0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in



















‘এ পাড়ায় সূর্য ওঠে না’ – গত ২১শে জুন ২০২০ রবিবার, প্রতিদিন ছুটিতে প্রকাশিত কবীর সুমনের লেখাটি প্রসঙ্গে কিছু লেখার ইচ্ছে থেকেই এ রচনার সৃষ্টি।

মূল লেখাটি মূলত আমেরিকার কালো মানুষদের নিয়ে। এই প্রসঙ্গে লেখক বাঙালী ও কেরালার বামপন্থী এবং হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করেছেন। আমার যৌবনের সুমনকে আবার প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায় খুঁজে পেলাম। হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করে তিনি যা লিখেছেন, তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে আমি গঙ্গাজলেই গঙ্গাপুজো সারবো।

হিন্দুত্ববাদীদের মোকাবিলায় আমাদের তার লেখা গানের একটি কলিকেই মূলমন্ত্র করে নিতে হবে – “হাল ছেড়ো না বন্ধু, বরং কন্ঠ ছাড়ো জোরে”। অন্য গানের ভোরে আমাদের দেখা হবে কিনা তা নির্ধারণ করবে আমাদের কন্ঠের জোর। এ ব্যাপারে চ্যাপ্টার ক্লোজড্‌। আমি যদি হঠাৎ বেশ একজন কেউকেটা হয়ে উঠি, এবং সাংবাদিকরা আমাকে এই ব্যাপারে পর্যুদস্ত করার জন্য বন্দী করেন, আমি ঘোড়েল রাজনীতিক কিম্বা দক্ষ অভিনেতার মতোই বলে উঠবো – “নো কমেন্টস্‌”।

এবার আসি কেরালার বামপন্থী দম্পতির কথায়। এখানে বামপন্থী দম্পতি বর্ণবিভেদের সমর্থক। কেরালার দম্পতি আমেরিকায় ছেলের কাছে গিয়ে জানতে পারেন ছেলে আফ্রিকান আমেরিকান এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে। ছেলে বাবা-মায়ের সাথে মেয়েটির আলাপ করাতে নিয়ে এলে দুজনেই আর্তনাদ সহকারে বলে ওঠেন – “আমরা কমিউনিষ্ট ও মানবতাবাদী, কিন্তু তাই বলে আমরা চাইবো না আমাদের ছেলে এ দেশে এতো সাদা মেয়ে থাকতে কোথাকার একটা নিগ্রো মেয়েকে বিয়ে করুক। বাচ্চাগুলো যা হবে!” মেয়েটি তখন তার বয়ফ্রেন্ডকে বললেন – “আমি বরং যাই, আমি নিগ্রো বলে তোমার মা-বাবার যা অবস্থা, এবারে তো এম্বুলেন্স ডাকতে হবে যা দেখছি”। কেরলকুমারও মিউ মিউ করে বললেন – “হ্যাঁ, সেই ভালো”।

আমার একান্তভাবে মনে হয়েছে এই ঘটনায় শিক্ষিত প্রীমিক প্রেমিকার প্রেমের দৌর্বল্য অনেক বেশি প্রণিধানযোগ্য ব্যাপার। প্রেম যদি শিক্ষিত মানবতাবাদী বামপন্থী বলে পরিচয়দানকারীদের সাথেও লড়তে না পারে, তাহলে বামপন্থীদের অবক্ষয় তো সুনিশ্চিত। কারণ বামপন্থী হলেও তারা তো আসলে মানুষই। দোষ ত্রুটি তো থাকবেই। এবং সেই ত্রুটি যদি সন্তান ও তার প্রেমিকা দূর করতে না পারে, বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়, তাহলে প্রকৃত দায়িত্ব কার? বামপন্থাকে বাঁচাতে হলে, রকৃত বামপন্থী পেতে হলেও তো লড়াই চাই। ডান, বাম, অতি-বাম কোনো পন্থাই কিন্তু লড়াই কিম্বা প্রতিবাদ ছাড়া বাঁচে না। হাওড়ার শিবপুরে সুমনের একক অনুষ্ঠানে গিটার হাতে বিশেষ একটি গান গাইতে গাইতে গান থামিয়ে বলে উঠেছিলেন – “কী সুভাষবাবু, দিনবদলের স্বপ্ন আর কতোদিন আমাদের দেখে যেতে হবে?” প্রশ্ন দরকার। প্রতিবাদ দরকার। সই কিম্বা নাম কোনোটাতেই প্রকৃত খাঁটি জিনিস মেলে না। সু-মনদের প্রশ্নেই তৈরি হতে পারে খাঁটি কিম্বা কম ত্রুটিপূর্ণ মানুষ। 

এবার আসি বাঙালি বামপন্থী প্রসঙ্গে। তাদের সম্পর্কে আপনার অভিযোগ “বাঙালি বামপন্থী মানে কবীর সুমনকে এতো বছর পরেও সুমন চট্টোপাধ্যায় বলে যাওয়া”। এই ধরণের ঘটনা থেকেই তো মানুষের প্রকৃত মনোভাব বুঝতে পারা যায়। ভাগ্যিস! যায়। তবে এ নিয়ে আক্ষেপ না রাখাই ভালো। আপনিই তো এই লেখায় উল্লেখ করেছেন – সবার উপরে মানুষ সত্য। তা যদি হয় তাহলে কবীর সুমন যতোটা সত্য, সুমন চট্টোপাধ্যায়ও ততোটাই। আর আমার মতো একজন সাধারণ মানুষেরই কি কম দোষ? আপনি যে লোকসভার সাংসদ, ভুলতে বসেছিলাম। আপনার লেখায় মনে পড়ে গেলো। আমাদের তিনজনের সংসারে আপনার নামের আগে কবীর এখন নেই এবং আগেও নামের শেষে চট্টোপাধ্যায় ছিলো না। আপনি আমাদের কাছে শুধুই সু-মন। আপনার আগে আমরা মাঠ-ঘাট-বন পেরিয়ে আসা আহ্বান শুনেছি, পথে নেমে জেতার স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু আপনিই প্রথম লড়তে নেমে হেরে যাওয়ার সম্ভাবনায় আপোস করা মানুষের বিবেক দংশনে প্রলেপ লাগিয়ে গেয়েছেন – “আমাকে না আমার আপোস কিনছো তুমি”

আপনার লেখার শেষদিকে আপনি সংশয় প্রকাশ করেছেন – আমেরিকার কালো মানুষদের পাড়ায় সূর্য কি আর উঠবে কোনোদিন? এই প্রসঙ্গে বলি, আমার ছেলের সূত্রে জানতে পারলাম শিক্ষিত বাঙালি এখন আর আমেরিকায় ‘ওদের’ কালুয়া বলে ডাকতে পারে না। শব্দটা বাঙলা হলেও এতোদিনের বহুল ব্যবহারে ‘ওরা’ বুঝতে পারছে যে এটা ‘ওদের’কেই বলা হচ্ছে। বাঙালিরা ইদানিং ‘ওদের’ তাই ‘শ্যামল’ ‘শ্যামলী’ বলে ডাকতে শুরু করেছে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, বিদ্বেষ কমেনি এতোটুকুও। আশার কথা একটাই, কালো মানুষের আন্দোলনে অনেক সাদা মানুষও সামিল হচ্ছেন। আজকের আন্দোলনের মূলে ‘জর্জ ফ্লয়েড’ নামটি এবং ঘটনাটি প্রায় গোটা পৃথিবীটাই জানে।

এবারের someপ্রতীক যথার্থ হলো কিনা, তা নিয়ে আমার নিজের মধ্যেই যথেষ্ট সংশয় দেখা দিচ্ছে। এই মুহূর্তে নিজের রাজ্যে ১৮ বছরের ছেলেটির মায়ের কান্না হৃদয় ভারাক্রান্ত করে তুলছে। বিশ্বাস করুন পাঠক, মাতৃহৃদয়ের হাহাকার নিয়েই কলম চালাচ্ছি। নিজেকেই প্রশ্ন করছি - একজন মা হয়েও ছেলেটিকে ‘সাম্প্রতিক’ করতে পারলাম না কেন? একটু চিন্তা করতেই উত্তর পেয়ে গেলাম। কোটি কোটি সু-মন যদি হিন্দুত্ববাদী সুবিধাবাদী এবং মানবতাবাদীদের মেরুকরণ করতেই না পারেন, তাহলে আরো অনেক তাজা প্রাণ ঝরবে। যাঁরা নিজেদের ‘মানবতাবাদী’ বলে পরিচয় দেন, দোষ ত্রুটি থাকলেও তাদেরই সমালোচনা করা যায়। প্রতিবাদ করা যায়। এ হেন করোনা আবহেও দেশে এবং রাজ্যে সকল রাজনৈতিক দলই যখন গদির স্বপ্ন দেখতে অথবা গদি সামলাতে ব্যস্ত, তখন গদিতে কাকে বসাবো বা থাকতে দেবো – সাধারণ মানুষের এ চিন্তা করার এটাই সঠিক সময়। না হলে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাবে।

0 comments: