0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১১ 


ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে প্রেমের কবিতার সম্ভার। এই দু:সময়ে বইপত্রের সন্ধানে বিফল হয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পেয়েছি তাই উপস্থিত করতে চাই সুধী পাঠকের সামনে। সংকলিত সাতজন কবির মধ্যে অনেকেই আমাদের পরিচিত নাম।

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস পেশায় চিকিৎসক, রাজনীতিতে বামপন্থী এবং পুঁজিবাদের তীব্র বিরোধী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যখন আমে রিকায় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে অবদমন এবং নির্যাতনের জোয়ার এসেছিলো, তার বিরুদ্ধে যে অল্প কয়েকজন কবিলেখক প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। “ম্যাকার্থিজম” মার্কিন রাজনীতির এক কুখ্যাত সময় যার ফলে ধ্বংস হয়েছে অনেক নিরপরাধ মানুষের সুনাম ও পেশা। তিনি চেষ্টা করেছিলেন রুখে দাঁড়াতে। মার্কিন কবিতায় ব্রিটিশ কবিদের গভীর প্রভাবের বিরুদ্ধে তাঁর সাহিত্যচর্চা। শিশুদের চিকিৎসক হিসেবেও তিনি সফল -- যে হাসপাতালে তিনি চার দশক চিকিৎসা করেছেন, সেখানে তাঁর মৃত্যুর পর একটি সম্মানফলকে লেখা রয়েছে, "We walk the wards that Williams walked." ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর নাম, “আমি একটা কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম”।

ডি এইচ লরেন্স বিংশ শতাব্দীর এক বিতর্কিত লেখক। শিল্পায়ন ও আধুনিকতার ফলে মানবসমাজ যে হারিয়ে ফেলছে তার আন্তরিকতা ও মানবিকতাকে, সেটাই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। “পুত্রেরা এবং প্রেমিকেরা“, “রামধনু”, “প্রেমে পড়া নারী”, “লেডি চ্যাটার্লির প্রেম”: এই লেখকের কয়েকটি যুগান্তকারী উপন্যাস। নি:সংকোচ আর স্বতঃস্ফূর্ত যৌনতা যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর, কথাসাহিত্যের মাধ্যমে সেই ভাবনাবিশ্বকেই তিনি তুলে ধরেছেন; শেষোক্ত উপন্যাসটি নিয়ে অশ্লীলতার দায়ে নিষ্ফল মামলা চলেছিল বহু বছর, প্রধান আপত্তি ছিল দুটি অপ্রচলিত ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার নিয়ে: একটি নারীতনু সংক্রান্ত এবং অন্যটি যৌনকর্মের ক্রিয়াপদ। দুটি শব্দই (“সি” এবং”এফ” যাদের আদ্যক্ষর) এখন সুভদ্র ইংরেজিতে জলভাত। ছোটোগল্প এবং উপন্যাসিকার জগতেও তিনি নতুন পথ দেখিয়েছেন; তাঁর রচিত কবিতা তুলনামূলকভাবে অবহেলিত।

সাহিত্যিক টমাস লানিয়ার উইলিয়ামস এর জন্ম আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যে, কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করার পর নাম পাল্টে করে নেন “টেনেসি”। তাঁর বাবার জন্ম প্রতিবেশী টেনেসি প্রদেশে, এবং তাঁর মৌখিক শব্দব্যবহারেও ছিল টেনেসির প্রাধান্য। প্রায় দু দশক ধরে তাঁর রচিত নাটকগুলি সুসমালোচিত, প্রশংসিত ও জনপ্রিয়; নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়েতে তাঁর একের পর এক হাউসফুল নাটক: “গ্রীষ্ম এবং ধোঁয়া” (১৯৪৮), “গোলাপি উল্কি” (১৯৫১), “রাজপথ” (১৯৫৩), “গরম টিনের ছাদে বেড়াল” (১৯৫৫), “অর্ফিউস নেমে আসছেন” (১৯৫৭), “উদ্যান জেলা” (১৯৫৮) এবং “যৌবনের মিষ্টি পাখি” (১৯৫৯)। একই সময়ে তাঁর নাটক অবলম্বনে একের পর এক চলচ্চিত্র। এলিয়া কাজান, যিনি লেখকের বেশির ভাগ নাটকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্ররূপ দেন, তিনি লিখেছিলেন, “তাঁর জীবনের বেশির ভাগ উপাদান রয়েছে তাঁর নাটকে, তাঁর নাটকের বেশির ভাগ উপাদান রয়েছে তাঁর জীবনে”। নিভৃত জীবনে তিনি সমকামী, কিন্তু সময়টা সমকামীদের পক্ষে সুখের ছিল না| তাঁর সাহিত্য শৈলির নাম “দক্ষিণের গথিক “। ১৯৮৩ সালে নিউ ইয়র্কের একটি হোটেল ঘরে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু, মৃত্যুর কারণ ড্রাগ্স বিষয়ক দুর্ঘটনা অথবা ওভারডোজ। তাঁর কবিতাগুলি নিয়েও সিরিয়াস আলোচনা হয়নি বিশেষ।

অন্য মার্কিন কবিদের সঙ্গে বিলি কলিন্সের একটা প্রধান তফাৎ: তাঁর কবিতা প্রথম পাঠেই বোঝা যায় এবং বেশ কয়েক হাজার কপি বিক্রি হয় তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ। কবিতার জটিলতম গঠন তাঁর ভীষণভাবে অপছন্দ, সেই সঙ্গে তার ধ্রুপদী, বিশ্লেষণমূলক আলোচনাও। হাই স্কুল পাস করা ছাত্রছাত্রীরাও যাতে তাঁর কবিতার সমঝদার হতে পারেন, সেই ভাবেই তিনি কবিতা লেখেন। কবিতায় হাস্যরসের জন্যে “মার্ক টোয়েন পুরষ্কার“ দেওয়া হয় প্রতি বছর, তাঁকে দিয়েই এই পুরষ্কারের সূচনা।

কোস্তা রিকার কবি আনা ইসতারু বাঁধনছেঁড়া কবিতা লিখে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ১৯৯০ এর দশাব্দে, এখন তিনি সেই দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি, নাট্যকার এবং নারীবাদী টিভিব্যক্তিত্ব। 

ইরাকের নির্যাতিত কবি দুনিয়া মিখাইল আমেরিকায় বাস করেছেন দু দশকের বেশি -- আরবি এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই কবিতা ও গদ্য লেখেন।

জশুয়া বেকম্যান মার্কিন কবি -- এক দশক আগে তিনি বাস পরিক্রমা করে কবিতা পাঠের আসর বসিয়েছিলেন পঞ্চাশটি শহরে।

সব মিলিয়ে সাত কবির বিচিত্র সমাবেশ। আসুন তাঁদের প্রেমের কবিতাগুলি উপভোগ করি:

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৮৩-১৯৬৩)


অমরত্বের প্রমাণ 

যত পুষ্প আছে এ ধরায়, তাদের সবার থেকে বীর,
স্বচ্ছ জহরত থেকে মূল্যবান, আকাশের সমান গভীর;
অমর ও অচঞ্চল: তাঁহার উত্তুঙ্গ শক্তি ডাকে
পার হয় যুক্তি, প্রেম, মানসিক প্রকৃতিস্থতাকে !

আর তুমি, হে প্রেয়সী, হলে সেই দেবোপমা নারী।
একই ঝলকে তার দুই রূপ, অলৌকিক এবং আনাড়ি।
স্বর্গের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে রত, বিক্ষত যে জুনো!
তার নাম অজ্ঞানতা, হে সুন্দরী, কান পেতে শুনো।

টীকা: জুনো: রোমের পুরাণের দেবী; গ্রিক পুরাণে তাঁর নাম “হেরা”। ভার্জিলের “এনেইড” মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র।

[পেশায় চিকিৎসক, কিন্তু জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সাহিত্যের সেবায়। “মডার্নিজম” এবং “ইমেজিজম”: এই দুটি সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা। বাবা ইংল্যান্ডের আর মা পুয়ের্তো রিকোর; বিটকবিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অ্যালেন গিন্সবার্গের “আর্তনাদ” কবিতার ভূমিকা লিখেছিলেন। কমিউনিস্ট সন্দেহে নানান সন্দেহ ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন ১৯৫০ এর দশকে।]


ডি এইচ লরেন্স (ইংল্যান্ড, ১৮৮৫-১৯৩০)

অবৈধ 

স্থিতপ্রজ্ঞ পর্বতের গায়ে, সরু ফিতের মতন রামধনু,
আর আমাদের মাঝে তুমুল ঝড়;
অনেক অনেক নিচে, সবুজ গমের ফাঁকে ফাঁকে শ্রমিকেরা 
হরিৎ বৃক্ষের মাঝখানে কালো ডাকটিকিটের মতন দাঁড়িয়ে।

কাছে রয়েছ তুমি আর তোমার খালি পা চটিতে,
এবং বারান্দার নগ্ন কাঠের গন্ধ পেরিয়ে 
তোমার চুলের ঘ্রাণ পাই; আর সেই মুহূর্তে 
স্বর্গ থেকে নামে অনাবৃত বজ্র আর বিদ্যুৎ।

হালকা সবুজ বরফ-গলা জলস্রোতে 
তমসায় কালো নৌকা -- কোনদিকে যায়?
বন্ধ হয় না বিদ্যুতের আওয়াজ। আমরা দুজনে একান্তে।
স্বর্গের নিরাবরণ বিদ্যুৎ আনমনে আকাশে আসে আর 
অদৃশ্য, চলে যায়। আমরা ছাড়া আমাদের কে আছে?
নৌকাটিও নেই আর।

[ডেভিড হারবার্ট লরেন্স তাঁর নামের আদ্যক্ষরেই পরিচিত। “লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক” এর লেখক হিসেবে যদিও তাঁর বিশেষ খ্যাতি, পয়ঁতাল্লিশ বছরের জীবনে তিনি লিখেছেন প্রচুর: উপন্যাস, ছোটোগল্প , প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, ভ্রমণকাহিনি , অনুবাদ ও অন্যান্য; অর্থাৎ কবিতাও; হ্যাঁ, প্রায় আটশোটি। বিংশ শতাব্দীর এক বিতর্কিত লেখক তিনি।]

টেনেসি উইলিয়ামস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১১-১৯৮৩)

দিন ফুরালো ভালোবাসার 

দিন ফুরালো ভালোবাসার 
কমতে থাকে আলো।
কোমলতা ভাঁজ করে সে 
তোরঙ্গে ঢোকালো।

আমার গায়ে মোটা কাপড় 
বৃষ্টিঘামে মলিন।
নীরব হাতে তোমায় দেখি 
বাঁধতে চুলের বেণী।

ছড়াল সেই নীরবতা 
উষ্ণ ও নিষ্প্রভ।
হাত বাড়িয়ে তোমার বাহু 
আবার কবে ছোঁব।

ভাঙতে চাই যা নিথর, তাকে 
বিফল হয়ে সাজাই।
(ফিসফিসানি ভাষাও কানে 
তীব্র ঢেউয়ে বাজে।)

মুহূর্তেরা পার হয়ে যায় 
ইচ্ছে তাদের থামে।
দিন ফুরালো ভালোবাসার 
অন্তপ্রহর নামে……

[বিখ্যাত মার্কিন নাটককার, জন্ম মিসিসিপি রাজ্যে। ইউজিন ও’নিল এবং আর্থার মিলার মিলে বিংশ শতাব্দীর তিন মহীরুহ। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “কাচের চিড়িয়াখানা” এবং ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত “ট্রামগাড়ির নাম অভিলাষ”: দুটি যুগান্তকারী অথচ জনপ্রিয় নাটক। কথাসাহিত্য আর নাটককে টেনেহিঁচড়ে পাশাপাশি দাঁড় করাতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যাও কম নয়। সংকলিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবির মরণোত্তর, ১৯৯১ সালে “পোয়েট্রি” পত্রিকায়।]


বিলি কলিন্স (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

সনেট 

দরকার আর কুল্লে চোদ্দোটি লাইন, এরপর তেরো,
আর এইটে শেষ হলেই আরো এক ডজন দিয়ে 
প্রেমের ঝড়ব্যাকুল সাগরে ভাসাতে পারি নৌকো,
তারপরে দশটি পড়ে থাকে শিমের বিচির মতন সারি বেঁধে।
এলিজাবেথিয় ঢঙে না গেলে খুব সহজেই করা যায় 
যদি ছান্দসিকের ঢাক পেটাতে জোরজার না কারো 
আর প্রতিটি লাইনের শেষ অন্তমিলের বায়না না ধরো,
বধদণ্ডের প্রতিটি গাঁটের জন্যে একটি একটি করে।
কিন্তু শক্ত করে হাল ধরো -- আমরা এমন মোড় নিচ্ছি 
শেষ ছ’ লাইনে হয়ে যাবে সব সমস্যার সমাধান,
আকাঙ্খা ও বুক ধড়পড়ানির সমাপ্তি, যেখানে 
লরা বললেন পেত্রার্ককে -- কলমটা নাবাও এবার ছাই,
মান্ধাতার আমলের জংলি টাইট জাঙিয়াটি ছেড়ে ফেলো,
আলো নিভিয়ে দাও আর শেষমেশ উঠে এস বিছানায়।

[কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছাকাছি আনতে সারা জীবন চেষ্টা করেছেন বিলি কলিন্স: তাঁর কবিতা গভীর অথচ সহজবোধ্য, তাঁর আগে যেমন ছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্টের পোয়েট লরিয়েট ছিলেন দু বছর। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের সভাকবি খেতাব পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। নিউ ইয়র্কের স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। কাব্যগ্রন্থ বিপণনের সংখ্যায় তিনি আমেরিকার জনপ্রিয়তম কবি।]

আনা ইস্তারু: (কোস্তা রিকা, ১৯৬০- )

যোনির পাপড়ি মেলো 

যোনির পাপড়ি মেলো
ভীরু, নতমুখ ফুলের মতন 
খিড়কির দরজা খুলে 
যাতে 
পালাতে পারে সহনশীল সাঁতারু,
থামো, বাধা দিও না,
ভঙ্গুর নৃত্যের তালে এগোও,
সাহসে ভর দিয়ে দাঁড়াও,
শূন্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ঝুলবারান্দায় 
গর্ব করে দেখাও তোমার জেরানিয়াম পুষ্পগুচ্ছ 
প্রকাশ করো 
তোমার গভীরতার রহস্য। 

পালতোলা নৌকাটিকে ঢুকতে দাও 
বাধা দিও না 
তোমার বিদায়বার্তা 
বিদ্ধ করবে উত্তুরে বাতাসের মতন,
তোমার জঘনকে ভিত করে 
বানাবে তার শীতল বাসগৃহ।

যোনির পাপড়ি মেলে ধরে 
জলপ্রপাতে পরিণত হও,
ভুলে যাও শোক দু:খ।
তোমার দিবাস্বপ্নের শিশুটির জন্যে 
খুলে ধরো তাকে।

সাহসে ভর দিয়ে 
খুলে দাও ফ্লাডগেট 
দ্যাখো, আসে মধু মাখানো ললিপপ,
আর আসে জন্তুটা 
ঝোড়ো বাতাসের মতন কাঁপতে কাঁপতে,
আর ওই কুঁচকে যাওয়া ফলদুটো 
নিমজ্জিত হবে তোমার আলোকিত ক্রোধে,
দুচোখ বন্ধ করে হরিণের মতন খুঁজবে 
দিবসের দুই স্তন,
বাতাসে আন্দোলিত তাদের বৃন্ত।

[মূল কবিতার নাম: “ওপেন আপ, জেনিটালিয়া”; ইংরেজি অনুবাদ আন্দ্রেস আলফারো।]


কামনার মুহূর্ত (নির্বাচিত অংশ)

।।১।।

কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি,
ঘুমন্ত প্রেমিক!
কোন মেঘ উথলে ওঠে তোমায় ঘিরে 
কোন ময়ূরপঙ্খী!
কে তোমায় অনুমতি দিল ছড়ানোর 
নীল পদ্মের দল,
কে তোমার ত্বকে ছড়িয়ে দেয় 
রুপালি পাখির পালক।
আমার শয্যায় শুয়ে থাকো দ্বিধাহীন 
পথ ভোলা দেবদূত,
যেন রাজার সকাশে উপস্থিত।
মানুষটাকে বুঝি না আমি 
নিশ্ছিদ্র, সম্পূর্ণ।
ঘুম আসে না: আমার চাদর 
ঝোড়ো হাওয়ায় নৌকার পাল,
ল্যাভেন্ডারের সুবাস বয়ে আনে।
আমার বালিশ 
সিন্ধুসারসের মতন পাড়ি দেয় আকাশে।
খাটের নীচে পুরানো জুতো,
দুটো সামুদ্রিক প্রাণী।

এই যে খুদে মানুষটা,
গায়ে একটা গোলাপের পাপড়ি পর্যন্ত নেই।
আমার দু হাত কেন উড়ে যায় 
তার চিনেমাটির বাটিতে অসতর্ক 
টোপা কুলদুটোর দিকে।
কী হতাশা 
এই নাগরকে দেখা সমাপ্ত হলে 
ধরায় আর কিছু দ্রষ্টব্য থাকবে না।
কোথায় পেলে তুমি ওই বৈঞ্চি ঝোপ ভুরু, 
আর বুকের দুটো তামাটে কানাকড়ি?
তোমার নরম চুলে হাত দিলে 
জীবনে ভেলভেট ছুঁতে চাইবো না আমি,
কোথায় কলসি-দড়ি, কোথায় চুম্বন,
তোমার ওষ্ঠবিহীন আমি নদীতীরে একা,
ঘুমন্ত মানুষ।
স্বপ্নে তোমায় ছাড়া 
সোনার থালায় রুটিও বিস্বাদ লাগে।


।।২।।

দ্বিতীয়ার চাঁদ

আমার দুই ঊরুর ফাঁকে।

তোমার জঘনে জ্বলে 
তেজি অশ্ব, সকালের সূর্য।

আমার স্বামী এক ঘুঘুপাখি
পাকা তালের মতন গোলগাল।

আমি তার অদূরে স্ত্রী 
ধনীর আবাসে ঘোরানো সিঁড়ির মতোই সম্ভ্রান্ত।

আমার জ্ঞানী মানুষটার শরীরে 
কুচকুচে কালো খরগোশ একটা।

আমার ভেতর শুয়ে থাকে দিগন্ত 
বক্রতা আর পাকা পেয়ারা সমেত।

তার শরীর আর আমার দেহ মিলে 
সন্ধি আর সম্পর্কের অক্ষ।

দুটি তোড়ায় একই কৃষ্ণচূড়া 
কালো কালির টানে।

দ্বিতীয়ার চাঁদ আমার 
দুই ঊরুর ফাঁকে।

তোমার জঘনে জ্বলে 
তেজি অশ্ব, সকালের সূর্য।

।।৩।।

স্বপ্নে তোমার লিঙ্গ 

নীল ডেইজি ফুলের মতন গড়াতে গড়াতে 
আমার পাতা অন্ধকার ফাঁদে এসে থামে।
শান্তি,
সঙ্গমের পর 
সিল্কের মৃদু ছোঁয়া।

[প্রকৃত নাম: আনা সোতো মারিন; নারীবাদী কবি, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব; নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেন প্রেম, যৌনতা ও নারীর সমতা; সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন: “My style of writing does not look for the objectivity, is scandalously subjective with eagerness to seduce the reader with games of words, rhythms, but, especially, with ideas.” কবিতাগুলির এসপানিওল থেকে ইংরেজি অনুবাদ শন টি গ্রিফিন এবং এমা সেপালবেদা-পালবিরেনতি।] 


দুনিয়া মিখাইল (ইরাক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৬৫- )

ছবি আঁকা

নারীটি তার পুরুষের নাম দিয়েছিল “নদী”
নিজেকে সে বলতো “মাছ।”
একদিন সে তার প্রেমিককে ছবি এঁকে পাঠালো 
ডাঙায় উল্টে পড়ে থাকা একটা মাছের --
সঙ্গে একটা নদী: তার ওপরে ইংরেজি “এক্স” 
অক্ষরের কাটাকুটি।
বিরহে শুকিয়ে থাকা প্রেমিকের দুশ্চিন্তা বাড়লো,
এই ছবির মানে কী সে তার 
প্রেমিকার চোখে মৃত, অথবা 
প্রেমিকা ভাবছে 
তাকে সঙ্গে না পেলে তার 
বেঁচে থাকা বৃথা।

শিলালিপি (অংশ)


।।১।।

আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তকে
যদি ফোটোকপি করে রাখতে পারতাম 
তার ভেতর ভোরে দেওয়া যেতো 
আমাদের দিন আর রাতগুলি।


।।২।।

চাঁদ চলে যায় 
পৃথিবীর ওপারে 
আমার মনের মানুষের সন্ধানে।


।।৩।।

ঋতুর সঙ্গে রঙ বদলায়,
তুমিও আসো আর যাও।
তোমার বিদায়ের রং কী?



।।৪।।

বলেছিল সে, 
“তুমি রয়েছো আমার নয়নে।”
এখন সে ঘুমিয়ে পড়লে 
আমি আশ্রয় নিই তার চোখের পাতায়।


।।৫।।

লোকে বলে, প্রেম মানে 
সবগুলি ডিম 
একই ঝুড়িতে রাখা।
যদি ভেঙে যায় সবগুলো ডিম 
ঝুড়িটার কী হবে?

[কবির জন্ম ইরাকে। “বাগদাদ অবজার্ভার” সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করতেন। সাদ্দামের বিরোধিতা করার জন্যে সরকারি রোষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথমে জর্ডন এবং পরে আমেরিকা। একই কবিতা তিনি ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখেন আরবি ভাষায়, আবার বাঁদিক থেকে ডানদিকে লেখেন ইংরেজি ভাষায়। সেগুলি অনুবাদ নয়, সেগুলি দুই ভাষায় লেখা মৌলিক কবিতা। বর্তমানে মিশিগান রাজ্যে আরবি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন;]

জশুয়া বেকম্যান (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭১- )


[শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবি]

বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবি
তোমার কুৎসিত, জনমানবহীন, দমবন্ধ করা এপার্টমেন্ট
আর তোমার দুটো চোখ। দুপুর বারোটা এখন, এবং ক্লান্ত আমি
বাকি দিনটার জাগরুক সময়ের দিকে তাকিয়ে কিছুই
অনুভব করি না, বিস্ময় অথবা সমীহও নয়, কেবল
বস্তুকণা ও তরঙ্গের উপস্থিতি টের পাই, কেবল সেই
সীমিত আর সুচিন্তিত মানবিক পর্যবেক্ষণ। 
তোমার সরু সরু আঙুলগুলির মুখোমুখি,
গলতে থাকে আমার দৃঢ় সক্ষমতা। মেলে ধরো একান্তে
তোমার শ্বেতশুভ্র, পবিত্র শরীর আর অপ্রস্তুত 
মৌমাছির মতন ডানা কাঁপিয়ে উড়ে উড়ে 
আমাকে সন্তর্পণে গিয়ে বসতে অনুমতি দাও সেখানে।
এক লাবণ্য আর এক স্বাচ্ছন্দ্য। এক দৃশ্য আর এক
সহজ সৌন্দর্য। তোমার সম্মোহনের জালে আবদ্ধ।
পথ কোথায়? তোমার গভীরে ডুবে যাই আমি।
এইভাবে দুজনকে সঞ্চারিত হতে হয়, আমরা এখন
এক উদ্যানের অংশবিশেষ, এই দৃশ্যাবলীর শরিক, 
তার মানে, আমরা পৃথিবীর সেই অংশের বাসিন্দা,
যার কথা বিশ্বাস করে না কেউ।

[মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। আটটি কাব্যগ্রন্থ; ২০০৬ সালে “কবিতার বাস পরিক্রমা” চালু করেছিলেন। ৪০ ফুট লম্বা আর বায়ো-ডিজেলে চালানো বাসটি উত্তর আমেরিকার ও কানাডার ৫০ টি শহরে ঘুরে ঘুরে কবিতা পাঠের আসর চালু করেছিল প্রতিদিন একটি করে; কবিতাটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত “ঝাঁকুনি” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে|]

জুলাই ২০২০ [ক্রমশ:]

0 comments: