনুভব নিয়েও ধ্রুপদী চালে তিনি নিজেকে আলাদা করে তুলেছিলেন। যেন নিভৃতে সমসাময়িকদের থেকে একটা আলাদা ভাষার খোঁজে নিজেকে সচল রেখেছিলেন। জীবনানন্দ পরবতী বাংলা কবিতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগিদে জীবনকে দেখতে চেয়েছিলেন আনন্দময় শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে। বলা যায় ভালোবাসায় ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস। সে সময়ে তাঁর সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন "দু একটি পংক্তি পড়লেই এই কবির নিজস্ব কন্ঠস্বর চেনা যায়। এ জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। বাংলা ভাষায় কিছু লিখতে গেলে বাংলা ভাষার সমগ্র রূপটি সম্পর্কেই একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। গভীর মনোযোগী পড়ুয়া না হলে লেখক হওয়া যায় কিনা তাতে সন্দেহ আছে। মঞ্জুষ পড়েছে অনেক।" (প্র: ম:, পৃ : ৯)

আমরা তাঁর পঠন-পাঠন, মেধা ও প্রজ্ঞার মুখোমুখি হতে পেরেছি এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। তিনি যখন "বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা" লিখছেন, প্রতিটি পর্বের পাঠ-পরিকল্পনা, উদ্ধৃতি উদ্ধারে প্রতিনিয়ত তরুণ কবিদের কাব্যগ্রন্থ নিয়ে, বা তখনও কোনও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি অথচ তিনি একটি সম্ভাবনাময় কবিতা কোনও পত্রিকায় পড়েছেন, তার পংক্তি স্মরণ করা বা উদ্ধার করা, সে আলোচনায় আমাদেরও সঙ্গী হতে হয়েছে। কাছ থেকে একজন নিমগ্ন পাঠক-আলোচক-কবি-প্রাবন্ধিককে দেখা। আমাদের মনে রাখতে হবে তাঁর পাঠ শুধু বাংলা ভাষার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ফরাসি, স্প্যানিশ সহ একাধিক বিদেশি ভাষা জানতেন। মূল ভাষায় সে দেশের কবিতাকে জানার আগ্রহে তিনি নিত্য সন্ধানে ব্রতী থেকেছেন। এতে তাঁর নিজের কবিতাই সমৃদ্ধ হয়েছে।

তাঁর সঙ্গে আড্ডায় কবিতার বিশ্বকে চেনা। যে ঋণ কোনও মূল্যে হয়তো পরিশোধযোগ্য নয়। আমার একান্ত বন্ধু বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক অরুণাংশু ভট্টাচার্য লিখিত আকারে বলেছেন ১৮ নং রবীন্দ্র সরণির পোদ্দার কোর্টের তিন তালার সেই অফিস ঘরটির কথা। বলেছেন "বাংলা সাহিত্যে এমন কবি কমই আছেন যে যিনি একবারও মঞ্জুষদার ঘরে আসেননি। এই ঘরটিতে কখনও দলাদলি হয় না। অথচ যাঁরা আসেন বাইরে হয়তো তাঁরা অনেকেই অনেক গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ১৮ নং রবীন্দ্র সরণিতে সকলে মুক্ত খোলামেলা। এর একমাত্র কারণ কিন্তু মঞ্জুষদার পক্ষপাতহীন বাউল মনোবৃত্তি।" (প্র: ম :, পৃ : ২০)

তিনি তাঁর লেখালেখির জীবনে কবিতার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বেশি নিবিষ্ট থেকেছেন কবি ও কবিতা বিষয়ক গদ্য রচনায়। সমস্ত গদ্যেই কম বেশি উঠে এসেছে কবিতার ইতিহাস। এ ব্যাপারে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে সবসময় মান্যতা দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের কবিদের কবিতার ভাষা, আঙ্গিক, নতুন নতুন প্রবণতা লক্ষণের দিকে যেমন ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি, তেমনি উৎসাহ দানের পদ্ধতিও ছিল নিখাদ। প্রেরণা পেয়ে যাতে একজন সম্ভাবনাময় কবি যথার্থ প্রতিভাদীপ্ত হয়ে ওঠেন। এ কাজ সকলের দ্বারা আসে না। এ কাজ কঠিন। আত্মত্যাগের সমান। আবার একথাও বলেছেন তরুণদের দেখে তিনি নিজেও উদ্দীপ্ত হন। এই কারণেই হয়তো তিনি নিজেকে বারবার ভাঙতে পেরেছেন। অতিক্রমের কথা বলেছেন। একজন কবিকে তাঁর নিজের তৈরি ভাষাভঙ্গী থেকে বেরিয়ে নতুন পথ খোঁজার কথা বলেছেন। তাঁর সমসাময়িক কবিরা যখন একটি পেয়ে যাওয়া ভাষা বা অর্জিত ভাষায় গতানুগতিক কাব্যচর্চা করে চলেছেন তখন তিনি নিজেকে ভেঙে ভেঙে নতুন ভাষার সন্ধানে ডুবে যাচ্ছেন। সারা পৃথিবীর কবিতার ভাঙচুর তিনি লক্ষ্য করতে চেষ্টা করছেন। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠও ছিল এতটা মরমী যে চিৎকৃত কলোরব ছাড়াই শব্দের কাছে কান পাতলে যেন কান্নাটুকু শোনা যায়। বলছেন "শব্দের ভিতরে ধর্ম পুরে দেয় পুরোহিত অথবা যাজক" আর কবিই একমাত্র পারেন শব্দের মধ্যে ভালোবাসা পুরে দিতে। এটা হয়তো সহজ কথা, কিন্তু কবি মঞ্জুষ তো নিজেকে অতো সহজে প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না, তাই বলছেন সেই ভালোবাসাটা কেমন, "অনেক সবুজ ক্ষেতে জাপটে ধরা শরীরের খুশি / সমুদ্রের শঙ্খ কণ্ঠস্বর" (বজ্রকীট/এত প্রিয় এখন পৃথিবী, প্রকাশ : জানুয়ারি ১৯৯২)। তাঁর প্রেম ও প্রতিবাদ এভাবে মিলে মিশে রয়েছে এসময়ের বহু কবিতায়। এই গ্রন্থের ভূমিকাগদ্য বা প্রাককথনে তার আভাস রয়েছে। সেখানে তিনি বলছেন, –"সাহিত্যের যে শাখাটি সবচেয়ে জটিল, গোলমেলে ও ঘোলাটে তা কবিতা। শব্দে ও পংক্তির ভাঁজে ভাঁজে যে রহস্যময়তা, অলৌকিকতা ও ব্যঞ্জনা তা অনেক সময়ই সহজ ও সুবোধ্য হয় না, অনেকের কাছে। ভাবাত্মক, রূপাত্মক, চিন্তা ও অনুভূতিপ্রসূত শব্দবর্ণমালা কখনও প্রচণ্ড ধাক্কায় মাথা ঝিমঝিম করায়, কখনও বা মাধুর্যের হাওয়ার নৌকোয় ভাসিয়ে নিয়ে যায় চেনা-অচেনার এক মায়াবীলোকে। …", এখানে তিনি সমকালীন সময় সমাজ পরিপার্শ্বর কথাও বলেছেন। চারপাশের ঘটনাপ্রবাহের আলোড়নের কথাও বলেছেন। চেতনে অচেতনে যা একজন কবিকে নিরন্তর বিদ্ধ করে। তাই লেখা হয়ে যায়-

আমার শরীরে কোনো পাপড়ি নেই শুধুমাত্র কাঁটা
এখন ভারতবর্ষে ছিটকে পড়ে কণিষ্ক গোধূলি
চারদিকে হিমঠাণ্ডা বিপুল সন্নাটা :

(ভাগলপুর ১৯৮৯/ ঐ, পৃ : ১৩)

এই গ্রন্থে এরকম আরও অজস্র পংক্তি রয়েছে যা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় একজন কবি ফুল পাখি লতা নদী সমুদ্র পাহাড় থেকে যেমন কবিতার রসদ সংগ্রহ করেন, আবার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক পরিবেশ থেকে, তার নানা ঘটনার অভিঘাত থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না।

# # #

আমরা লক্ষ্য করলাম কবিতার পাশাপাশি তাঁর গদ্যের ভাষাতেও এক চৌম্বকশক্তি রয়েছে এবং আশ্চর্য তার বনেদীয়ানা। একজন দীক্ষিত পাঠকের ঔজ্জ্বল্য সর্বত্র দীপ্যমান। এই প্রসঙ্গে শ্রদ্ধেয় দেবীপ্রসাদের আরেকটি বক্তব্য তুলে ধরতে খুব ইচ্ছা হয়। সেখানে তিনি বলছেন, "গল্প নাটক কবিতা গদ্যপ্রবন্ধ যত রকম লেখা লিখেছে সে, লিখেছে চূড়ান্ত মন দিয়ে। হয়তো কবিতাই প্রধানা শাসিকা তার। তবু আমার নিজের মনে হয় সুকরতর সিদ্ধি সে দেখতে পাবে তার চিন্তার গদ্য লেখাতে একদিন। কেননা যে সহজ বিবেচনা ও মনস্কতা তার সব লেখার মূল নিয়ামক আর যাতে কবিতা উত্তাপ হারায় হয়তো কখনও কখনও, তাতেই প্রভাবান হয়ে ওঠে শিক্ষাপ্রদ গদ্য লেখা।" (প্র: ম :, পৃ : ১২)

তাঁর এই মনে হওয়াটা যে যথাযথ তা আমরা কাছে থেকে লক্ষ্য করেছি যখন "নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি" নিয়ে তিনি ভাবতে বসেছিলেন। যা ছিল খুব সম্ভবত ১৯৯০ বা ৯১ সালের গোড়ার কথা। যেখানে মূলত তিনি সত্তর আশির দশকের কবিদের রচনার বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটি আলোচনা উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তারপরই আরও বিস্তৃতভাবে সন্ধান করতে বসলেন স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রবণতা লক্ষণ বা বিবর্তনের চিহ্নগুলি নিয়ে। যে খোঁজ শুরু হয়েছিল মধুসূদনের কাল থেকে। কারণ লক্ষ্য, আধুনিকতার পর্বগুলি তিনি তাঁর মতো করে বলবেন। অতীতের গবেষণার ফাঁকফোকর থেকে পর্বগুলি যাতে আমাদের মনে আরও নতুন ভাবনার রসদ জোগায়।

এই প্রবণতা প্রসঙ্গটি একটু বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। আবারও বলি "নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি" ছিল একটি ছোট প্রবন্ধসংকলন (দেড় ফর্মা)। তার পরপরই তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন বাংলা কবিতার পুরোনো আধুনিকতা থেকে নতুন আধুনিকতায় যাত্রাপথের ইতিহাস। এ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের গবেষকরা যাকে পুরোনো আধুনিকতার কাল বলেছেন, কবি মঞ্জুষ তাকে বলতে চাইলেন প্রথম আধুনিকতা। তিনি বলেছেন, –"বাংলা কবিতার ঐতিহাসিকেরা পুরোনো আধুনিকতার কালটিকে কিঞ্চিৎ দীর্ঘ করে দেখিয়েছেন। 'পুরোনো' বিশেষণটি বর্জন করে যদি 'প্রথম' বিশেষণটি জুড়ে এভাবে বলা যায় যে ১৮৬১ থেকে ১৮৯৯ পর্যন্ত প্রথম আধুনিকতার কালপর্ব তাহলে সীমানাটি বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৩৬)। প্রসঙ্গত তিনি বলেছেন ১৮৬১ সালে মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য'-এর মাধ্যমেই প্রথম আধুনিকতার পদসঞ্চার ঘটে। আর ১৮৯৯ মানে রবীন্দ্রনাথ এসে পড়েছেন। মাইকেল থেকে রবীন্দ্রনাথে এসে আধুনিকতার নতুন বাঁক আসে। যাকে তিনি বলছেন দ্বিতীয় আধুনিকতা। আর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্তির চেষ্টার মধ্যে জন্ম নেয় তৃতীয় আধুনিকতা। যা প্রতিষ্ঠিত হয় জীবনানন্দের হাত ধরে। তারপর পার হয়েছে আরও দীর্ঘ সময়। খেয়াল রাখতে হবে জীবনানন্দের মৃত্যু হয় ১৯৫৪ সালে। বাংলা কবিতা তারপরও চার চারটি দশক পার করেছে। স্বাভাবিক কারণে পরবর্তী আধুনিকতার খোঁজ আমাদের মধ্যে জারি থাকে। এই প্রসঙ্গেই তিনি বলেছিলেন, "স্বাধীনতা পরবর্তী কবিতা থেকে চতুর্থ আধুনিকতার যাত্রা শুরু।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৩৭)

তিনি পঞ্চাশ থেকে নয়ের দশকের মাঝামাঝি (১৯৯৪-৯৫) সময় পর্যন্ত সেই পর্বের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে যখন আলোচনা করতে বসেন তাকে এক একটা যাত্রাপথের মাধ্যমে দেখেছেন। যেমন –

১. প্রথম যাত্রাটি শুরু হয় সমিল থেকে অমিল কবিতার দিকে। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন ধ্রুপদী সংস্কৃত কবিতায় নিরূপিত ছন্দের ব্যবহার থাকলেও আদ্য মধ্য অন্ত্যমিলের ব্যবহার বা সহজস্বরের বিন্যাস প্রথম আসে জয়দেবের কবিতায়। এই কারণে জয়দেবই বাংলার আদি কবি বলে বিবেচিত হয়েছেন। তিনি আমাদের এই সামান্য পরিসরেই দেখিয়েছেন, বাংলা কবিতার শুরুর কাল যদিও ধরা হয় চর্যাপদ বা চর্যাগানকে, কিন্তু হাজার বছরের আগেও অর্থাৎ চর্যাগানের আগেও কোথাও হয়তো সংগৃহীত হয়ে আছে বাংলা কবিতা যা এখনও কোনও সংগ্রাহকের গবেষণার অপেক্ষায়। ফলে আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না যে, চর্যাপদ থেকেই বাংলা কবিতার স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল। আপাতত যা সংগৃহীত, তা-ই প্রমাণিত, সেভাবেই আমাদের চলা।

এভাবেই তিনি প্রচলিত ধারণার বাইরে নতুন কিছু ভাববার রসদ দিয়ে গেছেন। নিরূপিত ছন্দে লিখতে লিখতে কবিরা কীভাবে ছন্দের ভাঙচুর নিয়ে খেলতে শুরু করেছেন সেকথা যে এভাবেও বলা যায় তা এই গ্রন্থটি না পড়লে আমাদের জানাই হতো না। প্রতিটি পর্বের শেষে এসে তিনি তরুণতর কবিদের কবিতাই বেশি উদ্ধৃতি দিতে চেয়েছেন। অর্থাৎ প্রথাপ্রচল ইতিহাসবিদদের সংস্কার তিনি ভাঙতে চেয়েছিলেন, সঙ্গে লক্ষ্যণীয় হলো গদ্যভাষা। তাঁর এই মানসিকতার কথাই বোধকরি বলতে চেয়েছিলেন মাননীয় কবি-প্রাবন্ধিক দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।

২. এভাবেই তিনি এসেছেন বাংলা কবিতার প্রতিষ্ঠিত মিথ ভাঙার খেলায়। ধরা যাক মেঘনাদবধ কাব্যে যার শুরু। যেখানে অমিত্রাক্ষর ছন্দে যেমন মধুসূদন বাংলা কবিতার চেহারায় নতুন পোশাক পরালেন তেমনি বাল্মীকি রামায়ণের ভিলেন চরিত্রকে তিনি করে তুললেন হিরো। এভাবেই একটি মিথ ভেঙে নতুন মিথের জন্ম হয়। নতুন ভাষার জন্ম হয়। শিল্পের বিমূর্ততাও নতুন রূপ পায়। তিনি দেখিয়েছেন মধুসূদন থেকে জীবনানন্দ পর্যন্ত বাংলা কবিতার ছন্দমাধুর্য সঙ্গীতের আলোয়ান গায়ে যেমন সুন্দরের উপাসনা করে গেছে, তেমনি নিসর্গ দিয়ে রচিত অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের কাল কীভাবে বদলে বদলে এসেছে। তারপরই এসেছেন জীবনানন্দ পরবর্তী ভাষায় এবং বিষয়বৈচিত্র্যে‌। বুদ্ধদেব বসুই তো বলেছিলেন, কবিতার নবজন্ম তখনই সম্ভব, যখন কবিরা ভাষাকে দিতে পারেন নতুন প্রাণ ও ধ্বনিস্পন্দন।

৩. কবি মঞ্জুষের পরবর্তী যাত্রা হলো চিত্র থেকে চিত্রকল্পের দিকে। এই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় তিনি দেখিয়েছেন ইন্দ্রিয়ঘন চিত্রমালা কীভাবে 'আপাত অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যাতীতকে নিঃশব্দসুন্দর শব্দচিত্রে'র মাধ্যমে কবিতার অবয়বে নিয়ে আসা যায়। আমাদের লক্ষ্য করার বিষয় হলো শুধু রহস্যময় সুন্দরের ছায়ামুক্তি নয়, অসুন্দরকেও প্রকাশের ক্ষমতা রয়েছে চিত্রকল্পের। এসব ক্ষেত্রে অনুষঙ্গই শব্দকে তার বহুকৌণিক আলো দিয়ে চিত্র থেকে চিত্রকল্পের দিকে নিয়ে যায়।

৪. এরপর তিনি দেখিয়েছেন অলংকারহীন কবিতার সন্ধানে কবিরা কতটা পথ এগিয়ে যথার্থ পথিক হয়ে উঠলেন। বা একেবারে অলংকারমুক্ত কবিতা বা কবিতাবিরোধী কবিতা বা সে অর্থে প্রতিকবিতা বা অ্যান্টি পোয়েট্রি লেখা কতটা সম্ভব সে প্রশ্নের মুখোমুখিও তিনি আমাদের দাঁড় করালেন। তিনি বললেন, –"কোনো ধারার কবিতাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত রহস্যরিক্ত ব্যঞ্জনাহীন বা রূপক উপমা উৎপ্রেক্ষাহীন হতে পারে না। এমনকি বিবৃতিমূলক সামাজিক দায়বদ্ধতার শ্লোগানও কবির হাতে পড়ে শ্লোক হয়ে যায়।" (প্রবন্ধসংগ্রহ, পৃ : ৬২)।

৫. স্বভাবত কবিতার পরবর্তী যাত্রা শুরু হয় শ্লোগান থেকে শ্লোকের দিকে। এখানেও তিনি দেখিয়েছেন কবিতা থেকে সৌন্দর্যবোধের ব্যাকুলতা কখনও একেবারে মুক্ত হবার নয়। কবিতা কখনও তা সহ্য করতে পারে না। সে কোনও রক্তাক্ত প্রতিবাদ থেকে স্লোগানের জন্ম হতে পারে, কিন্তু যান্ত্রিক উচ্চারণে স্লোগানও ঐশ্বর্য হারায়। ফলে সমাজ সচেতনতার সঙ্গে যখন চিত্রকল্পে যথার্থ মিশে যায় আর্তহৃদয়ের আতুরতা, তখনই শব্দরা স্লোগান থেকে শ্লোকে পর্যবসিত হতে পারে। তাঁর কথায়, "সামগ্রিক সামাজিক প্রয়োজনে কবি কখনো কখনো কবিতা জলাঞ্জলি দিয়ে স্লোগান লিখলেও শেষ পর্যন্ত কবিতায় কবিতা ফিরিয়ে আনাই কবির কাজ।" (ঐ, পৃ : ৭১)।

৬. এরপর তিনি দেখিয়েছেন বাংলা কবিতা আখ্যানকাব্যের যুগ পেরিয়ে যেভাবে খণ্ডকবিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল, আবার একটা সময় ফিরে যেতে চেয়েছে দীর্ঘ বা মহাকবিতার দিকে। বাংলা কবিতায় বোধ করি ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে ঈশ্বর গুপ্তর সময় থেকে একটু একটু করে খণ্ডকবিতার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু গাঁথা বা কাহিনিকাব্যের কাল তখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে যায়নি। তা থেকে মুক্তির জন্যেই দীর্ঘকবিতায় আসা। জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন মহাকবিতা। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'শিশুতীর্থ'-এর কথা উল্লেখ করতে হয়। কবি মঞ্জুষ বললেন, "একটি ছিন্ন অনুভূতি বা মুডকে স্বতন্ত্রভাবে রূপায়িত না করে দীর্ঘ পরিসরে মানবমনের চেতন অবচেতন ও অচেতন অনুভব ও কল্পনাজগৎ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় যখন হয়তো তখনই দীর্ঘ কবিতার জন্মলাভ।" (ঐ, পৃ : ৭২)। এই দীর্ঘ কবিতা লেখার ধারাটি এখনও লক্ষ্য করা যায়। আজও অনেকেই এর মধ্যে তাঁর সৃষ্টির সিদ্ধি খোঁজেন। তবে এই মুহূর্তে সিরিজ কবিতা চর্চা অনেক বেশি সমৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে কবির ওই ছিন্ন ছিন্ন অনুভূতি বা মুডকে ধরছেন ক্রমানুসারে। একে আমরা দীর্ঘ কবিতার পরবর্তী পর্যায় বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে ধরতে পারি।

৭. দীর্ঘ কবিতার মধ্যে একটা অমিত বা বাড়তি কথা বলার ঝোঁক কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি। দীর্ঘ কবিতার সঙ্গে ছোট কবিতার মৌল পার্থক্য এখানেই। পরবর্তীতে আমরা দেখলাম আরও কম কথায় কবিতাকে কীভাবে ছোট অথচ স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায়। কবিতার যাত্রা শুরু হলো অমিত থেকে মিতকথনের দিকে। অর্থাৎ তীব্রভাবে আরও সংহত হতে থাকা। পুনরাবৃত্তিকে বর্জন করা, প্রগলভতাকে বর্জন করা। এ বিষয়ে অনেক অনেক উদ্ধৃতির উল্লেখ করা যায়। ষাটের দশকে শ্রুতির কবিরা মিতায়তনের কবিতায় বিশ্বাস রেখেছিলেন। এরপর এলো আরও সংহত কবিতা। এই মুহূর্তে আমরা দেখতে পাই এক পংক্তি, দুই পংক্তি থেকে চার পংক্তির কবিতার জোয়ার। কবিতা এভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতির রূপভেদে পাল্টে যেতে থাকে।

৮. যেমন আমরা এসেছি প্লেটোনিক থেকে শরীরী প্রেমের পথে। এ যাত্রাও কম দীর্ঘ নয়। প্রেমের কবিতায় অশরীরী রোমান্টিকতার কথা বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের কথা ভীষণভাবে এসে যায়। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতে চেয়েছিলেন 'আধুনিকতার ভূত' যার প্রকাশ শুরু হয় তাঁর সময়কালেই ত্রিশের দশক থেকে। তাঁর চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড় কবি গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮) কিন্তু অনেকটাই দ্বিধাহীন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন 'সোনারতরী' বা 'চিত্রা'র কবিতাগুলি লিখছেন অর্থাৎ ১৮৯৪ সাল, সে সসময়েই কবি গোবিন্দচন্দ্র লিখলেন –

আমি তারে ভালবাসি অস্থিমাংসসহ,
অমৃত সকলি তার – মিলন বিরহ।
বুঝি না আধ্যাত্মিকতা
দেহ ছাড়া প্রেমকথা
কামুক লম্পট ভাই যা কহ তা কহ।

(কস্তুরী আমার ভালবাসা)

দেহজ প্রেমের উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের তখনও আড়ষ্টতা রয়েছে। কিন্তু মোহিতলাল, বুদ্ধদেব বসুরা নারীদেহের বর্ণনায় অকপট হয়ে উঠছেন। তাঁদেরই প্রশ্রয়ে হয়তো পঞ্চাশের কবিরা প্রেম ও যৌনতার জোড়ে কবিতার জোর খুঁজেছিলেন। ষাটের হাংরির কবিরা এ বিষয়ে ছিলেন আরও উদার। ফলে সমালোচকদের আক্রমণে তাঁরা বিদ্ধ হয়েছেন। সমকালে দাঁড়িয়ে এই জৈব-আর্তনাদকে শ্রুতির কবিরা অবশ্য বর্জন করতে চেয়েছিলেন। তারপর তো কালের প্রবাহে নদীর জল বহুভাবে বহুপথে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। এখনও অনেকের কলম ক্ষুধার্ত ও অকপট। তবে কবি মঞ্জুষ প্রাবন্ধিক হিসাবে বিষয়টিকে যেভাবে শেষ করেছেন তা অতুলনীয়। বলছেন –"ইন্দ্রিয় নির্ভরতার বিরুদ্ধে উচ্চারিত চিৎকার পেরিয়ে চিরন্তন রোমান্টিকতায় কবি হয়তো লিখে ফেলেন 'আয় খুকু স্বর্গের বাগানে আজ ছোটাছুটি করি' যেখানে নক্ষত্রের রেণু কবির গায়ে এসে লাগে।" (ঐ, পৃ : ৯৬)।

৯. পরবর্তী প্রবণতাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞান ও কবিতার মেলবন্ধন। যাত্রাটি বিজ্ঞান থেকে কবিতার দিকে। এখানে ভাবার বিষয় হলো কবিতায় বৈজ্ঞানিক অনুষঙ্গ ব্যবহৃত হওয়াটাই প্রধান কথা নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে বিজ্ঞানচেতনার প্রসঙ্গটি। কবিতায় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিরীতির প্রচলন। জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন 'বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিদিব্যতা'। আর কবি মঞ্জুষ বলছেন, –"বিদ্রোহী ইলেকট্রন শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাতে ঘটাতে চক্রপথে প্রোটনের মুখোমুখি হয়ে ফিরে আবার অন্য প্রোটনের অভিমুখে লাফ দিয়ে ছুটে যায় – এই বিজ্ঞানসত্যকে সামনে রেখে কবিমানসের ভিতরে যেন নানা জ্যোতিমঞ্জরীর মঞ্জীরধ্বনি শোনা যায়। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের আলো কবির গায়ে এসে লাগলেও ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারকেই সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে স্পর্শ করার প্রয়াসই শেষ পর্যন্ত কবিতা।" (ঐ, পৃ : ১০১)। এই ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারই আমাদের বিশ্বপরিচয় ঘটায়। যে পরিচয় বিজ্ঞানের জ্ঞানচেতনা।

আমরা এরপরও অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। কবিতার যথেষ্ট পালাবদল ঘটে গেছে। আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হয়তো তখনই সংযোজন করা যেত, যেমন কবিতায় গল্প বলার প্রবণতা, যা আজও অনেকের মধ্যে রয়ে গেছে। পাশাপাশি চলছে টানা গদ্যে লেখার চল। জন্ম নিয়েছে দুটি বিশেষ্য, দুটি বিশেষণ বা বিশেষ্য বিশেষণ মিলিয়ে শব্দজোট তৈরি বা শব্দসমবায়ের মাধ্যমে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টির প্রবণতা। এসেছে কবিতাকে বিষয়কেন্দ্রের বাইরে এনে অনির্দিষ্টের দিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা। সিদ্ধান্তহীনতা। বিদ্রূপ, শ্লেষ বা তির্যকতার নতুন রূপসন্ধান ইত্যাদি। এভাবেই প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে আরও আরও নতুন প্রবণতা। কারণ কবিতার ইতিহাস হলো প্রবহমান ভাষাবদলের ইতিহাস, টেকনিকবদলের ইতিহাস।

# # #

আমরা লক্ষ্য করেছি কবি মঞ্জুষ নয়ের দশকের প্রথম পর্বে অর্থাৎ ১৯৯০-৯৫, এই সময়কালে লেখকজীবনের অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। যেমন এই প্রবন্ধগ্রন্থ দুটি – ১. নবীন আধুনিকতার অস্থিরতার বিন্দুগুলি ; ২. বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা। ১৯৯৩-এ লিখেছেন "স্বপ্নভূমি"র মতো একটি ভিন্ন আঙ্গিকের উপন্যাস। যেখানে চরিত্রগুলি নিজেরাই নিজেদের জীবনের কথা বলছে। বাংলা সাহিত্যে গুটিকয়েক উপন্যাস এই ধারায় লিখিত। লেখক নিজেও একটি চরিত্র হয়ে ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছেন। যাকে সে অর্থে আত্মজৈবনিক উপন্যাস বলা যাবে না। তবে যেমন হয়, কোনও কোনও চরিত্রের মধ্যে নিজের জীবন ভাবনা আদর্শ স্বপ্ন অবশ্যই ঢুকে পড়ে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো তিনি জীবদ্দশায় মাত্র তিনখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। "একদিন একরাত" (এপ্রিল ১৯৮১), "স্বপ্নভূমি" (অক্টোবর ১৯৯৩) এবং "ক্রশরোড" (জানুয়ারি ২০০৩)। বলার কথা হলো একজন কবি হিসাবে তিনি তাঁর কবিতার অনুভব ও সত্তাকে বজায় রেখেই এই উপন্যাসগুলি যে লিখতে বসেছিলেন তা পড়তে পড়তে সহজে বোঝা যায়। সরাসরি এসেছে কবিতার উদ্ধৃতি এবং কবি চরিত্রও। ফলে অন্যান্য কবি-লেখকদের থেকে তিনি এক্ষেত্রেও আলাদা। কারণ কবিতা দিয়ে শুরু করে অনেকেই গদ্যসাহিত্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁরা গদ্যের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও কবিতা সেখানে অবহেলিত হয়েছে।

কিন্তু তিনি আদ্যন্ত কবি। এই সময়কালেই তিনি কবিতার ফর্ম নিয়ে চূড়ান্ত ভাবনা চিন্তা করেছেন। প্রকাশিত হয় তাঁর "অন্ধকার অন্ধ নয়" (জানুয়ারি ১৯৯৫) কাব্যগ্রন্থখানি। তার আগে "আগুনের ডানা" (১৯৯৩) পর্যন্ত প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সাতখানি কাব্যগ্রন্থ। যেখানে আমরা দেখেছি অস্তিত্ববাদ ও প্রতীকের নানারকম মেলামেশা ঘটতে। সারা পৃথিবীতে তখনও Surrealism নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। উঠে আসছে Magic-realism-এর প্রসঙ্গগুলি। সেই অবস্থান থেকেও তিনি ভাবতে শুরু করেছিলেন বহুস্তরিক অবচেতনের আরও একটি পরত কীভাবে খোলা যায়, উন্মোচন করা যায়‌। ওই সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গেও তিনি যা বলেছিলেন, – ''অন্ধকার অন্ধ নয়' মূলত আমার অবচেতন স্তরের নানা বিরুদ্ধমূলক উদ্ভাস। কিছুটা বক্রোক্তি, কিছুটা কূটাভাস, কিছুটা নিরীহ শব্দচালের মধ্যে মায়াবিভ্রম লুকিয়ে রাখা। কিছুটা কোলাজ, কিছুটা মন্তাজ, কিছুটা দর্শন। সরল শব্দযূথ পরিত্যাগ করে ব্যঞ্জনাময় শব্দযূথ আবিষ্কারের প্রয়াস করেছি। 'অন্ধকার অন্ধ নয়' শুধুমাত্র পরাবাস্তব কবিতার সংকলন ভাবলে বোধহয় ভুল হবে। পরাবাস্তবতার সঙ্গে এখানে মিশে গেছে Entropy-র দ্বন্দ্ব।" (ফিনিক্স, বইমেলা ২০০১)।

এই entropy বলতে বলা হচ্ছে বিজ্ঞানের কণাতরঙ্গের কথা। এছাড়াও এর মধ্যে রয়েছে ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারের আভাস। যা প্রথা-প্রচল আলো-অন্ধকারের বিন্যাসকে ভেঙে ফেলতে চায়। বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডে তারই আলোড়ন চলছে বা বলা যায়, পৃথিবীতে অস্থিরতা যতক্ষণ বর্তমান, ততক্ষণই সৃষ্টির উদ্ভাস। এর রহস্যটা এখানেই। আমরা বরং এই গ্রন্থের একটি কবিতা থেকে বিষয়টা কিছুটা অনুভব করার চেষ্টা করি আমরা –

স্মৃতিঋতু। চোখ দিগন্তে। নীল শ্লেটে। লেখা ও ছবি পড়ে। মুছে
যায়। অদৃশ্য ইরেজারে। আলোয়ানওমে নারী শ্বাস ফেলে। দীর্ঘ
ঈকারের মতো দূর দীর্ঘশ্বাস। বাতাস কাঁপে। পাহাড়ে ঢালে দ্রুতসন্ধে।
রাত্রিও ! ঘুম ও না ঘুমের মাঝখানে অফুরান বর্ষা।

(শীত, পৃ : ২৩)

আমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছি যে, এ কবিতার অভিঘাত কোথায়! কোথায় তিনি অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র ! এধরনের কবিতা থেকে কোনও পংক্তি তুলে উদ্ধৃতি দেওয়া যায় না। টোটাল পোয়েট্রি। সম্পূর্ণ কবিতার মধ্যেই এক আশ্চর্য আলোড়ন, যা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। কিছুটা সেরিব্রালও বটে।

তবে সমকাল ও ইতিহাসই নির্ধারণ করে দেয় একজন কবি কীভাবে কবিতা লিখবেন। তিনি আত্মিক প্রেরণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই প্রেরণাকে আমরা যেমন প্রেম বলতে পারি তেমনি লক্ষ্য করবো গদ্যভাবনাও তাঁর কবিতার বিষয়কে ছুঁয়ে আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে অন্য এক দিগন্তে। তবে নির্দিষ্ট কোনও তত্ত্ব অনুসরণ করে কবিতা লেখায় তিনি বিশ্বাস করেননি। বিষয়ের অন্তঃপ্রকৃতি অনুযায়ী ভাষাকে নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর Metaprose বা পরাভাষা বহুমাত্রিক। কিন্তু একেবারে অনির্ণেয়তার দিকে তাঁর যাত্রা নয়, শেষ পর্যন্ত একটা সংযোগসেতু গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন সবসময়। তিনি বিশ্বাস করতেন, "পূর্বাপর বিরহিত, ঐতিহ্যছুট, স্বয়ম্ভূ কবিতা কখনো হতে পারে না। নানা কালপর্বে শিল্পশৈলী বাঁকবদল করে আর এই আঙ্গিকবদলই কবিতার ইতিহাস রচনা করে যায়।" (নির্বাচিত কবিতা /সূচনা-কথা, প্রকাশ: জানুয়ারি ১৯৯৮)।

আমরা এই পর্বের পরেই দেখবো সহজাত কবিত্ব থেকে উৎসারিত শব্দরা কীভাবে নির্মাণের হাত ধরে নতুন এক যাত্রায় সামিল হয়। প্রতি নিয়ত ছিল তাঁর এই শব্দসন্ধান। জাগতিক বিশৃঙ্খলা থেকেই তিনি সুন্দরকে খুঁজে নেন। লিখছেন –

চোখজলে জেগে ওঠে দেশরেখা। লহমায় ভাগ হয়ে যায় পাহাড় পর্বত
নদী-মানুষেরা। চোখ জ্বলে। কাঁটাতার, তুমি এতো শক্তিশালী ! ও দেয়াল,
ও শক্ত নিরেট জল, তোমরাও। দিগন্ত কাঁপিয়ে ট্রেন যায়। ও সবুজ ট্রেন,
তুমি কেন নিয়ে যাচ্ছ আমাদের ! কালো রং দু-একটি পালক ফেলে যাও।

(ত্রিকাল পাখির গল্প/ নির্বাচিত কবিতা, অগ্রন্থিত অংশে)

একটি দীর্ঘ কবিতা। কখনও টানাগদ্যে, কখনও কবিতার ফর্মে ভাঙা ভাঙা পংক্তি বিন্যাসে ত্রিকাল পাখিটি যেন জীবনের গল্প বলছে। সময়, সমাজ, পরিপার্শ্ব, বিজ্ঞানচেতনা এবং জীবনকে ভেতর থেকে দেখার তীব্র বাসনা। যা মেলে ধরে বড় একটা ক্যানভাস। অনন্য ভাষায় আমাদের নিয়ে যায় মহাকবিতার দিকে। তাঁর সময়ের কবিরা এই বয়সে কবিতাকে নিয়ে এভাবে কতটা ভেবেছেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই ত্রিকাল পাখিটি যে কবি নিজেই।

# # #

কবি মঞ্জুষের আগ্রহের আরেকটি দিক হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিতার অনুবাদ। বিশেষ করে ফরাসী কবিতা। তিনি অনুবাদের মধ্যেও একধরনের স্ফূর্তি খুঁজে পেতেন। অনুবাদ করা ছিল যেন তাঁর মৌলিক কবিতা লেখার আনন্দেরই একটা অংশ, আলাদা কোনও বাধ্যতামূলক অভ্যাস নয়। এই সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন "আসলে যখনই কোনও বিদেশি কবিতা পড়ি তখনই ইচ্ছা হয় সেগুলি অনুবাদ করি। মনে হয় আমার বন্ধুরা যদি এগুলো পড়েন তাঁরাও এই কবিতা থেকে বাংলা কবিতার জন্যে কিছু আহরণ করতে পারবেন।" তাঁর এই ভাবনার কাছে চিরকাল আমাদের নত হয়ে বসতে হয়। তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডিরোজিওর কবিতা, ভ্যারনার ল্যামবেরসির কবিতা সহ একগুচ্ছ ফরাসী কবির কবিতা।

তাঁর অসামান্য আত্মজীবনীমূলক গদ্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল 'পারানি' নামে একটি পত্রিকায়। তখন শুধু তাঁর গদ্যটির জন্যেই যে পত্রিকাটি আদৃত হয়েছিল পাঠকমহলে একথা বলার কোনও অপেক্ষা রাখে না। আমরা অধীর আগ্রহে থাকতাম। সেই "পটুয়ার বিমূর্ত শিল্প" গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় খুব সম্ভবত ২০০০-এর এপ্রিলে। শব্দের সঙ্গে সহবাস করতে করতে এই যে পিছন ফিরে দেখা, খুঁড়ে খুঁড়ে দেখা, নিঃসঙ্গ পথিকের গান হয়ে বেজে উঠছে আমাদের বুকের মাঝখানে। প্রবহমান স্রোতে জীবনের এক একটি প্রহর যেন রঙ বদলে বদলে সামনে ধরা দিচ্ছে। তিনি জীবন ও প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন খুব নিবিড়ভাবে। তাঁর শিল্পবোধ ও মানসিকতা আমাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় কবি হওয়ার আগে একজন ভালোমানুষ হয়ে ওঠার কথাটি। এ গ্রন্থের ভাষাও অনবদ্য। তিনি বলেছেন একজন মানুষের ফিরে ফিরে জন্ম হয়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে পাল্টাতে থাকে সেই মানুষটি। কারণ পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। তাঁর আত্মজৈবনিক এই রচনা হলো অনেকটাই শব্দ দিয়ে ছবি আঁকা। সব ছবিই হয়তো অসমাপ্ত ভাঙাচোরা, কিন্তু সুন্দরের সোনালি রেখাটি স্পষ্ট। হয়তো আরও অনেক কথা বলার ছিল, কিন্তু তিনি চাননি জীবন এরচেয়ে বেশি উন্মোচিত হোক। তাঁর সংযমবোধ, শালীনতাবোধ থেকেও আমাদের শেখার আছে। তাঁকে আরেকটু জানতে আমরা আর একবার তাঁর অফিস ঘরে ফিরে আসি। কবি-প্রাবন্ধিক বিপ্লব মাজী লিখেছিলেন –

"১. কেউ নতুন পত্রিকা বের করবেন। মঞ্জুষ পরিকল্পনা করে দিচ্ছেন। ২. কেউ নতুন বই করবেন। কী করতে হবে, কীভাবে করতে হবে মঞ্জুষ বলে দিচ্ছেন। ৩. কেউ পত্রিকা বের করছেন। ভালো লেখা পাচ্ছেন না। মঞ্জুষ বলে দিচ্ছেন। ৪. বহরমপুর বা ধানবাদে সাহিত্যসভা হবে। কে কে যাবেন ? মঞ্জুষ ঠিক করে দিচ্ছেন। ৫. সাহিত্যের অসংখ্য যেসব পুরস্কার আছে সেগুলো সম্পর্কে মঞ্জুষের সঙ্গে পুরস্কারদাতারা আলোচনা করছেন।

অর্থাৎ বিকেল তিনটে থেকে চারটে এমনকি সন্ধে ৬টা পর্যন্ত মঞ্জুষের ওখানে সাহিত্যের যে আড্ডা তা বাংলা সাহিত্যকেই সমৃদ্ধ করছে।" (প্রসঙ্গ মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, পৃ : ১৬)

এভাবেই আড্ডা আলোচনা থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। প্রথমেই নজরে আসে পূর্ণেন্দু পত্রীর অপূর্ব প্রচ্ছদে একটি নির্বাচিত কাব্য সংকলন "এই মুহূর্তের কবিতা" (প্রকাশ : রথযাত্রা, ১৩৮৮)। অসামান্য এই সংকলনে নির্বাচিত কবিরা ছিলেন সেই মুহূর্তে বিশেষভাবে সক্রিয়। তাঁদের অপ্রকাশিত কবিতা নিয়ে এই সংকলন। নির্বাচিত হয়েছিল প্রায় একশজন কবির একটি করে কবিতা। বাংলা কবিতার অনেক অনেক সংকলন থেকে যা অনেকটাই আলাদা। অন্তত কবিতার মান ও কবির বিচারে। তবে কোনও সংকলনই তো শেষপর্যন্ত সম্পূর্ণ নয়।

যাহোক, পরবর্তী সংকলনটি প্রকাশিত হয় পূর্ণেন্দু পত্রীকে নিয়ে পরের বছরই "পূর্ণেন্দু পত্রী : শিল্পী ও ব্যক্তি"। তারপর ১৯৮৮ সালে তিনি প্রকাশ করেন প্রতিবাদী কবিতার একটি সংকলন "প্রতিবাদ যখন কবিতা" এবং ১৯৯০ সালে কলকাতার তিনশ বছর উপলক্ষ্যে প্রকাশিত হয় "ছড়ায় না-ছড়ায় কলকাতা"। প্রতিটি সংকলন আলাদা আলাদা করে আলোচনার দাবি রাখে। শুধু ছড়ায় না-ছড়ায় প্রসঙ্গে একটু বলি, তিনি কবিদের কাছে কলকাতার উপর ছড়া দাবি করেছিলেন, কিন্তু নির্বাচনের সময় তিনি লক্ষ্য করলেন এর সব লেখাকে ছড়ায় আখ্যায়িত করা যায় না। আবার কবিদের কাছে নতুন করে ছড়া দাবি করাও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই তিনি সব লেখা রেখে সংকলনটির নামকরণ করলেন "ছড়ায় না-ছড়ায় কলকাতা"। এছাড়াও আরও কিছু সংকলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষে পরোক্ষে জড়িয়ে ছিলেন তিনি, সঙ্গে আমাদের মধ্যে অনেকেই।

এভাবে আরও অনেক কথাই মাঝে মাঝে মনে পড়ে। সব কথা হয়তো লেখার নয়। তবু যখন দেখি তাঁর অগুনতি স্নেহধন্য কবি-লেখক এখন প্রায় তাঁকে ভুলেই থাকেন, মনে পড়ে যায় তাঁরই এক পংক্তির কবিতাগুলি, যেমন– "কোন বন্ধুত্বই খুব দীর্ঘজীবী নয়"। বা মনে পড়ে যায় – "মানুষের মুখ আর চোখেই পড়ে না এই মুখোশ সমাজে"।

কিন্তু তাঁর সমস্ত প্রয়াস কি ব্যর্থ হতে পারে ! তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ! তাঁর মতো সাহিত্যপ্রেমী, কবি ব্যক্তিত্ব কি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে পারেন ! এই যে জীবনগ্রন্থখানি, মলাট খুলতেই বারবার ভেসে ওঠে অতীতের সঙ্গে ভবিষ্যৎকে মেলানোর জন্যে এক প্রাণবন্ত বর্তমান। আর ভেসে ওঠে তাঁর অমোঘ কণ্ঠস্বর "মানবিকতার সম্পর্কগুলো বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এই কবিত্ব, শুধুমাত্র কয়েকটি অক্ষরের মূলধন করে বেঁচে থাকা – তাও ব্যর্থ হয়ে যাবে।" এভাবেই হয়তো অন্ধকারের ভাষাশব্দ নিয়ে, নৈঃশব্দ্য নিয়ে তাঁর আলোকথা লিখে রাখা…!

0 comments: