0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in


জেলা শহরের সরকারী গার্লস ইশকুলের সামনে দিয়ে যতবার গাড়ি যায়, ততবার ইশকুলের গেটটা দেখে শিউরে উঠে তালিয়া। 

পাশে বসা সহকর্মী বা অন্য কেউ কিছু বুঝতে পারে না। তালিয়া বুঝতেও দেয় না । এমনিতে পাথরের মত মুখ করে বসে থাকে সে । দরকারের বাইরে সামান্যতম বাড়তি কথা খরচ করে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক চিলতে হাসিও সে হাসে না কারো সাথে । অনেক সময় স্থানীয় কেউ আন্তরিকতার সাথে কথা বলতে গেলে দূরত্বের কঠিন গন্ধ পেয়ে নিজেরাই সরে যায়। ফলে স্থানীয়দের কারো সাথেই কাজের বাইরে কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি জেলা প্রশাসক তালিয়া শাহরিয়ারের। 

এখানকার সবাই জেনে গেছে উনি উনার মধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। থাকুন গে। তাদের কাজ হলেই হলো। 

তালিয়ার স্বামী রায়হান ইউএনডিবির চাকুরে। আজ এদেশ কাল ওদেশ। একমাত্র ছেলে স্বাগত অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। কম্যুনিকেশন এন্ড জার্ণালিজম এ পড়াশুনা করছে। ছেলের খুব ইচ্ছে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে পরিবর্তনশীল বর্তমান সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে লেখালেখি এবং ফিল্ম বানানোর। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রায়হানের বাবাকে মেরে ফেলেছে স্থানীয় রাজাকাররা। তিনি ছিলেন একটি বেসরকারী কলেজের ফিজিক্যাল শিক্ষক। কলেজ চত্বরের শহিদ মিনার যখন ভেঙ্গে দিচ্ছিল উন্মত্ত রাজাকারের দল, তখন রায়হানের বাবা ছুটে এসে প্রতিবাদ করেছিলেন। রাজাকাররা তখনই রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে আধমরা মানুষটাকে বেয়নেট চার্জ করে মেরে ফেলেছিল । তারপর শহিদ মিনার ভাঙ্গা সম্পূর্ণ করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে সেই রাবিশের স্তুপের নীচে লাশ রেখে চলে গেছিল শয়তানের দল । 

শোনা যায় রাজাকারদের কেউ কেউ নাকি সেই স্তুপে মনের আনন্দে প্রস্রাব করে হাসাহাসিও করেছিল। শোনা গল্পের এই ঘটনা যখনই রায়হানের মনে পড়ে , রায়হানের মুখচোখ শক্ত হয়ে ওঠে। ও জানে শোনা গল্প হলেও ঘটনা সত্য। সে সময় এর চেয়েও জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে পাকিস্তানী আর্মি আর তাদের পা চাটা রাজাকারের বাচ্চারা। 

রায়হান বাবাকে পেয়েছিল মাত্র আটমাস। বাবার সাথে কিছু ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতি নেই ওর। মামারা অল্পবয়সি বিধবা মাকে বেশিদিন একা থাকতে দেয়নি। দ্বিতীয় বিয়ের ফলে মা হয়ে যায় প্রবাসি। ইচ্ছে থাকলেও রায়হানকে কাছে রাখতে পারেনি মা। কিন্তু কর্তব্যে কখনো অবহেলা করেনি। প্রবাসে থেকেও রায়হানের লেখাপড়ার দিকে সযত্নে নজরদারি করে গেছে। 

মা চলে যাওয়ায় একলা পড়ে গেছিল রায়হান। একবার দাদাবাড়ি একবার মামাবাড়ি করে করে শেষ পর্যন্ত ক্যাডেট ইশকুল এন্ড কলেজ পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে বেশ ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু কি যে নেশা রায়হানের। দেশে থাকলে যেখানেই একাত্তরের কিছু হয় ও পাগলের মত ছুটে যায়। শহিদ মিনারের গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে কি সব কথা বলে। হাসে। রাগ দেখিয়ে দু পা হেঁটে এসে আবার ফিরে গিয়ে অভিমানে তাকিয়ে থাকে । 

গাঢ় রোদ্দুর। গাছেরা ঝিমুচ্ছে, পাতারা অলস তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের মুখের দিকে চেয়ে। উলোঝুলো শিশু বাতাস হাঁটি হাঁটি পা পা খেলছে পথের ধূলাময়লার সাথে। সেই সময় রায়হান ফাঁকা শহিদ মিনারের গায়ে হাত বুলিয়ে চুপি চুপি ডাকে, বাবা, বাবা, ও বাবা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাবা আমার একটা ছেলে হয়েছে ! নাম রেখেছি স্বাগত! ভালো না বাবা? 

ঝুম বৃষ্টি । রায়হান শহিদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে ভেজে আর কথা বলে, বাবা ও বাবা এবারের পোস্টিং পড়েছে সাউথ আফ্রিকা। যাবো তো বাবা ? 

প্রথম দিকে তালিয়া ভয় পেয়েছিল, ওহ গড ! এই তুমি পাগল টাগল নও তো ? 

রায়হান লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলেছিল, জানো তো তালিয়া আমার কাছে না আমার বাবা আর শহিদ মিনার এক হয়ে গেছে। সবাইকে তো সব কথা বলা যায় না। তাই মন টানলে মাঝে মাঝে শহিদ মিনারে চলে যাই। মন ভাল হয়ে যায়। এই টুকুই পাগল আমি বুঝলে ফুল পাগলি ! 

ছেলে স্বাগতের তখন কথা ফুটেছে ভাল করে। সেও বাবার সাথে শহিদ মিনার ছুঁয়ে ডাকে, দাদু ও দাদু গান শুনবে দাদাভাই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ার ? 



তালিয়া এসবের কোনো কিছুতে কোনো দিন যায় নি। 

রায়হান কতবার ডেকেছে, হাত ধরে টেনে নিয়েছে, তালিয়া একবার গলা মেলাও ! শুধু একবার আমার সোনার বাংলা-- গেয়ে দেখো ! তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভালো লাগবে তোমার ! 

ছেলে চোখে, মুখে, চিবুকে চুমু খেয়ে কত বার বলেছে, গাও না মা, প্লিজ গাও---

তালিয়া কখনো গায়নি। 

এমনকি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানগুলোতেও তালিয়া ঠোঁট বদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে রাখে। ওর পিঠের উপর তখন শিরশির করে ওঠে সাদা অক্টোপাসের মত কতগুলো আঙ্গুলের ছোঁয়া, এ লাড়কি তু তো হাফ পাকিস্তানি হ্যায়—তু গা, গা বদনসীব নাপাক নাজায়েজ লাড়কি, গা পাক সার জমিন -- তুর জন্যি এই গান ----- 

তালিয়ার মা বিভিন্ন জেলা শহরের সরকারী গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস ছিল। মার কাছে সে গল্প শুনেছে সদ্য স্বাধীন দেশে নাকি নিয়ম করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। এসেম্বলীতে সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ধর্মপাঠও করানো হত। এমনকি এক ধর্মের ছাত্রি অন্য ধর্মের আয়াত, শ্লোক, বাণী পাঠ করলেও কেউ কিছু মনে করত না। তখনো মানুষের মাঝে সম্প্রীতির সহবস্থান ছিল, ছিল মায়া মমতা আর পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনম বিশ্বাস আর ভালোবাসার মোহময়ী সম্পর্ক । 

তালিয়ার সময় এগুলো আর হয়নি। এসেম্বলিই হত না নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথে সম্প্রীতি, সদ্ভাব উবে গিয়ে দেখা গেলো নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে বাংগালীরা দ্রুত খাঁটি মুসলিম হতে উঠে পড়ে লেগে গেছে। এমনকি কেউ কেউ আভাসে ইংগিতে বলেও ফেলেছে, হিন্দুর লেখা গান কেনো বাঙালি মুসলিমদের জাতীয় সংগীত হবে ?

সেই প্রথম তালিয়া জানলো, রবীন্দ্রনাথা মানুষ নয়। রবীন্দ্রনাথা হিন্দু ! নজরুল বিদ্রোহী সাম্যবাদি কবি নয়, কেবল মুসলিম!



ওর মা ছিল জয়বাংলার কট্টর সমর্থক। 

বাবা নামের লোকটা যুদ্ধের পর পর পালিয়ে চলে গেছিলো ইংল্যান্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একবার এসেছিল। পাকিস্তানের সমর্থনে আর বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের আজেবাজে কথা শেখানোর পাশে চুপি চুপি পাক সার জমিন নামে একটা গানও শেখাতে শুরু করে দিয়েছিলো তাদের। 

জানতে পেরে প্রচুর আপত্তি করেছিল ওর মা। আপত্তি থেকে ঝগড়া আর ঝগড়া থেকে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয় সেই বাবা। মা তখন কি সব কাগজপত্র বের করে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বলে, এক্ষুণি কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে না গেলে সেগুলো পুলিশের কাছে তুলে দেবে ! বেরিয়ে যাও এক্ষুণি। তালাকের কাগজ পেয়ে যাবে তুমি। 

মার ব্যক্তিত্বের কাছে লেজ গুটিয়ে চলে গেছে লোকটা। আর আসেনি। শুনেছে পাকিস্তানী কোন মহিলাকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে ভালই আছে। লোকটা চলে যাওয়ায় মা বা ওরা কেউ দুঃখ পায়নি। বরং হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সবাই। 

বেশি খুশি হয়েছিল তালিয়া। 

কারন সেই বাবাটা সুযোগ পেলেই তালিয়ার পিঠ খামচে দিয়ে বলত, তোর জন্যে এদেশ নয়। তোর জন্যে পাক সার জমিন। আরে তু তো হাফ পাকিস্তানি হ্যায় গুড়িয়া।



অই বয়সে কথাটার অর্থ ভালো করে বুঝতে পারত না সে। তাছাড়া বড় দুই বোন তানজিয়া আর তানহা, তালিয়াকে বাবা নামের লোকটা থেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখত। পুরো তিনটে মাস লোকটা ওদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গেছে নির্লজ্জ নিষ্ঠুর প্রতিহিংসায়। 

চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজ শহরে ফিরে আসে তালিয়ার মা। শরীরও কেমন ভেঙ্গে পড়ছিল তার। আড়িয়াল খাঁ নদীপারে বসে মা একদিন এক গোপন সত্যকে খুলে দিয়েছিলো ওদের সামনে। অন্য তিন সন্তানকে তিনি বলেছিলেন, তালিয়াকে তোমরা ঘিরে থেকো। তালিয়া আমার অহংকার। 



মুক্তিযুদ্ধর সময় তিনি একটি ছোট শহরের গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর প্রথমে বামধারার একজন সচেতন নেতা এসে বলেছিলেন, ম্যাম প্রতিরোধ যুদ্ধে মেয়েদেরও তৈরি করা দরকার। ওদের ট্রেনিংএর জন্যে ইশকুলের মাঠটা কি পেতে পারি ? 

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে মানুষটাকে তিনি চেনেন, ভালো করেই জানেন। শহরের অধিকাংশের মত তালিয়ার মার কাছে শ্রদ্ধায় সন্মানে অনেক উঁচুতে ছিলেন মানুষটা। তিনি সাথে সাথেই সম্মতি দিয়ে দেন। 

অই ইশকুলের মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে মেয়েদের ট্রেনিং করাতেন সেই কমরেড। অনেক সময় মেয়েদের সাহস দিতে তালিয়ার মাও নেমে পড়তেন ট্রেনিংরত মেয়েদের সাথে। একটু চা, সামান্য মুড়ি মাখা, কোনোদিন সব্জী লুচি খেয়ে সবাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প করত। কি টগবগ দুরন্ত সময় তখন। মেয়েদের প্রত্যয় মাখা মুখে যুদ্ধ করার স্বপ্ন দুলে যেত কঠিন প্রতিজ্ঞায়। রেডিওতে পাকিস্তানী মিলিটারিদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের খবর শুনে মেয়েরা চাপা ঠোঁটে জানতে চাইত, ম্যাম আমরা কবে যুদ্ধে নামবো ? আর তো সহ্য হচ্ছে না ! কবে যুদ্ধে যাবো আমরা ! 



তখনো পাকিস্তানী আর্মি অই শহর দখল করে নেয়নি। তবে খবর আসছিল, খুলনার পথ ধরে যে কোনো দিন শয়তানরা চলে আসতে পারে এই শহরের দিকে। 

এপ্রিলের শেষ দিনের সকাল। পাকিস্তানী আর্মি প্রতিরোধ ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছিল সে শহরে । তালিয়ার মা সুলতানা শাহরিয়ার গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস, মুক্তিপিয়াসি মেয়েদের নতুন কমরেড অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে পাকিস্তানীদের পথপ্রদর্শকদের মধ্যে তার স্বামী নেতাগিরি করছে। মাথায় জিন্না টুপি পরণে পেশোয়ারী কুর্তা কামিজে এক নতুন অবতার যেনো ! 

মধুমতি নদীকে রক্তে ভাসিয়ে পাকিস্তানীরা দখল নেয় শহরটি। ডামি রাইফেলে লড়া যাবে না বুঝে মেয়েরা গ্রামে পালিয়ে গিয়েও বটি, সড়কি, বর্শা, দা হাতে সতত সজাগ থাকে। মনের ভেতর যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র, মেরে তবে মরব ! 

এরমধ্যে অবশ্য কয়েকটি ঘটনাও ঘটে গেছে। সন্মিলিতভাবে শহরের কাছেরই এক গ্রামে দা, বটি, সড়কি, বর্শা হাতে আক্রমণ উদ্যত পাকিস্তানী সৈন্য আর রাজাকারদের মেরে কয়েকজন মেয়ে প্রাণ দিয়েছে। কেউ কেউ ভরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচুরিপানার সাথে ভেসে পালিয়ে গেছে। আবার কেউবা ধরা পড়ে গেছে। 

ইশকুলের দারোয়ান জলিল সে সব খবর বলতে গিয়ে সজল হয়ে যেত ইশকুলের দারোয়ান জলিল মোল্লার চখ, আহা কি সোনার মেয়েরা গো আম্মা ! আচ্ছা আম্মা আল্লাহ কি অন্ধ কালা বোবা । নমরূদের মত পাকিস্তানি মিলিটারিদের উপর গজব দিয়ে মেরে ফেলে না ক্যান ! 



জোর করে ইশকুল কলেজ খুলে রেখেছিল পাকিস্তানী আর্মিরা। ছোট ক্লাশের মেয়েরা কেউ কেউ ইশকুলে আসতো। হিন্দু শিক্ষক শিক্ষিকারা কেউ ছিলনা। তারা পালিয়ে গেছিল। শহরে বাসা এরকম কিছু মুসলিম শিক্ষক শিক্ষিকা সিগনেচার করে তাড়াতাড়ি চলে যেত বাসায় । 

দারোয়ানরা ভয়ে কাঁটা হয়ে গেট পাহারা দেয়। তাদের গলার জোর কমে গেছে। যখন তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা ইশকুলে ঢুকে ম্যামের কোয়ার্টারে তার স্বামীর সাথে দেখা করতে চলে আসে। ম্যামের স্বামি বিরাট রাজাকার। মিলিটারি গাড়ি করে শহরে ঘুরে বেড়ায়। দেখলে বাঙ্গালী লাগে না। কেমন পাকিস্তানী পাকিস্তানী লাগে। আজকাল কথাও বলে উর্দুতে। 

যুদ্ধ সময়ের একদিন ইশকুল ছুটির পর কি এক কাজে চারজন নিম্নপদস্থ পাকিস্তানী আর্মি ইশকুলে আসে। তালিয়ার মা তখন একজন শিক্ষিকাসহ অন্য একজন ছাত্রীর মাকে নিয়ে গল্প করছিলেন। সিনিয়র পাকিস্তানী সৈন্যটি ছাত্রীর মাকে টেনে নিতে গেলে বাঁধা দেন তালিয়ার মা। 

আর কি আশ্চর্য ! তার স্বামির কাছে বহুবার এসেছে নাজিম সালিম নামের যে সৈন্যটি, সেই তাকে ধর্ষণে উদ্যত হয়। শত প্রতিরোধেও তিনি সেদিন ধর্ষিত হয়েছিলেন হেডমিস্ট্রেসের রুমে। দেয়ালজুড়ে অখন্ড পাকিস্তানের ম্যাপ, তার পাশে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ছবি, টেবিলের উপর গ্লোব, ডাস্টার, শিক্ষকদের হাজিরা খাতা আর মুড়িমাখা একটি ঘি রঙ বিষণ্ণ গামলা দেখে নিলো ধর্ষণের দৃশ্যটি। 

রুমের সামনে টানা লাল বারান্দা। বারান্দার মাটি ছুঁয়ে বিশাল মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে ভাঙ্গা শহীদ মিনার। সেখানে উড়ছিল পাকিস্তানের চানতারা পতাকা। পতাকাদণ্ডের মাথার উপর আর্ত চীৎকার করে উড়ে উড়ে বসছিল কয়েকটি দাঁড়কাক। ম্যামের স্বামী তখন দারোয়ান জলিলকে শাসাচ্ছিল, চুপ। একদম চুপ থাকবি। কেউ যেনো কিছু জানতে না পারে। 

তালিয়া সেই ধর্ষণের সন্তান। 

সব শুনে তালিয়া কাঁদেনি। ইনফ্যাক্ট কান্নার সুযোগ পায়নি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মত তিন ভাইবোন তালিয়াকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। যেনো তালিয়া একটি বদ্বীপ। ব্রম্মপুত্রের গেরুয়া জল প্রতিদিন নৈবদ্য দিয়ে চলেছে পলিমাটির শুদ্ধতায়। আর বুড়ো আড়িয়াল খাঁ তার পুণ্য জলে ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে তালিয়ার জন্মকথন। 



বিসিএস ট্রেনিংএ রায়হানের সাথে পরিচয় হয়। তালিয়ায় মুগ্ধ রায়হান সব শুনে শক্ত হাতে ওর হাত ধরে বলেছিল, ঈগলের চোখে অই পতাকাকে দেখবে আর মন্ত্রের মত গেয়ে যাবে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি --- 

তালিয়া অবশ্য সুর তোলেনি গলায় কিন্তু রায়হানকে জড়িয়ে নিয়েছিল জীবন চলার পথের সাথি হিসেবে।  



এই সেই শহর। চাকরী জীবনে তালিয়া কেবল অপেক্ষা করেছে এই শহরে আসার। এখানেই এক পাশবিক সঙ্গমে তার ভ্রুণ স্থাপিত হয়েছিল একটি অনিচ্ছুক গর্ভে। তাকে ভেসে যেতে দেয়নি সে গর্ভফুল। এই গার্লস ইশকুলের কোয়ার্টারেই জন্ম হয়েছিল তালিয়ার। 

নুন নয়, মধু মুখে প্রথম চীৎকার করে কেঁদে উঠেছিল যুদ্ধশিশু তালিয়া। ধাত্রী, শহরের পার্টটাইম কির্তন গায়িকা ললিতা বালা নরম কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে খুশিতে বলে উঠেছিল, আহা আহা! কি ঝামা গলা গো আমাদের মেয়ের! শ্রীকৃষ্ণের চরণফুল ঝরে ঝরে পড়বে এ মেয়ের গান শুনে ! 



এবারের ছাব্বিশ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নাজমা নামের মেয়েটি লাঠি খেলায় ওস্তাদ জব্বার শেখকে হারিয়ে দিয়েছে। হাত তালিতে ভেসে যাচ্ছে গোটা স্টেডিয়াম। জব্বার শেখ স্নেহ আশীর্বাদের হাত রাখে তার পায়ের কাছে বসে থাকা শিষ্যা বিজয়নি নাজমার মাথায়। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে হাততালির সাথে ভেসে আসছে গর্ব আর অহংকারের স্নেহভাস , হু নাজু আমাদের মেয়ে ! বীর মেয়ে! সোনা মেয়ে ! আমাদের মাতঙ্গিনী হাজেরা বালার নাতনি। সেই হাজেরাবালা গো। বর্শা আর রামদার কোপে যে একাত্তরে দুজন রাজাকার আর একজন পাকিস্তানি সৈন্য মেরেছিল ! মনে নাই ? 

দ্বিতীয় পুরস্কার হাতে নিয়ে জব্বার শেখ এক অদ্ভুত অনুমতি চেয়ে বসে জেলা প্রশাসক তালিয়া শাহরিয়ারের কাছে, হুজুর একবার দেখা করতি চাই। বড় দরকার গো হুজুর মা জননী। 

অনেকটা বাধ্য হয়েই বিকেলে নিজ বাংলোয় আসতে অনুমতি দেয় তালিয়া। 



চৈত্রের গুম বিকেলে নাজমাকে নিয়ে ডিসি সাহেবার বাংলোয় আসে জব্বার শেখ। তালিয়ার সামনে নত হয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে, মাগো একাত্তরে ওর দাদুকে দুহাতে পেরেক গেড়ে নারকেল গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা। রক্তের গন্ধ পেয়ে অসংখ্য পিঁপড়ে খুবলে খেয়েছিল জ্যান্ত মানুষটাকে। সে দিরিশ্য কথায় বলা যায় না গো মা। ওর দাদিমা বর্শা আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে দুজন রাজাকার আর একজন পাকিস্তানি সৈন্য মেরেও নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে পারেনি। ধর্ষণের পর বর্শায় গেঁথে ঝুলিয়ে রেখেছিল হাজেরা বালার লাশ। নাজমা আমাদের অহংকার। কিছু কি করা যায় না এই বাপ মা মরা মেয়েটার জন্যে ? 



ফ্যানের বাতাসে ভারি পর্দাগুলো দুলে দুলে উঠছে। গড়িয়ে যাচ্ছে অস্বস্তির কয়েকটি মূহূর্ত। তালিয়া বৃদ্ধ জব্বার শেখের দিকে অনিমিখে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধের চোখ অনেকটা ওর মায়ের মত দৃষ্টিবদ্ধ। উজ্জ্বল দরদী মায়াময়। সেখানে ভাসছে বন্ধুতা, ভালোবাসা আর অণুপ্রেরণনার ঋদ্ধ ছায়া। আর পরম আশ্রয়ে নাজমা নামের মেয়েটি ছুঁয়ে আছে জব্বার শেখের একটি হাত। 

উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে অতিশয় গম্ভির অসামাজিক জেলা প্রশাসক নাজমাকে কাছে ডেকে নেয়। বুকের কোথায় যেনো আত্মীয়তার সুখসুর বেজে ওঠে। কারা যেনো শুভ শুভ শব্দে হেসে ওঠে চারদিকে। আর দুটি দেহের রক্তের ভেতর মার্চ করে যায় রক্তাক্ত একাত্তর। 

নাজমার শক্ত পোক্ত হাতদুটি নিজের হা্তের ভেতর নিয়ে কথা দেয় তালিয়া, নাজমার জন্যে কিছু সে করবেই। 

বৃদ্ধের চলে যাওয়া ধুলো পথ থেকে যেনো সুর ভেসে আসছে। পলাশ ফোটা সন্ধ্যায় তালিয়ার মনের ভেতর গুণগুণিয়ে ওঠে , খেলাধূলা সকল ফেলে তোমার কোলে, ওমা তোমার কোলে ফিরে আসি, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি --- 

0 comments: