ধারাবাহিক - গার্গী বসু
Posted in ধারাবাহিক(পর্ব ২)
ভার্জিনিয়া কেন্ট মিলার অর্থাৎ বিলির পিসি মাঝে মাঝেই আসেন সালেমে, ওর দিদার বাড়িতে। কি অসাধারণ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আর ব্যাক্তিত্ব! বিলি মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বিলির মনে হয় দিদা ওঁকে সহ্য করতে পারেন না। মুখে অবশ্য বেশি কিছু বলেন না, এমনিতেই কম কথার মানুষ। কিন্তু হাবেভাবে একটা বিরক্তি প্রকাশ করেন। ভার্জিনিয়া বিলির জন্যে নিয়ে আসেন নানারকম উপহার। আর বিলিকে আদর করে একটাই কথা বলেন, “আর মাত্র কয়েকটা বছর বিলিন্ডা, তোমাকে আমি নিয়ে যাব এখান থেকে। তুমি আমার কাছে থাকবে নিউইয়র্কে।“ কিন্তু দিদা দাদুর কি হবে তাহলে? বিলি এই প্রশ্নের উত্তর পায়নি। পিসির কাছে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেও পিসি চুপ করে থাকেন। বিলির মনে হয়, বাবার হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বোধহয় উনাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। তাই হয়ত চুপ কর থাকেন। এত সুন্দর একজন মানুষ কষ্ট পেলে বিলিরও খারাপ লাগে। তাই বেশি প্রশ্ন করতে পারেনা ও। দিদা কিন্তু বিলিকে অনেক গল্প বলেন। মায়ের ছোটবেলার গল্প। মা যখন তার মত কিশোরী ছিলেন তখনকার সব কথা। ভারি মজা লাগে শুনতে।
বিলিন্ডা গ্রিন এখন এক মিষ্টি কিশোরী। ”মিষ্টি” কথাটা অবশ্য দিদাই একমাত্র বলেন। বিলি জানে সে একটু অন্যরকম। মিষ্টি তো একেবারেই নয়। তার সবচেয়ে বড় প্রমান এই যে এত বছরেও ওর কোন বন্ধু হয়নি। স্কুলের মেয়েরা ওর সাথে কথা বলে না। তাদের আড্ডায় বিলির স্থান নেই। সবাই এড়িয়ে চলে বিলিকে। এক এক সময় মনে হয় ভার্জিনিয়া পিসির সাথে নিউইয়র্ক চলে গেলেই বোধহয় ভাল হত। সত্যি সত্যি সেখানে হয়তো নতুন বন্ধু পাওয়া যেত। জীবন অন্যরকম হত। অনাথ আশ্রমের সেই বন্ধুদের খুব মনে পড়ে। জীবন তখনও সুন্দর ছিল না। কিন্তু মনের কথা ভাগ করে নেওয়ার লোক ছিল। শার্লি ছিল। শার্লি কি এখনও ওখানেই আছে নাকি ওর পরিবারের কাছে ফিরে গেছে? কিন্তু ওরও তো কেউ নেই। বিলিও তো একা। আরও একা হয়ে গেছে সালেমে এসে। আরও চুপচাপ। পড়াশোনার পরেও যে সময়টা থাকে সেই সময়ে বিলির একমাত্র সঙ্গী ডার্বি। এই বাড়িটা এমনিতে বিলির পছন্দসই। এত গাছ চারিদিকে। একটা সবুজ ঠাণ্ডা ছায়া ভরে থাকে ঘর, বারান্দা। নানারকম মসলা আর ভেষজ ঔষধি গাছের ছড়াছড়ি। দিদার সাথে থেকে থেকে সেসব চেনা হয়ে গেছে বিলির। সাধারণ থেকে কঠিন সব অসুখ-বিসুখের ওষুধ লুকিয়ে আছে আছে গাছ-গাছড়ার সঠিক প্রয়োগের মধ্যে। দিদা বলেন, “মানুষের সব প্রশ্নের সমাধান আছে প্রকৃতির কাছে।“ কোন গাছের ছাল কোন অসুখ সারায় আর কোন গাছের পাতা কোন রোগ তাড়ায় সেসব বিলির মুখস্থ। বাড়ির পেছনের বাগানটায় আরও সব বড় বড় গাছ আছে। কত পাখি, কাঠবিড়ালি, প্রজাপতি, পিঁপড়ে আছে সেখানে। অঢেল আলো, ছায়া আর শান্তি। বাগান পেরিয়ে যেখানে বেড়াটা শেষ হয়েছে সেখান থেকে একটা চওড়া রাস্তা উঠে যায়। সেই রাস্তার ওপারে একটা জঙ্গল আছে। এপার থেকে দেখা যায় লম্বা লম্বা গাছেরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে এ ওর গায়ের সাথে লেগে। ভেতরে নাকি আরও গভীর বন। সেখানে সূর্যের আলো মাটিতে পড়ে না। দিন-রাত সব যেন এক। অন্ধকার। লতাপাতা বিছানো ভেজা ভেজা নরম মাটি। বিলির খুব ইচ্ছা করে ঐ বনের ভেতরে যেতে। বর্ষার দিনগুলোতে হাওয়ায় শ্যাওলার গন্ধ ভেসে আসে। জোরে জোরে নাক টেনে নিশ্বাস নেয় বিলি। রাস্তা পেরিয়ে দু একবার বনের কাছাকাছি গেছে সে। কিন্তু সেখান থেকেই আবার ফিরেও এসেছে। একদিন অরণ্য অভিযানে বেরিয়ে পড়তে ভীষণ ইচ্ছা করে। আর ঐ জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে কি আছে ওখানে? মাথার অনেকটা জুড়ে ঐ রোমাঞ্চকর অরণ্য ভ্রমণের কল্পনা বুনে চলে একা একা।
নিউইয়র্কের মত শহরে এসব কল্পনা করাও দুরস্থান।
সেইদিক থেকে বিচার করলে এই জায়গাটা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কিন্তু প্রকৃতির সান্নিধ্য আর নৈসর্গিক দৃশ্য ছাড়া আর কি আছে সালেমে? পুরনো শহর । তার থেকেও পুরনো বোধহয় এই বাড়ি। গাছপালা ঘেরা শান্ত পরিবেশে সারা পৃথিবীর থেকে আলাদা হয়ে থাকা একটা কালো দেওয়ালের আড়াল ঢাকা বাড়ি। দিদার জন্ম এখানেই হয়েছিল, এই বাড়িতেই। তখন পরিবারে অনেক লোকজন ছিল। একান্নবর্তী পরিবারে অনেক ভাইবোনেরা মিলে থাকতো। হাসি মজায় গমগম করত এই বাড়িটা। তারপর একদিন গভীর রাত্রে হঠাৎ আগুন লেগে যায়। পুড়ে ছাই হয়ে যায় সব। দিদা তখন বিলির মতই কিশোরী। সেই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে দিদার শরীরের ডান দিকটা ঝলসে গেছিল। একটা চোখও নষ্ট হয়ে যায়। কোনোরকমে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারে দিদা। কিন্তু আর কেউ বাচেঁনি। আর তারপর থেকে বিলির মত দিদাও একা একা বড় হয়েছে। সেই কারণেই কি দিদা এত আগলে সবার থেকে আড়াল করে রাখে বিলিকে? কে জানে হয়ত সব দিদারাই তাদের নাতি নাতনিকে নিয়ে এরকম করেই ভাবে। সালেমের আশেপাশে আরও যে ছোট ছোট টাউন আছে সেখানেও অনেক আত্মীয়রা থাকত নাকি বহুদিন আগে। তারা সবাই মারা গেছে। দিদার আরও ভাইবোন যারা সালিসবারি, গ্লসেস্টার, টপ্সফিল্ডে থাকতো তারাও অনেকে আগুনে পুড়ে মারা গেছে। কি আশ্চর্য কাণ্ড! এইখানেই একটা খটকা লাগে বিলির। দিদার কাছে ছোটবেলার গল্প শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। তার পরিবারের এত মানুষ একইভাবে আগুন পুড়ে মারা গেল কিভাবে? কিন্তু প্রশ্ন করলে দিদা বলে সে এখনও যথেষ্ট বড় হয়নি এইসব কথা জানার জন্য। যথাসময়ে সব জানতে পারবে।
স্কুলে বিলিকে ছাড়তে যখন দিদা যেত, অন্যান্য মেয়েরা ভয়ে দৌড়ে পালাত। দিদার এক মাথা রুপোলী চুল, অজস্র বলিরেখা ছড়ানো মুখমণ্ডল, ডান চোখের জায়গায় কালো গর্ত, ডান হাতের ঝলসানো চামড়া আর খুঁড়িয়ে হাঁটা দেখে ছোট মেয়েরা “ডাইনি” বলে চিৎকার করে উঠত। সেই কারণেই হয়ত বিলির সাথে বন্ধুত্ব করতে কেউ আসতো না। দিদা কিন্তু এসব কথায় বিশেষ পাত্তা দিতোনা। দিদার সারাক্ষণ বিলির দিকেই নজর থাকত।
বন্ধুহীন জীবনে নিজেকে ভীষণ অসুন্দর মনে হত বিলির। একমাত্র সাথী ডার্বিকে সঙ্গে নিয়ে বিলি ঘুরে বেড়াত বাড়ির পেছনের বাগানটায়। মাঝে মাঝে চলে যেত ঐ দূরের জঙ্গলটার কাছাকাছি। আর এক একদিন আশ্চর্য সব জিনিষ আবিষ্কার করে ফেলত। বাগানের শেষে যে গাছে ঢাকা জঙ্গলের রাস্তাটা আছে, সেখানেই বিলি একদিন তিন আঙ্গুলযুক্ত অতিকায় পায়ের ছাপ খুঁজে পেল। পাখির পায়ের মত ছাপ কিন্তু আকারে বিশাল। এত বড় আকৃতির পাখি যদি সত্যি থাকে তাহলে তার ডানাও অনেক বড় হওয়া উচিৎ। তবে সেটা আকাশে ওড়ার বদলে মাটিতে হাঁটে কেন? পায়ের ছাপটা বাইরে থেকে ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে গেছে। অদম্য আকর্ষণ বোধ করতে থাকে বিলি। যেতেই হবে তাকে ঐ মায়া-অরণ্যে রহস্যের বাকি অংশটুকুর খোঁজে। একটা আজব দুনিয়া নিশ্চয়ই আছে ঐ বনের ভেতরে।
তারপর একদিন ডার্বিকে সঙ্গে নিয়ে ঐ পথে পা বাড়ায় বিলি। গাছ থেকে নেমে আসা ডালপালা সরাতে সরাতে ক্রমশ ভেতরে যেতে থাকে। দিনের আলো যেন মরে আসে ধীরে ধীরে। সবুজ ঘন জঙ্গলের মধ্যে ধূসর নৈশব্দ। কিছু দূর গিয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়াগার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল একটা গাছ। সেই গাছটার মোটা মোটা ডাল ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর পর্যন্ত। ডাল গুলো থেকে ঝুলে আছে অনেকগুলো দড়ির ফাঁস। যেন অনেকে মিলে একসাথে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে এখানে। বিলি সেখানে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে গুনতে লাগল ফাঁস গুলো। এক দুই তিন করে উনিশটা ফাঁস ঝুলে আছে গাছ থেকে। গোনা শেষ হওয়ার আগেই বিলির মনে হল ঠিক তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ও। কৈ? কেউ তো নেই। শুধু গাছের পাতায় পাতায় হাওয়ার শব্দ বয়ে গেল। বিলির খেয়াল হল ডার্বি পাশে নেই। ডার্বি? কোথায় গেল ডার্বি? বিলি ডার্বির নাম ধরে ডাকল কয়েকবার। কেউ কোন সাড়া দিল না। বিলি পেছন ফিরে দৌড়তে লাগল বাড়ির দিকে।
ডার্বিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। বিলি মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকলো। বেচারি ডার্বি। বিলির সব সময়ের সঙ্গী আজ তারই একটা ভুলের জন্য নিখোঁজ। কান্না পেতে থাকে বিলির। দিদাকে এসব কথা বললে একা একা বেরনো বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু বলতে পারেনা ও। অনেক নিয়ম কানুন মেনে বিলিকে থাকতে হয় এখানে। রাত বারোটার পরে জেগে থাকার অনুমতি নেই। কারুর বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি নেই। এমনকি দিদা তাকে চার্চেও কখনও নিয়ে যাননা। এত কড়াকড়ি ভাল লাগে না বিলির। কিন্তু উপায় কি? দাদু দিদা দুজনেই বিলিকে সাবধানে থাকতে বলেন। ওদের ভয় ভার্জিনিয়া যে কোনদিন এসে নিয়ে যেতে পারেন ওকে এখান থেকে। আরও একটা ভয় আছে। সেটা কিসের জানেনা বিলি। কিন্তু বাড়ির পেছনের ঐ জঙ্গলের নাম শুনলে সবাই ভয় পায়। বহু বছর ধরে কোন গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে ওখানে। এরকমটা বিলির মনে হয়। অতিকায় পায়ের ছাপ! পাখির নাকি অন্য কিছুর? কোন অজানা প্রাণী? যার কথা পৃথিবীর কেউ জানেই না? আর ঐ উনিশটা ফাঁস? বিলির মনে অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করতে থাকে। সেগুলো নিয়েই দিনরাত ভাবতে থাকে ও। ভাবে একদিন এই রহস্যের সমাধান করবেই করবে।
ঠিক পরের দিনই ডার্বির রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া গেল বাড়ির পেছনের বাগানে। ধারালো নখ দিয়ে কোনো পশু ফালাফালা করে দিয়েছে ডার্বির শরীরটা। গলার লাল রিবন আর ক্রিস্টালের লকেটটা নেই। এ যে ভয়াবহ কাণ্ড! শোকের ছায়া নেমে এল বাড়ির ভেতরে। ডার্বিকে হারিয়ে ফেলার দুঃখ তো ছিলই। এখন তার সাথে যোগ হল রাগ। একটা অবলা প্রাণীকে যে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলল, তাকে ছেড়ে দেওয়া যায়না। তার শাস্তি প্রাপ্য। খুঁজে বের করতে হবে আততায়ীকে। তারপর শাস্তি। চোয়াল শক্ত করল বিলি। বাগানেই একটা মেপল গাছের নিচে ডার্বিকে কবর দেওয়া হল। বিলি মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করল।
এরপর যেদিন ভার্জিনিয়া এলেন, সেদিন অবস্থা চরমে উঠল। ভার্জিনিয়া আইনের পথে যাওয়ার হুমকি দিতেই দিদা তাকে ভয়ানক আক্রমণ করলেন। প্রচন্ড কথা কাটাকাটি হল। বিলি কিছু বলার সুযোগ পেল না। বিলির মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে ওরা যেটা করছিলেন সেটাকে ঝগড়া বললে কম বলা হয়। এমনকি তাদের গলার আওয়াজ বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বিলি যেন একটা মূল্যবান সম্পত্তি, যার মালিকানা নিয়ে ঝগড়া করছেন দুজন ভাগীদার। কিন্তু সেই ঝগড়ায় বিলির প্রতি কারুর ভালবাসা প্রকাশ পাচ্ছে না উল্টে তাকে কব্জা করার জন্য দুই যুযুধান ভীষণ লড়াই করছেন বলেই মনে হচ্ছে। বিলির লজ্জা করল খুব। এ কেমন পরিবারে সে জন্মেছে? কার সাথে সে থাকতে চায় সে ব্যাপারে তার কোন মতামতই নেই? কেউ তো বিলিকে জিজ্ঞেস করছে না ও কার সাথে থাকতে চায়! দুই প্রাপ্তবয়স্ক অভিভাবকের কথোপকথন শুনে হতবাক হয়ে গেল ও। অর্থহীন লাগতে থাকল সব। নাহ! মুক্তি চাই। এইসব কিছু থেকে দূরে যেতে হবে।
বিলি ঠিক করল পালিয়ে যাবে।
কিন্তু কোথায় যাবে? একটা মতলব এল মাথায়।
আটঘাট বেঁধে পালানোর একটা দিনও ঠিক করে ফেলল। এবারের জন্মদিনটা কিছু তো একটা কারণ পাবে স্মরণীয় হয়ে থাকার। বিলি ঠিক করল পালিয়ে যাওয়ার আগে একটা চিঠি লিখবে শার্লিকে। অনাথ আশ্রমের ঠিকানায়।
(ক্রমশ)
0 comments: