1

গল্প - সৌমিত্র চক্রবর্তী

Posted in

নীলের কথা

গড়াতে চাওয়া লালা আলতো করে মুছে নিল নীল। সযত্নে তাকালো। বেশ পরিচ্ছন্ন লাগছে এখন। আজ সকালেই শেভ করে দিয়েছে, শ্যাম্পুও। এই ফতুয়াটা বেশ মানিয়েছে। বোধহয় মণি পিসি দিয়েছিল। মা খুব মনে রাখতে পারত এসব, কে কি দিল, কবে কার জন্মদিন। এখন অবশ্য নীলও মনে রাখে এই জন্মদিনটা। কেন? মা-র হয়ে নাকি তার মনে রাখতে ভালো লাগে বলে? মানুষটার দিকে আরেকবার দেখল সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ছ ফুট থেকে ইঞ্চি চারেক কমে যাওয়া একটা শরীর। সময়ের থাবা বড় বেশী দাম নেয় কখনও কখনও। ছোটবেলা থেকে বড়বেলায় পৌঁছনোর সময়টা কি উত্তালই না ছিল এ'বাড়ি। রোজ সংঘাত, রোজ যুদ্ধ। একদিকে শৃংখলা শেখানোর অনবরত প্রচেষ্টা, অন্যদিকে বাঁধনকে দেখামাত্র তুড়ি মেরে ওড়ানো। নীলের অসহ্য লাগত মাঝে মাঝে, এতো মেপে চলা, এত কর্তব্যবোধ, ঠিক-বেঠিকের হিসাব, মনে হতো রোবটের ঔরসে জন্ম তার। সে নত হতে চায়নি, মেনে নিতে চায়নি, তার কাছে জীবন মানে অন্য কিছু ছিল। পাখির মতো জীবনকে খুঁটে দেখতে চেয়েছিল সে, ঝড় কিংবা বাসার তোয়াক্কা না করেই। তার মনে হয়েছিল খড়কুটো উড়বেই, নেমে আসবে হিংস্র বাজ, তা বলে উড়ানের থেমে যাওয়া চলেনা। আর যাই হোক, জীবনের হিসাব ক্যালকুলেটরে হয় না। শেষ অবধি হতাশায় মাথা নামিয়েছিল শৃংখল, ক্যালকুলেটরের বোতামগুলো কাজ করা বন্ধ করেছিল। নীল বুঝেছিল জিতে গেছে, অর্জন করেছে সে নিজের জীবন নিজের শর্তে। বোঝেনি নরম মাটির শিক্ষা ঘুণপোকার মতো, রন্ধ্রে রন্ধ্রে তার অমোঘ বিস্তার। তা না হলে আজ, ইদানীং কি করছে সে? কেন ঘষে-মেজে পরিস্কার করছে বন্ধন? ডানারা আকাশে নিজেদের না মেলে কেন হয়ে উঠছে আকাশের মতো এক আশ্রয়? মা নেই, তার নিজের সংসার নেই, তবু তার পা এত বাধ্য কেন? তার মাথার মধ্যের ক্যালকুলেটরে দিনে-রাতে চলতে থাকা ওষুধ- স্নান - রক্তচাপ মাপার হিসাব নীলকে প্রতি মুহূর্তে বোঝাতে থাকে, তার ডানা মেলতে চাওয়ায় ভুল ছিল না, কিন্তু ঝড় হলে বাসার খড়কুটো সামলানোর শিক্ষাও পাখিকে নিতে হয়, নিতেই হয়।


অমলের কথা 

অমল হাসলেন। অমল হাসেন। যদিও কেউ দেখতে পায় না। এখন অনেক কিছুই দেখা-বোঝা যায় না তাঁর। অথচ যাবতীয় দোলাচল, আবেগের ওঠা-পড়া আগের মতোই চলে অন্তরমহলে। শুধু অমল তা বোঝেন, অন্যরা নয়। তাদের দৃষ্টিপথে ধরা থাকে ঈষৎ ন্যুব্জ, কর্মক্ষমতাহীন এক প্রায় অচল দেহ আর ভাষাবিহীন জোয়ার-ভাঁটা না খেলা দুই চোখ। মাঝে মাঝে বড় ক্লান্তি আসে শরীরে। অবাধ্য স্নায়ুরা থেকে থেকেই অব্যাহতি চায়। বিছানা কিংবা এই হুইল চেয়ারে দেহ ফেলে দিয়ে অবচতনে অদ্ভুত এক হিসেব কষতে থাকেন অমল। একটা মজার জিনিষ লক্ষ্য করেছেন তিনি। একেকদিন হিসেবের একেক রকম ফল উঠে আসে আর প্রতিটি ফলাফলই তাঁকে অসম্ভব তৃপ্তি দেয়। আসলে জীবন এমন খেরোর খাতা যেখানে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগে কোনও নির্দিষ্ট একটা নিয়ম নেই। এখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হয় নতুন নতুন নিয়ম, মানুষের সংস্কার অনুযায়ী। আজীবন হিসেবী অমল বোঝেন, যে হিসেব তিনি আজীবন কষে গেলেন, তার যথার্থতা সম্বন্ধে তিনি প্রায় নিশ্চিত থাকলেও, সে হিসেবের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল আসলে নামমাত্র। অন্যভাবে হিসেবকে চলতে দিলেও বোধহয় ফলাফল মন্দ হতনা। নাহলে নিজেকে যে অন্য জীবনের নিয়ন্তা ভেবেছিলেন, বারবার সংঘাতে রক্তাক্ত হলেন ও করলেন, সে জীবন তাঁর হিসেব মতো বইল কই? সে তো নিজের নিয়মেই গড়িয়ে গেল এবং যেখানে যেভাবে পৌঁছল, তার সার্থকতা মেনে নেওয়া ছাড়া দ্বিতীয় উপায় তো নেই! অমল আজ বোঝেন, যে পথ তাঁর ছিল, সে এক পথ বটে, হয়তো সুবিধাজনকই এক পথ, কিন্তু সেটাই একমাত্র পথ নয়। আর তাই তো তাঁর পথের বিদ্রোহী পথিক এই পড়ন্ত আলোয় এখন তাঁর পাশে, অমল অনুভব করছেন সে পথিকের স্নেহের স্পর্শ নিজের মাথায়, কপালে, গালে। সে পথিক জানে না, অমল রোজ মনে মনে তার কাছে হার স্বীকার করে নেন, মেনে নেন একদিন না মেনে নেওয়া সেই অন্য পথের সার্থকতা। বিকেল বেলার রোদে রোজের মতো স্থির হয়ে বসে রইলেন অমল, গর্বিত পিতার মতো উপভোগ করতে থাকলেন তাঁর সমস্ত চেতনা জুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া নীলের যত্ন-আদর।

1 comment: