ধারাবাহিক - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in ধারাবাহিক৩
Illness is the night-side of life, a more onerous citizenship. Everyone who is born holds dual citizenship, in the kingdom of the well and in the kingdom of the sick.
মনীষা টোস্ট ওমলেটটা প্লেটে এগিয়ে দিতে দিতে একবার তাকালো। অর্ণব এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি। একবার তাই জেনে নিতে চাইল -তুমি কি কাল ফিরছ? অর্ণব মাথা নাড়ল -নাহ, বলতে পারবনা কবে ফিরছি। ডিউটি এখন সবই এমারজেন্সি। তুমি বসে থেকো না। খেয়ে নিও। শুয়ে পোড়ো। আমি আসলে জানিয়ে দেবো। মনীষা সামনের স্টেন গ্লাসের ওয়ালটা মুছতে মুছতে বলল -কতদিন যে মাধুদের আসতে দেবেনা কে জানে। এত কাজ করা যায়? অর্ণব হাসল -হুঁ। বুঝতে পারছি। কিন্তু এ সময়ে ওদের তো এলাউ করা যায়না? আর কটা দিন কষ্ট করো। ওরা আসতে পারবে। ততদিন তুমি তুতুনকে বলো না হেল্প করতে। অন্তত হাতে হাতে মপ করা কি মেশিনে কাপড়গুলো কেচে দেওয়া, ডাস্টিং, এগুলো তো করতেই পারে। নাকি? মনীষা হাঁ করে দেখছিল অর্ণবকে। কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। শেষে মুখ খুলল -তুমি সত্যিই আশা করো তুতুন এসব করবে? -কেন করবে না? অন্য সময় হলে আলাদা। এখন সবাইকেই কোঅপারেট করতে হবে মণি! ওকে ঘুম থেকে তোলো। আমাকেও টোয়েন্টি ফোর আওয়ারস কনটিনিউয়াস ডিউটি করতে হয়। তোমারও ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ডেকে দাও ওকে। মনীষা নীচু স্বরে বলল -আঃ! এত জোরে জোরে বলার কি আছে? ও কাল রাত জেগে পড়াশুনো করেছে। ওদের গ্রুপে এখন স্টাডি আওয়ার রাতেই। এখন ডাকা যাবেনা। অর্ণব কঠিন চোখে মনীষাকে দেখল -তোমার জন্য ছেলেটা এই পনেরোতেই না নষ্ট হয়ে যায়। কিছু বলব না আমি। আমি বললেই তো তোমার আবার মনে হবে আমার মিডলক্লাস মেন্টালিটি। মিশনের ন্যাকা আদর্শবাদ। চললাম। তবে কোনোভাবেই মাধুকে ডেকে পাঠিও না। মনীষা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে ওঠে -সিকিওরিটি ঢুকতে দিলে তো!
অর্ণব হেসে ফেলে বেরিয়ে যায়।
অর্ণবদের হাসপাতালটার বয়স বেশিদিন হয়নি। অসুখটা আসার মাত্র মাস ছয়েক আগে পাব্লিক প্রাইভেট ওনারশিপ মডেলে কয়েকজন ডাক্তার মিলে বানানো হয়েছিল। বোর্ডে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে একজন সুপার আছেন। কমিটিতে আছেন অচিকিৎসক কর্মচারী। কয়েকজন ডাক্তার নিয়ে শুরু করে দ্রুত হাসপাতাল বেশ দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অর্ণব গুপ্ত, মণি স্বামীনাথন, প্রেরণা গোস্বামী, শঙ্খ সামন্ত, বিজয় দুবের মতন ডেডিকেটেড ডাক্তাররা দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন বেশ। মাত্র ষাট বেডের হাসপাতাল এই অসুখের জন্য টেনে হিঁচড়ে একশো করা হয়েছে। ডাক্তার নার্স ও অন্যান্য কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় আশি জন আছেন। তবে এখনও ডাক্তারদের কোয়ারটার বা কর্মচারীদের থাকার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। এই এমারজেন্সির সময় নিজস্ব চেম্বারেই তাই ডাক্তাররা গা এলিয়ে দ্যান। সুপার দেবর্ষি তপাদার একটু খিটখিটে। সিনিক টাইপ। খারাপ নন। তবে সব কিছুকেই কেমন সন্দেহের চোখে দ্যাখেন। বিশেষত এই সময়ে তিনি কারুকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এক্সট্রা কশাস। এই বুঝি অসুখ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঘাড়ে পড়ল। যারা রেগুলার আসছেন এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে তাদের মাঝেমাঝেই বলছেন -দেখুন, বুঝে শুনে ডিউটি করুন। বাড়াবাড়ি করবেন না। কোনো কোনো ডাক্তার না এলে উনি তাদের হয়ে ওকালতি করেন। -আরে না না। ছেলে বউ নিয়ে ঘর করতে হয়। আড়ালে সবাই হাসাহাসি করে। স্বামীনাথন বলেন -ডাক্তার তপাদার কিন্তু নেগেটিভ স্টিমিউলেশানে পারফেক্ট।
শেষ দু মাসে অবশ্য হাসাহাসির জায়গায় আর ব্যাপারটা নেই। অদ্ভুতভাবে হাসপাতালে একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে গেছে সকলে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে, কোনোরকমে করিডোরে চেম্বারে ওয়েটিং এ যেখানে পেরেছে একটু শুয়ে নিয়েছে। কাজের শেষ ছিল না। সবচেয়ে হতাশার ব্যাপার হল যে অসুখটার কোনো কিওর নেই। এখনও পর্যন্ত। প্রিকশান বলতে ডিসট্যানসিং আর ক্লিন এটমস্ফিয়ার। মাস্ক গ্লাভস আর প্লাস্টিকের ওই ওভারঅলই বলা চলে এমন গা ঢাকা পোশাক।
হাসপাতালে রাশ বাড়ছে। রেগুলার পেসেন্টদের দুরবস্থার একশেষ। সুপারকে এ নিয়ে বলতে গেলে সোজা উত্তর এসেছে -স্বাস্থ্যসচিব যা বলেছেন শুনুন। এখন এটাই এমারজেন্সি। আর কোনো এমারজেন্সি নেই। তবু অর্ণব বলেছে -মানে রেনাল ফেলিওর বা ক্যান্সার জলভাত? হাত পা ভাঙা, এক্সিডেন্ট ছেড়েই দিলাম। গাইনিও বাদ থাক। বাড়ির আঁতুড় ঘরে ডেলিভারি হোক। -কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কি এসব সারমন শোনাবেন নাকি? নাকি আপনার ধারণা এগুলো আমি বুঝি না? যা অর্ডার তার বাইরে কিছু করা যাবেনা। এটুকুই বলেছি। বেশি নয়। এরপর আপনাদের ইচ্ছে হয় সব ডিপার্টমেন্ট খুলে রাখুন। চিকিৎসা চালিয়ে যান। কোমরবিডিটি বাড়লে না স্বাস্থ্য দফতর ছাড়বে না ছাড়বে পাব্লিক। এটুকু খেয়াল রাখবেন। আর হ্যাঁ, পরের মিটিং এ সেক্রেটারির সঙ্গে আপনাকেই বসিয়ে দেবো।
সুপার বাধ্য হয়েই অর্ণবের স্পর্ধা সহ্য করেন। ডাক্তার হিসেবে অতুলনীয়।
তবে স্ট্যাটিস্টিকস বলছে কার্ভ ফ্ল্যাটেনড হচ্ছে। যেভাবে রাইজ করছিল তা থেকে ফল করছে। আর বেশ দ্রুতই। তাই পেসেন্ট আসা কমেছে। কিন্তু যারা এখনও হাসপাতালে তারা সুস্থ হয়ে বা না হয়ে যতক্ষণ না ফিরছেন, ততক্ষণ অন্য চিকিৎসা চলবে না।
ইস্টার্ন সিটির এই কমপ্লেক্সে আসার আগে মনীষা নিজের মনের মতো করে ডেভেলপারকে বলে ফ্ল্যাটটা সাজিয়ে ছিল। ডুপ্লে ফ্ল্যাট। অর্ণব ডাক্তারি ছাড়া কিছু বোঝে না। তাই একাই সব করেছে ও। অর্ণবকে যখন বলেছিল -আমরা না একটা ডুপ্লে ফ্ল্যাট নিচ্ছি। অর্ণব অবাক হয়ে চেয়েছিল -ডুপ্লে? সে তো সেই ফরাসী যুদ্ধবাজটা! মনীষা আহত স্বরে বলেছিল -সিরিয়াসলি? তুমি জানো না ডুপ্লে ফ্ল্যাট কী? অর্ণব চাপা হাসিতে মুখ ভরিয়ে মাথা নেড়েছিল। নাহ, ও জানেনা। অগত্যা মনীষা একাই ফ্ল্যাট গুছিয়েছে। নীচের ফ্লোরে ওদের শোবার ঘরগুলো। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে এলে কিচেন আর ডাইনিং। একটা লম্বা হল স্টাডি কাম ড্রয়িং। সঙ্গে টেরেস। টেরেসে ম্যানিকিওরড গার্ডেন। সাতাশ তলার ওপর থেকে অসাধারণ লাগে। জাস্ট অ্যামেইজিং।
কিন্তু সেই ডুপ্লে এখন গলার কাঁটা। অর্ণবকে বলে লাভ নেই। ও রান্না করতে জানে। খিচুড়ি বা মাছের ঝোল রেঁধে বাড়িতে থাকলেই খাইয়ে দিতে পারে। দেয়ও। নিজের কাজ নিজে করতে অভ্যস্ত। কিন্তু তুতুন ওসব খেতে পারেনা। পাস্তা বা পিজা ভালো খায়। নইলে মাটন কিংবা ফিসের অন্য কিছু। ভাত খায়না বললেই চলে। এ রান্না মনীষা ছাড়া করবে কে? মাধুকে অবশ্য ট্রেনিং দেওয়া ছিল।
অর্ণবের চলে যাওয়ার পর মনীষা দ্রুত হাতে কাজ গোছাতে শুরু করল। দশটা থেকে অনলাইন ক্লাস। স্কুল এখন ক্রমশ অভ্যস্ত হচ্ছে। বেশ ভালোই কিন্তু। অথচ সেদিন এক বেয়াদপ গার্জেন ফট করে গ্রুপে লিখে বসল -ম্যাডাম, ছেলেপুলেদের খেলার মাঠটা কেড়ে নিলেন? উত্তর দেয়নি যদিও। বিহেভিয়ার নিয়ে কমপ্লেন এলে মুশকিল। চাকরি বাঁচাতে হবে। ঠিক দশটায় মনীষা নিজের ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসে গেল। দরজা বন্ধ করে দিলো। তুতুন এখন ঘুমোচ্ছে।
অন্য ঘরে তখন শহরের এক নামজাদা স্কুলের নবম শ্রেণী বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে চ্যাটে মগ্ন। এটা এক্সক্লুসিভলি বয়েজ গ্রুপ। খুব ক্লোজড সার্কেল। অনবরত মেসেজ ঢুকছে।
ডিম আলোয় ল্যাপটপ ভেসে যাচ্ছে। কিছু ছবি আসছে। একটি কিশোরীর ছবি। এনলারজ করে ক্রপ করা বিশেষ বিশেষ অঙ্গ। আবার মেসেজের বন্যা। হাসির হররা। নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন। কীভাবে এনজয় করা যেতে পারে।
শেষ মেসেজ এরকম,
-হে ডুড! ফিক্স আপ আওয়ার ডেন। লায়ন্স আর কামিং।
একটা মারাত্মক কুৎসিত খেলায় মেতে ওঠে কয়েকটা কিশোর। বেপরোয়া, বেলাগাম।
রাত বারোটার আশেপাশে নিজের ঘরে বসে রুটি মুড়ে মুখে দিচ্ছিল অর্ণব। ফোনটা বেজে উঠল। অতীন। এসময়েই ও ফোন করে। ছোট ভাই। একটা আস্ত পাগল।
-হ্যালো, বল। সব ঠিকঠাক?
-ওই আর কি। সোশ্যাল ডিসট্যান্স এখানে কি আদৌ সম্ভব? বস্তির আট ফুট বাই আট ফুটে দশজন থাকে। বাইরে টেনে আনা প্লাস্টিকের ঢাকায় আরও দশজন। তবু সামলাতে হচ্ছে।
-মাস্ক আর লাইফবয় সাবানটা মাস্ট, এটা মনে রাখিস। আর শোবার সময় উলটোদিকে মাথা করে শোয়া। মানে একজনের মাথা আর একজনের পা, পাশাপাশি শুলেও ডিসট্যান্স থাকবে, বুঝলি? ভয় পাস না কেউ। মনে হচ্ছে টাইড রিসিড করছে। যাক, তোদের স্কুল?
অতীন হাসে। -বউদির স্কুলের মতো অনলাইন পড়াবো বলছ? এখন ভাগ করে ক্লাস চলছে। সবাই রোজ আসছেনা। ছাত্রছাত্রীদের বলে করা হয়েছে। হ্যাঁ, তবে ওদের খাবারটা রোজ পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
-বাঃ, ভালো।
-দাদা?
-বল
-টাকা চাই যে?
-কত?
-যা পারো, যতটা পারো। লোকগুলোর আয় নেই তো।
-আচ্ছা। পাঠিয়ে দিচ্ছি।
-তুমি কিন্তু ঠিকঠাক থেকো।
অতীনের ফোন রেখে অর্ণব বাকি খাবারটা খেয়ে নেয়। ধড়াচুড়ো পরে আবার ওয়ার্ডে যেতে হবে। এয়ার কন্ডিশন চালানো বারণ। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে। পেসেন্টগুলো সারসার শুয়ে। কারোর কারোর অবস্থা সঙ্গিন। এই সেট আপে পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটার নেই। সাধারণ অবস্থায় চালানোর মতন দুটো ছিল। এখন অনেকেরই দরকার। তাই কষ্টেসৃষ্টে আরও তিনটে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতে শেষ দুমাস যে কার্যত বোকার মতন চেয়ে চেয়ে রুগীর মরে যাওয়া দেখতে হয়েছে বলাই বাহুল্য। এখন অবস্থা অনেকটা আয়ত্ত্বে। কর্নারে একটা বছর চল্লিশের পেসেন্ট ভর্তি হয়েছে সন্ধ্যেবেলায়। এ নিয়ে সুপারের সঙ্গে এক চোট হয়ে গেল। পেসেন্টের স্ট্রোক। তাকে ভর্তি করে এই ওয়ার্ডেই রাখা হয়েছে। কী? না অন্য কোথাও তো খালি বেড নেই! সেরকম হলে তো করিডোরেই বেড ফেলে দেওয়া যেত! কে শোনে কার কথা! অর্ণব অবশ্য সিস্টারকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে। ওনাকে যেন ছোঁয়া না হয়।
ওয়ার্ডে গিয়ে ভালো লাগল। প্রায় বিনা ট্রিটমেন্টে বেশ কয়েকজনের অবস্থা ভালোর দিকে। ডেথরেট কমেছে অনেক। যদিও গতকাল একজন পেসেন্টের ডেথ হয়েছে। বয়স্ক মানুষ ছিলেন। তার পাশের বেডে শুয়ে নতুন পেসেন্ট। অর্ণব কর্নারের পেসেন্টের কাছে গেল। খাটের সঙ্গে নাম ঝুলছে। ‘এইদিন’ কাগজের স্পোর্টস রিপোর্টার না? চিরজিত সেন? মুখটা চেনা লাগছে। অর্ণব জিজ্ঞেস করতে গেলো -সিস্টার? ওনার ভাইটাল সাইনস নোট করেছেন? সিস্টার মাথা নাড়লেন -মাইলড স্যার। ওষুধ চলছে। একটু অক্সিজেন দরকার ছিল। দিয়েছি। অর্ণব চমকে উঠল -কি করে? -কেন স্যার? সেন্ট্রাল সাপ্লাই থেকেই। অর্ণবের মনে হলো এক ধাক্কায় ঘরের দেওয়াল ভেঙে ফ্যালে -হাও ইডিয়টিক? হাও ইরেস্পন্সিবল!! কী করে করলেন এটা? -স্যার কাল স্যানিটাইজ করা হয়েছিল তো! -সো? পাশের বেডের পেসেন্ট এক্সপায়ার করেছে কখন? তার বিলঙ্গিংস কখন বাড়ির লোককে দিলেন? তারপর?
যতক্ষণ না ডেড পেসেন্টের চারপাশ ভালো করে স্যানিটিজ করা হচ্ছে, অক্সিজেন সাপ্লাই টিউবগুলো স্যানিটাইজড হচ্ছে ততক্ষণ ওগুলো নতুন কাউকে এপ্লাই করা যায়না। সিস্টারের মুখটা ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। অর্ণব জানে। বাড়িতে একটা দশ বছরের মেয়েকে মায়ের কাছে রেখে মেয়েটা চাকরি করে। ডিভোর্সি। হয়তো অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকেই ভুল হয়েছে। মারাত্মক ভুল। অর্ণব পেসেন্টের কাছে দাঁড়ায়। এখনও অচেতন। তারই মধ্যে মুখে একটা নীলচে ভাব এসেছে। নাকের পাশ দিয়ে গড়িয়ে আসছে হলদেটে জল। নিঃশ্বাসের কষ্ট বেড়েছে।
-এখন কি একটা এক্সরে করা সম্ভব?
সিস্টার দ্রুত দৌড়য় রেডিওলজির দিকে।
হতাশ অর্ণব দেখল এক্সরে প্লেটটা সাদা। একিউট নিউমনিক শ্যাডো। দুটো লাংসই সাদা।
রাত এখন দুটো। চিরজিত সেন বেশি সময় নেননি। হাসিমুখের মানুষটা খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। বেশ পপুলার ছিলেন তো। খেলার পাতায় খবরের সঙ্গে ওনার একটা ছবি থাকত। ফুটবল খেলা খুব পছন্দের ছিল। ঠিক ওরকম দ্রুত খেলেই যেন স্টেডিয়াম ছাড়লেন।
ডেথ সার্টিফিকেট লেখা সহজ। স্ট্রোক খুব কমন ব্যাপার। কিন্তু এরপরের ব্যাপারটা অমানুষিক। ফোরথ ক্লাস স্টাফেরা মিলে বডি প্যাক করল ব্যাগে। তারপর এ্যাম্বুলেন্স এলো। হুটার না বাজিয়ে কতগুলো রোবটের মতো পোশাক পরা লোক নিয়ে চলে গেল চিরজিত সেনের ডেড বডি।
ভোরের আলোয় অর্ণব দেখল ওয়ার্ডের আশি বছর বয়সী বৃদ্ধা স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মিরাকল। সেরকম চিকিৎসা ছাড়াই বেঁচে উঠলেন। কিন্তু চিরজিত সেন? একটু সময় দিলেন না!
অর্ণব চিরকাল সকালটা খুব ভালোবাসে। ভোরের আকাশ, ভোরের হাওয়ায় যে স্নিগ্ধতা সেই আরাম কখনও পাওয়া যায় না। তার ওপরে পরপর সারাদিনের কাজ মনেমনে সাজিয়ে নেওয়া। মিশনের অভ্যেস মতন ও নিজের সঙ্গে একটু একা থাকতেও ভালোবাসে। মনীষা ঠাট্টা করে। দেবদ্বিজে তো তেমন ভক্তি দেখিনা? এসব আবার কি ভড়ং? অর্ণব উত্তর দেয়না। ভেতরে ডুব দিতে হয়। একেবারে ভেতরে একটা নিঃশব্দ শান্তি আছে। কিন্তু কিছুদিন হল সেই শান্তি আর পাওয়া হয়ে ওঠেনা। ভোর আর শান্তির নেই। একা থাকলেও নানা চিন্তা নানা হতাশা ভিড় করে। যদিও হতাশার স্থান থাকা উচিত নয়। ডাক্তার স্বামীনাথন যেমন বলেন -স্টে পজেটিভ ভাই। দীর্ঘদিন এ শহরে থেকে স্বামীনাথন একেবারে বাঙালি হয়ে গেছেন। শুধু আহার ব্যাপারে এখনও দক্ষিণী।
আজ সকালে কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অর্ণব দেখতে পেলো স্বামীনাথনের গাড়িটা ঢুকছে। ও জানে কি বলবে স্বামীনাথন। বলবে -আরে বাবা! কতজন সেরে উঠছে দেখেছ? ওঃ! প্রে টু গড! একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব পেসেন্ট ভালো হয়ে গেছে। জিরো মর্টালিটি। কী? কেমন লাগবে তখন?
কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে স্বামীনাথন অর্ণবকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন -ইউ আর স্টিল আ কিড। একটা এপিডেমিক তার হাই ওয়াটার লেভেলে পৌঁছক। তারপর সেখানে কিছুদিন থেমে থাকুক। তারপর আস্তে আস্তে কার্ভটা ফ্ল্যাট থেকে লো হবে। তখন তুমি দেখতে পাবে এটা যাচ্ছে। এখন তো কার্ভ ইজ ফ্ল্যাটনিং! দেখছ তো! আর কটা উইক মাত্র। অর্ণব হাসল -ইউ আর সিওর দ্যাট ইট ইউল হ্যাপেন এক্স্যাক্টলি এজ ইউ আর এক্সপ্লেইনিং! অঙ্ক এত সোজা মনে হয়না। স্বামীনাথন কফির কাপের ওপর থেকে চাইলেন। দুই ভুরুর মাঝে একটা রেখা। -তুমি কি সিওর যে এটা এন্ড অফ হিউম্যানিটি? অর্ণব যেন স্বগত কথা বলে – হিউম্যানিটি স্টিল এক্সিস্টস? স্বামীনাথন এবার কফির কাপটা নামিয়ে উঠে দাঁড়ান। বয়স অর্ণবের চেয়ে নয় নয় করে দশ বারো বছর বেশি। তাই কথায় একটা অভিভাবকসুলভ গাম্ভীর্য আছে।
-আই স্টিল বিলিভ ইন হিউম্যানিটি, অর্ণব। কেন? মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ কথাটা আগে শোনোনি? যাক, এখন চলো কাজ শুরু করি। আমাকে একটু ডিটেলস গুলো দিয়ে তুমি একটু অফ নাও।
আপাতত এই হাসপাতালে কুড়িজন ডাক্তার ও প্যারামেডিক কোয়ারানটাইনে। টেস্ট পজিটিভ এসেছিল। দুদিন বন্ধ রেখে স্যানিটাইজ করে ফের খোলা হয়েছে। আর তারপর থেকেই বাকি সব ডিপার্টমেন্ট বন্ধ। সুপারের সঙ্গে এই নিয়েই অর্ণবের মতভেদ। সুপার অবশ্য একদিন বলেই ফেলেছিলেন -বেশ তো। শঙ্খ তো তোমার ব্যাচমেট। অর্থোপেডিক খোলা হোক। এমারজেন্সি ট্রিটমেন্ট চলুক। নো আউটডোর। দেখো কি বলে। অর্ণব ফোন করেছিল -এই শঙ্খ, হাসপাতালে আয়। রুক্ষ গলা ভেসে এসেছিল -কেন? আমার বাবা মায়ের বয়স জানিস? ইনফেকটেড হলে ওরা বাঁচবে? আমি তাছাড়া ফিজিসিয়ান নই। পারবনা সামলাতে। এতটুকু কথার এত বড় উত্তর পেয়ে ফোনের ওপরেই অর্ণব খুব জোরে হেসে ফেলেছিল -তুই মাইরি এক ভীতু রয়ে গেলি। আরে বাবা, তোর নিজের পেসেন্টগুলোকে তো দ্যাখ! নাকি সুমনা বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করেছে? -এই বিশ্বাস কর, ফালতু ইয়ার্কি একদম ভালো লাগছেনা। আমি অনলাইনে চেম্বার করছি, বুঝলি। সার্ভিসের জ্ঞান দিস না আর। শঙ্খর গলায় বন্ধুত্বের ছিটেফোঁটা নেই। -অনলাইনে চেম্বার? ফি নিচ্ছিস? সেটা কিরকম? মানে পা ভাঙলে পেসেন্টকে শিখিয়ে দিচ্ছিস কিভাবে প্লাস্টারটা সে নিজে নিজে করে নিতে পারবে? ওঃ! তুই তো জিনিয়াস রে! অর্ণবের গলায় শ্লেষ ঝরে পড়ে।
শঙ্খ ফোন কেটে দেবার পর অর্ণব আর ফোন করেনি। গাইনি ডিপার্টমেন্টের প্রেরণা এসেছে কিছুদিন। কিন্তু গাইনি পেসেন্ট ভর্তি করা বারণ হতে ও আর আসেনা।
ফিজিসিয়ান মাত্র পাঁচজন। ওরা সামলাতে চাইছে। কিন্তু অনেকেই ভয়ে পেসেন্টের খুব কাছে যাচ্ছেনা। অর্ণব আর স্বামীনাথন বাদে। একটা অদ্ভুত সাইকিক কন্ডিশান। অসুখের আতঙ্ক যেন অসুখকে ছাপিয়ে গিয়েছে।
মনীষা ব্রেকে উঠে ঘরের দরজা খুলল। দেখা যাক এবার যদি তুতুন ওঠে। ওর বড্ড চাপ পড়ছে। ক্লাস নাইন। তার ওপরে অত বড় স্কুল। রেজাল্ট ভালো করার কী যে চাপ! ও অবশ্য পড়াশুনোয় খুবই ভালো। সুপ্রতীক আর ওর মধ্যে একজন ফার্স্ট হয় প্রতিবার। দুজনেই দারুন বন্ধু। আবার কম্পিটিশানও আছে। এই রাত জেগে পড়ার ব্যাপারে অর্ণব একটু সেকেলে। তার ওপরে দরজা বন্ধ রেখে। এটা আবার কি? বিরক্ত হয় অর্ণব। এইটুকু ছেলের আবার প্রাইভেসি কিসের? আর বাড়িতে আছে টা কে? ওকে বিরক্ত করবে? কিন্তু মনীষা কিছু বলেনা। আরে বাবা, ওটুকু দিতে হয়। ওই স্পেস। ওই প্রিভিলেজ। নাহলে প্রিভিলেজড ক্লাসের মানসিকতা তৈরি হবেনা। মিডলক্লাস হয়ে মরায় কোনো গৌরব নেই। যত্ত সব বস্তাপচা আদর্শ।
আস্তে আস্তে ঘরের দরজা নক করে। তুতুন? উঠবি? একটু খেয়ে নে। তারপর আবার বসিস।
মনীষাকে অবাক করে তুতুন হঠাৎ মিশুকে হয়ে ওঠে। -দেখি কি রান্না করেছ? -কিছু তেমন নয়। ওই সালামি দিয়ে স্যান্ডউইচ আর চিকেন স্টেক করেছি। ফ্রুট জুস খাবি? মনীষা জানায়। -দাও। দিয়ে দাও। খুব খিদে পেয়েছে। -তুই একটু ফ্রেশ হবিনা? -আগে খাই মা? প্লিজ? তারপর ফ্রেশ হবো। একটু ছাদে বেড়াবো। মনীষা বিস্ময় চাপতে পারে না। -ছাদে যাবি? তাহলে একটু গাছগুলোতে জল দিয়ে দিস তো। সাকিউলেন্টগুলোতে নয় কিন্তু। -চীল মা! দিয়ে দেবো।
বড্ড আনন্দ হয় মনীষার। অর্ণব যে ছেলেটাকে অসামাজিক বলে সেটা সত্যি না। ওদের বয়সে ওদেরও কিছু প্রেসার থাকে। সেটা বুঝতে হয়। তার ওপরে এখন এই লক ডাউনে রাত্রিদিন ঘরে বন্দী। মাথাটা ঠিক থাকে? অর্ণব তো রোজ হসপিটালে যায়। ও কি বুঝবে?
খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেলে তুতুন ছাদে যায়। মনীষা লক্ষ করে গাছে বেশ যত্ন করেই জল দিচ্ছে তুতুন। মায়া হয়। কেন যে হয়? উঠে গিয়ে বলে -দে আমায়। তুই হেঁটে নে একটু। পাইপটা মায়ের হাতে দিয়ে তুতুন মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। -কী? এখন তো হোম ডেলিভারি বন্ধ। কি খাবি? আমি বানিয়ে দেবো। -মা, একটা কথা বলব? মনীষা পাইপ ছেড়ে ছেলের মুখের দিকে তাকায় -বল। -আজ সুপ্রতীকের বাড়িতে নাইটস্টে। একসঙ্গে পড়াশুনো করব। বুঝতেই পারছ তো, এভাবে অনলাইনে ঠিক হচ্ছেনা। হ্যাঁ, সেটা মনীষা বুঝছে। সামনাসামনি না বসলে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কিন্তু এখন? ও ঘাড় নাড়ে -না তুতুন, সেটা হয়না। কেউই কারোর বাড়ি যাওয়া যাবেনা। বাবা জানতে পারলে তো তুলকালাম করে দেবে। -মা প্লিজ! একটু বোঝার চেষ্টা করো। খুব ক্রিটিকাল কটা পয়েন্ট আমরা ক্লিয়ার করব। ব্যাস। এই একটা দিনই। তারপর তো ডে এন্ড নাইট যেমন চলছে অনলাইন তাইই চলবে। মনীষা ছেলের মুখের দিকে তাকায়। চোখের তলায় ঘন কালি। গাল দুটো বাড়িতে থেকেও কেমন বসে গিয়েছে। খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমোয় না। পাগল না হয়ে যায় পড়া পড়া করে। একটু ঘুরে এলে ক্ষতি কি? তাছাড়া অর্ণব তো আজকালের মধ্যে বাড়িতে আসছে না।
মায়ের মুখটা বেশ নরম হয়ে এসেছে। তুতুন গম্ভীর হয়ে দূরে চেয়ে থাকে। মনীষা কাছে এসে ওর মাথার চুল নেড়ে দেয় -আচ্ছা যা। তবে সকাল হলেই চলে আসবি। একদম দেরি করিস না। আর এই একদিনই কিন্তু।
ইয়েস! ইয়েস মা! এই একদিন। জাস্ট একদিন।
লাফাতে লাফাতে চলে যায় তুতুন।
আগে থেকেই নিশ্চয় সময় ঠিক করা ছিল। গাড়ির হর্ন শুনে তুতুন বেরিয়ে যায় -মা বাই। সকালে ফিরছি। -তোর সঙ্গে আর কে যাচ্ছে তুতুন? গাড়ি কার? -ওটা রিয়াদের গাড়ি। ও যাচ্ছে তো। মনীষা একটু চমকায় -তুই আর সুপ্রতীক একা পড়বি না? -না মা, উই হ্যাভ কাম আউট অফ দ্যাট। কম্পিটিশান নয়। কোঅপারেশান চাই, বুঝলে। গ্রুপের সবাই আসছে ওখানে। -কিন্তু সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং? মনীষা সাবধান করে। -ডোন্ট ওরি। আমরা ঠিক দূরে দূরে থাকব মা।
ছেলেটা যেন হাওয়ায় ভর করে নেমে যায়।
একা বাড়িতে মনীষা চুপ করে শুয়ে থাকে। গান শুনতে বা বই পড়তেও আর ইচ্ছে করেনা। বাবা একা পিতৃপুরুষের বাড়ি আগলে বসে রইল এদ্দিন। একমাস হলো বাবা এই অসুখে চলে গেল। মনীষা অবশ্য খোঁজ খবর রাখত। কিন্তু ওখানে যাওয়া হয়ে উঠত না। ভাই ব্যাঙ্গালোরে। খুব কমই কথা হয়। বাবা চলে যেতে ভাই ওকে একটু দোষারোপও করেছিল। অর্ণবদা নিজে ডাক্তার। তাও এরকম ভাবে বাবা চলে গেল? একটু ব্যবস্থা নিলি না? কী বলবে মনীষা? বাবা যা একগুঁয়ে! কারও কথা শুনেছে কোনোদিন? অর্ণব অবধি ওকে বলেছিল -বাবাকে এখানে এনে রাখলেই তো হয়। নাকি তোমার আর তোমার পুত্রের অসুবিধে হবে? একা একা এসবই মনে পড়ছিল মনীষার। সেদিন যখন ব্যারিকেডের সামনে গিয়ে ও একবার বাবাকে দেখবে বলে কান্নাকাটি করছিল তখন ওই ছোকরা প্যারামেডিকটা ওকে কী না বলল! খুব খারাপ লেগেছিল। পাড়ার লোকে নিশ্চয় এ নিয়ে কথা বলাবলি করেছে। নইলে ও ছেলে জানবে কি করে? নিশ্চয় ওই ফালতু লোকটা, হারু মুকুজ্যে, হারুকাকা, এরকম রটিয়েছে। রাগ হয় মনীষার।
বাবাকে হারানোর শোক ছাপিয়ে সেই অপমানটা কেন যে বারবার মনে পড়ছে! এসব মিটলে ভাইকে বলতে হবে, ও বাড়িটা এবার বেচে দিলেই হয়। কে থাকবে আর ওখানে? কিন্তু দাম ভালোই।
সারাটা রাত তেমন ঘুম এলো না মনীষার। এই প্রথম মনে হল, অর্ণব রাত জেগে ডিউটি করছে। ছেলেটাও তো রাত জেগে পড়াশুনো করছে। ও একা আর কত ঘুমোবে!
দিনের আলো ফুটেছে। চিরজিত সেনের খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। হসপিটালে অনেকেই ফোন করেছে খবরের সত্যতা জানতে। আশি বছরের সেই বৃদ্ধা আজ অক্সিজেন ছাড়াই নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। স্বামীনাথন এখন রাউন্ডে। পেসেন্টদের মুখে হাসি ফোটাতে পারদর্শী একেবারে। যারা কথা বলছে তাদের সবার সঙ্গে ডাক্তারবাবু নানা গল্প করছেন -এখানে খাওয়াদাওয়া কেমন হচ্ছে? মাছটা ভালো ছিল? লোকাল পুকুরের কিন্তু। ট্রান্সপোর্ট বন্ধ, সো নো চালানি মাছ। বুঝলেন? পেসেন্ট কৃতার্থ। অর্ণব একটা ন্যাপ দিয়ে এসেছে। চোখ দুটো তবু জ্বালা জ্বালা করছে। বাড়ি যাবে নাকি আজ? একটা ঘুম দরকার। রাতের ঘুম। অর্ণব এরকম সিনিকাল হলেও, স্বীকার না করলেও, কার্ভটা কিন্তু নামতে শুরু করেছে।
হঠাৎই মনীষার ফোন। এসময়ে তো ফোন করেনা? সিকিওরিটির সঙ্গে ঝামেলা করেছে নাকি? বড্ড ঝামেলা করে মনীষা। বিরক্ত মুখে ফোন ধরে অর্ণব -বলো। ওপাশ থেকে এক অদ্ভুত কান্না ভয়ে জড়ানো গলা ভেসে আসে -শুনছ! তুতুনের বন্ধু সুপ্রতীক মারা গেছে! অর্ণব একটু সময় নেয়। তবে কি অতটুকু ছেলেও এই অসুখে মারা যেতে পারে? নরম গলায় বলে -মণি, চুপ করো। শান্ত হও। প্লিজ! এটা একটা অত্যন্ত খারাপ খবর। তুতুন কই? ও জানে? তুমি জানলে কি করে? মনীষাও চুপ করে থাকে খানিক। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে ওঠে -তুতুন কাল রাতে ওদের বাড়িতেই ছিল। বাড়িতে নেই। থানা থেকে ফোন করে খবর দেওয়া হয়েছে। তুতুনকে থানায় নিয়ে গেছে। অর্ণবের হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ে। স্বামীনাথন তখন এক পেসেন্টের সঙ্গে খোশ গল্প করছেন। সিস্টারের ডাকে ফিরে দেখতে পেলেন অর্ণব মাটিতে বসে পড়েছে -ওঃ! অর্ণব! হোয়াট হ্যাপেনড? ফিলিং সিক? তাড়াতাড়ি হাত ধরে তুলতে চেষ্টা করেন। অর্ণব উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু শরীরের সমস্ত ভারটা ছেড়ে দেয় স্বামীনাথনের গায়ে।
থানায় বসে স্বামীনাথন তখন অফিসারকে বোঝাচ্ছেন -লুক অফিসার, হি ইজ ফ্রম আ ভেরি ডিসেন্ট ব্যাকগ্রাউন্ড। হিয়ার ইজ হিজ ফাদার। নাইস ম্যান। আ রেপিউটেড ডক্টর। আপনারা নিশ্চয় আপনার কাজ করবেন, বাট প্লিজ ডু সামথিং। এট লিস্ট ফর হিজ পেরেন্টস সেক। অফিসার তেতো হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন -দিস ইজ ইয়োর প্রবলেম স্যার। দিস এক্স্যাক্টলি ইজ ইয়োর প্রবলেম। আপনারা ভাবেন বাবা ভালো লোক, অতএব ছেলেও ভালো হবে। দেখুন কত ভালো ছেলে! বন্ধুবান্ধব মিলে চোদ্দ পনেরোতেই মদ মেয়েমানুষ করতে শিখে গেছে! একটা ওই বয়সের মেয়েও তো ছিল ওখানে! আর ওই ছেলেটা, অতসী চক্রবর্তীর ছেলে, সুপ্রতীক, উঃ! একটা হলো গ্রাউন্ডে মাতাল হয়ে নিজে লাফিয়েছে না এরা ঠেলে ফেলেছে সেটাই রহস্য। অর্ণব মাথা নীচু করে বসে। উঠে দাঁড়াতে বা কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। মনীষা কোথায়? একটু এসে এদের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারত তো! ছেলে তার কত ভালো ছেলে! নাহয় একটু মদই খেয়েছে। নাহয় ক্লাসমেটের সঙ্গে একটু ফুর্তিই করেছে!
স্বামীনাথন অবশ্য হাল ছাড়বার লোক নন। -অফিসার এখন তো কোর্ট কাজ করবেনা। ততদিন যদি আপনারা বাড়িতে ছাড়েন। ইন এনি কেস, বাড়ি থেকে তো বেরনোর প্রশ্ন নেই। -তাই বুঝি? তাহলে রাতের ফুর্তির আয়োজন হলো কি করে?
অবশেষে স্বামীনাথনের শেষ অস্ত্র। মেয়রের বন্ধু কিনা।
0 comments: