0

প্রবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


আপামর বঙ্গীয় সমাজ যখন রবীন্দ্রনাথের দিকে ঝুঁকে তখন কখনও কখনও মনে হয় না কি বাঙালির জীবনে নজরুল একটু পেছনে পড়ে রইলেন! তিনিওতো বহু রূপে আমাদের সামনে হাজির হয়েছেন। কবিতায়, গানে, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধে-নিবন্ধে, শিশুসাহিত্যে-নাটকে। তিনি আমাদের কাছে আরও আরও বেশি প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে বাংলা কবিতা যখন ভীষণরকম রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন ঠিক সে সময়ে তিনি এলেন নিজস্ব মেজাজে একেবারে নতুনের জয়ধ্বজা উড়িয়ে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ যে ধারার প্রবর্তন করেছিলেন সেখানে নজরুলকে বাদ দিয়ে ধারাবিবর্তনের ইতিহাস লেখা কখনও সম্ভব কীনা!

সময় যখন দাবি করছে পালাবদলের, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথরা ভাবছেন প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারলে বাংলা কবিতা একঘেয়ে হয়ে পড়ছে, রবীন্দ্র ঘেরাটোপে আটকা পড়ে যাচ্ছে, বৈচিত্র্যের সন্ধান অবশ্যম্ভাবী, সে সময়ে নজরুলের আবির্ভাব। অবশ্য অশ্রুকুমার সিকদার মহাশয় তাঁর "হাজার বছরের বাংলা কবিতা"য় বলছেন –"রবীন্দ্রনাথের মাছি-মারা অনুকরণের অর্থ হবে নিজেই মরা, একথা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ সমসাময়িক যতীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল আর নজরুল" - (পৃ : ১২৪)। কিন্তু আজকের বিচারে বিষয়টা একটু ভাবায়, যতীন্দ্রনাথ এবং মোহিতলালের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা রেখেও আমরা বলতে চাই তাঁরা কি যথার্থই রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছিলেন! একটু মতভেদ রয়েছে। তবে তাঁরা যে একটা নতুন পথ খুঁজছেন সেকথা অবশ্যই মাননীয়। সে আভাস আমরাও লক্ষ্য করে থাকি। তবে সেভাবে দেখলে নজরুল এতটাই স্বতন্ত্র, তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা যেন সব প্রভাবকেই অমান্য করে। তিনি ত্রিশের দশকের আধুনিকতাবাদীদের তাঁর স্বতন্ত্রতা দিয়েই মুগ্ধ করেছেন, আপ্লুত করেছেন এবং আক্রান্ত করেছিলেন। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ঝরা পালক" (১৯২৮) প্রকাশের পর তৎকালীন সমালোচকরা জীবনানন্দের কবিতায় নজরুলের প্রভাব দেখতে পেলেন। কেউ কেউ সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবের কথাও বলতে চেয়েছেন। এ নিয়ে আজকের দিনে মতভেদ উঠতেই পারে।

আসলে জীবনানন্দের এই পর্বের কবিতায় যে প্রকৃতিচেতনা, মানবতা এবং দেশপ্রেমের স্পর্শ পাওয়া যায়, তা থেকেই হয়তো সত্যেন্দ্রনাথ এবং নজরুলের প্রসঙ্গ এসেছে। অবশ্য তারপরই তিনি অর্জন করে নিয়েছিলেন একেবারে নিজস্ব ভাষা, স্বকীয় কণ্ঠস্বর। এখানে নজরুলের ভূমিকা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কারণ পথটা তিনি দেখান। তাঁর কবিতার দৃঢ়তা এবং বলিষ্ঠতাই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তাঁর অদম্য আবেগকে তিনি হয়তো সুবিন্যস্ত করতে পারেননি, তবে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছেন, এই স্বভাব ও মেজাজটাই ক্রান্তিকালের মুহূর্তে সবার প্রেরণা হয়ে ওঠে।

জীবনানন্দ এবং নজরুল দুজনেরই জন্মসাল ১৮৯৯; দুজনের প্রথম প্রকাশও একই সময়ে। জীবনানন্দের প্রথম প্রকাশ 'ব্রক্ষ্মবাদী' পত্রিকায়, 'বর্ষ আবাহন' কবিতাটির মাধ্যমে, ১৩২৬ বঙ্গাব্দে (১৯১৯ সাল)। ওই একই সময়ে নজরুলের 'মুক্তি' কবিতাটি প্রকাশিত হয় 'বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য' পত্রিকায়। তার দুবছরের (১৯২১) মাথায় 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায় তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি প্রকাশের পরই সাহিত্যসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এতটাই আলোড়ন ওঠে যে পরপর 'বিজলী', 'প্রবাসী', 'সাধনা' এবং 'ধূমকেতু'তেও উক্ত কবিতাটি প্রকাশিত হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে 'ধূমকেতু' নজরুল সম্পাদিত পত্রিকা, তার ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় ( আগষ্ট ১৯২২ ) তিনি আবার কবিতাটি পুনর্মুদ্রণ করেন।

বিষয়টি হল সমকালে দাঁড়িয়ে দুই সমবয়সী কবি একই সময়ে দুভাবে রবীন্দ্রছায়া থেকে নিজেদের এবং বাংলা কবিতাকে মুক্ত করতে চাইছেন। দুভাবে বলতে জীবনানন্দ ছিলেন শুরু থেকেই অনেকটাই অন্তর্মুখী এবং আবেগ সংযত। আর নজরুল ছিলেন উচ্চকণ্ঠী, অদম্য দুঃসাহসী। স্বভাবত তাঁর আবেগের কোনও বাঁধন ছিল না। তাঁর কবিতার চড়া সুরই তাঁকে লোকপ্রিয় করে তুলেছিল। প্রসঙ্গত আমরা জানি ওই 'বিদ্রোহী' কবিতাটির জন্যেই তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয় 'বিদ্রোহী কবি' বলে। আবার কখনও তিনি 'সাম্যবাদী কবি',কখনও 'সর্বহারা'র কবি। কিন্তু তাঁর বিদ্রোহী রূপ আর প্রেমিক সত্তা নিয়ে আমাদের মনে একটা দ্বন্দ্ব থেকে যায়। কোন্ সত্তাটি বড়! যেখানে তিনি লিখছেন–

কারার ঐ লৌহ-কবাট ভেঙে ফেল্ কর্ রে লোপাট
রক্ত-জমাট শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী। …

পাশাপাশি তিনি লিখছেন গজল গানগুলি, যার মধ্যে ঝরে পড়ছে প্রেমের তৃষ্ণা, যা অতৃপ্ত হয়েও অপরূপ। সেই বিখ্যাত গানটি, আমরা মনে করি একবার –

পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁওয়ায়।
গলিয়া সুরের তুষার গীতি-নির্ঝর ব'য়ে যায়।। …

এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু আমাদের কাছে আজও পথপ্রদর্শক। তিনি তাঁর 'কবিতা' পত্রিকার দশম বর্ষ প্রকাশ করেছিলেন "নজরুল সংখ্যা" (১৩৫২ বঙ্গাব্দ, ১৯৪৫ সাল) হিসাবে। বাংলা সাহিত্য পত্রিকার ইতিহাসে প্রথম নজরুল সংখ্যা। সেখানে একটি নিবন্ধে তিনি লিখছেন, –"নজরুল সম্বন্ধে বলার কথা এইটেই যে তিনি একই সঙ্গে লোকপ্রিয় কবি এবং ভালো কবি – তাঁর পরে একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে এই সমন্বয়ের সম্ভাবনা দেখা গেছে। বলা বাহুল্য এ-সমন্বয় দুর্লভ, কারণ সাধারণত দেখা যায় যে বাজে লেখাই সঙ্গে-সঙ্গে সর্বসাধারণের হাততালি পায়, ভালো লেখার ভালোত্ব উপলব্ধি করতে সময় লাগে।"

কী চমৎকার বিশ্লেষণ বুদ্ধদেববাবুর! নজরুলের অনন্যতাকে যেমন তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন আবার এই গদ্যে তাঁর চোখে উঠে আসা নজরুলের দূর্বলতাগুলিও তুলে ধরতে কুণ্ঠাবোধ করেননি, এতটাই কর্তৃত্ব ছিল তাঁর। তবে এই প্রসঙ্গে জীবনানন্দের কথাও বলতে হয়। নজরুল সম্পর্কে সেই সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন, –"কোনো এক যুগে মহৎ কবিতা খুব বেশি লেখা হয় না। কিন্তু যে বিশেষ সময়ধর্ম, ব্যক্তিক আগ্রহ ও একান্ততার জন্যে নজরুলের অনেক কবিতা সার্থক হয়েছিল – জ্ঞানে ও অভিজ্ঞতায় মূল্য-ও-মাত্রা-চেতনায় খানিকটা সুস্থির হয়েও আজকের দিনের অনেক কবিতাই যে সে তুলনায় ব্যাহত হয়ে যাচ্ছে তা শুধু আধুনিক বিমুখ সময়রূপের জন্যেই নয় – আমাদের হৃদয়ও আমাদের বিরূপাচার করে, অনেক সময়ই আমাদের মনও আমাদের নিজেদের নয় ; এই সাময়িকতার নিয়মই হয়তো তাই। কিন্তু নজরুলের ব্যক্তিকতা ও সময় এই বুদ্ধিসর্বস্বতা হাত থেকে তাঁকে নিস্তার দিয়েছিল।" কারণ নজরুল তখন সাহিত্যের পথ ছেড়ে দিয়েছেন এবং অসুস্থ হয়ে সময়ের ডামাডোলের বাইরে নিরালায় জীবন যাপন করছেন। 

যাহোক, নজরুল তাঁর লেখালেখিতে ব্যক্তিগত আদর্শ মেনে সময় ও সমাজকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন ভীষণভাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বাংলায় যে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতাটি হয়ে উঠেছিল অগ্নিদীক্ষার মতো। তাঁর এই তেজ, দূরন্ত অভিনবত্বই আকর্ষণ করেছিল তখনকার কবি লেখকদের, বিশেষ করে 'কল্লোল', 'প্রগতি'র লেখকগোষ্ঠীদের। তিনি বেপরোয়া, দিলখোলা, গান লেখেন, গান বাঁধেন, পথে পথে গান গেয়ে মানুষের মন জয় করেন। ব্যক্তিগতভাবে রবীন্দ্রগানের ভক্ত, শুরুতে বিভিন্ন আসরে-আড্ডায় রবীন্দ্রনাথের গানই করতেন। কিন্তু নিজে যখন গানরচনায় মেতে উঠলেন দেখা গেল রবীন্দ্রপ্রভাব থেকে সে গান হয়ে উঠলো মুক্ত ও নতুন সুরের সন্ধানী।

সত্যেন্দ্রনাথের কথা আমরা যা বলতে চেয়েছিলাম, তখন রবীন্দ্রনাথের পর সত্যেন্দ্রনাথের প্রভাবও বাংলা কবিতায় কম নয়। অনেকের মধ্যেই তাঁর ছায়া লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু নজরুল ফূর্তিবাজ, জাত-বোহেমিয়ান হয়েও নিজের স্বতন্ত্রতার প্রতি সচেতন ছিলেন আশ্চর্যজনকভাবে। কোথাও কোথাও তাঁর লেখা একটু এলিয়ে পড়েছে বলে মনে হয়, কিন্তু রবীন্দ্র ও সত্যেন্দ্রছায়া কাটাতে তাঁর বিশেষ অসুবিধা হয়নি।

তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার, গীতিকার, গায়ক, শিল্পী, অভিনেতা – এতকিছু সত্ত্বেও তাঁর গানের ক্ষেত্রটি বোধ হয় সবচেয়ে বিস্তৃত এবং রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি আজও অম্লান। তিনি সাম্যবাদী গানের স্রষ্টা, যাকে আমরা বলে থাকি গণসঙ্গীত। আবার বাংলা গজল গানে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। 'কল্লোল' পত্রিকা তাঁর প্রথম পর্যায়ের গজলগুলি প্রকাশ করেছিল। তাঁর গান নিয়ে বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, –"নজরুলের সমস্ত গানের মধ্যে যেগুলি ভালো সেগুলি সযত্নে বাছাই ক'রে নিয়ে একটি বই বের করলে সেটাই হবে নজরুল-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় – সেখানে আমরা যাঁর দেখা পাবো তিনি সত্যিকার কবি, তাঁর মন সংবেদনশীল, সূক্ষ্ম-কোমল, আবেগপ্রবণ উদ্দীপনাপূর্ণ। সে-কবি শুধু বীররসের নন, আদিরসের পথে তাঁর স্বচ্ছন্দ আনাগোনা, এমন কি হাস্যরসের ক্ষেত্রেও প্রবেশ নিষিদ্ধ নয় তাঁর।"

রবীন্দ্রনাথও কিন্তু তাঁর গানের স্থায়িত্ব সম্পর্কে নিজেই আশাবাদী ছিলেন। আমরা তার প্রমাণও পাই কালে কালে। শোনা যায় নজরুলের রচিত গানের সংখ্যা রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি। পৃথিবীতে কোনও একজন কবি এত বেশি গান লেখেননি। সংখ্যাটা চারহাজারের কাছাকাছি হতে পারে। তিনি অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমায়েশে অনবরত গান লিখেছেন – প্রেমের গান, শ্যামাসঙ্গীত, ইসলামী সঙ্গীত, হাসির গান – সব মিলিয়ে এত এত গান! কিন্তু দুঃখের বিষয় সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার অনেক গান গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়নি, তেমনি অনেক গানের অস্তিত্বই হয়তো বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তবে একথা তো মানতেই হবে তাঁর সঙ্গীতের বিষয়বৈচিত্র্য এবং সুরের মাধুর্য আজও বাংলার মাটিকে স্পর্শ করে আছে। আমরা মাঝেমাঝেই বলে থাকি রবীন্দ্রনাথের 'গীতবিতান' শুধু গাওয়ার নয়, তার পাঠও আমাদের শুশ্রূষা। তাহলে নজরুলের গানের ক্ষেত্রেও কি একথা খাটে না ! আমরা পড়েই দেখি না! এই তো তিনি যখন বলছেন –

রিম্ ঝিম্ রিম্ ঝিম্ ঝিম্ ঘন বরষে।
কাজরী গাহিয়া চল পুর নারী হরষে।।

নিতান্তই সাধারণ গানের কথা, কিন্তু পাঠের পর মনে হয় না যে কী অপূর্ব এই রিম ঝিমের দোলাটা! এক বৃষ্টির ছন্দে অন্তরে সেই তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে! গুনগুন করে উঠছে ভেতরটা। এতে বিষাদভোলা এক কাব্যিক মূর্ছনা রয়েছে। যেন ছবিটাও ভেসে উঠছে চোখের উপর। কদমের ডালে, তমালের ডালে কুহু-পাপিয়া-ময়ূর এসে বসছে, দোল খাচ্ছে। মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। কবির মনে হচ্ছে যেন নট-শ্যাম-সুন্দর। মন-যমুনায় ঢেউ উঠছে, কূলহারা ঢেউ। ঘর ছাড়া বাঁশিটিও তখন বেজে উঠলো। মন তখন রাধা হয়ে ওঠে, ঘরে তার যেন আর বাঁধ মানছে না।

এই হল তার আবহ। এই যে সুর দিয়ে নিসর্গকে জাগানো, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ভেঙে নতুন ভাবচৈতন্যে প্রেমের অবস্থান নির্ণয়, এখানেই তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে নিজের মতো করে আলাদা হতে চাইলেন। রবীন্দ্রনাথ হয়তো তাঁর গানের বাণী ও সুরে অন্তরকে জাগিয়ে তুলতে চান, আর সেখানে নজরুল আত্মার বাইরেকে বাজিয়ে তুলতে চান। এইতো আমরা আবার যেখানে পড়ছি–

তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?
চাঁদেরে হেরিয়া কাঁদে চকোরিনী, কিছু বলেনাত কিছু চাঁদ।। 

অতি সাধারণ কথায় এক অনন্য প্রেমানুভূতি। খুব চেনা গান। কিন্তু পাঠের সময় মনে হয় উপলব্ধিটুকুও সুরের সঙ্গে প্রাণের মাধুর্য নিয়ে বাতাসে ঘুরছে। কী চমৎকার বলেছেন–

মেঘ হেরি' ঝুরে চাতকিনী, মেঘ করেনাত' প্রতিবাদ।।
জানে সূর্য্যেরে পাবে না, তবু অবুঝ সূর্য্যমুখী
চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতাকে, দেখিয়াই সে যে সুখী। 

এ প্রসঙ্গে আবার বুদ্ধদেব বসুর কথাই মনে পড়ে। কারণ তিনিই বলার সাহস জোগান। তিনি বলেছিলেন –“'বিদ্রোহী' কবি, 'সাম্যবাদী' কবি, কিংবা 'সর্বহারা'র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানিনে, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের মালা তিনি পরিয়ে দিয়েছেন, সে-মালা ছোট কিন্তু অক্ষয়। আর কবিতাতেও তাঁর আসন নিঃসংশয়, কেননা কবিতায় তাঁর আছে শক্তি, আছে স্বাচ্ছন্দ্য, আছে সচ্ছলতা, আর এগুলিই কবিতার আদি গুণ।"

তাঁর ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আমরা খুব বেশি নাইবা তুললাম। তাঁর দারিদ্র্য, তাঁর অভাব…। তিনি মাটির মানুষ, তাইতো সারাজীবন থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। এখানেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর একটা বেসিক পার্থক্য আমরা লক্ষ্য করি। রবীন্দ্রনাথ অবস্থাসম্পন্নতার মধ্যে থেকে জীবনকে দেখেছেন নিজস্ব পঠন-পাঠন, শিক্ষা এবং উপলব্ধির মাধ্যমে, আর নজরুল জীবনকে দেখেছেন জীবনের কাছাকাছি থেকে, কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে। বাবার অকালমৃত্যুতে বালক বয়সেই সংসার চালানোর জন্যে কাজ করেছেন কখনও রুটির দোকানে, কখনও মক্তবের শিক্ষকতা, কখনও লেটোর দলে গান বাঁধার কাজ। দশম শ্রেণীতে পড়তে পড়তেই যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজ সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে। ১৯১৭ থেকে ১৯২০ অর্থাৎ বয়স তখন ১৮ থেকে ২০ ; লেখালেখি শুরু তখনই। তবে আমরা বলবো লেটোর দলের গান বাঁধতে বাঁধতেই সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর আত্মার সংযোগ ঘটে যায়।

করাচির সেনানিবাসে থাকতে থাকতে তিনি একাধিক গল্প লিখেছিলেন – 'ব্যথার দান', 'হেনা', 'বাদল-বরিষণে', 'অতৃপ্ত কামনা' ইত্যাদি। সেই সব লেখায় উদ্ধৃতি হিসাবে রবীন্দ্রনাথের গান এসেছে, হাফিজের গজল, রুমির গজল–এসব তিনি ব্যবহার করেছেন। ছাত্রজীবন ব্যাহত হয়েছে কর্মজীবনের কারণে, কিন্তু যেভাবে তিনি তাঁর লেখালেখির মধ্যে বৈষ্ণব পদাবলী এনেছেন, রামায়ণ, মহাভারত, কোরআন, পুরান, ভাগবত তথা আরবি, ফারসি, উর্দু, সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তাতে সহজেই অনুমান করা যায় তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা কখনও থেমে থাকেনি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে বলা হয় 'স্বাধীন পাঠ'। তাঁর গানের মধ্যে আমরা পাই শাস্ত্রীয় ও ধ্রুপদী সঙ্গীতের ছোঁয়া, রয়েছে যাত্রা, কথকতা, সুফি, বাউল, ফকির, সাধুসন্ন্যাসীদের জীবনচর্যার ছোঁয়া। এই স্বশিক্ষিত মানুষটিকে যেন সংস্কৃতির ভুবনে আমরা একটু খাটো করেই দেখলাম !

একটা কথা আমাদের বারবার মনে এসে পড়ে, যতবার তাঁর লেখা ইংরেজের রোষানলে পড়েছে ততই তাঁর কবিতার পাঠকপ্রিয়তা বেড়েছে, গ্রন্থের বাজার কাটতি হয়েছে, একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। যদিও কালের বিচারে এসবের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু ওই যে নজরুল "একই সঙ্গে লোকপ্রিয় এবং ভালো কবি" ( বুদ্ধদেব বসু )। আমরা আজও তাঁর কিছু কবিতার প্রতি আকৃষ্ট তো হই। এ সমন্বয় সত্যিই দুর্লভ। 

১৯২৮ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির হয়ে কাজ করেছেন। তাঁকে ঘিরে ওই সময়ে কোম্পানির গীতিকার সুরকারদের একটি সংগঠন 'সুরসভা' গড়ে উঠেছিল। আধুনিক বাংলা গানের উদ্ভব সেইসময়ে একে অন্যের ভাবনার আদানপ্রদান থেকেই। গীতিকার-কবি প্রণব রায়, সুরকার কমল দাশগুপ্তর কথা নিশ্চয়ই মনে পড়বে। টপ্পা, ঠুংরি, কীর্তন, ভজন, ভক্তিগীতির বাইরে তাঁরা প্রেম ও প্রকৃতি নিয়ে গানে কাব্যের সুষমা ও সুরের মেলোডির সমন্বয় গড়ে তোলার নানারকম কাজ করেছেন। কমল দাশগুপ্ত নজরুলের অনেক গানের সুর করেছেন। এভাবেই আধুনিক গানের একটি ধারা প্রবর্তিত হয়। এখানেই রয়েছে নজরুলের লোকপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে কালাতীতের ঐশ্বর্যদানের এক অপার মহিমা।

লেখালেখির শুরুতে তাঁর বেশিরভাগ কবিতা প্রকাশিত হত 'মোসলেম ভারত' পত্রিকায়। তাঁর একটা বিশেষ কারণ হয়তো তিনি যেখানে থাকতেন মেডিকেল কলেজের সামনে ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে, তার পাশের ঘরেই ছিল ওই পত্রিকার দপ্তর। তাঁর রুমমেট ছিলেন তৎকালীন কমিউনিষ্ট নেতা শ্রদ্ধেয় মুজফ্ফর আহম্মদ। তাঁদের বন্ধুত্ব নিবিড় হওয়া সত্ত্বেও নজরুল সমাদৃত ছিলেন সব রাজনৈতিক মহলে। তিনি কার্যত কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। কিন্তু প্রথাসিদ্ধ কোনও রাজনৈতিক গণ্ডিতে আবদ্ধ হতে চাননি। তাঁর গান ও কবিতার জোরেই তিনি ছিলেন সব রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দলের রসিকজনের একান্ত প্রিয়।

১৯২১-এ কুমিল্লার পথ-ঘাট তিনি উত্তাল করেছিলেন অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের মিছিলে গান গেয়ে। তাঁর 'বিদ্রোহী' কবিতার পরপরই লেখা "কারার ঐ লৌহ কপাট" অর্থাৎ 'ভাঙার গান'। তাঁর গানে উদ্বেলিত আপামর স্বদেশীর প্রাণ। তাঁর গানই পরাধীনতার বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের এক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। এটাই তাঁর প্রধান শক্তি, প্রধান জোরের জায়গা। তবে দেখা গেছে যেখানেই মনের মিল পাননি, সেখানেই তিনি স্থির থাকতে পারেননি। হয় প্রতিবাদী হয়েছেন, নাহলে সরে এসেছেন। এমন একটা অবস্থার মধ্যেই তিনি শুরু করেছিলেন 'ধূমকেতু' পত্রিকাটির প্রকাশ।

বিষয়টা হলো, ১৯২০ সাল থেকেই তিনি জড়িয়ে ছিলেন 'নবযুগ' পত্রিকার সঙ্গে। পত্রিকাটি প্রকাশিত হত তাঁর এবং মাননীয় মুজফ্ফর আহম্মদের যুগ্ম-সম্পাদনায়। এখানেই তাঁর সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। এখানেই তিনি হাত পাকান সম্পাদকীয় হিসাবে ধারালো গদ্যরচনায়। খুবই পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেইসব গদ্য। সেই নিবন্ধগুলির একটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ পায় ১৯২২-এ। প্রকাশের পর সরকার সেটি বাজেয়াপ্ত করে। তখন 'নবযুগ'-এর প্রকাশও সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। তিনি তখন মহম্মদ আকরাম খাঁর 'সেবক' পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যে কবি সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যু উপলক্ষে তিনি একটি সম্পাদকীয় গদ্য লেখেন। কিন্তু নিবন্ধটি তাঁর অজ্ঞাতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে প্রকাশিত হওয়ায় তিনি অপমানিত বোধ করেন। পত্রিকার সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন করেন এবং 'ধূমকেতু'র প্রকাশ শুরু করেন। এই পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গেও বেশ কিছু ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে, সে প্রসঙ্গে এখানে খুব বেশি প্রয়োজনীয় নয় বরং অন্য একটি প্রসঙ্গ এখানে মাথায় এলো।

অনেকেই বাঙালি মুসলমান সম্পাদিত পত্রিকার তালিকা বা ইতিহাস রচনায় আগ্রহী হয়েছেন, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন সময়ে। এখনও কারও কারও মধ্যে এই উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নানা মত থাকতে পারে। মুসলিম জনমত গঠন বা তাঁদের উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে এর ভূমিকার কথাও কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা গেছে শুরু থেকেই পত্রিকাগুলোতে হিন্দু-মুসলমানদের মিলনের কথা বলা হচ্ছে। আমাদের প্রশ্ন হল মিলনের কথা যখন বলতেই হচ্ছে তার মানে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল বলেই মিলনের ডাক দিতে হচ্ছে। এই ধরনের গবেষণার মধ্যে কোথাও যেন একদেশদর্শিতার একটা আভাস লুকিয়ে থাকে। আমাদের নানারকম সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে, কিন্তু আরেকটু উদার ও নিরপেক্ষ হওয়ার চেষ্টা থাকায় দোষ কোথায়!

যাহোক নজরুলের 'ধূমকেতু' প্রকাশে আমরা নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজের বাণী বহন করার উদ্দেশ্য খুঁজতে বসবো না ! কারণ সে সুযোগ তিনি দেননি। আমরা যদি 'নবনূর', 'কোহিনুর', 'মোসলেম ভারত' (এই তিনটি পত্রিকারই জন্মসাল ১৯১১) বা 'নবযুগ' (১৯২০) প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো এই পত্রিকাগুলির মূলত লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশের বিরোধিতা। নজরুলও 'ধূমকেতু'র (১৯২২) প্রকাশ শুরু করেন এমন একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে। আর স্বাধীন সত্তায় আপোষহীন ভাবে নিজের মনের কথা বলার জন্যে স্বাধীন একটা মুখপত্র তিনি চেয়েছিলেন। তাঁর বিস্ফোরণের একটা আধার খুব জরুরি মনে হয়েছিল। 'ধূমকেতু' তাঁর সেই প্রয়োজন মিটিয়েছিল। খুব স্বল্প সময়ে মোট বত্রিশটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় (১১আগষ্ট ১৯২২ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯২৩)। এই সামান্য সময়ে তাঁর শাণিত বক্তব্য প্রকাশে কোনও অভিভাবকীয় শাসন আর রইলো না। কিন্তু তাঁর এই উদ্ধত ও দুঃসাহসিক কলমের দিকে পুলিশের ছিল কড়া নজর।

নজরুল 'ধূমকেতু'র প্রথম সংখ্যাতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, –"রাজভয়, লোকভয়, কোনো ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না।" এই কারণে হয়তো প্রথম থেকেই সরকারের লোক 'ধূমকেতু'কে উগ্রপন্থী পত্রিকা বলে চিহ্নিত কর রেখেছিল। এর নেপথ্যে কোনও সন্ত্রাসবাদী বা উগ্রপন্থী দলের কোনও সংযোগ না পেলেও পুলিশের কড়া নজর তাঁকে কখনও তিষ্ঠোতে দেয়নি। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ (প্রসঙ্গত পত্রিকাটি সপ্তাহে দুদিন এই হিসাবে প্রকাশিত হতো) সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর 'আনন্দময়ীর আগমনে' কবিতাটি এবং এগারো বছরের এক সদ্য কিশোরী লীলা মিত্রর একটি ছোট গদ্য 'বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ'। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ৮ নভেম্বর ১৯২২ লেখাদুটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয়। সম্পাদক নজরুল এবং প্রকাশক আফজালুল হকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯২৩-এর ২৭ জানুয়ারি কলকাতার চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে তাঁকে একবছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। কারাগারে তিনি অনশনে ব্রতী হন, একটানা ৩৯ দিন অনশন করেন। তাঁর অনশনে উদ্বিগ্ন হয় সাহিত্যসমাজ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁর অনশন ভাঙার জন্যে টেলিগ্রাফ করেছিলেন এই বলে –"Give up hunger strike, our literature claims you." জেল কর্তৃপক্ষ "addressee not found" বলে সেই টেলিগ্রাফ ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল। আরও জানা যায় দৌলতপুরের জনৈকা বিরজাসুন্দরী দেবী, যাঁকে তিনি মা বলে ডাকতেন, তাঁর অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।

তাঁর সম্পর্কে বলার কোনও শেষ নেই। তাঁকে নিয়ে এত কম আলোচনা হয়, ভাবতে অবাক লাগে। আজ বলতে বসলে অনেক অনেক কথা উঠে আসবে, বিশেষ করে ইতিহাসের অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফৎ আন্দোলনের কথা। এসময়ে তাঁর কলম হয়ে ওঠে শাণিত তলোয়ারের মতো। আমরা যে তথ্য পাই সেখানে দেখা যাচ্ছে,–"অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের তত্ত্বগত চরিত্রের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা থাকলেও, নেতৃত্বের প্রতি ভক্তি তেমন ছিল না। লক্ষ্য করা যাবে, 'ধূমকেতু'র অজস্র লেখায় আন্দোলনকে নানান দিক থেকে বিশ্লেষণ করে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে, কখনো কখনো সংশোধনের পথও নির্দেশিত হয়েছে।" (নজরুল ও ধূমকেতু /সাহারার জাহান, দেশ ১৩৯৭, সাহিত্য সংখ্যা)।

এই আন্দোলনের পাশাপাশি খেলাফৎ আন্দোলন সম্পর্কেও এই পত্রিকায় নিয়মিত বিভিন্ন খবর ও প্রবন্ধ প্রকাশ পেত। ঘটনা হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে তুরস্কের খেলাফৎ উচ্ছেদের চক্রান্ত ফাঁস হলে সারা বিশ্বে মূলত মুসলমান সমাজ প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। ভারতীয় মুসলমানরাও স্বাভাবিকভাবে একে সমর্থন জানান। শুরু হয় খেলাফৎ আন্দোলন। এই প্রসঙ্গে 'ধূমকেতু'তে তুরস্ক সংকটের যাবতীয় সংবাদ এবং একাধিক সাহসী নিবন্ধ প্রকাশ পেতে থাকে। এই খেলাফৎ আন্দোলন নিয়েও অনেক কথা আছে। নজরুলের মতো উদার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল কবির মধ্যযুগীয় খলিফাতন্ত্র বা ধর্মভিত্তিক আন্দোলনকে কীভাবে সমর্থন করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আসলে তাঁর খেলাফৎ আন্দোলনের সমর্থনের মূলে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা। এই আন্দোলনকে তিনি সমর্থন করলেও এর প্রতি যে ততটা আন্তরিক ছিলেন না সে প্রমাণ 'ধূমকেতু'র পাতায় রয়েছে। আমাদের কাছে লক্ষ্যণীয় হল তাঁর লেখনি। যেমন গদ্যে তিনি হয়ে উঠলেন কঠোর বিশ্লেষক, তেমনি এসময়ে তিনি কবিতা ও গানের অন্তরাত্মার জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন মুক্তি সংগ্রামের প্রবল আওয়াজ। এই আন্দোলনের প্রভাবে তিনি হয়ে ওঠেন সাম্যবাদী ও স্বদেশী গানের স্রষ্টা, শিল্পী। তিনি তাঁর লেখনি দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন নৈরাশ্যতাড়িত যুবসমাজকে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একদিকে প্রেম অন্যদিকে বৈপ্লবিক চেতনা।

আরেকটি বিষয় অবশ্যই লক্ষণীয় – তা হল নারী জাগরণ। তিনি বিশ্বাস করতেন নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজের মুক্তি বা জাগরণ সম্ভব নয়। আমরা জানি রামমোহন, বিদ্যাসাগরের হাত ধরে যে আন্দোলনের শুরু হয়েছিল সমাজ কিন্তু সংস্কারের বেড়াজালে সেখানেই আবদ্ধ। নজরুলও বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি এও বিশ্বাস করতেন নারী-জাগরণে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে সবার আগে। তাঁর পত্রিকা 'ধূমকেতু'তে মহিলাদের জন্যে একটি বিভাগ ছিল 'সন্ধ্যা-প্রদীপ'। মেয়েদের স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্যে বিভাগটি ছিল উন্মুক্ত। সেখানে নারীজাতির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো।

তিনি চেয়েছিলেন ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার জন্যে চেয়েছিলেন আত্মার বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের জন্যে চেয়েছিলেন তারুণ্যের জাগরণ। আর সেই জাগরণের জন্যে চেয়েছিলেন সমাজের বলিষ্ঠ প্রত্যয়। বাইরের আবেগ ভেতরেও প্রবাহিত হয়েছে সমানভাবে, কারণ দেশের জন্যে তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি যেমন জাতির জন্যে উৎসর্গিত এক বাঙালি প্রাণ তেমনি একজন খাঁটি বাঙালি কবি। প্রতিভাদীপ্ত তাঁর বহুমুখী জীবনের প্রতিটি কর্মকাণ্ড আজও সমান উজ্জ্বল।

অসামান্য প্রতিভাসম্পন্ন না হলে এত এত কাজের মধ্যে এত এত গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, চিত্রনাট্য, শিশুসাহিত্য তিনি রচনা করে গেছেন। এছাড়া মৌলিক কবিতা তো রয়েছেই। দেখা যাচ্ছে তাঁর সৃষ্টিকাল মাত্র ২২ বছরের। এর মধ্যেই এত সৃষ্টি, যা অকল্পনীয়। তবে কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও একটু পরিমার্জন হয়তো দাবি করেছিল। এমনটা অনেকেরই মনে হয়েছে। বুদ্ধদেববাবু তখন বলেছিলেন,–"কত গান সুন্দর আরম্ভ হয়েছে, সুন্দর চ'লে এসেছে, কিন্তু শেষ স্তবকে কোনো-একটা অমার্জিত শব্দ-প্রয়োগে সমস্ত জিনিশটাই গেছে নষ্ট হয়ে। তাঁর প্রেমের গান সরস, কমনীয়, চিত্রবহুল ; কিন্তু তার রস আমাদের মধ্যে ঘনীভূত হ'তে -হ'তে হঠাৎ কোনো স্থূল স্পর্শ এসে প্রায়ই মনকে বিমুখ করে দেয়।" আরও হয়তো কোথাও কোথাও মনে হয়েছে যৌবনের তারল্য থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেননি কখনও‌। একজন কবির জীবনদর্শনের গভীরতা তাঁর কাব্যকে ক্রমশ রূপলোক থেকে ভাবলোকে উত্তীর্ণ করে। প্রতিভাকে যত্নে লালন করা, যাকে বলা হয় সাহিত্যের গৃহিনীপনা। নজরুলের ক্ষেত্রে যা অনেকটা অনুপস্থিত।

এতসব সত্ত্বেও আমরা বলবো কোনও মানুষ যেমন ত্রুটিহীন নয়, তেমনি কোনও স্রষ্টাও স্বয়ংসম্পূর্ণ নন। ভোলা কি যায়, তিনি যখন আমাদের শোনান –

আমায় নহে গো, ভালবাস শুধু, ভালবাস মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।।

বা,

খেলিছ এ বিশ্ব ল'য়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে।।

এই অতুলনীয় কথা ও সুরের সমারোহ আমাদের আজও ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রবীন্দ্র গান এবং নজরুলের সঙ্গীত দুটি ভিন্ন আবহ, আমরা সহজেই আলাদা করতে পারি। তাঁর অসামান্য গজল, ভজন, ধ্রূপদীয়ানা যেন সহজাত প্রতিভার স্ফূরণ। মূলধারা থেকে স্বতন্ত্র গতি ও মূর্ছনারই আভাস দেয়। একটা সময় রবীন্দ্র এবং নজরুল বিতর্ক দুই দেশের মধ্যে কিছুটা উত্তপ্ত হয়েছিল। এই যে আমি রবীন্দ্রগান আর নজরুলসঙ্গীত বললাম, বিতর্কটা এর মধ্যেও। আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং নজরুলগীতি বলতেই অভ্যস্ত হয়েছি। এই বিতর্কটাও এখানে উহ্য থাক।

চল্লিশের দশকের সাম্যবাদী কবিরা প্রাণিত হয়েছিলেন তাঁর কবিতায়‌। সুকান্ত এবং নজরুল। আজও অনেকেই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তাঁর কাব্যাদর্শের প্রেরণা বহন করে চলেছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে শুধু ভাষা ও প্রকরণ। এ প্রসঙ্গে অজস্র উদ্ধৃতি উল্লেখ করা যায়। সে বিষয় না হয় আমরা আবার কোনোদিন উত্থাপন করবো। এখানে কথা হল তিনি একজন আধ্যাত্মবাদী, কিন্তু ধর্ম থেকে মানুষকে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। মানুষের কথাই বলে এসেছেন সমগ্র ক্রিয়াশীল জীবনে। কেউ যদি বলে থাকেন,– তিনি হলেন আগামীর কোলে গত শতকের বিদায়কালের এক প্রীতি-উপহার, সে কথা মনেহয় যথার্থ।

কেউ বলছেন তাঁর কবিতা চমৎকার কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়। একজন স্রষ্টার সব সৃষ্টিই যে মানের উত্তরণ ঘটাবে এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কিন্তু প্রতিভা চিনতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। জীবনানন্দ অন্তর্মুখী কবি ছিলেন। নিজের লেখার প্রতি কখনও তৃপ্ত হতেন না, রূপলোক থেকে ভাবলোকে উত্তরণের চূড়ান্ত সাড়া না পাওয়ায় অধিকাংশ লেখাই অপ্রকাশিত রেখে চলে যান। আমাদের কাছে নজরুলের সফল সৃষ্টিগুলোই প্রাণের স্পন্দন। আমরা না হয় সেদিকেই ফিরে ফিরে তাকাবো বারবার।

যে কথা বলতে বলতে এতটা পথ চলে আসা, সেটি হল, নজরুল হলেন এমন এক স্রষ্টা, এমন এক শব্দশ্রমিক, যিনি শুরু থেকেই সহজাত প্রতিভাবলে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এবং থেমেও গেলেন সুদূর প্রসারী অপরিহার্যতা রেখে। পৃথিবীতে যতদিন বঞ্চনা থাকবে, শোষণ থাকবে, নিপীড়ন থাকবে, বাঙালি হিসাবে নজরুলকে ভোলা অসম্ভব। আমার ভাবতে ভালো লাগে সবার হৃদয়ে যদি রবীন্দ্রনাথ থাকেন, তাহলে চেতনায় রাখুন নজরুলকে। খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে তাতে! গানটা তো বাজছে…।

0 comments: