4

ধারাবাহিক - প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জী

Posted in

পর্ব-৬ 

সম্রাটের শান্ত স্বভাব যেন উধাও। মতি চঞ্চল হলেও কঠোর হস্তে তিনি দমন করছিলেন ছোট বড় বেশীরভাগ বিদ্রোহগুলি। মহারাজ অশোকের নাম শুনে সকলের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার হত। বিদ্রোহ দমনের নামে সম্রাটের শাসন ও অত্যাচারে তটস্থ জনগন। সহদেব হতবাক। সহদেবের বিনীত অনুরোধ তিনি অগ্রাহ্য করতেন। দুই অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর মধ্যে তৈরী হয়েছে দূরত্ব। মহাদেবীর বলা শয়তানের কথা মস্তিষ্কে এলেও তার বন্ধুবৎসল হৃদয় তা মানতে অসম্মত। 

কিছুকাল পরেই সম্রাট তাঁকে বললেন 

--- প্রাগজ্যোতিষপুরে যাব। ব্যবস্থা কর মিত্র। 

---মহারাজের যেমন ইচ্ছে। 

সৈন্যসামন্ত নিয়ে যাত্রা করলেন, মহারাজ ও সহদেব। পথ দীর্ঘ এবং বন্ধুর। পরিশেষে প্রাগজ্যোতিষপুরের সীমান্তে এলেন মহারাজ অশোক। প্রাতঃকালে সহদেব লক্ষ্য করেন মহারাজ এক গুপ্তচরের সাথে কথা বলছেন। কৌতুহল প্রকাশ করলে তিনি বলেন 

--গোপনীয় কার্য মিত্র। 

পরদিন প্রাতেই প্রাগজ্যোতিষপুর আক্রমণ করলেন সম্রাট। তাদের তীক্ষ্ণ রণনীতির সামনে খড়কুটোর মত ভেসে গেল প্রাগজ্যোতিষপুরের প্রতিরোধ। সেখানের রাজন বিরোচনকে তিনি প্রাণদান করেন। সহদেব জানতে পারে বিরোচন যুদ্ধের পূর্বে সুসীমকে অশোকের হস্তে তুলে দিতে চাননি। 

সেই দিবসে বৈকালে তার ভ্রাতা সুসীমের সাথে আলাপচারীতার বন্দোবস্ত হয়। তার উদ্ধত স্বভাব এখন নমনীয় হলেও খুব প্রীতকর বাক্যালাপ হয় নি সেদিন। রাত্রি এইখানেই কাটাবেন স্থির করলেও সন্ধ্যাকালে ফিরে যান নিজ আবাসেই। পরের দিন অতর্কিতে আক্রমণ হয় সম্রাটের উপরে। সম্রাটের কিছু হয় না, গুপ্তঘাতক মারা যায় । মৃত্যুর আগে সেই ঘাতকের জবানবন্দি অনুসারে জানা যায় এই গর্হিত কার্য সুসীমের। সহদেব , সুসীমকে বন্দী করার নির্দেশ দিলেও মহারাজ বলেন, 

--আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সে, তাকে বন্দী করা নিষ্প্রয়োজন। 

বিশেষ সূত্রে সহদেব সংবাদ পান, সুসীম দ্বিপ্রহর হতে নিরুদ্দেশ। সব কিছু যেন অদ্ভুত ঠেকে তার কাছে। 

সেই রাত্রে তৃষ্ণার কারণে কক্ষ হতে নির্গত হতেই দেখেন আপাদমস্তক চাদরে আবৃত হয়ে কেউ সঙ্গোপনে প্রাসাদের বাইরে নির্গত হচ্ছে। তস্কর সন্দেহ করে পিছু ধাওয়া করতে করতে সহদেব পৌঁছে গেলেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে। অমাবস্যার রাত্রি। নিকষ অন্ধকার। হায়না, শেয়াল এরকম বন্যজন্তুর আওয়াজ শোনা যায়। প্রদীপের স্বল্প আলোতে দেখা যায়, ব্যক্তিটি থলের মধ্যের তরল দিয়ে কিছু অঙ্কন করে। পাঁচখানি প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন পঞ্চ বিন্দুতে। প্রদীপ জ্বালানোর পর সেই আলোকে দেখা যায় বৃত্ত ও পঞ্চভুজ অঙ্কন করেছে সে। ঝোপের থেকে একটি পুরুষের দেহকে টেনে নিয়ে আসে।পুরুষটির হাত পা মুখ বাধা, তাকে ঐ বৃত্তের মধ্যে শুইয়ে দিলেন। 

চমকে গেলেন সহদেব। প্রদীপের আলোক ক্ষীণ হলেও চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হল না তার। বৃত্ত মধ্যে শায়িত ব্যক্তি আর কেউ নয়, সুসীম। প্রথম ভদ্রলোক সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে এক দুর্বোধ্য ভাষায় মন্ত্র পড়তে থাকে। অকস্মাৎ প্রজ্বলিত হয় অগ্নি। 

এসময় সহদেবের মনে হয় তরোয়াল দিয়ে ঐ ব্যক্তির মুণ্ডচ্ছেদ করে। কিন্তু তার অবচেতন মন যেন বলে, ---সাবধান ঘোর বিপদ! 

সেকথা অগ্রাহ্য করে এগোতেই অনুভব করেন, কেউ পেছন থেকে শক্ত করে তার হাত ধরেছে। ফিরতেই দেখেন গেরুয়া বহনকারী মুণ্ডিত মস্তক এক সন্ন্যাসী। চাপাস্বরে তিনি বলেন, 

--এ, প্রকৃত সময় নয় সহদেব। শয়তান এখন শক্তিশালী। তুমি বা আমি চাইলেও তার কিছু ক্ষতি করা সম্ভব না। এখন সে অপ্রতিরোধ্য। 

অসিচালনা না করে দেখতে থাকেন সহদেব। ক্ষণিকের জন্য অন্যমনা হয়েছিলেন তিনি, সেসময় দেখেন সেই ব্যক্তি ছোরা দিয়ে কর্তন করেছে সুসীমের বক্ষ, তখনো প্রাণ আছে হয়তো সুসীমের। বক্ষ হতে নির্গত রুধির ধারা , একটি বাটিতে নিয়ে তার মধ্যে একটি অঙ্গুরীয়কে নিমজ্জিত করে, তারপর পরম তৃপ্তির সাথে পান করে সেই শয়তান এবং অঙ্গুরীয়টি বাম তর্জনীতে ধারণ করেন।সেই অঙ্গুরীয় হতে এক রক্তিম দ্যুতি নির্গত হচ্ছে। সেই ব্যক্তি সম্মুখে ফিরতেই অগ্নীর লেলিহান শিখায় আশ্চর্য হয়ে দেখেন সহদেব এ যে কেউ নয়, স্বয়ং মহারাজ। কি বীভৎস তার রূপ। সমগ্র মুখ, শরীর ভাতৃ রক্তে স্নাত। এরপরেই তিনি সুসীমের উপরে তৈল নিক্ষেপ করে তাতে অগ্নী সংযোগ করেন। সুসীমের আর্ত চিৎকারে রাত্রির নৈঃশব্দ খানখান হয়ে যায়। 

সহদেবের মাথা ঘুরতে থাকে এই বীভৎস দৃশ্যে। মুণ্ডিতমস্তক সেই সন্ন্যাসী তাকে টানতে টানতে নিয়ে যায় এক পর্ণকুটিরে। সেখানে পৌঁছে সহদেব শুয়ে পড়েন। সন্ন্যাসী বাইরে গেলেন। 

ঐ বিশেষ অঙ্গুরীয় দেখে মনে পড়ে এটা সেই অঙ্গুরীয় যেটি কুমার তক্ষশীলায় পেয়েছিলেন। কিভাবে পেয়েছিলেন তা তিনি বলেননি। তবে সম্রাট স্বপ্নে দেখেছিলেন যে অঙ্গুরীয়, পরে যেদিন সমস্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন, সেদিন বলেছিলেন সেই অঙ্গুরীয়র কথা। তার পিতাও বলেছিলেন এক বিশেষ অঙ্গুরীয়র কথা। আর সন্দিহান নেই। এই সেই অঙ্গুরীয়। 

একটু সময় পর সন্ন্যাসী ফিরে এলে সহদেব বললেন 

---আপনি কে? 

---মারীচ 

---তুমি তো বালক! 

--- আচার্য আমায় নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন মহারাজের গতিবিধির উপরে নজর রাখি। 

-- বৌদ্ধ মঠের আচার্য, তিনি জানেন? 

---তক্ষশীলায় আপনি যে পত্র পেয়েছিলেন, তা আচার্যের সম্মতিতে আমি পাঠিয়েছিলাম। এর বেশী প্রশ্ন অনাবশ্যক। যথাসময়ে আমি দেখা করব। আপনি মহলে ফিরে যান, না হলে সন্দেহের শিকার হবেন। আপনার পিতা ও রাজজ্যোতিষী অনেক কিছু জানেন। সে সকল বিষয় জানুন। হঠকারিতা করবেন না। বিপদ কিন্তু মাথার উপরে। একবার সম্রাটের সন্দেহভাজনের তালিকায় এলেই অবস্থা হবে শোচনীয়। 

সে রাত্রে লুকিয়ে প্রাসাদে আসেন সহদেব। পরের দিন সুসীমের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুখে কিছুটি না বললেও সকলের তীর্যক দৃষ্টি ছিল সম্রাটের উপরেই। এরপরেই মগধে প্রত্যাগমন করেন মহারাজ।

4 comments:

  1. গেরুয়া "বসনধারী" হবে। পরবর্তী লেখাগুলির সাগ্ৰহে অপেক্ষায় রইলাম ভাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ‍্যাঁ ঠিক বলেছেন। ধন‍্যবাদ

      Delete
  2. অসাধারণ লাগলো এই পর্বটা... বেশ শিহরণ জাগানো লেখা... গল্পের প্রয়োজনে একটু বীভৎস রস ও এসেছে, পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম...

    ReplyDelete