0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in


বাউলের সাধনা সুটলের, আগেই বলেছি। টল হল স্বাভাবিক দেহ মিলনে যে শুক্র স্খলন হয় সেই দশা। গোদা বাংলায় বলা যায়, দেহ মিলনের সময় সঙ্গিনীর যোনিতে সঙ্গীর বীর্যপাত হয়ে যাওয়াই হল বাউলের টল। কামনার ধারা বাউলের হল নদীর বেগ। নদীকে কিছু আগেই সঙ্গিনীর শরীর হিসেবে বাউল সাধকের দেখবার কথা বলেছি— যখন নদী বোঝাই ছিল/ ঝড় তুফানের ভয় ছিল না গো—/ নদীর জল শুকাইল চর পড়িল/ তবু নদীর বেগ গেল না। বেগ হল গিয়ে কামনা যেমন, আবার বাঁকা নদীর উপমা যেন গানে এসেছে তা একেবারে সঙ্গিনীর শরীর নয় আর— আরও নির্দিষ্ট তাঁর জননাঙ্গ— নাইতে গেলে বাঁকার ঘাটে/ বিদ্যে বুদ্ধি রয় না ঘটে— কাম নামের কুমির জুটে/ চিবিয়ে চুষে খায় তাকে। 

লালশশী গানে পদকর্তা সর্বমোট ষোলো জনের কথা না ভোলার কথা বলেছেন দেহ-সাধককে। ছয় রিপু— কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাত্সর্য। একে অতিক্রমের কথা সমস্ত সাধনারই মূল কথা। বাউল, তাঁর গানে ছয়কে নানা রূপক-এও ব্যবহার করে থাকেন। যেমন তার একটি— তোর ঘরে ছয়টি ইঁদুর আছে, তুই বুদ্ধি নিলি তাদের কাছে, জ্ঞান হৈল না পর-আপন॥ ছয়কে দেহস্থ সাধনার ষট্-চক্র হিসেবেও দেখা যেতে পারে। যা সাধককে ভেদ করতে হয় বিবিধ শ্বাস-ক্রিয়ায়। এই ষট্-চক্র হল— মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা চক্র। দেহ-সাধককে তা অতিক্রম করতে হয় কুণ্ডলিনী যোগে। আর এই ষট্-চক্র ভেদেই বীর্যের অভিমুখ উল্টোদিকে নিয়ে যেতে পারেন তন্ত্র-সাধক। বাউল-সাধক উল্টো স্রোতে নৌকো বেয়ে চলেন। কীভাবে তা হয়? মানব দেহের গুহ্যদেশ থেকে দু’-আঙুল ওপরে ও লিঙ্গমূল থেকে দু’-আঙুল নিচে চার-আঙুল বিস্তৃত যে যোনিমণ্ডল— তার ওপরে মূলাধার চক্র বা পদ্ম অবস্থিত। একানেই পঞ্চভূতের ক্ষিতির অবস্থানের কথাও বলেন সাধক। তন্ত্রে তার বীজ হল গিয়ে লং। মূলাধারস্থ এই শক্তিকে সাধক জাগরিত করে সহস্রারে গিয়ে লয় করেন। এর জোরেই বাউলের বীর্য-ধারণ হয়। পিতৃবস্তু রক্ষার কথাও তাঁরা বলেন— শুক্র ধাতু ভবেৎ পিতা/ রজ ধাতু ভবেৎ মাতা/ শূন্য ধাতু ভবেৎ প্রাণঃ। বাউলের মত, রজ-বীর্যে গঠিত মানবদেহে প্রাণ আসে শূন্য থেকে। আর তা আসতে পারে কেবল, যুগল সাধনাকেই পিতৃবস্তু রক্ষা করে— যে বস্তু জীবনের কারণ/ তাই বাউল করে সাধন। অর্থাৎ যা দিয়ে প্রাণস্পন্দন আসে পৃথিবীতে, বীর্য-রজের মিলনে সেই সন্তান উত্পাদন বাউল জীবনের উদ্দেশ্য নয়। তাঁদের প্রাণ তরঙ্গায়িত আনন্দ চেতনা। যা আসতে পারে নির্দিষ্ট পদ্ধতির দেহ-মিলনে। তার জন্যেই তাঁদের বস্তু-রক্ষা। বস্তু হল পিতৃবস্তু আর মাতৃবস্তু। বীর্জ-রজ। মূলাধারের শক্তিকে সাধক স্বাধিষ্ঠানে নিয়ে আসেন। লিঙ্গ-মূলে সংস্থিত দ্বিতীয় পদ্ম-চক্র হল স্বাধিষ্ঠান। এখানে রয়েছে পঞ্চভূতের অপ। বাউল সাধক আবার স্বাধিষ্ঠানের কথা বলেন না— চতুর্দল মূলাধারে/ মণিপুর তার ওপরে/ অনাহত বিশুদ্ধ পারে/ লক্ষ যোজন যাও না কেঁদে/ ইড়া আর পিঙ্গলার মাঝে। নাভিদেশ বরাবর মণিপুর চক্র। পঞ্চভূতের তেজ এখানে বিরাজ করছে। হৃদয়স্থিত অনাহত চক্রে বায়ুবীজ মরুৎ। কণ্ঠদেশের বিশুদ্ধ চক্রে আকাশতত্ত্ব বা ব্যোম। আর ভ্রূ-মধ্যে আজ্ঞা চক্র। আজ্ঞা চক্রের ওপরেই বিরাজ করছে করছে বাউলের ত্রিবেণী বা ত্রিকূট। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না— এই তিন নাড়ির মিলন স্থল এটি। বাউল একে আরশিনগর হিসেবেও সম্বোধন করেন। 

ছয়ের ভাবগত ও অন্বয়গত ভাঙচুরের পর বাউলের ইন্দ্রিয় দশ-এ আসা যেতে পারে। এই দশ ইন্দ্রিয়ের দুটো ভাগ করেন তাঁরা। পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়— চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক আর পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়— বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু উপস্থ। নবদ্বারের কথাও বলেন তাঁরা— দুই নাক, দুই কান, দুই চোখ, মুখবিবর, পায়ু, উপস্থ। আর অষ্টসিদ্ধি তন্ত্রেরই ভাবজাত প্রতীক। যার কথা আগে আলোচনা করে ফেলেছি। এই ছয় আর দশের যোগফল ষোলো। এদে না ভোলার কাথীই কিনেতু বলেছেন বাউল পদকর্তারা। কারণ হল ছয় আর দশ যথেষ্টই শারীর-ক্রিয়া। যোগ-মিলন ক্রিয়ায় যেতে হলে এগুলোকে ভালোভাবে আয়ত্ত করা অতি প্রয়োজন। নামাশ্রয় আর মন্ত্রাশ্রয়য়ের কথাও বলেন তাঁরা। দুটোই বীজমন্ত্র। এরপর ভাবাশ্রয়ে কাম-বীজ ও কাম-গায়ত্রী জপে তাঁরা সেই যুগলে রাঙায়িত হয়ে যান বলেই বিশ্বাস। তারপরেই গুরুর উপদেশে রেচক-পূরক-কুম্ভকের কাজ— বাণ ক্রিয়া। আর এতেই তাঁরা তাঁদের কথিত বিশ্বাসে জেন্তে-মরা হয়ে ওঠেন। গানে লালশশী বলেছেন: এরা যখন হইবে শান্ত/ তখন দেখবে ভাই কোথায় আছে ঋতু-বসন্ত/ আর নীর-ক্ষীরে একযোগে/ নীর ফেলে ক্ষীর বেছে খাও। 

নীর বাউলের কাম। রজকেও তাঁরা নীর হিসেবে দেখে থাকেন। ক্ষীর হল তাঁদের প্রেম। কামে থেকে নিষ্কামী হওয়া তাঁদের সাধনগত অভিপ্রায়। অর্থাৎ কিনা কামকে প্রেম থেকে যোগাভ্যাসের দ্বারা বাদ দিয়ে দেন। কীভাবে দেন, সেই প্রক্রিয়াজাত অধ্যায়ের কথা বলা হয়েছে কিন্তু কথা হচ্ছে এতে, এইভাবে কাম বা যৌনতা কতখানি বাদ পড়ে? প্রশ্ন থেকে যায়। বরং যেটা মনে হয়, দেহকে নন্দন-নির্ভর সরলাঙ্কের চারুকলা, তাঁরা প্রতীক-সন্ধানী অমেয় শক্তিতে দিয়ে ওঠেন। দেহ সেখানে কামের বা যৌনতার অধিগত অধ্যায়কে মুছে ফেলে ঠিকই তাঁদের ধারিত বিশ্বাসে কিন্তু আমাদের মনে হয় তাঁদের এই সাধন-মার্গ, মিলনের জন্যে শরীরের কল-কব্জাকে নতুন রূপস্থ দশাতে উদ্ঘাটনে যথেষ্ট অর্থেই যৌনতা চিহ্নিত হয়ে পড়ে। যৌনতা তার ক্রিয়াগত ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ ভালোভাবেই নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে বাউলের সাধন-মার্গের পদে। কীভাবে সেই সাধন-রহস্য শারীরিক নন্দন-নির্ভর হয়ে পড়ে আলোচ্য মর্ম-তৃপ্তিকে খুলে ধরে তাকেই এখন স্পষ্ট করব খ্যাপা বাবা বা মনোহর খ্যাপার একটা পদকে ঘিরে। 

শুনরে তোরা ক্ষ্যাপার কথা— 
ক্ষ্যাপার চোদ্দ ক্ষেপীর আট 
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা, 
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা 
চব্বিশের ছয় ছেড়ে দিয়ে… 
এবার, যুক্তি কর যেথা সেথা॥ 

বাহান্নর চার বাদ দিয়ে দেখ 
(তোরা) পাবি নিজের মনের কথা 
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা ৷ 
ক্ষ্যাপার চোদ্দ ক্ষেপীর আট 
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা॥ 

একশ আটের চব্বিশ বাদে 
গণনাতে হয় চুরাশি 
সাধক সিদ্ধ মাহপুরুষ 
কথায় বলে একাই আসি ৷ 
শুনরে তোরা ক্ষ্যাপার কথা— 
ক্ষ্যাপার চোদ্দ ক্ষেপীর আট 
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা॥ 

বিশ্ব-জুড়ে দেখ না ঘুরে 
(আছে) চোদ্দ ব্রহ্মাণ্ডের কথা ৷ 
অষ্টাদশে শ্রীমদ্ ভাগবত 
(ক্ষ্যাপা) গুরু-শিষ্যের স্বার্থকতা— 
শুনরে তোরা, ক্ষ্যাপার কথা ৷ 
যায় বাহান্ন, তায় তিপান্ন 
ঐ দেখ আছে পঞ্চ-তত্ত্ব গাঁথা ৷
পাঁচে পাঁচে পঁচিশ হলে 
(ক্ষ্যাপা) সহস্র দল দেখবি হেথা— 
শুনরে তোরা ক্ষ্যাপার কথা 
ক্ষ্যাপার চোদ্দ ক্ষেপীর আট 
বল, এই নিয়ে কার মাথা ব্যথা॥ 

গানে খ্যাপার চোদ্দর দশ-কে কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়-র পাঁচ-পাঁচ করে সর্বমোট দশ হিসেবে ভাবতে পারি। যার কথা প্রসঙ্গত আগেও বলেছি। দশকে অনেক সাধক আবার মশম-দ্বার হিসেবেও চিহ্নিত করে থাকেন। এর রূপগত প্রত্যঙ্গের কথাও প্রসঙ্গত উল্লেখ করেছি আমরা। তবু বলি, পাঁচ কর্মেন্দ্রিয় (বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু উপস্থ)। বাক্ হল কথার সংযম। তন্ত্রের পর্শ্বাচারের একটি। তার কথাও জায়গা বিশেষে বলা হয়ে গেছে। পাণিকে শুক্র-রস বা বীর্য হিসেবে ধরতে পারি। পাদ নিতম্ব। পায়ু হল মলদ্বার। উপস্থ হল গিয়ে জননেন্দ্রিয়, লিঙ্গ অথবা যোনি। পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক)। তবে দেহ-তত্ত্বের গানে স্ত্রী জননাঙ্গকেও দশমী দ্বার বলা হয়ে থাকে। বাকি রইল চার। যা প্রকৃত অর্থেই চার চন্দ্রের নামান্তর। বাউলের সাধনা হল গিয়ে চার চন্দ্রেরই সাধনা। চার চন্দ্র (মল, মূত্র, শুক্র, রজ)। সকাল-বেলাকার বিষ্ঠার প্রথম খানিকটা অংশ তুলে খেতে হয়। বাকিটা রেখে দিতে হয়। স্নানের সয়ম বুকে-মুখে-পেটে ভালো করে মালিশ করে কিছুক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে স্নান সেরে নিতে হবে। মলকে ফ্যাটাতে-ফ্যাটাতে এমন করে নিতে হবে, তা যখন তেলতেলে মাখনের মতো হয়ে যাবে তখনই খেতে ও মাখতে হবে। তাহলে তার আর দুর্গন্ধ থাকবে না একদম। মূত্র বা পেচ্ছাপ/প্রস্রাব যতবার হবে নারকেল মালাতে ধরে খেয়ে শরীরেই ফিরিয়ে নিতে হবে। শ্বাস ও দমের কাজের পর গুরু তাঁর শিষ্যের জন্যে যে কুমারীর রজ ধরে রাখেন পাত্রে, তাও খেতে হয়। দেব-যোগের পর সেটা মনে হবে সদ্য-দোয়া দুধ। বাউল আবার উলঙ্গ নৃত্যে একত্রে নারী-পুরুষ নাচানাচির পর বীর্য-স্খলন হলে পর তাকে তুলে ময়দাতে মেখে রুটি প্রস্তুত করে খান। এ হল তাঁদের প্রেমভাজা। আগেও বলেছি, মূত্র বাউলের রস বা রামরস। তাঁরা চার-চন্দ্র ভেদ করেন দেহ-নিঃসৃত এই চারটি বস্তুকে শরীরে বা দেহে ফিরিয়ে এনেই। ব্রহ্মচর্যেও তাঁরা তিন রস পালন করে থাকেন। মল-মূত্র খেয়ে-মেখে, রজ-বীর্য শরীরে ধারণ করে। পঞ্চভূতে দেহ গঠিত তাঁরা মনে করেন। মল তাঁদের ক্ষিতি। মূত্র হল অপ। তেজকে তাঁরা রজ ও শুক্রকে মরুৎ হিসেবেও ভেবে থাকেন। 

গানে বর্ণিত খেপীর আট হল, তাঁদের অষ্ট চন্দ্র বা অষ্ট ইন্দু। সঙ্গিনীর শরীরের আটটি প্রত্যঙ্গ। মুখ এক, দুটি স্তন, দুই হাত, বুক এক, নাভি এক, যোনি এক। বাউল সাধক এদেরও ভেদ করেন। তাঁরা বলেন, এই ভেদ প্রথম হয় দৃষ্টিস্পর্শে। কিন্তু বাস্তবিক নারী শরীরে উত্তেজনা কী পুরুষের দৃষ্টিস্পর্শে কেবল আসে? আর পুরুষ নারীর এইসব কাম জাগৃতির প্রত্যঙ্গ শুধু দেখে নিজের উত্তেজনা কি ধরে রাখতে পারেন? বাউলের এই মত তাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদিও তাঁরা বলেন যোগের দ্বারা তা করা যায়। যেটা এখানে বাস্তবিকই বলার, তা হল, যোগ ঠিক। কিন্তু তা হল গিয়ে কামযোগ। যৌনাচার, যৌনতার কাব্যময় প্রকাশ আসলে এইসব। চোদ্দকে বাউল আবার ভুবন হিসেবেও দেখেন। চোদ্দ ভুবন (দুই চোখ, দুই কান, মুখ, মাজা, পায়ু, উপস্থ, বুক, দুই স্তন, নাভি, ব্রহ্মরন্ধ্র)। এগুলো সব দুই শরীরের প্রত্যঙ্গ। দেহকে তাঁরা চোদ্দ পোয়া বলেন। যা সাড়ে-তিন হাত। প্রচলিত এক কথা আছে। মৃত্যুর পর দাহ করতে বা গোর দিতে সাড়ে-তিন হাত জমি লাগবেই। এ কথার সঠিক অর্থ, এ হল দৈহিক পরিমাপ, শারীর-বিজ্ঞান। যাঁর-যাঁর নিজের হাতের মাপে তাঁর-তাঁর শরীর সেই সাড়ে-তিন হাতই। 

চব্বিশের ছয় পদে বাদ দেবার কথা বলেছেন পদকর্তা। ছয় তো ষড়রিপু। দেহস্থ ষট্-যন্ত্রও আবার। প্রথমটির সংযম আর দ্বিতীয়টির ক্রিয়া দেহ সাধনেতে অনিবার্যই। সেই ক্রিয়া-কলাপের কথা আগেই আলোচিত হয়েছে। এবার এখানে চব্বিশের কথা বলি। চব্বিশ হল তত্ত্বরূপ। কী ভাবে? পঞ্চভূত, পঞ্চগুণ, দশেন্দ্রিয়, ষড়রিপু আর অষ্টদ্বারের যোগফল। প্রতীক রূপগুলো আর উল্লেখ করলাম না। প্রসঙ্গত বলা হয়ে গেছে সবই। আবার মিলন যোগে সাড়ে-চব্বিশ চন্দ্র-স্পর্শের কথাও বলা হয়। এ হল সব বাউল মতের দৃষ্টি-চুম্বন। পায়ের নখে দশ বার, হাতের নখে দশ বার, দুই গলায় দুই বার, জিভে এক বার, নিচের ঠোঁটে এক বার আর কপালে অর্ধেক। এগুলো কেবল দৃষ্টিতে সঙ্গিনীর শরীরের কাম ভোঁতা করা হয় বলে বাউল মতকে সেইভাবে মানা যায় না। বাহান্নর চার বাদের কথা রয়েছে গানে। চার হল চার চন্দ্র। বাদের পর থাকা আট-চল্লিশ হল গিয়ে যুগল শরীরের চল্লিশ তত্ত্বরূপের গুণফল। একশ’ আটের আবার চব্বিশ বাদ। এই চব্বিশকে আরেকটু অন্যভাবেও দেখে থাকেন দেহ-সাধক। বৈষ্ণব সাধক বলেন, চব্বিশ অক্ষর কাম-গায়ত্রীর কথা— ক্লীং কামদেবায় বিদ্বহে পুষ্পবাণায় ধীমহি তন্নো কৃষ্ণ প্রচোদয়াৎ। বাউলও অবশ্য বলেন এক কথা। চব্বিশ হল গিয়ে আরেক প্রকার— ছয় রিপু, দশ ইন্দ্রিয়, আটটি পাশ— সর্বমোট চব্বিশ। ষড়রিপু ও ইন্দ্রিয়ের উল্লেখ আগেও হয়েছে। অষ্ট পাশ হল— ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শঙ্কা, জিগীষা, জাতি, কুল ও মান— দেহ সাধককে এই সব অনুভূতির ঊর্ধ্বে উঠতে হয়। একশো আট থেকে চব্বিশ যে বাদ পড়ল গণনাতে তা হল চুরাশি। বলা হয়, চুরাশি লক্ষ যোনি পার হয়ে এই মানব জীবন। চুরাশি তাই মানুষের প্রতিরূপ। যে মানুষকে বাউল মতেই সহজ শিরোপা অধিকার করে নিতে হবে। একশো আটকে পূর্ণ শরীর হিসেবে দেখা হচ্ছে। একশো পরম শূন্যতা আর আট অষ্টপাশ। একশো আট-কে আবার অষ্টদল পদ্ম ও নিজেকে যুক্ত করেও দেখা চলতে পারে। এ-ও সহজিয়া মত। এর একশত সাত ফুল— অষ্ট ক্রোশ গভীরের নিচে রূপের একটা গাছ রয়েছে/ একশত সাত ফুল ত্রি-জগৎ তার গন্ধে আকুল/ ফুল ফুটে তার মাসে মাসে মধু খায় ভ্রমর ডালে ডালে। এখানে রজঃবিকাশের কথা আসলে বলা হয়েছে। গানে পাঁচ-পাঁচে পঁচিশ হবার কথাও আছে। পঁচিশ হল চব্বিশ তত্ত্বের সঙ্গে অর্ধাংশ করে রজ-বীর্যের যোগফল। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ দেহস্থ দশা। আর তা প্রাপ্ত হলেই সহস্র-দল পদ্ম দেখা যায়। বাউল মতে যুগল মিলনে স্থির-অচঞ্চল দশা এখানে স্থিত হয়। বীর্য ব্রহ্মরন্ধ্রে উঠে চলে যাবার পর সহস্রদলে সহস্রার পদ্মচক্রে এর বিকাশ অনুভূত হয়। বাহান্ন-তিপান্ন হল নারী শরীরের রস-বওয়া বিভিন্ন নাড়ি। 

যোগশাস্ত্রে কথিত সাতটি প্রাথমিক চক্র নিম্নরূপ: 

মূলাধার, (সংস্কৃত: मूलाधार, Mūlādhāra) ভূমি বা মূল চক্র (মেরুদণ্ডের অন্তিম হাড় *কোক্সিক্স*) স্বাধিষ্ঠান, (সংস্কৃত: स्वाधिष्ठान, Svādhiṣṭhāna) ত্রিক চক্র (অণ্ডাশয়/পুরস্থ গ্রন্থি) 

মণিপুর, (সংস্কৃত: मणिपुर, Maṇipūra) সৌর স্নায়ুজাল চক্র (নাভি ক্ষেত্র) 

অনাহত, (সংস্কৃত: अनाहत, Anāhata) হৃদয় চক্র (হৃদয় ক্ষেত্র) 

বিশুদ্ধ, (সংস্কৃত: विशुद्ध, Viśuddha) কণ্ঠ চক্র (কণ্ঠ ও গর্দান ক্ষেত্র) 

আজ্ঞা, (সংস্কৃত: आज्ञा, Ājñā) ললাট বা তৃতীয় নেত্র (তৃতীয় নেত্র) 

সহস্রার, (সংস্কৃত: सहस्रार, Sahasrāra) শীর্ষ চক্র (মাথার শীর্ষে; একটি নবজাত শিশুর মাথার 'কোমল স্থান') ।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যুগল-তত্ত্বের এই সব গান বা পদ দুই শরীরের পূর্ণাত্মক মিলন বিকাশকে স্পষ্ট করে যাচ্ছে বারে বারে। যৌনতার চিন্তাস্রোতে তাই এই সব সাধন-আখরকে আমরা কোনওভাবেই বাদ রাখতে পারি না। কেন না যৌনতা এখানে স্পন্দিত সব রসাবয়ব।

সমাপ্ত 

0 comments: