5

ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি - অভীক মুখোপাধ্যায়

Posted in


পদ্মনাভ দিব্যদেশম

বিষ্ণুসহস্রনাম আসলে একটি ব্যঞ্জনা। তাঁর অনন্ত নামরাজির মধ্যে থেকে গুটি কয়েককে চয়ন করে নিয়ে তৈরি একটি সীমিত সূচী। সেখানে শ্রদ্ধানত হয়েছে মানুষের উদ্যোগ। 

কে করেছিলেন? 

পিতামহ ভীষ্ম। নিজের পৌত্র যুধিষ্ঠিরের জন্যে বেছে দিয়েছিলেন সহস্র নাম। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বিষ্ণুর নাম মাত্র এক সহস্র। কখনোই নয়!

কিন্তু তবুও এই সূচীটাই বিষ্ণুভক্ত মানুষের মনের শান্তি। যাক গে বাবা, এই এক সহস্র নামটাও তো পেলাম। এই শ্রমসাধ্য নামতালিকাতে মোট পাঁচবার ‘নাভি প্রকরণ’-এর উল্লেখ রয়েছে:

উনিশতম শ্লোক,

চৌত্রিশতম শ্লোক (দু’বার),

একান্নতম শ্লোক এবং

আটান্নতম শ্লোক।

এগুলিতে মোট তিনবার পদ্মনাভ, একবার হিরণ্যনাভ (নাভি থেকে ব্রহ্মাকে প্রকটকারী) এবং একবার রত্ননাভ (যার নাভিই সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন) বলা হয়েছে।

এই ভারতে বুদ্ধিপিশাচদের অভাব নেই। অনেক বুদ্ধিপিশাচ এই পদ্মনাভর উল্লেখকে মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত বলেন। হয়তো তাঁরা জানেন কিংবা জানেন না যে এই তিনটি ‘পদ্মনাভ’-নামের তিনটি পৃথক অর্থ রয়েছে।

উনিশতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যার নাভি থেকে কমল পুষ্প জন্মায়।

চৌত্রিশতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যার নাভি কমল পুষ্পের মতো।

আর তৃতীয়টায়? সেখানে কিন্তু পদ্মনাভ শব্দের অর্থ একটু গূঢ়। গম্ভীর। প্রভুর ভক্তবাৎসল্যের রূপ।

একান্নতম শ্লোকে পদ্মনাভ মানে, যিনি নিজের ভক্তদের পদ্মফুলের মতো হৃদয়ের কেন্দ্রে বা নাভিতে বিরাজ করেন। 

মহাত্মা ভীষ্ম নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা দিয়ে এই নাভি প্রকরণের উল্লেখ করে গেছেন। কিন্তু তিনিও মানুষ। সাধ্যের অতীত কাজ করতে পারেন না। তাঁর প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ বলে দক্ষিণভূমির অন্তিম তটীয় নগরীর বুকে বিরাজমান মহাবিষ্ণু প্রথমে উল্লেখিত পদ্মনাভর মূর্তরূপ, যার নাভি থেকে ফোটে পদ্মের ফুল। 

‘দিব্যদেশম’ তামিল ভাষার প্রাচ্য ধার্মিক সাহিত্যের সবথেকে বড় মান্যতাগুলির মধ্যে একটি।

এই মান্যতার জন্ম হয়েছে দিব্যপ্রবন্ধম থেকে। একে তামিল ভাষায় সংগৃহীত বৈষ্ণব-বেদ বলা হলেও তা অত্যুক্তি হবে না। এতে মোট বারো হাজার বৈষ্ণব সন্তদের দ্বারা বিরচিত চার হাজার পদ্য স্থান পেয়েছে। তা শ্লোক হতে পারে, মন্ত্র হতে পারে, দোহা চৌপাই সোরঠা ইত্যাদি ছন্দ হতে পারে।

মোট চার হাজার পদ্য থাকায় একে নালায়ির দিব্যপ্রবন্ধম বলা হয়। তামিলে নালায়ির মানে চার হাজার।

এই দিব্যপ্রবন্ধমে যত বিষ্ণুমন্দিরের উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলিকেই বলা হয় দিব্যদেশম। 

এমন মন্দিরের সংখ্যা কত?

একশো আট।

এই একশো আটটি মন্দিরের মধ্যে একশো ছয়টি পৃথিবী পৃষ্ঠে বিরাজমান। বাকি দুটির অবস্থান ব্রহ্মাণ্ডের অন্যত্র কোথাও। একশো ছ’টির মধ্যে আবার একশো পাঁচটি ভারতে এবং একটি নেপালে। নেপালে অধিষ্ঠিত মন্দিরটি হল মুক্তিনাথ শালিগ্রাম। 

উত্তর ভারতের বুকে রয়েছে আটটি দিব্যদেশম। উত্তরপ্রদেশে চারটি, উত্তরাখণ্ডে তিনটি, গুজরাতে একটি। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা চলে যে, অযোধ্যাভূমিতে শ্রীরামজন্মভূমিকে তামিলের দিব্যপ্রবন্ধমে একটি দিব্যদেশমের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য পড়ে চমকে উঠতেই হয় যে কারা উত্তর আর দক্ষিণের মধ্যে ভেদাভেদের পশুটাকে জলপানি জোগায়?

সবথেকে বেশি সংখ্যক দিব্যদেশম আছে তামিলনাড়ুতে। মোট পঁচাশিটি। কেরলে এগারোটি। অন্ধ্রে দুটি। কেরলের একাদশ দিব্যদেশমের মধ্যেই একটি হল পদ্মনাভস্বামী। জনপদের নাম তিরুবনন্তপুরম।

অনন্তপদ্মনাভস্বামীর মন্দির দ্রাবিড় মন্দির স্থাপত্যশৈলীর আধারে নির্মিত হয়েছে। 

কত কিংবদন্তী! শোনা যায় যে, শেষনাগের ওপরে অধিষ্ঠিত মহাবিষ্ণুর এই পদ্মনাভ মূর্তির মূলস্থান আসলে কেরলেও কাসরগোড জনপদে স্থিত একমাত্র হ্রদ-মন্দির, যেখানে একটি নিরামিষাশী কুমীর ছিল মন্দিরটির প্রধান রক্ষক। সেখান থেকেই মার্তণ্ড বর্মা এই মূর্তিটিকে নিয়ে আসেন।

যেহেতু এই মন্দিরের নির্মাণে চের সাম্রাজ্যের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, তাই অতি সঙ্গত ভাবেই স্থাপত্য কলায় চের প্রভাব লক্ষণীয়। যেমন উঁচু পাঁচিলের পিঠে অধিষ্ঠিত গোপূরম, নির্মাণে তিরুবত্তরের আদিকেশব মন্দিরের হুবহু প্রতিকৃতিকরণ।

ত্রাভাংকোর রাজবংশ আসলে চের রাজবংশের শাখা। চের-দের বলা হয় কেরল-পুত্র। এমনি এমনি বলা হয় না, এর পেছনে আছে দুহাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস। ত্রাভাংকোরের রাজবংশ নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো একটা বইও কম পড়বে।

বর্তমান পরিদৃশ্যের ইতিয়াশ সতেরশো পঞ্চাশ সালের পৌষ –মাঘের সন্ধিক্ষণে চাপা পরে গেছে। যখন মহারাজ ত্রাভাংকোর মার্তণ্ড বর্মা নিজের রাজ্যকে পদ্মনাভ স্বামীর হাতে সঁপে দিয়ে নিজেকে এবং নিজের সকল উত্তরপুরুষকে ‘পদ্মনাভ দাস’ বলে ঘোষণা করেছিলেন।

আজও ত্রাভাংকোরের মহারাজ এই উপাধিই ধারণ করেন। এখনকার মহারাজের সম্পূর্ণ নাম: শ্রী পদ্মনাভ দাস শ্রীমূলং রামা বর্মা। তাঁর পুত্রও এই উপাধি নেবেন। পৌত্রও। প্রপৌত্রও।

পদ্মানাভস্বামী মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব ফিরে পেয়ে ত্রাভাংকোর রাজবংশ যে সম্মান পেল, তা কেবল উচিৎ নয়, তা কেবল রাজনৈতিক নয়, তা কেবল অনায়াস নয়, তা হল মহাবিষ্ণুরপ্রতি সমর্পিতপ্রাণ কেরল-পুত্রদের মহান চের পরম্পরাকে ভারতভূমির নতশির অভিবাদন। 

5 comments:

  1. আপনার লেখায় মন্তব্য করা বাতুলতা মাত্র।আপনার লেখার সামনে আসলে আমার মনে হয় বুঝি বিরাট এক পর্বতের পাদদেশে এসেছি। পড়ি আর ভাবি। শত সহস্র বছর আগের চিত্র এসে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সম্মোহিত হই। অসাধারণ বললেও কম বলাই হয়।

    ReplyDelete
  2. দূর্দান্ত লাগলো লেখাটা। এটা আগের লেখাগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম পুরো লেখাটা। অনেক নতুন তথ্য জানতে পারলাম এই লেখাটা থেকে।

    ReplyDelete
  3. ভীষণ ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো

    ReplyDelete