0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in


করোনা সংক্রমণপর্বে বাইক বা সাইকেলপ্রেম এক লাফে অনেকটাই বেড়ে গেছে। একেই ‘বাইক বুম’ বলছেন অনেকে। বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সংক্রমণের ভয় থেকে যায়। সাইকেল বা বাইক সে ক্ষেত্রে নিরাপদ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংগঠন বিকল্প পরিবহন হিসেবে সাইকেল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। 

ইউরোপে লকডাউন শিথিল হতেই সাইকেল কেনার হিড়িক পড়ে গেছে। লন্ডনে সাইকেল চালাবার জন্য সাময়িকভাবে পৃথক লেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্রিক লেন বাইকসের দোকানে ক্রেতাদের লম্বা লাইন ব্রাসেলসের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে সাইকেলের ভিড়। ফ্রেঞ্চ ফেডারেশন অফ বাইক ইউজারের সভাপতি অলিভার সাচনেইডার সাইকেলের বিক্রি ও ব্যবহার দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছেন যে অচল পরিবহনকে সচল করেছে বাইক। 

আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। ট্রেন-বাস বন্ধ থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে নিরুপায় পরিযায়ী শ্রমিকরা সাইকেলের উপর ভরসা করে দেশে ফিরেছেন। পঞ্জাব ও হরিয়ানায় সাইকেল ব্যবসায়ীরা পরিযায়ীদের সাইকেলের যোগান দিতে পারছেন না। তাঁদের বিক্রি বেড়ে গেছে ২০%। সাইকেলে চেপে চেন্নাই থেকে ২৪০০ কি মি পাড়ি দিয়ে গোরক্ষপুর, দিল্লি থেকে ১২০০ কি মি পাড়ি দিয়ে দ্বারভাঙ্গা, মহারাষ্ট্র থেকে ২২০০ কি মি পাড়ি দিয়ে তাঁরা চলে যাচ্ছেন অসম। 

কেন্দ্রীয় আবাসন ও নগর মন্ত্রক বাজারগুলিকে ‘পথচারী বান্ধব’ করার কথা বলেছেন। সেখানে থাকবে পায়ে হাঁটা ও সাইকেল চালনার পথ। রাজ্যগুলিকে একটি অ্যাডভাইজারি জারি করে বলা হয়েছে, শহরগুলিতে যখন লকডাউন শিথিল করা হচ্ছে তখন প্রয়োজন হল পরিবহনের নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং উপযুক্ত মাধ্যমের সুবিধা দেওয়া ও শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। বাজারগুলিতে সুরক্ষাবিধি মেনে যাতায়াত করার রাস্তা আছে কি না, সে সম্পর্কে স্বল্পকালীন ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে সেখানে। অন্যান্য পরিবহন একে সংখ্যায় কম, তার উপর বিপদের ভয় থাকায় মানুষ সাইকেলের উপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন। আমাদের প্রতিবেশী অনুপ বেহালা থেকে সাইকেলে তার ধর্মতলার অফিসে যাচ্ছে, স্মিতার 











কাপড়ের কোম্পানির ম্যানেজার মানস সাইকেলে মাল ডেলিভারি করছেন। আমার মেয়ে সাইকেল কিনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল, সবিনয়ে দোকানি বলেছেন তাঁর এক মাসের বিক্রি গত দিন দিনে হয়েছে, তাই স্টক শেষ। 

১৮১৮ সালে জার্মানির ব‍্যারন কার্ল ভন ড্রেইজি প্যাডেলহীন যে যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন, সেটিই সাইকেলের পূর্বসূরী। কালান্তরে সে যন্ত্রের বিবর্তন হয়েছে। তার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে মানুষের। ১৮৬০ সালে প্যারিসে তৈরি হল আধুনিক সাইকেল। ইউরোপ-আমেরিকায় তাকে নিয়ে সৃষ্টি হল উন্মাদনা। কার্লটন রিড তাঁর ‘বাইক বুম- দ্য আনেক্সপেক্টেড রিসার্জেন্স অফ সাইকেলিং’ বইতে ‘বাইক বুমে’র ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। আমেরিকায় এই হিড়িক দেখা গিয়েছিল গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে। কার্লটন এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের হার্ট অ্যাটাকের প্রসঙ্গ উথ্থাপন করেছেন। প্রেসিডেন্টের চিকিৎসক তাঁকে সাইকেলে চড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমেরিকায় ১৯৭০ সালে ৭০ লক্ষ ও ১৯৭২ সালে ১ কোটি ৪০ লক্ষ সাইকেল বিক্রি হয় । ‘লাইফ’ পত্রিকা একে ‘বাইসাইকেল ম্যাডনেশ’ বলেছিল। ‘টাইমস’ পত্রিকা লিখেছিল সাইকেলের ১৫৪ বছরের জীবনে এমন জনপ্রিয়তার তরঙ্গ দেখা যায় নি। 

এই হিড়িক বা পাগলামি সাময়িক ব্যাপার। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কিছু দেশ আছে, যেখানে বিকল্প পরিবহন হিসেবে সাইকেল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেসব দেশের জনসংখ্যা, সাইকেলের সংখ্যা, সাইকেল ব্যবহারকারীদের শতকরা হার দেওয়া হল : 

ক] নেদারল্যান্ড—১৬,৬৫২,৮০০----১৬,৫০০,০০০ ----৯৯.১% 

খ] ডেনমার্ক---৫,৫৬০,৬২৮-----৪,৫০০,০০০------৮০.১% 

গ] জার্মানি------৮১,৮০২,৩০০---৬২,০০০,০০০ ---৭৫.৮% 

ঘ] সুইডেন---৯,৪১৮,৭৩২------৬,০০০,০০০------৬৩.৭% 

ঙ] নরওয়ে---৪,৯৪৩,০০০-----৩,০০০,০০-------৬০.৭% 

চ] ফিনল্যান্ড—৫,৩৮০,২০০----৩,২৫০,০০০-------৬০.৪% 

ছ] জাপান---১২৭,৩৭০,০০০---৭২,৫৪০,০০০-----৫৬.৯% 

জ] সুইজারল্যান্ড—৭,৭৮২,৯০০---৩,৮০০,০০----৪৮.৮% 

ঝ] বেলজিয়াম—১০,৮২৭,৫১৯----৫,২০০,০০---৪৮% 

ঞ] চিন—১,৩৪২,৭০০,০০০---৫০০.০০০.০০০—৩৭% 

পরিবহন হিসেবে সাইকেলের ব্যবহার সম্বন্ধে জাতীয় নীতি নির্ধারণের চেষ্টা করেছিল ইউরোপীয়ান কনফারেন্স অফ মিনিস্টারস অফ ট্রান্সপোর্ট। ২০০৪ সালে তাদের পক্ষ থেকে ‘সাসটেনেবল আরবান ট্রাভেল রিপোর্ট’ পেশ করা হয়। যে ২১ টি দেশের তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেগুলি : চেক রিপাবলিক, বেলারুশ, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, আর্য়াল্যান্ড, জাপান, লাটভিয়া, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পোল্যান্ড, স্লোভাক রিপাবলিক, স্লোভেনিয়া, স্পেন, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ইউনাইটেড কিংডাম, যুক্তরাষ্ট্র। 

এই প্রতিবেদনে সাইকেলকে ‘পরিবেশ বান্ধব’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাইকেলের ব্যয়ভার কম। সাইকেল থাকলে অযথা ট্রাফিকের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। তাছাড়া সাইকেল চালনা এক ধরনের ব্যায়াম। এতে উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে শর্করা, স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে সাইকেলের সীমাবদ্ধতার কথাও প্রতিবেদনে ছিল। শহরাঞ্চলে, স্বাভাবিক অবস্থায় যখন মোটরচালিত যান চলে, তখন সাইকেলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। অস্বাভাবিক আবহাওয়াতে সাইকেল ব্যবহার করা যায় না। দুরবর্তী গন্তব্যস্থলে সাইকেল ব্যবহার সম্ভব নয়। এসব অসুবিধের কথা মাথায় রেখে শহরাঞ্চলে কিভাবে সাইকেল ব্যবহারের বৃদ্ধি ঘটানো যায়, তারই চেষ্টা করেন ই সি এম টি। 

করোনা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিকল্প পরিবহন হিসেবে সাইকেল গুরুত্ব পাবে। কিন্তু তারপরে আমরা কি ‘বিদায় ঘন্টা’ বাজাব সাইকেলের? গত কয়েক মাসে প্রকৃতির ক্ষতে যতটা প্রলেপ পড়েছিল, তাকে আবার খুঁচিয়ে দ্বিগুণ করে তুলব? মোটরচালিত যানকে কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না? করোনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা মনে রেখে আমরা কি আমাদের দেশে সাইকেল সম্বন্ধে একটা জাতীয় নীতি তৈরি করতে পারি না?

0 comments: