1

গল্প - দীপঙ্কর রায়

Posted in


বাঘজানের প্রাকৃতিক গ্যাসের কুয়োতে আগুন লেগে গেল। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে উচ্চচাপে প্রাকৃতিক গ্যাস বেরুতে শুরু করেছিল গত মাসের ২৭ তারিখ থেকে, এক ব্লোআউট বা বিস্ফোরণের পর। সেই গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত স্ফূরণ নিয়ন্ত্রণ করার কারিগরী কর্তৃপক্ষের ছিলনা। সিঙ্গাপুর থেকে বিশেষজ্ঞদের এসে পৌঁছাতে দেরী হচ্ছিল কোভিড পরিস্থিতিতে। অত্যন্ত দাহ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত ধারায় আগুন লাগা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। ইতিমধ্যে দুই প্রাণ কেড়ে নিয়ে, বহু মানুষকে গৃহচ্যুত করে, বাঘজানের লেলিহান শিখা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে দু'শ ফুটের ওপর। ধোঁয়ার মেঘ উড়ছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, ছড়িয়ে পড়ছে ডিব্রু সৈখোয়া অভয়ারণ্যের চারিপাশে। 

ডিব্রু সৈখোয়া ন্যাশনাল পার্ক। সবুজের সমারোহে ভরা বনানী। জোছনা রাতে সাদা বুনো ঘোড়া ঘুরে বেড়ায়। লোকে বলে ঐ ঘোড়াদের পূর্বপুরুষ বুনো ছিলনা, তারা সাদা চামড়া সাহেবের আস্তাবলে আরামে থাকত। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে তখন খনিজ তেল খনন, চা বাগান পত্তন আর রেল লাইন পাতার কাজে ব্যস্ত। তারপর তো তারা চলে গেল দেশ ছেড়ে, আর ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দিয়ে গেল বনে জঙ্গলে। তাদেরই বংশধররা ঘুরে বেড়ায় এখন ডিব্রু সৈখোয়া অভয়ারণ্যে। এ ছাড়াও আছে কত জৈব বৈচিত্র্যের বাহার। হরিণের পাল, হাতির সংসার, লেপার্ডের পায়চারি, আর পাখির ঝাঁক। অভয়ারণ্যের একদিকে ডিব্রু নদীর ধারে বিশাল কপোতাক্ষ জলাশয়, স্থানীয় নাম মাগুরি বিল। কাজের সূত্রে তিনসুকিয়া প্রায়ই যেতে হত আর মাগুরি বিল ছিল আমার খুব পছন্দের জায়গা। সকালে চা খেয়ে ঘাটের থেকে ডিঙি নিয়ে এগিয়ে চলা যায় তিরতিরিয়ে। শীতের ধোঁয়া ওড়া সকাল, বিলের ওপর কুয়াশায় মাখামাখি, ছোট ছোট মাছ মাঝে মাঝেই ঘাই দিচ্ছে ... হোগলা পাতার মত ঝোপ ঠেলে উঠেছে জল থেকে, তার ফাঁকে ফাঁকে ছোট্ট টুনটুনি বা ফিঙের মতো লেজঝোলা পাখি, ওগুলো বাসিন্দা পাখী। এখানেই থাকে। তবে ঝিলের জলে, ঝুঁকে আসা গাছের ডালে বা জলে গা ডুবিয়ে রোদ পোয়ানো বুনো মোষের শিঙে বসে থাকে পরিযায়ী পাখির ঝাঁক। সরাল হাঁস বা হুইসলিংটিলের কিচিরমিচির শুনতে শুনতে এগিয়ে চলি, ঝুঁকে আসা গাছের ডালে কাল ঘোমটায় মুখ ঢেকে বসে থাকে গাঢ় হলুদ বেনেবৌ। এদিকে মাছের আশায় বসে আছে হাড়গিলে আর সারস, স্থানীয় নাম শামুকভাঙ্গা। শামুক ভেঙ্গে খায়, তাই। জলার মোরগ বা কামচরাই ডেকে ওঠে, বুনোহাঁস সপরিবারে সাঁতার কাটে বিলের জলে। কানা বক ধূসর চরে রঙ মিলিয়ে ঘাপটি মেরে আছে। একবার ডিঙির চারদিকে চলে এল ব্রাহ্মিণি হাঁসের ঝাঁক। সকালের আলোয় মনে হয় সোনার হাঁস। ব্রাহ্মিণি হাঁসের পোষাকি নাম রুডিশেল ডাক্, স্থানীয়রা বলে রামকম। কেন বলে জানিনে, তবে আওয়াজটা নাকি ঐরকম। অন্তত তিনশ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় মাগুরি মতাপুং বিলে। তাদের নানান রঙ, নানান ডাক, নানান আকার আর নানান খেলা।

ডিব্রু সৈখোয়ার পাশে চিয়াং আর দিবাং নদী এসে মিশেছে লোহিতে আর এখান থেকেই সেই ত্রিধারা ব্রহ্মপুত্র নামে বইছে অসমের বুক চিরে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা প্রতি বছর বর্ষায় প্লাবিত হয় আর সেই প্লাবনের সাথে মাগুরি বিলে ঢুকে পড়ে নানান মাছের ঝাঁক। প্লাবন সরে গেলে থেকে যায় বিলের জলে। শোনা যায় বিলের নাম মাগুরি হয়েছিল মাগুর মাছের ঝাঁক থেকে। তবে শুধু মাগুর নয়, অন্তত আশি প্রজাতির মাছের বাসা মাগুরিতে। মাঝে মাঝে ঘাই মারে গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন। আশেপাশের দশ এগারোটি গ্রামের মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে এই মাগুরি বিলের উপর নির্ভরশীল। তারা কেউ বিলের জলে মাছ ধরে, কেউ হোগলা পাতা সংগ্রহ করে আবার কেউ ডিঙি নিয়ে পর্যটকদের পাখির সংসার দেখাতে নিয়ে যায়।

এখন বাঘজানের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে মাগুরির পরিবেশ। আগুন আর শব্দে পাখির দল পালিয়ে গেছে। ছাই আর তেলের ধোঁয়া ঢেকে দিচ্ছে বিলের জল, মাছেদের উঠেছে নাভিশ্বাস। ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে এসেছে পাড়ে। বুনো মোষেরা যারা বিলের ধারে হোগলা জঙ্গলে জাবর কাটত তাদের আর দেখা যাচ্ছে না। পাশের অভয়ারণ্যের হরিণের দল নেই, হাতিরা নিরুদ্দিষ্ট। খনিজ তেল আর গ্যাসের আগুন নেভেনো প্রায় অসম্ভব। কতৃপক্ষ চেষ্টা করছেন যাতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে, তবে কূপের আগুন সম্ভবত জ্বলতেই থাকবে যতক্ষণ না ভূস্তরে গ্যাসের মজুদ জ্বলে জ্বলে শেষ হয়। অন্তত একমাস জ্বলবে এ আগুন, ছাই ছড়িয়ে। পরিযায়ী পাখিদের শীতের ঠিকানা হারিয়ে গেল।

তিনসুকিয়া ডিগবয় অঞ্চল ভারতের খনিজ তেলের আঁতুড়ঘর। সেই কবে, প্রায় সোয়াশো বছর আগে হাতির পায়ে তেলের দাগ দেখে বগা (সাদা) সাহেবেরা চেঁচিয়ে ওঠেন ..ডিগ্ বয়.. ডিগ্ তারপর মাটি খুঁড়ে তেলের কুয়ো বসল, প্রথম শোধনাগার তৈরী হল। ডিগবয় তিনসুকিয়া অঞ্চলে এখন ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় এক হাজার তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের কুয়ো। অসমের প্রধান খনিজ সম্পদ হল তেল। এখন উৎপাদন নিম্নমুখী আর সেইজন্য চলছে আরও অনুসন্ধানের কাজ। সম্প্রতি এই ডিব্রু সৈখোয়া বনাঞ্চলেও তেলের অনুসন্ধান চালানোর জন্যে পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

বাঘজানের আগুন আর মাগুরি বিলের সর্বনাশ তাই একটা প্রশ্নের সামনে ফেলেই দেয় আমাদের। প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনীতির সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের কোনো বিরোধ আছে কি? প্রকৃতির সাথে প্রগতির? কোনোটার প্রাথমিকতাই তো অস্বীকার করা যায় না। এই মেলবন্ধন হয়ত করতে পারে প্রযুক্তি। বাঘজানের গ্যাস উত্তোলনে প্রযুক্তি কি ছিলনা? জানা যাচ্ছে, কূপে কিছু প্রক্রিয়াগত কাজ চলছিল, গ্যাসের মজুদ স্তর পরিবর্তন করার জন্য। পরিভাষায় যাকে ওয়র্ক ওভার বলে। এই ধরণের কাজে প্রথমে নিশ্চিত করা হয়, কূপটি সাময়িক ভাবে নিষ্কৃয় করা হয়েছে। থাকে বিস্ফোরণ আটকানোর নানান সুরক্ষা প্রযুক্তি। দেওয়া হয় কাজের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি, স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্র্যাকটিস। তবু কেন হল ব্লো আউট? হলই যদি, সেই অনিয়ন্ত্রিত গ্যাসের ধারাকে বন্ধ করার আত্মনির্ভর প্রযুক্তি কেন নেই দেশে ? আর যখন নেই, তখন বিদেশী বিশেষজ্ঞদের উড়িয়ে আনতে ন' দিন লাগল কেন, এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে?

দুর্ঘটনা একটি। তবে কোন দুর্ঘটনাই নিজে নিজে ঘটেনা। অসাবধানতাবশত সেটি ঘটানো হয়। প্রযুক্তি কোনো কাজেই আসে না, যদি মানসিকতার অভাব থাকে। তখন আমরা সুরক্ষা বলয় কে তোয়াক্কা করিনা। দায়বদ্ধতা ভুলে যাই, যতক্ষণ না বাঘজানের মত ঘটনা আমাদের নাড়িয়ে দেয়। বাঘজানের বিধ্বংসী আগুনের তদন্ত তো হচ্ছে বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরে। আশা থাকল, পরিবেশ আর প্রগতির সহাবস্থান সম্পর্কে সুচিন্তিত অভিমত থাকবে সেখানে। বাঘজানের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার তো ধ্বংস হয়েই গেল, এখন দেখার প্রকৃতিকে কিভাবে আবার ফিরিয়ে আনা যায়।

মাগুরি মতাপুং বিলের জৈব বৈচিত্র্য ফিরে আসুক। অসমের অসাধারণ প্রকৃতি পল্লবিত হোক দিগন্ত বিস্তৃত বণানী আর চা বাগানের শ্যামলিমায়।এই দুঃসময় কেটে যাক, আবার মাগুরির জলে ডিঙা ভাসাব।

Maguri Motpung Beel
Picture Courtesy : Aloke Kumar Singh 






Ruddy Shell Ducks in Maguri
PictureCourtsey:
Dipdyuti Choudhury 





Flock of Rudy Shell Ducks
Picture Courtsey : Aloke Kumar Singh


Bar headed geese in Maguri
Picture Courtesy : 
Dipdyuti Choudhury 

1 comment:

  1. খুব ভালো ও দরকারি লেখা।

    ReplyDelete