গল্প - সুবল দত্ত
Posted in গল্পপ্রায় তিরিশ বছর আগের এই পুকুরটার এমন যে দশা হবে মোহন সিংহের ধারণাই ছিল না। টলটল করতো যার জল, ওপর থেকে নিচের শ্যাওলার হেলদোল পরিষ্কার দেখা যেত, এমন জীবন্ত পুকুরেরও যে মৃত্যু আর কবর হয় এখন স্বচক্ষে দেখছেন। গ্রামের রাজঘরানার পুকুর। পুকুরের মাঝে দু রকমের শাহী পদ্ম ফুটতো। বহুআগে রাণীরা ও রাজপরিবারের মেয়েরা এখানেই স্নান করতো। তখনকার পুকুরের বাহার কী? এইকথা ঠাকুমার কাছ থেকে প্রায়ই শুনতেন। পুকুরের বাঁধানো ঘাট অবশ্যি ভেঙে যেতে দেখে গেছিলেন তিনি। কেউ আর পুকুরে স্নান করতে আসতো না। মোহন সিংহ তখন ছোটো ছিলেন। রাজ বংশের ছেলে। দালানঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বিকেলে পুকুরের চওড়া পাড়ের উপরে হাঁটতে বেরতেন। বছর তিরিশ আগে এই গ্রাম ছেড়ে ব্যাংগালোর কলেজে পড়তে যাওয়া আর সেখান থেকে সোজা আটলান্টায়। আর সেখানেই সেটেলড।
বহু বছর পর দেশে এসে তিনি দেখলেন, সেই রাজমহল আর নেই। পুকুরের কাছে দুটো বিশাল বাংলোবাড়ি হয়েছে। মহল ভেঙে রাবিশগুলো দিয়ে পুকুর বোজানো হয়েছে। তবুও দু চারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোহন সিংহ আবিষ্কার করলেন পুকুরের একটা পাড়। যেখানে একটা অশত্থ ও একটা বটগাছ পরস্পরকে আলিঙ্গন করে একসাথে বড়ো হয়েছে। দুটোর মধ্যে অশত্থ একটু কমজোর। আড়াল হয়েছে বলেই স্মৃতিও বিশ্বাসঘাতকতা করছে। এবার প্রায় অদৃশ্য গাছটার ঝুরি দেখে চিনলেন। অশত্থের ঝুরি ঝোপের মতো জড়িয়ে রয়েছে দুই গাছের কাণ্ড। তবুও গাছটার চারদিকে বেশ কবার পরিক্রমা করেও ওইজায়গাটা কোথায় ঠাহর করতে পারলেন না তিনি। কোথায় সেই স্পট? মনে পড়ছে না সেই স্থানের দিশা। অবশ্য স্মৃতির আর দোষ কি! আজ চার দশক আগে যে কাজটা করেছিলাম, তখন ছিলাম অবোধ বালক। অসুস্থ। মরণের দুয়ার ছুঁয়ে বেঁচে ফেরা মানুষ। তার ওপর সেই নরক গুলজার করা পরিস্থিতি। মনে পড়া প্রায় অসম্ভব। মোহন সিংহ তাঁর গিরগিটির মতো খসখসে গালে হাত বোলালেন। সারা মুখে চাঁদের পিঠের মতো অসংখ্য গর্ত। এই অসুন্দর মুখের জন্য জীবনে এতদিন অব্দি বসন্ত আসেনি। বসন্ত তাঁর মুখ মণ্ডল অসংখ্য গর্তে ভরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু হাজার হোক তিনি রাজপুত। রাজ ঘরানার। ফর্সা সুন্দর দেহ সৌষ্ঠব। বিদেশে তাঁর বসবাস। অঢেল সম্পত্তি। একটু যা বয়েস বেশি পঞ্চাশের উপর আর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কিন্তু তাতে কি? মেয়ে রাজি। বিয়েও হয়ে গেল। আজ ফুলশয্যা। আজ মোহন সিংহের প্রথম বসন্ত রাত।
সূর্য প্রায় মাথার উপর। অনেক বেলা হয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে এখন কোভিড ঊনিশের রেশ। যদিও এখন থিতিয়ে আর এই গ্রামে একটাও কেস নেই, তবু তিনি মাস্ক ও গ্লাভস পরে বেরিয়েছেন। এখনো অন্তররাষ্ট্রীয় উড়ানে অনেক নিয়ম পালন করা হচ্ছে। অশত্থের ঝুরি সরিয়ে বটগাছের মোটা শিকড়ের উপর বসে পড়লেন মোহন সিংহ। ঝুরির কয়েকটা কোমল ডগা ভেঙে চিবোলেন। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। পাড়ের উপর আরো দুটো অশত্থ গাছ ছিল তখন। ওগুলো সব লোপাট। যেসময় গুটি বসন্ত মহাপ্রলয়ের মতো ঘরে ঘরে শোক যন্ত্রণা হয়ে এসেছিল, মনেপড়ে, এই জোড়া গাছের নিচে মা শীতলার সাত দিন সাত রাত অখণ্ড পুজো চলছিল। তার আগে এখানে কুলগাছের ঘনঝোপ ছিল।সেগুলো কেটে পরিষ্কার করে মা শীতলাকে স্থাপনা করা হয়েছিল। মোহন সিংহ চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন। একটি সাদা ছাই রঙের নোড়ার মতো মসৃণ পাথর ছিল মা শীতলার শিলা রূপ। সিঁদুর লেপে সাতদিনে তাকে লাল বীভত্স মূর্তি বানিয়ে দিয়েছিল। সারা গ্রামে ছেয়ে গেছিল মহা মড়কের হাহাকার। এই পুকুর পাড়ে লম্বা উপুড় হয়ে পড়ে থাকতো গাঁয়ের মানুষ। তেমনি গা ছমছম করা পুজোর মন্ত্রপাঠ ও মা মা ডাক। প্রতি ঘরে যখন তখন কান্নার রোল উঠতো। সে সময়কার জীবন যেমন অস্থায়ী ছিল,তেমনি এই শীতলা থানটি হয়ে দাঁড়াল অস্থায়ী। দুঃসময় পার হয়ে যাবার পর মা শীতলা হয়ে উঠলো সবার কাছে ভয়ঙ্করী। তাই এখানে কোনো মন্দির গড়ে ওঠেনি। বহুবছর এই জায়গাটি পরিত্যক্ত রয়ে গেল। তবে যে কবছর মোহন সিংহ এখানে ছিলেন ততদিন তিনি দেখেছেন সিঁদুরে এই জায়গাটা লাল হয়ে থাকতো।
মোহন সিংহ দু হাতে সেখানের মাটি সরাতে লাগলেন। একটা জিদ চেপে গেছে মাথায়। ওই শিলা খণ্ডটি খুঁজে বের করতেই হবে। মাটি পাথর সরাতেই দুপুর হয়ে গেল তবু কিছু মিলল না। আজ তাঁর বিশেষ দিন। লোকজন নিশ্চয় খুঁজতে বেরিয়েছে হবে। মাটি তো বালির মতো সরাতে খুব কষ্ট হচ্ছে না, শুধু গাছের অজস্র মোটা শিকড়ের জাল বিরক্তিকর। উনি উঠে দাঁড়িয়ে একবার বাংলোর দিকে তাকালেন। অট্টালিকাটি আজ এতো সুন্দর সাজে সেজেছে, দেখার মতো। এখানে এসেই তাঁর উপলব্ধি হচ্ছে যে তিনি বনেদি রাজপুত্র। বিদেশে কে কাকে বোঝে বা তোয়াক্কা করে। আমেরিকার আটলান্টায় বিশাল ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টে প্রচুর সায়েন্টিস্ট। কে কার খবর রাখে? কিন্তু একটা বিশেষ কিছু পেলে হয়। সঙ্গে সঙ্গে তার নাম দ্রুত ছড়িয়ে যায়। রাতারাতি নামী দামী হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে মোহন সিংহের মন আবার ব্যাকুল হয়ে উঠলো। আগামীকাল অব্দি এখানে। তারপর তো তাঁকে ফিরে যেতেই হবে। খালি হাত? তিনি ঘুরে গাছের দিকে একপা এগোতেই হুশ করে একটা চোরা গর্তে পা জাঙ্ঘ অব্দি ঢুকে গেল। পড়ে গেলেন তিনি। উঠে সাবধানে গর্ত থেকে পাটা বের করতেই অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন। পায়ের পাতাটা রক্ত লাল হয়ে আছে। দু হাত ধরে পা চেপে ধরতেই বুঝে গেলেন তাঁর ভ্রম। পায়ের পাতাতে সিঁদুর লেগেছে। গর্তটা সম্ভবত মেঠো ইঁদুরের। মুখ থেকে হাহা হাসি বেরিয়ে এল। তিনি দ্বিগুণ উত্সাহে গর্তের মুখ থেকে মাটি সরাতে লাগলেন। বেশ কিছুটা মাটি সরাতেই মসৃণ পাথরটা হাতে ঠেকলো। তিনি জোড় হাতে আভূমি প্রণাম করে পাথরটা নড়াতে চেষ্টা করলেন। অসম্ভব মনে হলো তাঁর। এইকাজটা এমন যে কাউকে ডাকা চলবে না। শেষে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে দাঁড়াবে। তিনি থামলেন না। মাটি সরাতে লাগলেন। মাথা গা ঘামে ভিজে সপসপ। জামা গেঞ্জি খুলে ফেললেন। ভাগ্যিস এইদিকটা বাংলোর পিছন দিক। তার ওপর গাছের ঝুরিগুলো আড়াল করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ মাটি সরানোর পর একটু নাড়াতে পাথর নড়ে উঠলো। আর সেই সঙ্গে হাতে গ্লাভস ভেদ করে ধারালো কিছু ফুটলো। তিনি গ্লাভস না খুলে জিনিসটা কি দেখার জন্যে সেটা টেনে বের করলেন। একটা রূপোর কারুকার্য করা ছোটো কৌটো। পদ্মের পাপড়ির মতো রূপোর পাতে পাথর খচিত। প্রায় চল্লিশ বছর মাটিতে চাপা পড়ে থেকেও তার জেল্লা কমেনি। সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে হঠাত্ আনন্দে তিনি নাচতে লাগলেন।
[গ্রীক দেবী প্যান্ডোরা অসাধারণ রূপসী ছিলেন। মর্ত্যের মানুষের আগুন ব্যবহারে কুপিত হয়ে তাদের শায়েস্তা করতে স্বর্গের সমস্ত দেবতার ইচ্ছেতে গ্রীক দেবতা হেফাস্টাস অনেক যত্ন করে তাঁকে সৃষ্টি করে পাঠালেন মর্ত্যে। প্রথমেই গ্রীক দেবতা জিউস প্যান্ডোরাকে প্রমিথিউসের হাতে উপহার হিসেবে তুলে দিতে চাইলেন। চালাক প্রমিথিউসের সন্দেহ হলো। তিনি দান প্রত্যাখ্যান করলেন। কিন্তু প্রমিথিউসের ভাই এপিমিথিউস প্যান্ডোরার রূপে মুগ্ধ হয়ে প্যান্ডোরাকে গ্রহণ করলেন। প্যান্ডোরা সাথে করে একটা বাক্স নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সরল,নিজেই জানতেন না ওতে কী আছে। শুধু জানতেন ওতে দেবতাদের উপহার রয়েছে। কৌতুহলী এপিমিথিউস ও প্যান্ডোরা বাক্সটিকে খুললেন। বাক্স থেকে বেরিয়ে এল মহামারী]
গাঁয়ে তখনো মা শীতলার প্রকোপ ছিল না। ভাগচাষীদের বাড়ির দরজায় নিমডাল আর এক আধটা ঘরে চাপা কান্নার রোল। সেইসময় আষাঢ় মাসের প্রথমে তিথি দেখে প্রতিবছরের নিয়ম অনুসারে মোহন সিংহকে জ্বর গায়ে নিয়েও রাজপুত্রের সাজ সাজতে হয়েছিল। জমিদার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী বলে কথা। মাথায় রূপোর জরি বসানো পাগড়ি, গায়ে রাজপোশাক কোমরে খাপে ভরা তলোয়ার মাথায় বাহারি রূপোর ছাতা। দশবছরের মোহন সিংহ ঘোড়ায় চেপে লোক লস্কর নিয়ে চলছিলেন ইন্দ্র দেবের পতাকা উত্তোলন করতে আর বরুণ দেবের জলাভিষেক করতে। দুপাশে ওর বয়েসী ছেলেরা হাততালি দিয়ে গাইছিল, ‘রাজা ইন্দ তুলতে যায়/রাজা শালুক মধু খায়’।
সেইদিন রাতে মোহন সিংহের গায়ে গুটি বসন্ত দেখা দিয়েছিল। তারপর যমে মানুষে টানাটানি। সেই যন্ত্রণার কথা মনে পড়লে আজও সারা গা শিরশির করে। গ্রামে মহামারী সেই শুরু। তারপর শীতলা পুজো। ন দিনের দিন নিম হলুদ জলে গা ধোয়ার পর শুকিয়ে আসা ঘায়ের খোসাগুলো মোহন সিংহ সাবধানে এই রূপোর কৌটোতে ভরে রাখতেন। প্রায় দুমাস পর যখন শীতলা মন্দিরে ভক্ত সমাগম কমে এসেছিল, একদিন ভোরবেলায় শিলাবিগ্রহের পিছনে মাটি খুঁড়ে তিনি পুঁতে দিয়ে এসেছিলেন। আর যাতে এই বিষ কোথাও না ছড়ায়।
আটলান্টায় বিশাল রিসার্চ সেন্টারে ডিপার্টমেন্ট অফ ভাইরোলোজিতে অনেক বছর ধরে মোহন সিংহ ভাবতেন, যদি ওই সুপ্ত গুটি বসন্তের বিষাণু এখানে এনে রিসার্চ করা যায় তো কেমন হয়? তার মিউটেশন এখনো হতে পারে কী? ভাবতেন কিন্তু মন সায় দিত না। এখন যখন সুপ্ত কোভিড দুই ছাড়া পেয়ে ভয়ঙ্কর কোভিড ঊনিশের রূপ ধারণ করার কথা সারা বিশ্বের রিসার্চ ফেলোরা জানতে পারলো, তখন আর তিনি থাকতে পারলেন না। খ্যাতি ও বিলিয়ন ডলারের কথা ভেবে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর কি শুভ সংযোগ! এত কম সময়ে বিয়ে পাকা, বিয়ে হওয়া আর হাতে আলাদীনের প্রদীপ? ভাবা যায় না।
মোহন সিংহ পকেট থেকে স্যানিটাইজার বের করে কৌটো ও হাত ধুয়ে ফেললেন। ভালো করে পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হলেন কৌটো বেশ টাইট করে বন্ধ আছে। সাবধানে এটাকে আটলান্টা নিয়ে যেতে হবে, এই দৃঢ় নিশ্চয়ে তিনি বাংলোর দিকে এগোলেন।
ঘরের ওয়াশ রুমটি অতি আধুনিক সৌখীন জিনিষপত্রে সাজানো। বেসিনে কৌটো রেখে খুব সাবধানে ওয়াশ করলেন। তিনি জানেন, এই স্মল পক্স ভাইরাসটি এতো ভয়ঙ্কর যে, এই বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সারা পৃথিবী জুড়ে তিনশো মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। কতজন যে বিকৃত বিকলাঙ্গ হয়ে বেঁচে আছে তার হিসেব নেই। এই ভাইরাসটির টিকা পৃথিবীর সব স্থানে সাতাত্তোর সাল অব্দি সব মানুষের শরীরে দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। রোগের ভিরুলেন্স মানে মারক ক্ষমতা একেবারেই কমে এসেছিল। তবু, ঊনিশশো আঠাত্তোরে ইংল্যাণ্ডের একটি ল্যাবরেটরিতে কোনও ভাবে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে আবার মারাত্মক মহামারী দেখা দিয়েছিল। ঠিক যেমনটি চীনদেশের ল্যাবে এখন কোভিড দুই ছড়িয়ে পড়েছিল, যার ফলে পৃথিবীব্যাপী অতিমারীতে আক্রান্ত। মোহন সিংহ অতি সাবধানে এই রূপোর কৌটোটি মুছে শুকিয়ে নিয়ে একটা কাগজে মুড়ে নিজস্ব ওয়াড্রোবে রেখে দিলেন। খুব সাবধানে এটি আটলান্টাতে রিসার্চ ল্যাবে পৌঁছাতে হবে।
স্নান করে ফ্রেশ হয়ে রাজঘরানার পোশাক পরে বেরোতে যেতেই সদ্য বিয়ে করা বউএর সাথে ধাক্কা। তাকে তাঁর মুখের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজের কুরূপ মুখের কথা বেমালুম ভুলে জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে ধীর পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকলেন। জীবনের প্রথম আস্বাদ। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। ঘরের ভিতরে ঢুকে তিনি থেমে গেলেন। বউকে একটু দূরে সরিয়ে দিলেন। দেওয়াল জুড়ে বিশাল আয়নাতে ওই সুন্দর মুখের সামনে তাঁর মুখ আরও কুতসিত দেখাচ্ছে। কিন্তু তাঁর নব বিবাহিতা স্ত্রী তাঁকে খুব সহজভাবে মেনে নিয়েছে দেখে ধীরে ধীরে মন শান্ত হলো। খুব সাধারণভাবে নতুন বউ যেমন আচরণ করে, তেমনিই করছিল। তিনি বুঝলেন তাঁর স্ত্রী একটু বেশি কথা বলে ও বলতে চায়। তিনি সেইভাবেই সঙ্গ দিলেন। নিজেকে কুরূপ ভেবে বহু বছর ধরে কুণ্ঠিত ও হীনমন্যতায় ভুগতেন। এখন সেই কলুষ মন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। রাত্রে ফুলশয্যার খাট একটা অন্য ঘরে সাজানো ছিল। বনেদি ঘরের রীতি রেওয়াজ মেনে দম্পতি সেই ঘরে আসতে অনেক রাত হয়ে গেল। ঘরে ঢুকেই বউকে বলে দিতে হলো আগামীকাল তাদের ফ্লাইট আছে, দুপুরেই বেরিয়ে পড়তে হবে। সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে নেওয়া দরকার।
সকালে একটু দেরী করে ঘুম ভাঙতেই সবচেয়ে প্রথম কৌটোর কথা মনে পড়ল মোহন সিংহের। রাতের মাদক রোমাঞ্চময় জীবনের সবচেয়ে সুন্দর রাতের আবেশ মাথায় রেখে নিজের ওয়াড্রোব খুললেন। খুলতেই এক অজানা আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠলো। ওয়াড্রোব খালি। কয়েকটা কাপড় পড়ে রয়েছে। পাগলের মতো হাতড়াতে লাগলেন তিনি। মুখ থেকে হিস হিস কান্নার শব্দ। মাথার চুল ছিড়তে লাগলেন। সেই সময় আয়নাতে দেখলেন লাল শাড়ি পরা তাঁর স্ত্রীকে। চুল খোলা। অর্ধেক চুল কাঁধ বেয়ে বুকের উপর। টপটপ জল গড়াচ্ছে। মাথাতে সিঁথির সিঁদুর টকটকে উজ্জ্বল লাল। মোহন সিংহ বার দুই কেশে ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি একটা রূপোর কৌটো এখানে রেখেছিলাম, সেটা কোথায়?
-খুব সুন্দর সিঁদুর কৌটো। ওটা আমি ঘষে মেজে পরিষ্কার করে ওতে সিঁদুর ভরে রেখেছি। ভিতরে নোংরা ছিল।
বউ আরো কিছু বলছিল। মোহন সিংহের কানে কিছুই ঢুকছিল না। তিনি একদৃষ্টে ওর সিঁথির সিঁদুরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মা শীতলার সিঁদুরে গাবানো শিলা ছাড়া দৃষ্টিপটে আর কিছু ছিল না আর কানে বাজছিল অসংখ্য মা মা আর্তনাদ।
0 comments: