0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in














(১)
…আরে পড়বি পড়বি! আর ঝুঁকিস না। আর ঝুঁকিস না রে!
ট্রলার থেকে ঝপাস করে গগন পড়ল জলে।
ওমনি সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ফেটে পড়ল পবন, নিতাই আর তারাপদ।একটু তলিয়ে গেল গগন। সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল জলের উপর।তারপর ভয়ে ভয়ে জোরে জোরে সাঁতার কাটছে। পুকুরে সাঁতার কাটা আর নদীতে সাঁতার কাটা তার কাছে এক বলে আর মনে হলো না।স্রোতের টানে সে যেন ভেসে যাচ্ছে, তার মনে হচ্ছে কেউ বুঝি টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। চোখে মুখে তার উদ্বেগের ছাপ।

ট্রলারও ভেসে গেল একটু দূরে। এমনকি স্রোতের টানে সে কিছুটা দূরে সরে গেছে।
নিতাই হাসতে হাসতে নাইলনের দড়িটা ছুঁড়ে দিল গগনের উদ্দেশ্যে।
–নে, ধর। শক্ত করে ধরবি।
সকাল বেলার এমন কাণ্ডে তারাপদ আর নিজেকে সামলাতে পারল না। জাল ছেড়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
–ওরে, ও শালাকে ঐ রকম টানতে টানতে নিয়ে আয়। ভাসুক ব্যাটা।মাছ ধরতে এসেছে?
পবন তারাপদর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে শোনাল,
–ভাগ্যিস, এখানে কুমির নেই। নইলে, সকালে তার খাবারটা বেশ রাজকীয় হতো। ততক্ষণে নাইলন দড়ির টানে গগন ট্রলারের কাছে এসে গেছে। ট্রলারের ডালাটা ধরল।কোমরের নিচের অংশ তখনও জলের তলায়।

হাঁপাচ্ছে, নিঃশ্বাস ছাড়ছে জোরে জোরে।

...জলে টানতে টানতে নিয়ে যাবে? কুমির নেই? তার খাবার রাজকীয় হতো?
পবনরা হাসিতে ফেটে পড়ল।তারাপদ ট্রলারের মেঝে পড়ে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।তাদের খিলখিল হাসির সুর ট্রলারের গায়ে লাগা ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
নিতাই হাসতে হাসতে গগনকে টেনে তুলতেই গগন পবনকে দমাদম কিল মারতে লাগল,
...আমাকে কুমির খাবে না? কুমির খাবে?


পবন হাসছে আর মার খাচ্ছে। হঠাৎ গগনকে জড়িয়ে ধরে সে। দুজন পড়ে গেল মেঝে। তারাপদ আর নিতাই তা দেখে ট্রলারে ডাঁই করা জাল নিয়ে ঢাকা দিয়ে দিল তাদেরকে।
পবন চেঁচাচ্ছে, 
...ওরে এবার তো ছাড়। ছাড় রে।


হঠাৎ হাসির রোল বদলে গেল কান্নায়। গগন কাঁদছে। নিতাই আর তারাপদ জাল সরিয়ে টেনে তুলল তাদের।
গগন তখনও কাঁদছে। তারা তিনজনে মিলে জড়িয়ে ধরল গগনকে।তাদেরও চোখ ছলছল করছে।
...ওরে তোকে কি আমরা কুমিরের গালে দিতে এসেছি? কাঁদিস না।চুপ কর। বলতে বলতে পবন তার মাথায় স্নেহের হাত বুলাচ্ছে।
তারাপদ নাক টানতে টানতে বলল,
…কি, কি, দরকার ছিল তোর, অত ঝুঁকে মাছ ছাড়ানো? শুনলি না, গেলি তো পড়ে !
নিতাই তার গামছা দিয়ে গগনের চোখের জল মুছে দিতে লাগল।


ট্রলার তখন মন্থর গতিতে ভেসে চলেছে বুড়ি গঙ্গার বুকে। ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ট্রলারের গায়ে। গগনের কান্নার শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল সেই কূল কিনারাহীন জলরাশির সঙ্গে।তারাপদ তার নিতাই জাল টেনে টেনে তুলছে ধীরে ধীরে। সকালের সূর্যের লাল আভা ঢেউয়ে ঢেউয়ে নেচে নেচে বেড়াতে লাগল। নিতাই মাছ ছাড়াতে ছাড়াতে গান জুড়ে দিল,
...আমি ডুবে যাব, ভেসে যাব
অকূলে যে কুল হারাব...


(২)

চারদিকে জল আর জল। মাঝে মাঝে একটা দুটো ট্রলার দেখা গেলেও আবার তারা কোথায় মিলিয়ে যায়। তিন দিন হল তারা এই ট্রলার নিয়ে জলে ভেসেছে। কত দূরে তারা এসেছে গগন তা ঠিক ঠাওর করতে পারে না। দিনে, সূর্যের আলোয় জলের নানান রূপের পরিবর্তন।স্রোতের টানে কত কিছু ভেসেও আসে...প্লাস্টিকের বোতল, গাছের ডাল, পচা গলা দেহও।
আবার রাতের অন্য রূপ। দূরে দূরে এক--একটা আলো জলের উপর যেন ভেসে ভেসে কোথায় চলে যায়!
মাথার উপর লক্ষ লক্ষ তারা। কেউ যেন থরে থরে সাজিয়ে দিয়েছে তাদের। অন্ধকারের বুকে তারা এক পলকে তাকিয়ে আছে গগনের দিকে। হয়তো বা কিসের প্রতিক্ষায়, সেগুলো আলো জ্বালিয়ে যুগের পর যুগ, তাকিয়ে রয়েছে এই জল-মাটির দিকে!

গগন রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছে মাস্তুলের উপর। এখানে ছাউনিটা অর্ধেক ফাঁকা। জলো হওয়া আসছে দমকায় দমকায়। গা শীত শীত করছে। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নেয়। একদৃষ্টিতে সেই তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। ঢেউয়ের এক একটা দোলায় দোলায় বুড়ি গঙ্গা যেন তাদের ট্রলারটাকে কড়ায় ফেলে ভাজছে উল্টে-পাল্টে।
প্রথম প্রথম তার এই ঢেউয়ে ভয় লাগলেও এখন কেমন যেন সয়ে গেছে। ঘুম আসছে না তার।কত কথা মনে পড়ছে...
এখন হয়তো সে পড়ে বাড়ি ফিরছে। পাড়ার মোড়ের মাথায় রতন-মুদি দোকানের পাল্লা থেকে ঝোলানো খাবারগুলো একে একে নামিয়ে নামিয়ে গুছিয়ে রাখছে। তাকে দেখেই রোজ নানান কথা জিগ্যেস করে। এখানে আসার আগের দিনের কথা তার মনে পড়ল।
…বাবা কেমন আছে রে গগন?
…ভালো নয়, কাকা। কাল শহরে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবো।
…কে, তুই নিয়ে যাবি?
…না, মাও যাবে। ও পাড়ার সঞ্জয়দাও থাকবে। ওখানে নাকি বিনা পয়সায় ডাক্তার দেখে আবার ফ্রিতে ওষুধ দেয়।
…তোর তো কাল তাহলে স্কুলে যাওয়া হবে না!
…হ্যাঁ, এবার স্কুল অনেক কামাই হয়ে গেল। বাবার কিছু হয়ে গেলে আর হয়তো আমার স্কুলে যাওয়া হবে না।
…অন্তত মাধ্যমিকটা দে। বুঝলি।
…আর মাধ্যমিক! জানি না কি হবে? যাই কাকা। মা বাড়িতে এক আছে। বাবার শরীর বিশেষ ভালো নয়।

তাড়াতাড়ি পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। আজ খিদেয় পেটটা তেমনি চোঁ চোঁ করছে। পায়ের গতিবেগ আরো বাড়াল।
রাস্তাটা ফাঁকা। ছিপছিপে অন্ধকার। দু-একটা জোনাকি ঝোপে ঝোপে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। কোটর ব্যাঙ ডাকছে কট কট করে। কুকুরের মতো কি একটা দৌড়ে গেল তার সামনে দিয়ে। থতমত খেয়ে গেল সে।হয়তো বা শিয়াল হবে। মনকে সংযত করে। কার একটা কান্নার আওয়াজ ওদের পাড়ার দিক থেকে আসছে, তা বেশ শোনা যাচ্ছে।মনটা তার কু ডাকতে শুরু করল। বাঁশঝাড়ের কাছে আসতেই তার গা'টা কেমন ঝাড়া দিয়ে উঠল।
…বাবার কিছু হয়নি তো? আজ সন্ধেয় পড়তে যাবার আগে তো বাবার শরীরটা অন্যদিনের তুলনায় অন্য রকম দেখে এসেছি। বোনটাও বাড়িতে নেই। না আর এভাবে হাঁটলে চলবে না।
ভাবতে ভাবতে দিল দৌড়।
কান্নাটা তো থেমে গেছে আর কানে আসছে না।

পাড়ায় ঢুকে দৌড়তে গিয়ে থমকে গেল। তাদের পাড়ার কোনো কোনো বাড়ি থেকে লন্ঠনের আলো জ্বলছে। কোনো কোনো বাড়ির লোক ঘুমিয়ে পড়েছে।
…গলির মধ্যে ওটা কে দাঁড়িয়ে আছে?
মোড়ল জ্যেঠিমার কথা কানে আসছে তার।
…আর কতদিন এভাবে ধার দেব লো? আমরা কি আজিয়ে রেখেছি? লজ্জা করে না? এভাবে আঁচল পেতে বার বার ধার নিয়ে যাস। এবারে সব শুধবি। নইলে পরের বারে ছাই ঢেলে দেব আঁচলে।
বলেই খিড়কির দরজাটা দড়াম করে বন্ধ করে দিল।
আঁচলের খুঁটটা মুঠো করে সেই কালো মূর্তিটা ওদের বাড়িতে ঢুকে গেল।
গগনের চোখ নিথর হয়ে গেল। তার বুকের ওঠা নামা থেমে গেল নিমেষে। চোখ থেকে অঝর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল বুকের উপর। পা যেন আটকে গেল মাটিতে। কান্নাটা গলায় দলা পাকিয়ে উঠল। গলাটা আরো ভারী হয়ে এল। খিদেটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে চুপি চুপি উঠনে পা দিয়ে দেখে...উনুনে হাঁড়ি চড়ানো।খড়ের জ্বাল দাউদাউ করে জ্বলছে।
তার মা চাল ধুয়ে ঢালছে হাঁড়িতে। কোনো কথা না বলে পাশ বারান্দায় উঠে পড়ল সে। ব্যাগটা জানালার খোপে রেখে শুয়ে পড়ল বিছানায়।পাশ বারান্দায় বাঁশের মাচা করে দিয়েছে তার বাবা। সেটাই চৌকির মতো উঁচু। সেখানে বিছানা করা। সে সেখানে একা শোয়।
সেটায় শুয়ে তার বাবার জন্য মনটা কেমন করে উঠল। একটু উঁচু হয়ে জানালার ফাঁক থেকে ঘরে উঁকি মেরে দেখে তার বাবা ঝিম মেরে পড়ে আছে বিছানায়। ঘরের মৃদু লণ্ঠনের আলোয় সেই দেহখানা যেন পৃথিবীর মায়া কাটানোর অপেক্ষায় দিন গুনছে।
অব্যক্ত বেদনায় তার বুকটা যেন মুচড়ে যেতে লাগল।
চোখের সামনে তার বাবার এমন কষ্ট দেখা ছাড়া কিবা করার আছে তার? কিবা সে পারবে করতে?

এখন তো বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। মাঠঘাট জলে টইটুম্বুর। মাঠ ঘাটের কাজ নেই যে সে দুটাকা উপার্জন করে এনে দেবে। অসহায়তায় তার প্রাণটা কেমন যেন ছটফট করতে লাগল। হাতের ঝাপটায় মাথার দিকে জ্বলা কেরোসিনের ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল।
…কিরে খোকা না খেয়ে শুয়ে পড়লি যে?
শরীর খারাপ নাকি? একটু জেগে থাক ভাতের সঙ্গে আলু সেদ্ধ করতে দিয়েছি। খেয়ে নেস।
কখন তার চোখ জুড়ে গিয়েছিল কে জানে? ঘুম ভাঙল তার মার কান্নায়।
তড়িঘড়ি ঘরে গিয়ে দেখে তার বাবা খুব জোরে জোরে কাতরাচ্ছে।আর বাবার রুক্ষ্ম বুকে তার মা তেল গরম করে দোলে দোলে দিচ্ছে।
গগন আর দাঁড়ালো না, দিল দৌড়। অন্ধকারে তার পা কোথায় পড়ল সে নিজে টের পেল না। দৌড়ে গেল ও পাড়ায় যতন ডাক্তারের বাড়ি।তাঁর খিড়কি দরজায় সে বার বার ধাক্কা দিয়ে চেঁচাতে লাগল,
…জ্যেঠু, ও জ্যেঠু একটু ওঠো না। বাবার খুব শরীর খারাপ। একটু চল না আমাদের বাড়ি। জ্যেঠু, ও জ্যেঠু...
বেশ কিছুক্ষণ চেঁচানোর পর যতন ডাক্তার হ্যারিকেন জ্বালিয়ে খিড়কি-দরজা খুলে দিলেন। গ্রামের এই হাতুড়ে ডাক্তার সকলের আপদে বিপদে একমাত্র ভরসা। কারো ডাকে কোনোদিন না করেননি। আজও না। হ্যারিকেনের আলোটা হাতে নিল গগন। পাড়ার ভেতর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলল দুজনে।

রাত গড়াল অনেক। ডাক্তারের ওষুধে তার বাবার কাতরানি কমে গেল। ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে এসে শুয়ে পড়ল গগন। শুয়ে তার ঘুম আসছে না। ডাক্তারের শেষের কথাটা তাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলছে।
…এভাবে আর বাড়িতে ফেলে রাখিস না গগন। টাকা পয়সা যোগাড় করে শহরের কোনো ডাক্তার দেখিয়ে নে। নইলে বেশি দিন আর বাচঁবে না।

বাবার মুখটা মনে পড়তেই তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেল।


(৩)

রাতের তারাগুলোও তার চোখে ঝাপসা হয়ে গেল।নীরব কান্নায় চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে তার কানের ভেতরে।আজ তিন দিন হয়ে গেল তার বাবা,মা,বোন কেমন আছে কে জানে?আসার দিন বোনটা খুব কান্নাকাটি করছিল।
তারও মনটা কেঁদে উঠতে চাই ছিল কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দেয়নি।
…আমি ফিরে এসে তোকে গল্প শোনাব। তুই, মা-বাবার খেওয়াল রাখিস।
তারপর নিতাই, পবন ও তারাপদর সঙ্গে মাছ ধরতে বেরিয়ে ছিল বাড়ি থেকে। তার মা পথে এসে পবনের উদ্দেশ্যে বলে,
…ঠাকুরপো, ওকে একটু চোখে চোখে রেখো। ও তোমাদের সঙ্গে ট্রলারে মাছ ধরতে যাচ্ছে শুনে ওর বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে। দুপুরে ভাত মুখে তুলেনি। সেই তখন থেকে বার বার কাঁদছে। আমাকে বলেছে, "ছেলেটার পড়া বুঝি শেষ হয়ে গেল, তপতি। ভালো করে খেতে দিতে পারি না। পড়ার বই কিনে দিতে পারি না। আর সে কিনা আমার জন্য পড়াশোনা ফেলে টাকা রোজগার করতে যাচ্ছে !"
এটুকু বলতে গিয়ে গলা ধরে এল। চোখ ছলছল করে উঠল।
…মন খারাপ করো না, বৌদি। আমরা থাকতে ওর কিছু হবে না। তুমি দাদার খেয়াল রেখো।
পবনের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে নিতাই গগনের কাঁধে হাত রেখে তার মার উদ্দেশ্যে বলল,
…ফিরে এসে আবার স্কুলে যাবে। ওর পড়া আটকায় কে?দাদাকে একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে তো? তুমি বাড়ি যাও।
গগনের মনটা তার মা'র কথায় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। কান্নাটাকে ঢোক গিলে নিল।
…মা,তুমি যাও। বাবাকে বলো, বেশি চিন্তা যেন না করে। আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব। বেশি কিছু হলে ডাক্তার জ্যেঠুই ব্যবস্থা করে দেবে, আমি জ্যেঠুকে বলে এসেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
গগনের জন্য তার মার মনটা হু হু করতে থাকে।তপতি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে পবনকে বলে
…আমরা কেমন যেন স্বার্থপর না, ঠাকুরপো? নিজেদের জন্য ওকে তোমাদের সঙ্গে পাঠাচ্ছি?
…এমন কেন ভাবছ? ওর বয়সের ছেলেরা রোজগার করতে কোথাও কি যায়নি? আর ও তো এমনি যাচ্ছে না। ওর বাবার এই অবস্থা। তারপর লোকের কাছে কত ধার দেনা। ও যদি দুটো পয়সা এনে তোমার হাতে দেয়। তা ভালই হবে। ও আমার কাছে এসেছিল রাতে।আমি যেন ওকে মাছ ধরতে নিয়ে যাই।প্ৰথমে রাজি হয়নি। ছেলে মানুষ। আমার ছেলের বয়সী। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া পড়ে গেল। না বলতে পারলাম না। যাক, ও ওর ন্যায্য পয়সা পাবে। তাতে তোমাদের একটু সুরাহাও হবে। সংসারটাও বেঁচে যাবে। এসব সংসারেরই অঙ্গ। হাত দিয়ে তুমি কি আটকাতে পারবে? ওর কপালে যা আছে তা হবে। তুমি এখন যাও।

গগনরা যতক্ষণ না গ্রামের বাঁকে হারিয়ে গেছে, ততক্ষণ পথেই দাঁড়িয়ে ছিল তার মা। পাছে সে দুর্বল হয়ে পড়ে, সেজন্য গগন একবারও ফিরেও তাকায়নি।

রাতে শুলেই গগনের চোখের সামনে এ দৃশ্য ভাসে। সারাদিন এত বেশি মনে আসে না। সকালেই তো না।
জাল টেনে তুলতে তুলতে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। কত রকমের মাছ জলের ফাঁসে আটকে থাকে। সূর্যের আলো তাদের শরীরে পড়লে চকচক করে। তখন তার চোখ ছলাৎ করে ওঠে।
এই তো আজ সকালে গগনের চোখ খিলখিল করে হেসে উঠল।একঝাঁক ইলিশ। বেশ বড় বড়। গায়ের রং রুপোর মতো ঝকঝক করছে। রাঙা আলোয় তা যেন আরো আরো রমণীয় হয়ে উঠছে। তার আনন্দের শেষ নেই।
…কিরে গগন, আজ কেমন লাগছে?
…আগে জ্যান্ত ইলিশ দেখিনি গো কাকা। অহ কত্ত ইলিশ! একটা যদি বাঁচিয়ে রাখা যেত!
ট্রলারের পেটের ভেতরে নেমে নিতাই মাছ গুছিয়ে গুছিয়ে বরফে ঢাকছিল। গগনের কথা শুনে সোজা হয়ে বলল,
…কেন রে কি করবি? 
…না, কিছু না। ওই বোনের জন্য নিয়ে যেতুম। ও দেখলে না, খুব আনন্দ পেত !
…দূর। দেখছিস না? তুলতেই সঙ্গে সঙ্গে মরে যাচ্ছে।
তারাপদ তার পাশেই ছিল। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে শোনাল,
…বোনের জন্য মন খারাপ করিস না। ওদিকে গেলে তোর মন আরো আরো ভালো হয়ে যাবে।
…কোনদিকে?
…ঐ যে দূরে। দেখছিস, ঐখানে। ওখানে গেলে এর থেকে ঢের মাছ দেখবি। আর ইলিশ? ঐখানে আরো ঝাঁকে ঝাঁকে পাওয়া যায়।
…চলো না কাকা ঐখানে যাই।
নিতাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইল তারাপদর দিকে।
…ক্যালানে, তোর কি আক্কেল জ্ঞান নেই। কেন এসব কথা শোনাচ্ছিস ওকে? ওখানকার ঘটনা জানিস না?
…না, মানে, দাদা ও...
…ও জানে ওখানে এত্ত এত্ত মাছ পাওয়া যায়? তুইও ছেলে মানুষ হলি নাকি?
ওখানে যাব না। এদিকে যা হয় হবে।
গগন চুপ করে শুনছিল কথাগুলো। কিন্তু তাদের কথা ঠিক করে বুঝে উঠতে পারেনি।ওখানে কিছু একটা যে ব্যাপার আছে,তা অনুমান করে সেও চুপ করে রইল।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে ট্রলারের মেঝে ছাউনির ভেতরে তারাপদ, পবন, গগন শুয়ে পড়ল।ঠাণ্ডা হওয়া এসে লাগছে তাদের গায়ে। ট্রলার দোলনার মত দুলছে। পবন ঘুমিয়ে পড়েছে। জালগুলো মাস্তুলে আছে। রোদে শুকোচ্ছে। গগন পাশ ফিরে শুয়ে তারাপদকে জিগ্যেস করল,
…ওদিকে কি আছে গো? নিতাইকা তোমাকে বকল কেন?
…ও, কিছু না। ওদিকে জলের টান খুব কিনা! তাই…
…ও বুঝেছি, তুমি আমাকে বলবে না।
ঠিক আছে বলতে হবে না।
বলেই তারাপদর উল্টোদিকে ফিরে শোয়। তাকিয়ে থাকে জলের দিকে। ঢেউয়ে ঢেউয়ে সূর্যের আলো আয়নার মতো ঝলসে উঠছে।দূরে দু-একটা নৌকা দেখতে পাচ্ছে। ভাবলেশহীন হয়ে অপলকে সে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে ।
তারাপদ তার গায়ে হাত দিয়ে বলে,
…আসলে ওদিকে...
…ঠিক আছে, আমাকে বলতে হবে না। আমি জেনে কি করব বলো?।
দুজনেই একটু চুপ করে যায়। গগন আবার শুরু করে,
…কিন্তু যদি ওদিকে গেলে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ পাওয়া যায়। তাহলে আমাদের ট্রলারটা তাড়াতাড়ি ভরে যেত। আর আমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি...
কথা আর তার বের হলো না। কেবিন থেকে নিতাই বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল।

চুপ করে গেল সে। আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। অন্যদের মতো সেও কিছুক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়ল।

(৪)

অপ্রত্যাশিত কিছু পেলে মানুষ প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খায়। প্রথমেই যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। পবনদের তাই হলো। তারাপদ গগনকে নাড়া দিয়ে ডাকতে লাগল। গগন চোখ ঘষতে ঘষতে উঠল।
…কি হলো? ডাকলে কেন?
…আরে দেখ, আমরা সেইখানেই প্রায় এসে গেছি রে। ওঠ ওঠ। জাল গুছাতে হবে। একটু পরেই তো জলে ফেলব। ওঠ।
গগন তাকিয়ে দেখে বিকেলের সূর্যের পরন্ত আলোয় নদীর জল লাল হয়ে খেলতে খেলতে মিলিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। তারা যেন একটা বাঁকের কাছেই এসে পড়েছে। বেশ অনেকটা দূরে গাছের সারি বলে মনে হলো। তা দ্বীপ, না কোনো লোকালয়ের, না তীরভূমির ইঙ্গিত, কে জানে?
নিতাই মেশিন বন্ধ করে মাস্তুলে বেরিয়ে এল।
গগন দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে।
…কি এবার খুশি তো? আছ যদি কপাল ভালো থাকে তো কাল সকালে দেখবি মাছ কাকে বলে? আর সব ঠিক থাকলে কালই আমরা বাড়ির দিকে রওনা দেব। যা জাল রেডি কর সবাই। কিরে রে তারা? আমার কথায় খুব খারাপ লেগেছিল না? এবার?
তারাপদ, পবন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
…যা দেরি করিস না। সূর্য ডুবলেই জাল ফেলতে হবে। তৈরি কর।

জাল তৈরি করে তারা অপেক্ষায় ছিল। সূর্য ডুবতেই জাল ফেলতে ফেলতে সেই দিকে এগিয়ে গেল।

রাত বাড়ল। স্রোতের টানে তারাও ভাসতে লাগল। খেয়ে শুয়ে পড়ল সবাই। নিতাই শোবার আগে একবার জালের দড়িতে হাত দিয়ে কি ভেবে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
…গগনরে,মনে হয় কালই আমরা বাড়ি ফিরব।
তারাপদ উঠে বসে। নিতাইয়ের কথায় তার মুখে হাসি ফোটে।
…সত্যিই বলছ, দা? কি করে বুঝলে?
…একবার এদিকে এসে হাত দিয়ে দেখ।
তারা সবাই গেল সেখানে। একে একে দনে হাত দিতে লাগল। নিতাই গর্বের সঙ্গে বলে উঠল,
…কি টের পেলি? আমি কি মিথ্যে বলছি।
যা এবার সবাই শুয়ে পড়। একটু ভোর ভোর উঠতে হবে।

ভোর থাকতে থাকতে সবাই জাল টেনে টেনে তুলতে লাগল। নিতাই ট্রলারের পেটের ভেতরে নেমে মাছ এদিকে ওদিকে সরিয়ে দিতে লাগল। আবছা আলোয় তাদের লণ্ঠন ফ্যাকাসে হয়ে এল। হঠাৎ নিতাই বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখে একটা ট্রলার তরতর করে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
তড়িঘড়ি উঠে পড়ে সে। শিউরে উঠল তার সারা শরীর।
…তারাপদ, পবন জাল কেটে ফেলা। যা ভয় পাচ্ছিলাম তাই হলো।কাট তাড়াতাড়ি।
মাছ ছাড়াতে ছাড়াতে তারাপদ মশগুল হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ এমন নির্দেশ কেন? বুঝে উঠতে পারেনি।
…কেন দাদা, কি হলো। ট্রলারের খোল কি ভরে গেছে?
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলে ওঠে,
…না রে, না। কাট বলছি।
পবনের মতো গগনও যেন তা মেনে নিতে পারল না। আজ এত মাছ দেখে সে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল। কথাটা সহজে হজম করতে পারল না।
…কেন কাকা? এখনো তো অনেক জাল তুলতে বাকি আছে।তারাপদকা, পবনকা কেউ কাটবে না। এখনো…
তার কথা শেষ হবার আগেই নিতাই ধকম দিয়ে ওঠে।
…তারাপদ, পবন কাট শিগগির। ঐ দেখ এসেই পড়েছে। কাট কাট।
বলেই নিচে নেমে ইঞ্জিন স্টার্ট করে দিল। তারাপদ, পবন সেদিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে গেল। ট্রলারটা তাদের কাছেই প্রায় এসে পড়েছে। বিপদ তাদের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে যেন। মাছ ধরার ঘোরে তারা তা টের পায়নি।

দুজনে মিলে জাল কাটতে লাগল। গগন একবার ওদের দেখে এবার সেই ট্রলারের দিকে দেখে। কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাস্তুলে বসে পড়ল সে।

নিতাই চেঁচাচ্ছে।
…জলদি কাট। জলদি কাট রে। ইঞ্জিন লোড নিতে পারছে না…
…আর বেশি বাকি নেই। হয়ে এসেছে।
…এত বড় জাল ইঞ্জিন টেনে নিয়ে যেতে পারছে না। কাট শিগগির।কাট-ট-ট...

আর রক্ষে নেই। দেখতে দেখতে জনা সাতেক লোক লাফিয়ে পড়ল তাদের ট্রলারে। তিনজন ঝাঁপিয়ে পড়ল কেবিনে। তারাপদ, পবন তাদের হাতের লম্বা লম্বা সোর্ড দেখে থ হয়ে গেল।
নিতাই আঁ করে চেঁচিয়ে উঠল। গগন এককোণে চুপচাপ বসে রইল। থর থর করে কাঁপছে।
নিতাইকে টানতে টানতে তারা মাস্তুলে বের করে আনছে। নিতাইয়ের কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। নাকের বেয়ে তা টপটপ করে ঝরে পড়ছে মাস্তুলে।
আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে। লোকগুলোর হাতের তরবারিগুলো সিতেপাটি মাছের মতো চকচক করছে। কারো হাতে বন্দুক। লোকের মুখে তারা এতদিন এমন ঘটনার কথা শুনত। কিন্তু তাদের এমন হবে কে জানত? আজ তাদের প্রাণ যেন এ ক'জনের হাতের মুঠোয়। মৃত্যুর মুখোমুখি যেন তারা দাঁড়িয়ে আছে।
তাদের অবস্থা ও নিতাইকে দেখে পবনদের মুখ থেকে আর একটাও শব্দ বের হলো না।

…চল সব ঐ ট্রলারে চল। দেরি করলে সব কটাকে এখানেই শেষ করে দেব।
…আমাদের ছেড়ে দাও। আমরা সব দিয়ে চলে যাব।
পবন কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু গেড়ে লোকটার পায়ের কাছে বসে পড়ল। লোকটা সরে গেল।
…ছেড়ে দেই তারপর কোনো হাঙ্গামা হোক আরকি? চল, চল, ঐ ট্রলারে চল।
তারাপদ গেল ক্ষেপে।
…তোমরা যা বলবে তাই নাকি। যাব না...কি করবে? 
...কি করব দেখবি?
বলেই একজন তরবারি হাতল দিয়ে সজোরে ঠুকল তারাপদর মাথায়।মাথাটা যেন তার ঘুরতে লাগল। বসে পড়ল সে। গগন দেখে তারাপদর কানের পাশ দিয়ে রক্ত সুতোর মতো গড়িয়ে আসছে।

ভয়ে সে আঁতকে ওঠে। তাকে দেখে একজন তার কাছে গেল।
…ওরে একটা বাচ্চাও আছে রে। এটাকে কি এখানে...
তার কথা শেষ হবার আগেই নিতাই অতি কষ্ট করে বলে ওঠে,
…ওকে কিছু করো না। আমরা যাচ্ছি।
অন্য ট্রলারে তখনও একজন ছিল। নিতাইদের ট্রলারের তুলনায় এই ট্রলার ছোটো। ট্রলারের পেটের ভেতর থেকে সেই লোকটা উঠে এল। তার হাতে একটা ছেনি আর হাতুড়ি।
…যা সব নিচে নাম। নাম বলছি।
নিতাইরা একে একে সেই ট্রলারে পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। তাদের নেবু গাঁট জলের তলায় ডুবে গেল।
গগনকে জোর করে ফেলে দিল তাদের কাছে। গগন ডুকরে কেঁদে উঠল।

ঝপাস করে ওপর থেকে একটা ডাকনা পড়ল। শিকল দিয়ে সেটা যেন কেউ আটকে দিল মনে হচ্ছে। নিতাই তা অনুমান করে শিউরে উঠল।
সেই ডাকনায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগল।
…খুলে দাও বলছি। খুলে দাও। তোমাদের পায়ে পড়ছি। খুলে দাও।
আর খুলে দাও? কে শুনছে সে কথা?

নিতাইরা ভয়ে, আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে গেল। মিনিট দু-তিন বয়ে গেল। মনে হলো এখন আর কেউ পাটাতনের উপর চলাফেরা করছে না। হঠাৎই নিতাইদের ট্রলারের মেশিন স্টার্ট হয়ে গেল। কালঘাম ঝরতে লাগল সবার শরীর থেকে।
…দাদা, তলা দিয়ে জল গলগল করে ভেতরে ঢুকছে। আমরা মনে হয়...
নিতাই এতক্ষণ পরে টের পেল। সত্যিই তো, জল এখন হাঁটুর কাছাকাছি। সোজা হয়ে কেউ দাঁড়াতে পারছে না। সেও ঝুঁকে রয়েছে। তারও চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে।কিছু বলতে গিয়ে কথা আটকে যাচ্ছে।
…কাঁ-কাঁ-কাঁদিস না পবন। সেই তো একদিন...
আর কথা বের হলো না। গলায় আটকে গেল। টপটপ করে জল পড়ছে চিবুক বেয়ে। গগনকে জড়িয়ে ধরল সে। গগন হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। তারাপদ,পবন কাঁধের ধাক্কায় কাঠের পাটাতন ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। কিন্তু পারছে কই? পেরেক দিয়ে জম্পেস করে সাঁটানো আছে মনে হলো।
জল ক্রমশ তাদের যেন আষ্টপৃষ্ঠে গিলে ফেলছে। ট্রলারের দুলুনি কমে আসছে।  ভয়ে তাদের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

বাইরের থেকে সামান্য সামান্য আলোর ছটা ঢুকছে ভেতরে।বাইরেটা বোধ হয় এখন পুরোপুরি ফর্সা হয়ে গেছে।
নিতাই গগনের মুখে বার বার চুমু খেতে লাগল।
…তোকে আর তোর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলাম নারে।নিয়তি মনের হয়ে তা চায় না।

গগন উচ্চ-স্বরে কাঁদতে লাগল। দম বন্ধ হয়ে আসছে সবার। প্রাণটা যেন ছটফট করে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে। মাথা আটকে গেছে পাঠাতনে। গগনের কান্নার স্বর মাঝে মাঝে কেটে কেটে যাচ্ছে।

তারপর হঠাৎই সেই কান্নার আওয়াজ জলে তলিয়ে গেল।

0 comments: