ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক৬ষ্ঠ পর্ব)
দেখতে দেখতে বর্মায় প্রাকমৌসুমী বর্ষা শুরু হয়ে গেল। পেগু, পেডং, মান্দালয় সহ উত্তর বর্মায় কদিনের একটানা বৃষ্টিতে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত। পার্বত্য এলাকায় মাঝে মধ্যেই ধস নেমে ন্যূনতম যানবাহন চলাচলের পথটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শরৎ তারই মধ্যে নিয়মিত অফিস যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন কামাই করলেই বেতন কেটে নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। সামনে অনেক খরচ আসন্ন। শান্তির যে কোন দিন প্রসববেদনা উঠতে পারে। শেষ পর্যায়ে এসেও কিছুতেই তার রক্তাল্পতাটা সারছে না। আজকাল তার ফ্যাকাশে চেহারায় কন্ঠার হাড়গুলো উঁচু হয়ে প্রকট হয়ে থাকে আর বাড়ছে চোখের নীচে কালির পোঁচ। এই কদিন আগেও দুজনে ডকের কাছে বেড়াতে গেছেন। এখন পূর্ণগর্ভ শান্তির ক্ষীণজীবনীশক্তি আর অজানিত আলস্যের কারণে সে বেচারা বিছানায় শুয়েই থাকে বেশী সময়। শরৎ তাই নিজেই দুজনের জন্য দুমুঠো যা হোক ফুটিয়ে নেন বা কখনো বাজারের হোটেল থেকে কিছু খাবার কিনে এনে কোনওমতে সংসার চালাচ্ছেন। যদিও সুরেশ অভয় দিয়েছে যে শেষ অবধি সবই ভালোয় ভালোয় উতরে যাবে।
অফিসে টিফিনটাইমের সময় যতীন হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে। বলে শান্তির প্রসবের ব্যথা উঠেছে, 'দা'ঠাউর চলেন গিয়া!' সেদিনকার কাজ ফেলে রেখেই শরৎ কোনওমতে বাসায় এসে পৌঁছে দেখেন পল্লীর অন্য মেয়ে বৌয়েরা ততক্ষণে জড়ো হয়ে আছে তাঁর ঘরে। শোবার ঘরের একদিকে একটা চটের পর্দা খাটিয়েই আঁতুড়ঘরের আয়োজন করে শান্তির প্রসব করানোর চেষ্টা করছে মোতিয়া নামের এক বিহারী বৌ। সে এই এলাকার প্রসূতিদের ধাত্রীর দায়িত্বটি সামলায়। অনেকক্ষণ ধরে শান্তির গোঙানী শোনা যাচ্ছিল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পরে বেড়ালছানার মত মিউমিউ করে একটা আওয়াজ কানে এল। ক্রমশ সেটা তীব্র হয়ে মানবশিশুর কান্নার শব্দে পরিণত হল অল্পক্ষণেই। পর্দার আড়াল সরিয়ে একমুখ হাসিতে ভরে মোতিয়া তার পেতলের দাঁতটির ঝলক দেখিয়ে বলে -
'এ বঙ্গালী বাবুয়া! বেটাছেল্যা হুয়া রে তুর! দুটা টাকা জেয়াদা বখশিস্ হামি লিবে কিন্তু হাঁ! '
শরতের বুকের ভিতর যেন ঢেউ ওঠে! তার আবার সন্তান! এ যেন অবিশ্বাস্য। সমস্তকাল শুধুই অনাদর আর বিচ্ছেদের ঘটনাপ্রবাহ এতদিন জীবনভর ধরে দেখেছেন। আজ তার পরিবর্তে একটা নতুন প্রাণ, একটা নতুন জীবনের সূচনা শুধু তারই জন্য তাহলে নতুন প্রত্যুষের মত অপেক্ষা করছিল? ভেবে দেখলে এ যেন সত্যি করে বিশ্বাসই হয় না। শান্তি তাকে এ কোন অভাবনীয় দানে ঋণী করল আজ?
খানিকপরেই শরৎ ব্যস্তসমস্ত হয়ে পুত্রমুখ দর্শন করলেন। সুরেশ আপাতত শান্তির পরিচর্যায় বিশেষ মনোযোগী। প্রসবকালীন রক্তপাত সামান্য বেশী হওয়ায় সে স্বভাবতই কাহিল আর তার নাড়ীর গতিটিও ক্ষীণ। তারমধ্যেই শরৎকে দেখতে পেয়ে একটি ম্লান হাসির রেখা চকিতে তার ওষ্ঠরেখায় একটু ঝলক দিল।
শরতের তার উনত্রিশ বছরেরজীবনে হয়তো প্রথমবার আজ সেই বিপদতারণ ঈশ্বরটিকে প্রণাম জানালেন। আজকের আষাঢ় মাসের এই একুশ তারিখটি চাইলেও শরৎ আর কোনওদিনই ভুলে যেতে পারবেন না।
শান্তি প্রসবের এই ধাক্কাটা সামলে উঠতে আরো মাস চারেক সময় নিল। শরৎকে একদিকে সদ্যজাত শিশুপুত্রটির যত্ন অন্যদিকে অসুস্থ শান্তির পরিচর্যা এই দুই কাজের অনভিজ্ঞতা হেতু একটু বিপাকেই পড়তে হল। শান্তির বুকে সেরকম দুধ আসেনি। প্রসবের সাতদিনের পরেই দুর্বল স্বাস্থহেতু বোধহয় তার মাতৃধারাটি বন্ধ হয়ে গেছে। শরৎদের পাশের বাড়ির লুসাং ডুং এর একটি আসবাবপত্রের ছোট কারখানা আছে। ওর বউটিও কয়েকমাস আগেই তাদের চতুর্থ সন্তানটির জন্ম দিয়েছে। সেই বর্মী স্ত্রীলোকটিই সামান্য অর্থের বিনিময়ে আপাতত শান্তি আর শিশুটির পরিচর্যার ভার নিল। সে শরৎের পুত্রটিকে নিজের সন্তানটির সাথেই স্তন্যপানও করায়। পৃথিবীতে মাতৃজাতির অপত্য স্নেহের বোধহয় কোনও বিভেদ হয়না। আর তার শিশুটিও কি পরম নির্ভরতায় তার বর্মী মাতৃস্বরূপার বৃন্তে মুখ রেখে অভূতপূর্ব মায়াদৃশ্য রচনা করতে করতে তার কোলেই ঘুমিয়ে পরে।
এদিকে বাটাভিয়া থেকে মহাতাপ সিং এর একটি চিঠিতে মহিমের হঠাৎ গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পেলেন শরৎ। ইনসিন্ থেকে বাটাভিয়া যাওয়ার পথেই এক বাক্স জার্মান মাউজার পিস্তল সহ তাকে পুলিশ ধরেছে। দলের মধ্যেই ব্রিজেন্দর সিং বলে একজন সম্ভবতঃ চরবৃত্তি করে পুলিশকে এ খবর আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছে বলে ওরা সন্দেহ করছে । এই পিস্তলগুলি ভারতবর্ষের বিপ্লবীদের গোপনে পাঠানোর ভার মহিমের ওপরই ছিল। ওখানে অরবিন্দ ঘোষ আর তার ভাই বারীন তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন উদ্যমী পুরুষ মিলে অনুশীলন সমিতি নামে একটা সংগঠন পরিচালনা করে। ব্যায়ামচর্চা, লাঠিখেলা আর নানারকম সামাজিক কাজকর্মের আড়ালে তারা ইংরেজবিরোধী সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থানের ক্ষেত্রটি একটু একটু প্রস্তুত করছে। এই সময়ে ওই অস্ত্রগুলো ওদের হাতে পৌঁছে দিতে পারলে বিপ্লবের কাজে একটু গতি আসত। আচমকা ধরা পড়ে যাওয়ায় তা যে ব্যাহত হল, তা বলাই বাহুল্য। অবশ্য তলোয়ারকর খুবই আশাবাদী হয়ে শরৎকে জানায় মহিমকে আটকে রাখার মত জেল এখনো ইংরেজরা বানাতে পারেনি। খুব শীঘ্রই পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে সে যে পালাতে সক্ষম হবে, এ বিষয়ে সে অন্ততঃ একশো শতাংশ নিশ্চিত।
শরৎদের বিবাহিত জীবনটি সবে দুবছর অতিক্রম করেছে। ইচ্ছা থাকলেও অর্থানুকূল্যের চাপেই মূলতঃ আর দেশে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে নিয়মিত অর্থ পাঠিয়ে যে কটি টাকা উদবৃত্ত থাকে তা দিয়েই সংসার চালাতে হয়। বইগুলি যে কটি প্রকাশিত হয়েছে তার অর্থ রয়্যালটি বাবদ বছরে একবারই সম্মীলিত ভাবেই প্রাপ্ত হয়। এখানে এবার একটি নিজের বাড়ি কেনবার শখ হয়েছে শরৎের। তাই সেইসব অর্থ তার উদ্দেশ্যেই সঞ্চিত হচ্ছে। এরমধ্যে 'বিরাজ বৌ' এর গ্রন্থস্বত্বটি প্রকাশককে দুশো টাকায় সাতপাঁচ ভেবেই বিক্রী করেই দিলেন। আসলে পত্রিকাগুলিতে এতদিন ধরে প্রকাশিত লেখাগুলির কোনওটাই তাঁকে যশোপার্জন ছাড়া অর্থোপার্জনে তেমন সাহায্য করতে পারেনি। ভারতবর্ষ আর যমুনা এই দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনবাবদ আয় কম। তাও তারা তাদের কপি বিক্রির লভ্যাংশ থেকে অনিয়মিত কিছু টাকা শরৎকে দিতে পেরেছে তা তো সত্যিই অস্বীকার করার নয়। প্রমথবাবুকে একটি ছোট জবাবী নোটে বেশ ঠাট্টা করেই শরৎ লিখলেন-
" আজ ২০০্ পেলাম! ছোটগুলোও পাঠাচ্ছি। লোভে পড়ছি নাকি, তাও অাবার ভাবছি। শুনি সাহিত্যিকের মৃত্যু ইহাতেই ঘটে....।"
এই চিঠিতে যে 'ছোটগুলোও পাঠাচ্ছি' আছে সেগুলো হ'ল 'রামের সুমতি', 'বিন্দুর ছেলে' ও 'পথ -নির্দেশ' গল্প তিনটি।
শরতের জীবনে কখনোই সুখ বস্তুটি নিরবিচ্ছিন্ন নয়। জীবনের প্রথমদিন থেকেই পথের দেবতা জীবনের ধারাপথে শরৎকে সততই ধন্য করেছেন বিচ্ছেদের প্রসাদে। তাঁর দরদী মনটি গঠিত হয়ে ওঠার আড়ালে সর্বদাই নিঠুরের নিঃশব্দ অক্ষপাত চলেছে নিরন্তর ভাবে। যে সুখনীড়ের গার্হস্থ্যজীবনের ওমে তিনি এতদিন পরে যে নিশ্চিন্ত উষ্ণতায় গুছিয়ে বসেছেন সুদীর্ঘ অবতরণিকার শেষে, উদাসীন মহাকালের নিষ্ঠুর স্রোতস্বিনী আবার তা ভাসিয়ে নিয়ে যেতে তৈরী হচ্ছে প্রবলবেগেই।
0 comments: