ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিকতৃতীয় ভাগ
৫
বিয়ের ঝামেলা কেটে গেল একটা ঘোরের মধ্যে। বাড়িতে এত লোকের ভিড় ও আগে দেখেনি। ওদের যে এত আত্মীয়স্বজন আছে তাও রূপেশের জানা ছিল না। ও জানত যে ওরা মাত্র দুইপুরুষ আগে, মানে ওর ঠাকুর্দার রেলের চাকরির সুবাদে, বিহারের বখতিয়ারপুর থেকে ছত্তিশগড়ের ভিলাইয়ে এসেছে। ছোটবেলায় প্রতি বছর শীতের মুখে ছট পরবের সময় দুর্গের কাছে সিরসাঘাটে বা ভিলাইয়ের তালপুরির দীঘিতে গিয়ে সবার সঙ্গে সুর্যদেবকে অর্ঘ্য দিয়েছে , পটাকা ফাটিয়েছে এবং প্রসাদী মিষ্টি খেয়েছে। এর বেশি কিছু জানা ছিল না।
গায়ে হলুদের হুল্লোড় ওর ভাল লাগেনি। কিন্তু দেখল বড়বৌদি ও টাটানগর এবং সমস্তিপুর থেকে আসা বয়স্ক মহিলারা কেমন কিশোরীদের মত উচ্ছল হয়ে উঠছেন। আর রাত্তিরে ছাদের থেকে ঢোলকের আওয়াজ শুনে ও উপরে গিয়ে দেখল যেন হাট বসেছে। বড়বৌদির ঢোলকের থাপের সাথে তাল মিলিয়ে দুই পাকা চুল মহিলা নিমপাতা খাওয়া মুখ করে ওদের দেশের বিয়ের কোন গেঁয়ো গান ধরেছেন। উচ্চারণ যেন কেমন! ওর দিকে চোখ পড়তেই সবাই হইহই করে উঠল, তারপর ওকে ভাগ- ভাগ করে তাড়িয়ে দিল। ওর কানে এল একটা লাইন-“ ছিয়া ছিয়া জেঠজি!”
( ছিঃ ছিঃ ভাসুরঠাকুর!)
কিন্তু গোল বাঁধল সুহাগরাত বা ফুলশয্যার সময়। ফুল দিয়ে সাজানো নিজের ঘরে বসে ও ভাবছিল-- একটা সিগ্রেট খেলে কেমন হয়! নিমকি কি কিছু মনে করবে? নীল বেনারসীতে ওকে দূর থেকেই দারুণ লাগছিল। যেন নীলপরী! ইউরেকা ! ওকে নীলপরী বলে ডাকলে কেমন হয়? নীলপরী কি একটু ফিল্মি? ও হেসে উঠবে না তো? তাহলে নীলিমা! এটাই বেশ হবে। ও জানে সময়ের ঘসা লেগে নীলপরী বা নীলিমা একসময় নীলু হয়ে যাবে । হোক নীলু, ওই নিমকি টিমকির মত গেঁয়ো নয়।
চিন্তায় ছেদ পড়ল। ঘরে ঢুকেছেন পাঁচজন মহিলা।বড়ীভাবীজি ধরে ধরে নিয়ে আসছেন সরলা বা নিমকিকে, ওর নতমুখে কনেচন্দনের আভা। রূপেশের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। বৌদি সরলাকে ছেড়ে রূপেশের গালে ঠোনা মেরে বললেন—নাও, এবার নিজের সম্পত্তি বুঝে নাও। আর সারাজীবন আগলে রেখো দেবরজি।
কিন্তু রূপেশ কিছু বলার আগে এগিয়ে এসেছেন দুই পাকাচুল মহিলা--একজনের হাতে একটি কাঁসার বগি থালা, অন্যজনের হাতে একটা শিলনোড়া আর নারকোল। তৃতীয়জন পেছনে থেকে বললেন—শুভকাজটা আগে হয়ে যাক।
--জরুর, জরুর।
মেজেতে থালা নামিয়ে রেখে তার উপর নারকোল আর শিলনোড়া রেখে ওরা বললেন—নাতিসাহেব, এগিয়ে এস। থালায় পা’ রেখে দাঁড়াও। নাতবৌ নারকোলটা ভেঙে জলটা দিয়ে এই থালার উপর তোমার পা ধোয়াবে, নিজের চুল দিয়ে তোমার পা মুছিয়ে দেবে। তারপর তুমি বিছানায় উঠবে। লজ্জা কর না, এস, এগিয়ে এস।
রূপেশ হতভম্ব; এসব তো কেউ আগে বলেনি। ওর কী করা উচিত? সরলার দিকে তাকায়। সরলা কাঠের মত দাঁড়িয়ে। কেউ কোন কথা বলছে না।
সবচেয়ে বয়স্কা মহিলাটি এসে ওর হাত ধরলেন—চল, দেরি কর না; রাত হয়েছে।
রূপেশ আবার সরলার দিকে তাকায়। ও এখন চোখ তুলে রূপেশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।
রূপেশের বুক ঢিপ ঢিপ করে । দিদিমা বা ঠাকুমা ওর হাত ধরে টান দেবার চেষ্টা করতেই ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কেমন যেন কৃত্রিম আওয়াজে কেটে কেটে বলে—এসব কিছু হবে না । কোন মেয়ে আমার পা ধোয়াবে না ।
একটা অস্ফুট স্বর। কেউ বললেন –ইয়ে হমারী প্রাচীন পরম্পরা হ্যায় বেটা, না নহীঁ করতে; অমঙ্গল হোগা।
রূপেশ নিজের বুকের ধকধক শুনতে পাচ্ছে।
--ও জব হোগা, তব দেখেঙ্গে। অব আপলোগ ইহাঁসে জাইয়ে; রাত বহোত হো গয়ী।
প্রাচীনার চোখে জল। ঊনি বিড়বিড় করতে লাগলেন। তৃতীয়জন বললেন—চলো রে, ছোঁড়াটার আর তর সইছে না।
রূপেশ বড়বৌদির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, ওঁর চোখে কেমন দুষ্টু হাসি। ঘর দ্রুত খালি হয়ে যায়। বৌদি যাবার আগে বলে যান—দেবরজী! পহলী রাত মেঁ হী বিল্লি মার না হ্যায়! ভুলনা মত!
রূপেশ ছিটকিনি লাগিয়ে বিছানায় পা তুলে বসে ঘামতে থাকে। বুকে আবার ধুকপুকি। সরলা ওর কাছে ঘন হয়ে আসে। ধুকপুকি বেড়ে যায়। রুপেশের কানে সরলার ঠোঁট , ওর সুগন্ধে ভরা নিঃশ্বাস। সরলা ফিসফিসিয়ে বলে—জানলার ওপাশে কয়েকজোড়া কান খাড়া হয়ে রয়েছে। আমরা আজ কিছু করব না। লাইট নেভাব না । খানিকক্ষণ গল্প করে দুদিকে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ব। কিছু ভেব না, সব হবে। আস্তে আস্তে।
ওরা গল্প করে। সরলা বলে ওর কলেজজীবনের কথা , আজ যে বন্ধুরা এসেছিল ওদের কথা। রূপেশ কলেজ প্রসংগ এড়িয়ে যায় , ও বলে ছুরি গাঁয়ের কথা, বারউৎসবের কথা, আহিরণ নদী, কোসগাই পাহাড় ও ঝোরাসিরকি গাঁয়ে পিকনিকের কথা। সরলা উদগ্র হয়ে শোনে, কিন্তু রুপেশ ভালুমার দ্রুপতীর গল্প এড়িয়ে যায় ।
ক’টা বাজে? আরে রাত তিনটে! এবার ঘুমুতে হবে। আমি দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুচ্ছি, তুমি ওদিকে ফিরে শোও।
রূপেশ পাশ ফেরে, কিন্তু কানে আসে ফিসিফিসানি। --তুমি পাশ করে গেছ, ম্যানেজার, উইথ ডিস্টিংশন। যেভাবে বুড়িগুলোকে ভাগালে! ওয়াহ! আমি অপেক্ষা করছিলাম। তুমি ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে গেলে আমি মুখ খুলতাম। চুল দিয়ে পা মোছা? মাই ফুট!
শেষরাতে জলতেষ্টায় রূপেশের ঘুম ভেঙে যায়। কেউ ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিয়ে একটা বেডল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়েছে ; মৃদু নীলচে আলো। অঘোরে ঘুমুচ্ছে সরলা। না; এখন ও পুরোপুরি নীলিমা।
জানলা দিয়ে কড়া রোদ্দূর বিছানায় এসে নানান নকশা তৈরি করেছে। এবার আঠা হয়ে লেগে থাকা চোখ খুলতেই হয়। বাইরের ঘরে হাসির হররা, গল্পগুজব, চায়ের আসর জমজমাট। রূপেশ মুখটুখ ধুয়ে টেবিলে আসতেই কোরাস—আ গয়ে! আ গয়ে!
নানান চিমটি কাটা উড়ো মন্তব্যের মাঝখানে রূপেশ চুপচাপ চায়ে চুমুক দেয়। ওর চোখ নীলিমাকে খোঁজে, কিন্তু কোথায় ও?
বাবা বারান্দায় বসে খবরে কাগজ পড়ছেন। বড়দা দরজার কাছে ডেকরেটার্সের বিল মেটাচ্ছে। এখন চায়ের টেবিলে শুধু অল্পবয়েসিদের গুলতানি। বিয়ে উপলক্ষে আসা কিছু রিস্তেদার ও মেহমান। বড়বৌদি এই আসরের মধ্যমণি। সরলা ওঁর তুতো বোন হওয়ায় উনি একাধারে বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি। একজন প্রগলভা মুচকি হেসে বৌদিকে বললেন— কল রাত কো ক্যা হুয়া? বিল্লি মারী গয়ী কি নহীঁ ? হ্যায় কোই খবর?
বৌদি মুখ ভ্যাঙচালেন—হুঁ; ইয়ে রৌয়া ক্যা বিল্লি মারেগা? মেরে পাস পাক্কি খবর—বিল্লা মর গয়া।
(এ ছোঁড়া কী বেড়াল মারবে? হুলোটাই অক্কা পেয়েছে, পাকা খবর।)
রূপেশ উঠে বাগানে চলে যায় ।
পরিবারের বড়ে বুজুর্গের অভিমত হল রূপেশ আগে ডিউটি জয়েন করে ছোটি বহুকে রাখার মত একটা ঠিকঠাক বাসস্থান খুঁজে নিক, তারপর বৌমা যাবে। বৌমার ভাই গিয়ে দিদিকে ছেড়ে আসবে।
ছুটি ফুরিয়ে এল। সরলা স্বামীর স্যুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছে। বলছে তাড়াতাড়ি ঘর খোঁজ, এখানে সারাক্ষণ ঘোমটা দিয়ে দিয়ে আমার ঘাড়ে গলায় ঘামাচি ভরে গেছে।
ওরা গিফট পেয়েছে অনেক। ইস্পাতনগরী ভিলাইয়ের লোকজন; সমানে স্টিলের বাসনকোসনই বেশি দিয়েছে । তিনটে নানা মাপের প্রেসার কুকার, কেক ওভেন, থার্মোফ্লাস্ক, টি- সেট, আরও কত কি । সরলার ইচ্ছে বেশির ভাগ এখানে রেখে যাবে, নেহাৎ যতটুকু দরকার তাই নিয়ে যাবে।
শাড়ি সালোয়ার কামিজ আগেই আলমারিতে তোলা হয়ে গেছল। এখন ও ছোটখাটো গিফটগুলো প্যাকেট খুলে খুলে আলাদা করে রাখছিল। দেবীদয়াল কোম্পানির স্টিলের চা-খাওয়ার মগ এখন নতুন ফ্যাশন। এটার এসেছে দুটো সেট। ও দুদিকে দুটো সেট রেখে বলল—এটা এ’বাড়ির জন্যে, অন্যটা ও বাড়ির, মানে আমরা নিয়ে যাব।
শাশুড়ি ঝাঁজিয়ে উঠলেন। এ’বাড়ি ও’বাড়ি আবার কি! সব তো একই—ইয়ে সমঝ লো বহু।
সরলা জবাব না দিয়ে শাশুড়ির চোখে চোখ রেখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল, উনি উঠে রান্নাঘরে চলে গেলেন ।
ঘোরাপাট কলোনিতে ২/২৮ নম্বর লেবার কোয়ার্টার চামার সায়ের নামে কয়লা কোম্পানির খাতায় চড়েছে একবছর আগে। রূপেশ দেখেটেখে বলল একবার চুণকাম করানো দরকার আর ব্লিচিং পাউডার ও সাবান দিয়ে গোটা বাড়ি, ভেতরের সিমেন্টবাঁধাই চাতাল –সব ভালো করে রগড়ে সাফ করা দরকার। কোথাও বৃষ্টির জলের দাগ, কোথাও শ্যাওলা জমে আছে। সামনের আঙিনায় কিছু আকন্দের চারা, বটের চারা এবং কাঁটাঝোপ গজিয়েছে। এসব কেটে ফেলতে হবে। এদিকে করেত আর চিতি সাপের উপদ্রব। চারদিকে এবং নালায় গ্যামাক্সিন বা নিদেনপক্ষে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিতে হবে। কোয়ার্টারগুলোর দুটো লাইন থেকে খানিক এগিয়ে রেললাইন শুরু হয়েছে। কয়লার ছোট ছোট ট্রলি এবং খোলা ওয়াগন চলার কোল ইন্ডিয়ার নিজস্ব ন্যারোগেজ।
তারপরেই আহিরণ নদী, এখানে ক্ষীণস্রোতা, রোগা ক্লান্ত ক্রনিক অ্যানিমিক চেহারা; ছুরি কাটঘোরার উচ্ছল আহিরণকে এখানে চেনা যায় না। কারণ, দশ কিলোমিটার আগে তৈরি হয়েছে বিশাল চেক ড্যাম, সেচের সুবিধের জন্যে। তাতে বিলাসপুর জেলার কৃষিতে এসেছে পরিবর্তন। বর্ষা কম হলেও খরিফের ধান মার খায় না এবং কিছু এলাকায় এখন রবি ফসল ও শাকসব্জীর চাষ হয়।ওখানে মিলেছে দুটি জলধারা—হসদেও আর আহিরণ।
আজকে ব্যাংকে ঢোকার মুখে রূপেশের মেজাজ বিগড়ে গেল। বাইরের দেয়ালে স্টেনসিল করে মাপা অক্ষরে লেখা ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর স্লোগানঃ “ দুলহন ডোলি মেঁ, নিরোধ ঝোলি মেঁ”।
(বৌ চড়েছে দোলায়, নিরোধের প্যাকেট ঝোলায়।)
এসব কি?
সাহাব, স্বাস্থ্যবিভাগ সে আদমী আকে লিখকে গয়ে।
তুই কী করছিলি মনবোধি? মানা করিসনি?
করে হন সাহাব, ও কহিস—সরকারি আদেশ, হর মকান কে দিওয়ার মা লিখনা জরুরী, হিসাব দেনা পড়থে, তব পগার মিলথে।
(সবকটা বাড়ির দেয়ালে লিখতে হবে, হিসাব মিললে তবে মাইনে পাব।)
লোকটা কে? ডেকে আন দিকি।
পান চিবুতে চিবুতে হাজির হল মঙ্গলরাম। বলল ওর কোন দোষ নেই। ভেলইবাজারে নতুন মিনি পিএইচ সি বা প্রাইমারি হেলথ সেন্টার খুলেছে। সেখানে ইনচার্জ ডাক্তার মহাকালেকর ওকে বলেছেন ব্যাংকের গায়ে যেন লিখতে ভুল না হয় ।কারণ ম্যানেজার সাহাব নতুন বিয়ে করেছেন। ওঁকে সতর্ক করা আমাদের পরম কর্তব্য। রোজ আসতে যেতে চোখে পড়বে, তাহলে ভুল হবে না। ডাক্তারসাহেব আরও বলেছেন ওটাকে জোর করে মুছতে গেলে দেয়াল নোংরা হবে। তারচেয়ে কিছুদিন থাক, পরে আমরা ওর উপরে নতুন শ্লোগান লিখে দেব।
রূপেশ দেখল চারপাশের সবাই মিটিমিটি হাসছে, এমনকি ওর ক্লার্ক এবং ফিল্ড অফিসারেরও দাঁত বেড়িয়ে এসেছে। ও আর এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। কিন্তু ফিল্ড অফিসার খান্ডেকে বলল মুভমেন্ট রেজিস্টারে এন্ট্রি করে ১৫ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি গ্রাম আমাখোখরাতে রিকভারি করতে যেতে হবে। অন্ততঃ সাতজন ডিফল্টার আছে। চাপরাশি মনবোধিকে সঙ্গে নিয়ে যাক । মোটরবাইকের ডিকিতে ইন্সপেকশন কার্ড, ডিপোজিট স্লিপ এবং অংগুঠা বা বুড়ো আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্যে স্ট্যাম্প প্যাড নিতে যেন না ভোলে।
বিকেল চারটে বেজে গেছে। ক্যাশ বন্ধ হয়ে গেছে। রূপেশ আর ক্যাশিয়ার নরেশ মিলে দিনের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছে—ডে বুক, ক্যাশ বুক, জেনারেল লেজার, পোস্টিং চেকিং। তারপর ক্যাশ মিলিয়ে সিন্দুকে ভরেছে কি হাসিমুখে মকান মালিক দাদুসাব এসে হাজির। আজ বোধহয় গল্প করার মুডে এসেছেন। নিজেই চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বললেন—দেখলাম এখন ভিড় প্রায় নেই। আর বিয়ে করে এসেছেন তারপর কথাবার্তাই হয়নি। ম্যাডামকে নিয়ে আসার পর একদিন কিন্তু আমার গরীবখানায় দুটি ভাত খেতে হবে, আগেভাগে বলে রাখলাম। এ নেমন্তন্ন আমি নয়, আমার ঠাকুরাইনের পক্ষ থেকে, না করতে পারবেন না।
আসলে চাপরাশি বুধরামকে চোর অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেয়াটা রূপেশ মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। ফলে ও এতদিন দাদুসাহেবের হাভেলি মাড়ায়নি।
আজ নতুন চাপরাশিও অফিসারের সঙ্গে তল্পিবাহক হয়ে ফিল্ড ভিজিটে গেছে। তাই রূপেশ নিজেই কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে দাদুসাবকে দিল। অবস্থা বুঝে উনিও নিজের গরু-মোষকে জাব দিতে থাকা কামিয়াকে ডেকে হুকুম করলেন—যা, ভেতর বাড়ি থেকে তিনকাপ চা বানিয়ে নিয়ে আয়। তাজা দুধ দিয়ে, মালাই শুদ্ধু।
নানান কথাবার্তার পর গলার স্বর নামিয়ে বললেন—সেদিন গিরিধারী পাটোয়ারি এসেছিল না? ও কিন্তু জলের উপরে যতটা তার চারগুণ নীচে; মহা গুরুঘন্টাল।
--কি যে বলেন! ও তো রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাওয়া পাটোয়ারি, এই জেলায় একমাত্র।
--আরে, পুরস্কার লোকে নানান নিয়মের ফাঁকে পেয়ে যায়। ঠিক আছে, চা এসে গেছে, চুস্কি নিতে থাকুন আর আমার গল্প শুনুন।পাঁচবছর আগের কথা, গিরিধারি এই রেভিনিউ সার্কেলে নতুন যোগ দিয়েছে। দুটো মাস গেল না ওর নামে চারদিক থেকে কমপ্লেইন। শিকায়েত গুলো বেশ সিরিয়াস। ও নাকি পয়সা খেয়ে কোন বিধবার জমি কোরবা শহরের কোন নগরশেঠকে বেচে দিয়েছে। ও সরকারে খাস জমি ডাইভার্সন করিয়ে বেনামে নিজের ছেলের জন্যে কিনেছে। চেন দিয়ে মাপার সময় বড়ভায়ের জমি ছোট ভায়ের অংশে দেখিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে তারপর শোধরাবার নাম করে দুদিক থেকেই পয়সা খেয়েছে। বিলাসপুরে অ্যাডিশনাল কলেক্টরের দপ্তরে ওর নামে একটা আলাদা ফাইল খুলে গেল। কিন্তু ওপরতলায় ওর এত সুনাম যে কেউ বিশ্বাস করল না , ভাবল কুচুটে হিংসুটেদের কারসাজি। ফলে কোন এনকোয়ারি হল না ।
এবার এল একটা কমপ্লেইন যে ও নাকি আহিরণ নদীর পারে ছোটকি ছুরি গাঁয়ে কোন আদিবাসীর জমি আদিবাসী নয় এমন কাউকে বেচতে সাহায্য করেছে, তার জন্যে রেভিনিউ রেকর্ডে কারচুপি করেছে। এই কমপ্লেইন আবার কোন এক আদিবাসী মহাসভা ফরওয়ার্ড করেছে। সবার টনক নড়ল। স্থানীয় সাব-ডিভিসনাল ম্যাজিস্ট্রেটের অফিস থেকে অনুসন্ধান দল এল। সমস্ত কাগজপত্র উলটে পালটে দেখল, অভিযোগকর্তাদের সবার সঙ্গে কথা বলল।
শেষে কী পেল? প্রত্যেকটা অভিযোগ মিথ্যে, এসব কিছুই হয়নি। আর যাদের নাম তারা কেউ অভিযোগ করেনি, ব্যাপারটা পুরো জালি। কী বুঝলেন?
--- মানে আগের ধারণাটাই ঠিক; কোন হিংসুটে স্বার্থপর কেউ—
মিটিমিটি হাসেন দাদুসাহেব—ম্যানেজার মহোদয়, আপনি কিস্যু বোঝেননি। অবশ্যি কলেক্টরের অফিসও কিচ্ছু বোঝেনি। আসলে ওই সব জাল শিকায়তগুলো পাটোয়ারি নিজেই করিয়েছিল – মানে প্রথম বছরে এবং নিজের বিরুদ্ধে। এর ফলে প্রশাসনের ধারণা হল যে গিরিধারি পাটোয়ারি একেবারে ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য ওর নাম পাঠিয়ে দেওয়া হল। যথাসময়ে পেয়েও গেল।
তারপরের বছর থেকে ও দেদার ঘুষ খেতে লাগল, তবে কাগজপত্রে সাবধান থাকত। যখন সত্যি সত্যি কমপ্লেইন গেল, রেভিনিউ ডিপার্টমেন্টের কর্তারা কেউ বিশ্বাস করল না। ভাবল সব জালি; এই পাটোয়ারি বড়জোর ডাল-ভাতের সঙ্গে নুন মিশিয়ে খেয়েছে।
বুঝলেন তো! একটু সামলে থাকবেন।
ইতিমধ্যে হাজির দুই শ্রীমান—ফিল্ড অফিসার খান্ডে ও মনবোধি চাপরাশি। মোটরবাইক থেকে নেমে হলে ঢুকে ব্রিফকেস টেবিলে রাখল। সাতহাজার চারশ’ টাকা রিকভারি এসেছে, আগামী দিনের অ্যাকাউন্টে এন্ট্রি হবে। কিন্তু দু’জনের দাঁত বেরিয়ে আছে, কিছু একটা মজার ঘটনা শোনাতে চায়?
--স্যার, আজ আপকে মনবোধি তো ফোড় ডালা। এক হোঁশিয়ারচন্দ কী বোলতী বন্দ করওয়া দী। এক উপরচালাকের মুখ বন্ধ করে ছেড়েছে।
রূপেশ কৃত্রিম গম্ভীর মুখে বলে—কী করেছিস রে মনবোধি? কোন ঝগড়া বাঁধাস্ নি তো?
ও মাথা নাড়ে। রূপেশ ফিল্ড অফিসারকে বলে- অ্যাই খান্ডে, তুই খুলে বল দিকি।
--স্যার, দশ কিলোমিটারের মাথায় ঘোগরা নালা আছে না ? তার পাশে একটা জায়গায় রাস্তাটা বড্ড সরু, দুটো সাইকেলও পাশাপাশি যেতে পারেনা। হয়েছে কি, উলটো দিক দিয়ে একটা সাইকেল আসছিল, কিছুতেই রাস্তা ছাড়বে না। এদিকে আমাদের রাজদুত মোটরবাইক কোনরকমে বেরিয়ে যাবে। ওই জায়গাটায় পিছিয়ে আসা মুশকিল। শুরু হল তক্কাতক্কি। মনবোধি বলল আমরা ব্যাংকের জরুরি কাজে যাচ্ছি। রাস্তা ছেড়ে দাও। সেই ওপরচালাক বলে কি বেশি ব্যাংক দেখিও না। গাঁয়ে থাকি বলে গেঁয়ো নই, আমিও গ্র্যাজুয়েট। কিসের গ্র্যাজুয়েট? বিএ? নাকি বি কম? ও বলল আমি ল’ গ্র্যাজুয়েট। মনবোধি মুখ ভেঙচে বলল—এঃ ল’ গ্রাজুয়েট! পুরো ডিগ্রিটা বল।
--এল এল বি; মানে ব্যাচেলর অফ ল’।
--ভুল; ব্যাচেলর অফ লজ। বহুবচন হোগা, কিঁউকি কানুন এক নেহি, অনেক হোতে হ্যায়।
হতভম্ব দেড় হোঁশিয়ার রাস্তা ছেড়ে দিল।
--সাবাশ! এটাতো সেলিব্রেট করার মত। যা, বনোয়ারির হোটেল থেকে আমার নামে এক পো ভাজিয়া (ফুলুরি) আর পাঁচটা চা নিয়ে আয়।
এমন সময় খান্ডে জিগ্যেস করে—স্যার, ভাবীজি কব পধারেঙ্গে? কমরে কা সাফ সাফাই পোতাই সব হো গয়া হ্যায়। ঘর পরিস্কার করা চূণকাম সব হয়ে গেছে।
--আগামী রোববার। আমার শালা নিয়ে আসছে।
দাদুসাহেবের চেহারা কোন অজ্ঞাত কারণে উজ্বল হয়ে ওঠে।
--তাহলে বহুজি আসার পরের রবিবার আমার বাড়িতে –দোপহর কা ভোজন? ইয়াদ রাখেঙ্গে না?
(চলবে)
0 comments: