0

ধারাবাহিক - রজন রায়

Posted in



রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো, তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়েছে। পাথুরে মোরামের উপর স্টোন চিপস বা গিট্টি বিছিয়ে তার উপর হুড়ুম দুড়ুম বুলডোজার চালিয়ে গরম পিচ ঢেলে দেয়া। মাত্র একটা বর্ষার জল খেয়েছে, তাতেই এখানে ওখানে দাঁত ছিরকুটে রয়েছে। এর উপর কয়লার পাহাড় বয়ে ছুটে চলেছে দৈত্যাকার ডোজার—একের পর এক; এগুলো হাইড্রলিক লিভারের বেলচা দিয়ে ষাট ফুট নীচের ওপেন কাস্ট মাইন থেকে তুলে আনে কয়লা, তারপর নিয়ে চলে বিশাল গোডাউনে। সেখানে ছোটখাটো টিলার মতন উঁচু করে রাখা কয়লার স্তুপ উঁচু হয়, আরও উঁচু । দেড়তলা উঁচু চালকের কেবিন বসা ড্রাইভার অনেক সময় নীচে গা ঘেঁষে চলা লোকজন বা বাইক দেখতে পায়না, ফলে মাঝে মাঝে অ্যাকসিডেন্ট হয়।

রূপেশ সাবধানে ওই রাক্ষুসে ডোজারগুলোর থেকে দূরত্ব বাঁচিয়ে ওর রাজদূত মোটরবাইক চালাচ্ছিল। তবু মাঝে মধ্যে গাড়ি গর্তে পড়ে লাফায়, সরলা ভয়ে ওকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। তারপর কৃত্রিম কোপে বলে—ম্যানেজার, ইচ্ছে করে গাড়ি গর্তে ফেলছ নাকি? তুমি একটা মিটমিটে শয়তান।

আজ রোববার। জলখাবার খেয়েই ওরা চটপট বেরিয়ে পড়েছে মনের সাধে ঘুরে বেড়াবে বলে। সরলার চোখে সানগ্লাস, পনিটেল চুল,পরনে সালোয়ার কুর্তা ;এতে বাইকে বসতে সুবিধে। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত ছুরিগাঁয়ে, চন্দুডাক্তারের বাড়িতে—ভাবীজি বিশেষ করে বলেছেন। এবার দুরপা গাঁয়ের কয়লা খাদান পেরোতেই ইরিগেশন ক্যানাল বা সেচের জন্যে কাটা খাল। আহিরণ নদী সাত কিলোমিটার দূরে গিয়ে হসদেও নদীতে মিশেছে। সেখানে বিরাট রিজার্ভার, বিশাল ক্যাচমেন্ট এরিয়া। এখান থেকে সেচখাল বেয়ে জল যায় দশগাঁয়ের চাষের ক্ষেতে। অন্ততঃ খরিফ বা আউশের ফসলের জন্যে গ্রামগুলোকে ইন্দ্রদেবের ভরসায় থাকতে হয় না। 

কিন্তু খালের পাড় ধরে তিনকিলোমিটার যাবার পর রূপেশের বাইক একটা সিমেন্ট বাঁধানো সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে গেল। একটু অন্ধকার মতন। সরলা এবার নিমকি হয়ে রূপেশকে জিজ্ঞেস করল –আমরা কোথায় যাচ্ছি?

--এটাই তো মজা। এটার কথা কোন জেনারেল নলেজের বইয়ে পাবে না। আমরা আহিরণের নীচে দিয়ে যাচ্ছি—দু’কিলোমিটার। মাথার উপরে একটা গুমগুম শব্দ শুনছ? আসলে আমাদের মাথার উপর দিয়ে নদী বইছে।

--যাঃ , এ’রকম আবার হয় নাকি?

--সত্যি, নদীটাকে দুদিকে বাঁধিয়ে স্লোপ বানিয়ে রাস্তার উপর দিয়ে বইয়ে দেওয়া হয়েছে—রেলপুলের মতন। দু’কিলোমিটার পর আবার নদী স্লোপ বেয়ে নীচে নেমে খাল হয়ে যাবে। নিজের চোখে দেখে নিও।

সরলা দেখে , দু’চোখ ভরে দেখে। তারপর বাইক উঠে যায় কোরবা বিলাসপুর হাইওয়েতে। ওরা লকগেটের কাছে রিজার্ভারের রেলিং ধরে দাঁড়ায়। সামনে অথৈ জল, ঢেউ উঠছে। প্রায় এপার ওপার দেখা যায়না। মাছরাঙা ছোঁ মেরে মাছ তুলে নিচ্ছে। সরলার চোখে ঘোর , ধরা গলায় বলে—ম্যানেজার, আমাকে এবছর কোন সমুদ্রের কাছে ঘুরতে নিয়ে যাবে? আমার বড্ড ইচ্ছে করে একদিন সমুদ্র দেখব।

রূপেশ হাসে। এই তো আজকে দেখিয়ে দিলাম।

সরলার ঘোর কেটে যায়। অ্যাই, এসব চালাকি চলবে না। 

--না না, ঠিক দেখাব। কিন্তু এ’বছর নয়, আগামী বছর।

-কেন? এ’বছর নয় কেন?

-- আসলে আগামী বছর থেকে আমাদের ব্যাংকে এলটিসি চালু হবে। চারবছরের একবার ভারতের যে কোন প্রান্তে যেতে পারি। তোমার আমার এসি কোচের ভাড়া অফিস দেবে ।

--ঠিক বলছ? ভাঁওতা দিচ্ছ না তো? দেখ ম্যানেজার, বেড়াতে গেলে টাকাপয়সা বড় সমস্যা নয়। একবার বেরিয়ে এসে তিনমাস আচারের তেল দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া যায়। আসলি চীজ হ্যায় দিল অউর জিগর। হৃদয় ও কলজের জোর। ভেবে দেখ।

আর একটু এগোতেই হঠাৎ জেগে উঠল দোকানের সারি আর আকাশ ছোঁয়া এক বিশাল চিমনি।

রূপেশ গর্বের সঙ্গে বলে—ওটা হল ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশনের ২১০০ মেগাওয়াটের ইউনিটের চিমনি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকায় তৈরি। এখান থেকে বিদ্যুৎ যায় ন্যাশনাল গ্রিডে। তারজন্যে কয়লা আসে নদীর ওপারে আমার এলাকার খাদান থেকে। আগে যখন নদীর এপারে ছুরিকলাঁ গ্রামে ছিলাম, মানে আমার প্রথম পোস্টিং, তখন এখানকার ভোরিয়া আদিবাসীদের গাঁয়ে কত অ্যাকাউন্ট খুলেছি।

ওরা রাস্তা ছেড়ে নতুন তৈরি টাউনশিপের মধ্যে ঢুকে পড়ে । সরলা আবার নিমকি চোখে দেখতে থাকে সারি সারি কোয়ার্টার। বড় মার্কেট কমপ্লেক্স, চওড়া মসৃণ পিচের রাস্তা, হাসপাতাল, সেন্ট্রাল স্কুল, স্টেট ব্যাংক, পিএনবি। রূপেশ বাইক থামায় কফি হাউসের সামনে। ভেতরে এসি চলছে। কফি ও বড়া খেতে খেতে নিমকি বলে –এটা দেখছি আমাদের বিলাসপুরের কফিহাউসের চেয়ে বড়। ওখানে এসি নেই। তোমাদের ব্যাংকের এখানে ব্র্যাঞ্চ নেই?

--অ্যাপ্লিকেশন গেছে রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে। এসব প্রসেস হতে সময় লাগে। ততদিনে আমার ট্রান্সফার হয়ে যাবে। ওঠ, এবার ছুরিকলাঁ গ্রাম আর দশমিনিটের রাস্তা। ডক্টর ভাইয়া আর ভাবীজি অপেক্ষা করছেন।

সরলার কিন্তু কিন্তু ভাব। এই নেমন্তন্ন সেই দাদুসাহেবের বাড়ির দাওয়াতের মত হবে না তো?

রূপেশ হেসে ফেলে।

হ্যাঁ, ওরা সংসার পেতে বসতে না বসতেই দাদুসাহেবের বাড়ি যেতে হল। উনি অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। একেবারে সোজা বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে যত্ন করে বসালেন। সরলাকে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওনার ভাবীজির কাছে। ও সেখানেই খেল। রূপেশ নীচের তলায় পিঁড়ি পেতে দাদুসাহেবের সঙ্গে।

ছত্তিশগড়ি রান্নায় অড়হরের ডাল বড় ভাল, সঙ্গে আমের আচার, মুখিকচু ভাজা আর লালশাক। এছাড়া ছিল দেশি মুরগীর ঝোল এবং খামারবাড়ির খড়ের গাদায় তৈরি ব্যাঙের ছাতার শুকনো পদ। শেষ পাতে সেমাইয়ের পায়েস।

খাওয়া দাওয়ার পর পান এল। সরলাও ততক্ষণে নীচে নেমে এসেছে।

এবার দাদুসাহেব কিন্তু কিন্তু করে কথাটা পাড়লেন। উনি একটি সেকন্ড হ্যান্ড গাড়ি কিনবেন। ফিয়েট কোম্পানির প্রিমিয়ার পদ্মিনী। কোরবা শহরের ডাক্তারের গাড়ি, ভাল কন্ডিশনে রয়েছে। উনি জানেন যে সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি রূপেশ ফাইনান্স করবে না । তবে ওনার প্রয়াত স্ত্রী ও বিধবা বৌদির কাছে অনেক সোনার গয়না আছে। কিছু গয়না বন্ধক রেখে গোল্ড লোন চাই – বৌদির নামে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পেলেই হবে। কিন্তু লোনটা গোপন রাখতে হবে। দশ গাঁয়ের প্রজা যদি জেনে যায় যে ওদের মাননীয় দাদুসাহেব বাড়ির মহিলাদের গয়না বন্ধক রেখে লোন নিচ্ছেন তো মানসম্মান কিছুই বাঁচবে না ।

কাজেই দাদুসাহেব বা বৌদি কেউই ব্যাংকে যাবেন না । ম্যানেজার যদি একটু কো-অপারেট করেন। যদি ব্যাংকের লোন ডকুমেন্ট এখানে চুপচাপ দাদুসাহেবের ঘরে বসেই ফিল আপ করিয়ে নেন। আর ভাবীজি রূপেশের সামনে আসবেন না । কিন্তু সরলা ম্যাডামের সঙ্গে তো পরিচয় হয়ে গেছে। সরলাজি যদি উপরে গিয়ে ডকুমেন্টে এবং ফটোগ্রাফে ওঁর সিগনেচার নিয়ে আসেন। উনিতো ম্যানেজারের বেটার হাফ! তায় পড়িলিখি অওরত।

আর গয়নাগুলো দাদুসাহেবের ঠাকুমার আমলে খাঁটি সোনা—একেবারে বাইশ ক্যারেট। ম্যানেজার ব্যাংকে গিয়ে নিজে সামনে দাঁড়িয়ে পীতাম্বর সোনীকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিন, কষ্টিপাথরে ঘষে এবং নাইট্রিক অ্যাসিড ঢেলে। স্বর্ণকার ব্যাটার থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে নিন। শুধু ও যেন জানতে না পারে গয়নাগুলো কোন বাড়ির।

রূপেশের হাড়পিত্তি জ্বলে যায় । এই ভাবীজিকে নিয়ে গত বছরের হোলির ঘটনার কথাটা রূপেশ ভুলতে পারেনি।এঁদের কিষ্কিন্ধ্যাকান্ডের ফলে বিনাদোষে বুধরাম চাপরাশিকে চোর অপবাদ মাথায় নিয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল।

কিন্তু রূপেশ লোনটা দিয়ে দেয় ।কারণ কয়লা খাদানের জন্য মনগাঁওয়ের জমি অধিগ্রহণের কমপেন্সেশনের সরকারি পেমেন্ট দু’মাসের মধ্যে শুরু হবে। তাতে দাদুসাহেবের কপালে অন্ততঃ পাঁচ লাখ টাকার চেক নাচছে। তখন এই লোন অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ও কোল মাইন্সের সাব -এরিয়া ম্যানেজারের নামে দাদুসাহেবের থেকে একটি চিঠি লিখিয়ে নেয় যাতে পুরো চেকটা সিধে গ্রামীণ ব্যাংকে জমা হয়, এদিক ওদিক না হয় । নইলে ওর কপালে দুঃখ আছে। হেড অফিস ওকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দেবে।

সরলা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। বাড়ি ফিরে বলল – কত কমিশন পেলে?

--মানে?

--কেন , ব্যাংকের স্ট্যান্ডার্ড নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে লুকিয়ে লোন দেওয়ার জন্যে ওই ভদ্রলোক তোমাকে পাঁচ বা দশ পার্সেন্ট দেয়নি? সেকী? তুমি দেখছি ভ্যাবাগঙ্গারাম । স্বভাব বিরুদ্ধ কোন কাজ করবে না।করলে কষ্ট পাবে। আর তোমার ব্যাংকের চক্করে বৌকে জড়িও না । আমি মহাভারতের দ্রৌপদী নই , মনে রেখ।

আধঘন্টার মধ্যে ওরা ছুরি পৌঁছে গেল। রূপেশ চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলে। গত কয়েকবছরে তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। আজ রোববার, ব্যাংক বন্ধ। সাইনবোর্ডটা বোধহয় আবার রঙ করা হয়েছে। ও ইশারায় বৌকে দেখায় আর রানিং কমেন্টারি দিতে থাকে। উলটো দিকের মাটির বাড়ি থেকে বৈগা আমোল সিং হাত নাড়ে। তাঁতিপাড়ার অর্জুন কোস্টা নমস্কার করে। একটু এগিয়ে শেঠ লক্ষীচান্দের দোকান। পাশের বারান্দায় একটা কাঠের চেয়ারে গেঞ্জি পাজামা পরে লক্ষ্মী বসে আছে। ও বাইক থামায়। শব্দে বেরিয়ে আসে শেঠের ছেলে মনোজ। হাসিমুখে ওকে নিয়ে শেঠের সামনে দাঁড় করায়। 

বাপুজি, ম্যানেজার সাহাব আয়ে হ্যায়, পহেলাওলা। শ্রীমতীজি কো সাথ লায়ে হ্যায়। 

শেঠ বসে বসেই শূন্যে হাত ঘোরায়।

--সাহাবজী, ম্যায় অন্ধা হো গয়া হুঁ; ভগবান কিস পাপ কা সাজা দে রহে ইয়হ তো পতা নহী। 

রূপেশ চমকে উঠে দেখে লক্ষীচন্দের চোখের মণিগুলো একদম সাদা, দৃষ্টিহীন চাউনি। ছেলে জানায় যে গতবছর কোন দামি কোম্পানির চুলের কলপ মাথায় বেশি করে লাগিয়েছিল। তারপর ঠিক করে না ধোয়ায় চোখের ভেতরে চলে গিয়ে এই অবস্থা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কোন লাভ হয় নি। 

রামনাথের আটাচাক্কির পাশ দিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে এগোতেই বিসাহু বলে –জয় রাম সাহাবজি। লৌটনে কে সময় মিলকর জাইয়ে, একসাথ চায় পিয়েঙ্গে।

চন্দুডাক্তারের বাড়িতে অনেক লোক। আসলে ওনার ছেলের জন্মদিন। একটা ব্যাচের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রূপেশকে দেখে সবাই হৈ হৈ করে ওঠে, -- আও ,সাহাবজী আও।

ভাবীজি অনুযোগ করেন—এতক্ষণে আমাদের কথা মনে পড়ল। সোজা খেতে বসে পড়।

উনি সরলার চিবুক তুলে ধরে গালে একটা চুমু খেয়ে ওকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। খেতে খেতে রামনিবাস আর শঙ্করের কাছে রূপেশ শুনে পেল গাঁয়ের লেটেস্ট কিসসাগুলো। 

যেমন, এবার মছলিতালাওয়ের ঠেকা চন্দু ডাক্তার পান নি, হকলারাম দেবাঙ্গন পেয়েছে। জীবরাখন বলে একটি নতুন ছোকরা সাপের পাঁচ পা দেখেছে। সিয়ান বা গাঁওবুড়োদের মান্যি করে না। দেখা হলে না রামরাম, না দুয়া সেলাম! আসলে এখান থেকে তাঁতিদের দাদন দিয়ে কোসা বা তসরের শাড়ি বুনিয়ে নিয়ে রায়গড় জেলার একটা জায়গায় বুটিকের কাজ করায়। তারপর দুই ঢাউস স্যুটকেস ভরে শাড়ি নিয়ে রাত্তিরের বাসে চড়ে সকালবেলায় জবলপুর। সেখানে কোন এক্সপোর্ট হাউসে মাল দিয়ে নগদ টাকা গুনে নেয় । তারপর সেই রাত্তিরে ফেরত বাসে চড়ে পরের দিন দিনের বেলায় আবার গাঁয়ে।

এই ছোঁড়াটা পাকা দোতলা বাড়ি তুলেছে পঞ্চায়েতের ভাটা জমিনে। কিছু ছেলেছোকরার দল জুটিয়ে একটা রামায়ণ মন্ডলী নামের ক্লাব খুলেছে। তাতে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার, ক্যারম বোর্ড ও দাবার ছক পাতা । শোনা যাচ্ছে ও নাকি আগামী বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে কুমার সাহেবের বিরুদ্ধে ক্যান্ডিডেট হবে।

শঙ্কর কম্পাউন্ডার জানায় যে মুদি দোকানদার রামচন্দ সিন্ধি—ওই যে কোবরেজি ওষুধও বিক্রি করত-- মারা গেছে। আরে বাকি পয়সার তাগাদা করতে ধনরাস গাঁয়ে ক্যাওট পাড়ায় গেছল। ধনীরাম ক্যাওটের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে জামার কলার চেপে ধরে ঝাঁকাচ্ছিল। তাতে ধনীরামের চোদ্দ বছরের ছেলেটা ক্ষেপে গিয়ে ঘরের ভেতর থেকে মাছমারার কোঁচ নিয়ে এসে সোজা রামচন্দের ভুঁড়িতে ঢুকিয়ে দেয় – এফোঁড় ওফোঁড়! ছেলেটা বিলাসপুরে বাচ্চাদের জেলখানায় রয়েছে।

রামনিবাস ফিসফিস করে—সাহাব, আর একটা কথা , কাউকে বলবেন না । ওই যে ছোটকি ছুরির মেয়েটা – ভালুমার দ্রুপতী বাঈ—ও না মা হতে চলেছে। না, কারও কাছে চুড়ি পরেনি। বচ্চে কা বাপ কুন- ঠিকসে পতা নহীঁ। দু’জন পর সবকা সন্দেহ। একনম্বর ম সমেলাল—ও যো গঞ্জেরি তবলচি। অউ দুসরা—

রূপেশের পেটে যেন কেউ ঘুসি মেরেছে।

ও সামলে নিয়ে কড়া করে ধমকে দেয়—আমাকে বলছিস কেন? আমি এসব শুনে কী করব?

রামনিবাস অপ্রস্তুত হয়ে অন্যদিকে সরে যায় । ভেবেছিল সাহাবের কাছে একটা সিজার চাইবে – কিন্তু কি যে হয়ে গেল!

রূপেশের মুখের স্বাদ তেতো হয়ে গেছে। ও সরলাকে রওনা হবার জন্যে খবর পাঠায়। ভাবীজি ওকে একটা স্থানীয় কোসার শাড়ি দিয়েছেন। রূপেশ না-না করছিল কিন্তু উনি ধমকে উঠলেন—আমার বোনকে দিয়েছি , তুমি কথা বলার কে? 

ডাক্তার বললেন—এবার ভীড়ের মধ্যে গপসপ ঠিক সে হো নহীঁ সকা। কোঈ দুসরা দিন আনা পড়েগা।

রূপেশ মাথা হেলায়, কিন্তু সরলা বলে এবার আপনারা একদিন আসুন। তারপর ঠিক হয়ে যায় যে আগামী মাসের প্রথম রোববারে দুই ফ্যামিলি মিলে পিকনিক করতে যাবে ফুটকা পাহাড়ে, অজগরবাহার রোডের ওপারে জঙ্গলের ধারে। 

ফেরার পথে রামনাথের বাড়ির কাছে গাড়ি থামিয়ে দেখে দরজার সামনে জনাদশেক লোক। রামনাথের বাবা ষাট ছুঁই ছুঁই ভাগবত শেঠ, পরনে সাদা ধুতি ও ধপধপে গেঞ্জি, একটি ভিনগাঁয়ের লোককে ধমকাচ্ছেন। রামনাথ বারণ করছে, শান্ত হতে বলছে, কিন্তু শোনে কে! কালোকোলো রোগামত লোকটা বিরক্ত মুখে চুপ করে শুনছে।মনে হচ্ছে কিছু লেনদেন বকেয়া টাকাপয়সার ব্যাপার।

সরলা অবাক হয়ে বলে –এখানে থামলে কেন ? নদীর পাড়ে নিয়ে যাবে বললে যে!

কিন্তু রূপেশ উত্তর দেবার আগেই একটা কান্ড ঘটে যায়। বলার তোড়ে শেঠজি যেই ‘পয়সা কব লৌটায়গা শালে’ বলেছেন অমনই লোকটা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। কেউকিছু বোঝার আগেই পা থেকে টায়ারের মোটা সোলের চপ্পল খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভাগবত শেঠের উপর। মুখে মাথায় পড়ছে চটির বাড়ি আর সঙ্গে চলছে মুখ—আবে মারওয়াড়ি! তু শালে কেইসে বোলে? ম্যায় তেরেকো অপনা বহিন দিয়া কা?

সবাই হতভম্ব; অসহায় মুখ করে রোগাপটকা রামনাথ সাহায্যের আশায় ভিড়ের দিকে তাকায়। কিন্তু ওর বাবাকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসে না। কিছু বোঝার আগে রূপেশ বাইক দাঁড় করিয়ে পৌঁছে যায় ভিড়ের মাঝখানে। দুহাতে লোক সরিয়ে আড়াল করে দাঁড়ায় ভাগবত শেঠকে। ধরে ফেলে চটিসমেত লোকটির উদ্যত হাত। লোকটা অবাক।

রূপেশ হাতজোড় করে ওকে মিনতি করে—ভাইজি! কুছ ভী হো, ইয়ে সিয়ান আদমি । আপ-হমার পিতা সমান। এইসা ন করে। গুসসা থুক দে।

ভাই , যাইহোক, বুড়ো মানুষ , তোমার আমার বাপের বয়সি। হাত তুলো না ; একটু শান্ত হও। রাগ-টাগ থুতু ফেলে উগরে দাও।

শেঠজিকে বলে- ঢের হয়েছে, আপনি এবার ভেতরে যান। রামনাথ কৃতজ্ঞ চোখে তাকায়, -- ভেতরে আসুন স্যার।

--আজ নয়, আর একদিন। একটু তাড়া আছে।

ও বাইক স্টার্ট করতে যাবে এমন সময় দু’জন লোক পথ আটকে দাঁড়ায়।

--শুনুন, সাহেবজি। কাজটা ঠিক করলেন না। ওই বুড়ো শেঠ হাড় পাজি। ওর একটু চিকিচ্ছে হওয়া দরকার ছিল। আপনি এসে ব্যাগড়া দিলেন।

--আরে ভাই, বাপের বয়সী বুড়োমানুষকে জুতিপেটা করবে সেটা চুপ করে দেখব?

-- আপনি এখন বাইরের লোক, এখানে থাকেন না। গ্রামের ব্যাপারে না বুঝে নাক গলিয়েছেন।

এবার কয়েকজন ওকে ঘিরে বলতে থাকে—বাপের বয়েসি? চালচলন তো বখাটে ছোকরাদের হার মানায়। শুনুন, ওর দোকানে যে মেয়েরা চাল-গমের কাঁকর সাফ করতে আসে বুড়ো ওদের পেছনে সমানে ছোঁক ছোঁক করে। আমরা তক্কে তক্কে ছিলাম। কিন্তু আপনি--!

সরলা ফিসফিস করে—এবার ফিরে চল।

রূপেশ হার মানবে না। ও বাইক ঘুরিয়ে নেয় উলটো দিকে। গাঁয়ের সীমানা পেরিয়ে একটি টিলার উপর বাইক দাঁড় করিয়ে বলে—এবার এদিকে দেখ।

সরলা অবাক। সরলার ঘোর লেগেছে। কালো পাথরের গায়ে অভ্রকুচির ঝিকিমিকি। সেখানে থেকে পাকদণ্ডী পথ এঁকেবেঁকে নেমেছে চুলের রূপোলি ফিতের মত নদীটির পাড়ে। এখন ক্ষেতে ধান নেই, বেলে জমিতে তরমুজ নেই। একটা মানুষের দেখা নেই।ওরা হেঁটে নদী পেরোয়। সরলা মন্ত্রমুগ্ধ। বেলা পড়ে আসছে। ওপারে প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথের দলের মত নীলচে পাহাড়ের সারি আকাশ ছুঁয়েছে। তার নীচে ঘন জঙ্গলের রঙ সবুজ থেকে কালো হচ্ছে। সরলা নিমকি হয়ে এলোপাথাড়ি দৌড়ে বেড়ায়, নদী থেকে আঁজলা করে জল তুলে চোখে মুখে জলের ছিটে দেয়, একটু ছিটিয়ে দেয় রূপেশের গায়ে। আলো কমে আসছে। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না । সরলা হাতব্যাগ থেকে হটশট ক্যামেরা বার করে ফটাফট ফ্ল্যাশ চমকায়। এরপর রূপেশের হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে নিজের চুল ঠিক করে। আবার কালো চশমা পরে মডেলের মত পোজ দিয়ে হেসে ওঠে। 

--এসব কায়দা কোথায় শিখেছ?

--বলি? কিছু মনে করবে নাতো? আমি না সেকন্ড ইয়ারে পড়ার সময় কলেজে মিস ক্যাম্পাস কম্পিটিশনে সেকন্ড রানার্স হয়েছিলেম। বাড়িতে কাউকে বলিনি।তুমিও বলবে না।

রূপেশ স্মিত মুখে বলে—তুমি না একটা পাগল!

--ঠিক; নইলে তোমার সঙ্গে জোড়া বাঁধি?

বনের দিক থেকে ঘরে ফেরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যে নামছে, রূপেশ জানে এখন অন্ধকার হঠাৎ করে নামবে। আর দেরি করা উচিত হবে না। ক্যামেরা ফেরত দিতে গিয়ে ও তাকায় নিমকির দিকে। নিমকি কখন নীলিমা হয়ে গেছে। ওদের নিঃশ্বাস ঘন হয়, নীলিমা মিশে যায় পাহাড়, জঙ্গল ও নদীর গাঢ় নীলে। জিভের স্বাদ এ’রকম? বহুদূরে পাহাড়ের চূড়োয় কোসগাই দেবীর মন্দির থেকে ঘন্টাধ্বনি হাওয়ায় ভেসে আসে।

একটা খিলখিল হাসির আওয়াজে ওরা আলগা হয়। 

--প্যার পরথন সাহাবজি! প্যার লাগু মেডামজি! আজ কেইসে রদ্দা ভুল গয়ে কা?

প্রণাম গো সাহেব, দণ্ডবৎ হই মেডাম। আজ এদিকে কি পথ ভুলে?

দশ হাত দূরের পলাশ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে এক নারী। শ্লথপায়ে এগিয়ে এসে হাসিমুখে হাত জোড় করে। বলে আমার সৌভাগ্য যে আজ দেবাদেবী দু’জনের দর্শন পেলাম।

রূপেশ অবাক হয়ে দেখে ওর গর্তেবসা উজ্বল চোখ, ঠেলে ওঠা কন্ঠার হাড়, ভারী বুক এবং এগিয়ে আসা স্ফীত পেট। ওর স্মৃতির সঙ্গে অনেকটাই মেলে না । কিন্তু একটা জিনিস মিলিয়ে যায়নি—কপালের ওপর সেই দাগটা! ভালুকের সঙ্গে লড়াইয়ের নিশান।

অপ্রস্তুত সরলা বেশ বিরক্ত। তাকায় রূপেশের দিকে, কিন্তু রূপেশের চোখে বিস্ময়ের ঘোর। অবস্থাটা বুঝে ফেলে অন্য নারী। আমি ভালুমার-দ্রুপতী গো বৌদি। আমার কথা বলেনি সাহাবজী? আমি যে ব্যাংকের প্রথম দিনের গ্রাহক, খাতা নম্বর ১/১০। 

সরলা ওকে পা থেকে মাথা পর্য্যন্ত চোখ দিয়ে মেপে নেয় । তারপর বলে তোমার এই অবস্থায় একা একা এভাবে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছ? যদি কিছু হয়ে যায় ?

--মিথ্যে ভয় পাচ্ছেন ভাবীজি! হবেটা কি? এই পাহাড় জঙ্গল আহিরণ নদী আমার ঘরবাড়ি, খেলার জায়গা। সেবার সাহেবরা পিকনিক করতে এসে ফেঁসে গেছলেন। আমিই মাংস ভাত রান্না করে দিয়েছিলাম। তারপর নদীতে জল বাড়লে ডিঙিতে লগি মেরে ওপারে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এক বাত বাতাউঁ ভাবী? আপকে ইয়ে যো পতিদেব হ্যায় না –একদম দেবতা জ্যায়সে। আপ বহোত ভাগমতী হো।

আপনার সৌভাগ্য যে এমন দেবতার মত স্বামী পেয়েছেন।

এবার চলুন, অন্ধকার হয়ে আসছে। আমিও ছুরিগাঁয়ের দিকে যাচ্ছি।একসাথে যাই, পথ হারাবে না।

সরলা শুধোয়—তোমার স্বামী বুঝি ছুরিতে থাকে?

দ্রুপতী উত্তর না দিয়ে হেসে ওঠে।

রূপেশের মনে পড়ে যায় কয়েকবছর আগে এক বারপূজোর রাতে মেলার অন্ধকারে একজোড়া নারীপুরুষের শঙ্খ লাগার দৃশ্য। গেঁজেল তবলচি সমেলাল ও দ্রুপতী!

সারা রাস্তা সাবধানে পথ চলে টিলার মুখে দাঁড় করানো বাইক স্টার্ট দেবার সময় দ্রুপতী বলে ওঠে – থোরকন রুক জাও সাহাব। মোর একঠিন গোঠ লা সুনিহ।

দাঁড়ান গো সাহেব। একটা কথা ছিল, একটু শুনে যান। 

এবার ও সরলার দিকে তাকিয়ে কেমন এক সুরেলা গলায় এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে—বুঝতেই পারছেন, আর দু’মাস, তারপরে যেই হোক ছেলে কি মেয়ে, আমার ইচ্ছে সাহাব ওর ধর্মবাপ হবেন। ছট্টি কে দিন আনা হ্যায় আপমন লা। নেওতা দেকে আউঁ।

ষষ্ঠীর দিন নাম রাখা হবে। আপনাদের আসা চাই। আমি আগেভাগে নেমন্তন্ন করে আসব।

রূপেশ মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে বাইক স্টার্ট করে। এদিকটায় পথে আলো নেই, ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।

গেওরার কলিয়ারির কোয়ার্টারে ফিরে রূপেশের কেমন ক্লান্ত লাগে। আজ বড্ড ঘোরাঘুরি গেছে। কাল থেকে আবার সেই ব্যাংক, সেই দিনগত পাপক্ষয়। অনেক আশা নিয়ে বৌকে নিজের প্রথম কাজের জায়গা দেখাতে নিয়ে গেছল। কিন্তু কেমন যেন আলুনি আলুনি হয়ে গেল।

জামাকাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসে দেখল সরলা একটা থালা সাজিয়ে দিয়েছে । বলল আজ রাত্তিরে খেতে ইচ্ছে করছে না । শোয়ার আগে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে সরলা বলল—মেয়েটা কে?

--কোন মেয়েটা?

--ন্যাকামি ছাড়, আজ ক’টা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? ওই ভালুমার না কি যেন!

সরলার গলায় খরজের তার বেজে উঠেছে।

--ওঃ , দ্রুপতী? ওর নাম দ্রৌপদী বাঈ, প্রথম দিন সেভিংস একাউন্ট খুলেছিল। 

-- দ্রৌপদী? ওর কি পঞ্চস্বামী? বর্তমান স্বামীটি কে?

--আমি কি করে জানব?

--কিন্তু ওর হাবভাবে তো মনে হল তুমি ওর নাড়িনক্ষত্র সব জান।

রূপেশ জবাব দেয় না।

--শোন, তুমি ওর বাচ্চার ষষ্ঠীর দিনে যাবে না। ধর্মবাপ! যত্ত আদিখ্যেতা! চাইলে ওর পঞ্চস্বামীর কাউকে ডেকে বাচ্চার নামকরণ করাক। তুমি যাবে না ব্যস।


সে রাত্তিরে সরলা পাশ ফিরে শুয়ে রইল, নিমকি বা নীলিমা হল না।

(চলবে)

0 comments: