প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ (১)
[এই সময়ে ভারতের রাজধানী দিল্লি প্রবেশের সমস্ত রাজপথে তাঁবু খাটিয়ে অবরোধে বসেছেন লক্ষাধিক কৃষক। বেশির ভাগ এসেছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ থেকে। এর সমর্থনে মন্ত্রীপদ ছেড়ে জোট থেকে বেরিয়ে এসেছেন শিরোমণি আকালি দল।আন্দোলনের সমর্থনে গায়ক, খেলোয়াড় , সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদেরা সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন পুরস্কার, মায় পদ্ম-সম্মান। এই শান্তিপূর্ণ অসহযোগ এবং ক্রুদ্ধ আন্দোলন তুচ্ছ করেছে টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং জলকামানকে। অথচ বহিষ্কার করেছে বিজ্ঞান ভবনে মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার সময় সরকারি ভোজন এবং চা-জলখাবার। এই অভুতপূর্ব আন্দোলনের প্রেরণা শক্তি এবং দুই যুযুধান পক্ষের যুক্তিতর্ক ও গপ্পো বুঝতে আমরা চেষ্টা করব, কিন্তু দুই কিস্তিতে।]
১ বরফ গলছে না
দেশের রাজধানীতে এখন তীব্র শীত লহর চলছে। রাত্রে পারা নেমে আসে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে দেশের রাজধানী দিল্লির চারদিকে রাজপথে অবস্থান করে অবরোধ গড়ে তোলা কৃষকদের মধ্যে ঠান্ডা লেগে বা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃতের সংখ্যা এক ডজন ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু নয়ডা-দিল্লি রাজপথের সংযোগস্থল সিংঘু মোড়ে শিবির খাটিয়ে তৈরি করা আন্দোলনকারী
সংযুক্ত মোর্চার নেতৃত্ব দেয়া চল্লিশটি ইউনিয়নের অস্থায়ী সদরদপ্তরে কেউ পিছিয়ে আসার বা তুমিও-ভাল আমিও-ভাল গোছের সমঝোতার কথা ভাবছেন না। সরকার ও কৃষকেরা নিজের নিজের পূর্ব-অবস্থানে অনড়। সুপ্রীম কোর্টে রাজপথ থেকে অবস্থানকারী কৃষকদের সরিয়ে দেবার দাবিতে বেশ ক’টি মামলা দায়ের হয়েছে। পালটা মামলা দায়ের হয়েছে ওই তিনটি কৃষি আইন সংবিধানসম্মত কিনা তার বিচার করতে। কোর্ট কৃষকদের আন্দোলনের অধিকার স্বীকার করেও অন্যের অসুবিধে না করে আন্দোলনের অন্য ফর্ম খোঁজার কথা বলেছে। পরামর্শ দিয়েছে সরকার এবং কৃষকদের প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি গড়ে আইনগুলো খুঁটিয়ে দেখে দু’পক্ষের মেনে নেওয়ার মত সমাধান খুঁজতে এবং সরকারকে বলেছে আদালতের ফয়সালা না হওয়া পর্য্যন্ত আইনগুলোর প্রয়োগ স্থগিত রাখার কথা ভেবে দেখতে। সরকারের ভাববঙ্গী নেতিবাচক। কৃষিমন্ত্রী আন্দোলনকারী কৃষকদের উদ্দেশে আঁট পাতার চিঠি লিখে মিডিয়াকে জানিয়েছেন। কিন্তু অখিল ভারতীয় কিসান সমন্বয় সমিতির মুখপাত্র বলছেন এই চিঠিতে কংগ্রেস, আকালী, অন্যান্য বিরোধী দল নিয়ে তেতো মন্তব্য আছে, বর্তমান সরকারের কাজকর্মের ফিরিস্তি আছে, নেই শুধু আন্দোলনরত কৃষকদের আপত্তিগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ ও জবাব। গত ১৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যপ্রদেশের কৃষকদের উদ্দেশে দীর্ঘভাষণ সমস্ত মিডিয়া গুরুত্ব দিয়ে টেলিকাস্ট করেছে।কিন্তু আন্দোলনরত কৃষকেরা বিরক্ত। ওদের বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশের প্রধানসেবকের ভূমিকা ছেড়ে নিজের দলের মুখপাত্রের মত কথা বলছেন।
কৃষকেরা এখন অবধি সুপ্রীম কোর্টে ওদের পক্ষ রাখতে কোন অ্যাডভোকেট নিযুক্ত করেনি। তবে নেতারা বলছেন ওঁরা সুপ্রীম কোর্টের নামকরা কিছু অ্যাডভোকেট যেমন বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট দুষ্যন্ত দাভে বা মানবাধিকার আইনজীবী প্রশান্তভূষণ ও কলিন গঞ্জালভেসদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। এদিকে দিল্লির ‘আম আদমী পার্টি’র সরকার বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে কৃষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ওই তিনটি কৃষি সংস্কার আইন বাতিলের দাবিতে প্রস্তাহ পাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ওই ‘কালা কানুনের’ কপি ছিঁড়ে ফেলে নাটকীয় ভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।সুপ্রীম কোর্টের প্রাথমিক বক্তব্য কৃষকদের আন্দোলনকে একরকম বৈধতা দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। কৃষকদের চোখে এটা ওঁদের নৈতিক জয়। কারণ, এর ফলে আর ওই আন্দোলনকে মাওবাদী-খালিস্তানি- হেরো কংগ্রেসিদের উস্কানিপ্রসূত বলা লোকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
আজ দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও কেরলের দশজন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, এঁদের মধ্যে জবাহরলাল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অরুণ কুমার ও অধ্যাপক হিমাংশু রয়েছেন, কৃষিমন্ত্রীকে খোলা চিঠি লিখে এই তিনটে আইন বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। ওঁরা পাঁচটি যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন কেন এই সংস্কার ছোট ও প্রান্তিক চাষিদেরও সর্বনাশ করবে। এই কুয়াশা কাটতে একটু সময় লাগবে মনে হয়। আসুন, ততক্ষণ আমরা এক পারস্পরিক অবিশ্বাসের আবহাওয়ায় দুই ইকো-সিস্টেমের লড়াইকে বোঝার চেষ্টা করি।
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, চাষিরা বোঝে না?
প্রধানমন্ত্রী বলছেনঃ কৃষিসংস্কারের উদ্দেশ্যে তৈরি এই তিনটি বিল পাশ হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা! এবার শোষিত পরাধীন কৃষকেরা খাঁচা থেকে বেরোতে পারবে, স্বাধীন হবে! কীভাবে? দেখা যাক ।
এক, কৃষক নিজের উৎপন্ন দ্রব্যের দাম নিজে ঠিক করতে পারবে এবং আড়তিয়া বা মিডলম্যানদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হবে।
দুই, দেশের এক প্রান্তের কৃষক তার নিজের সুবিধে মত দেশের আরেক প্রান্তে বা যে কোন জায়গায় নিজের কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারবে। এভাবে একটি রাষ্ট্রীয় কৃষিপণ্যের বাজার রূপ নেবে।
তিন, কন্ট্রাক্ট ফারমিং বা চুক্তিমাফিক চাষের মাধ্যমে পণ্যের বিক্রয় মূল্যের দাম চাষ শুরু করার আগে থেকেই ঠিক হয়ে থাকবে। ফলে বাজারদরের ওঠানামার ঝক্কি চাষিকে পোয়াতে হবে না। এর ফলে কৃষকের আয় ২০২২ নাগাদ দু’গুণ হয়ে যাবে।
এতসব ভাল ভাল কথা!
তাহলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশ থেকে কৃষকেরা করোনা এবং ৪ ডিগ্রি তীব্র শীতের কামড়কে অগ্রাহ্য করে কেন পথে নেমে রেলরোকো –রাস্তা রোকো করছে? কেন গত তেইশ দিন ধরে এভাবে রাজপথ অবরোধ করে ‘দিল্লি চলো’ আন্দোলন করছে? নিজের ভাল তো পাগলেও বোঝে। চাষিরা কেন বোঝেনা? বিরোধিরা উসকেছে?
ভুল বুঝিয়েছে? সে তো ওদের কাজ--ঘোলা জলে মাছ ধরা। কিন্তু এনডিএ বা বিজেপির পুরনো জোটসঙ্গী আকালি দল? বা খোদ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ? এদের কেন সন্দেহ হচ্ছে যে এই তিনটি বিল বা আইনের সম্মিলিত প্রভাবে চাষিদের লাভের বদলে ক্ষতি বেশি? লাভের গুড় কর্পোরেট হাউসের পিঁপড়ে খেয়ে যাবে?
দেখা যাচ্ছে দু’পক্ষের চাপান-উতোরের জট খুলে ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটির’ সত্যিটুকু বুঝতে একটু খতিয়ে দেখতে হবে। তাই আমরা খতিয়ে দেখব এতদিন কৃষিপণ্যের কেনাবেচার ব্যবস্থাটি কী ছিল? তিনটি বিলে কী কী পরিবর্তন করা হল এবং তার বাস্তব প্রয়োগের রূপরেখাটি কেমন হতে পারে । তাহলে এই সংস্কারের ফলে কার লাভ কার ক্ষতি তার কিছুটা অনুমান করা সম্ভব হবে। এই আলোচনায় আমাদের চারটি শব্দের তাৎপর্য বোঝা খুব গুরুত্বপূর্ণঃ এপিএমসি, আড়তিয়া, এম এস পি ও কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং।
এতদিন কী হচ্ছিল?
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশে কৃষকেরা কীভাবে তাদের উৎপাদন বাজারে বেচত তার চমৎকার ছবি রয়েছে তৎকালীন নার্গিস -সুনীল দত্ত অভিনীত ফিল্ম “মাদার ইন্ডিয়া”তে। সুখীলালার ( কানহাইয়ালাল) মত মহাজনেরা চাষিদের বীজ- হালবলদের জন্যে ঋণ দিত। এবং উৎপন্ন ফসল নানা অজুহাতে অনেক কম দামে কিনত। গরীব কৃষকের ঋণের বোঝা বেড়েই চলত, তারপর একদিন বন্ধক রাখা ভিটেমাটি চাটি হয়ে যেত। এই শোষণের হাত থেকে মুক্তি দিতে নেহরু সরকারের সময়ে পঞ্চাশের শেষের দিকে মডেল আইন তৈরি করে রাজ্যসরকারদের বলা হল এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট রেগুলেশন (এপিএমআর) অ্যাক্ট পাশ করাতে। কারণ, কৃষি সেক্টর-- সংবিধান অনুযায়ী- কেন্দ্রের বদলে রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে।এর ফলে ষাট সত্তরের দশক থেকে “সবুজ বিপ্লবের” সময় অধিকাংশ রাজ্য নিয়ম করল যে আগের মত আর কৃষকের দোরগোড়া থেকে ফসল কেনা চলবে না। তৈরি হল এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি বা এপিএমসি।
এর দুটো কাজঃ
১ এটা সুনিশ্চিত করা যে কৃষকেরা যেন সুদখোর মহাজন বা ফড়েদের চক্করে নিজেদের ক্ষেতের ফসল খুব কম দামে বেচতে বাধ্য না হয়।
২ সমস্ত খাদ্যান্ন (ফুড প্রোডিউস) আগে কৃষি মন্ডীর চত্বরে আনতে হবে, তারপর সেখানে নীলামের মাধ্যমে লাইসেন্সড ক্রেতাদের কাছে বেচতে হবে। তৈরি হল সরকারি কৃষিপণ্যের বাজার বা ‘মন্ডী’, ঠিক আজকালকার মিউনিসিপ্যালিটির সব্জীবাজারের মত। তাতে দোকান লাগিয়ে বসবে লাইসেন্স-প্রাপ্ত ক্রেতারা। তারা নীলাম করে ফদলের দাম ঠিক করবে। রাজ্যের এবং জিলাস্তরের এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি বা এপিএমসি তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের থেকে ট্যাক্স নেবে। কৃষক তার পণ্য নিয়ে এসে আড়তিয়ার মাধ্যমে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে যাবে। তারপর দরাদরি করে যার দর উপযুক্ত মনে হবে তাকে বেচবে। আড়তিয়ারা খানিকটা পুরীর পান্ডাদের মত।চাষিদের কী চাই সেটা বুঝে ঠিকঠাক ক্রেতার কাছে নিয়ে যাবে, বিনিময়ে দুই বা আড়াই প্রতিশত কমিশন নেবে।
হোলসেল এবং খুচরো দোকানদারেরা সোজাসুজি চাষিদের থেকে ফসল কিনতে পারবে না । তাদের ওই কৃষি মন্ডীতে এসে রেজিস্টার্ড বিক্রেতাদের(যারা চাষির জন্যে ক্রেতা) থেকে কিনতে হবে এবং সরকারকে ট্যাক্স দিতে হবে। ফলে চাষিরা যে দামে ফসল বেচে আর সেটা যে দামে উপভোক্তা (কনজিউমার)—সে শহরের লোকই হোক বা গ্রামের—তার মধ্যে থাকে বিস্তর ফারাক।
আড়তিয়াদের কাজঃ
লাইসেন্সধারী বিক্রেতারা চাষীর থেকে কেনা পণ্য নিজের খরচে গুদামে রাখবে যাতে নষ্ট না হয়ে যায় এবং পরে বাজারের অবস্থা বুঝে বড় ব্যবসায়ী বা খুচরো দোকানদারের কাছে যাতে ভাল দামে বেচতে পারে। এপিএমসি এটা দেখবে যাতে ওরা কৃত্রিম ভাবে খাদ্যদ্রব্য বা অন্যান্য কৃষিপণ্যের দাম খুব বেশি বাড়াতে না পারে। নইলে খোলা বাজারে হোলসেল এবং খুচরো ব্যাপারিরাও দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। ভোগান্তি হবে অন্তিম ক্রেতার, মানে সাধারণ মানুষের। এই নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার হল এসেনশিয়াল কমোডিটিজ কন্ট্রোল অ্যাক্ট বা আবশ্যক পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন যার মাধ্যমে ওই জরুরি পণ্যগুলি কতটা মজুত করে গোডাউনে ধরে রাখা যাবে তার উর্ধসীমা বেঁধে দেওয়া হয়। এভাবে আড়তিয়ারা উৎপাদনকর্তা কৃষক এবং হোলসেল থেকে রিটেল চেনের মধ্যে মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুর কাজ করে।
কিন্তু যদি কোন বছর এত বেশি ফসল হয় যে খোলা বাজারে দাম খুব পড়ে যায় তাহলে ওই রেজিস্টার্ড ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে সাঁটগাট করে (কার্টেল) বানিয়ে দর এমন কম রাখে যে চাষীদের পড়তা পোষায় না তখন?
এর জন্যে এসেছে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এম এস পি), অর্থাৎ সরকার ধান গম তেলতিসি থেকে শুরু করে ২১টি কৃষিউপজ পণ্য এমন একটি দামে কিনে নেবে যাতে কৃষকের চাষের খরচা উঠে গিয়ে সামান্য লাভ থাকে যাতে সে খেয়ে পরে বাঁচে এবং আগামী বছর আবার ফসল ফলাতে উৎসাহী হয়। সরকার এই এমএসপি প্রতিবছর চাষের মরশুমে আগাম ঘোষণা করবে এবং কেনা ফসল ফুড করপোরেশন অফ ইন্ডিয়ার (এফসিআই) গোডাউনে রাখবে। তার থেকে রেশনে সস্তা দরে মানুষকে চাল-গম-চিনি দেবে। গত দু’দশক ধরে মনমোহন সরকারের সময় থেকে দু’টাকা কেজি দরে গম এবং
তিনটাকা কেজি দরে চাল বিপিএল কার্ডধারকদের দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া খাদ্য সুরক্ষা আইনের (২০১৩) 1 প্রয়োগে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশ হল যে কেউ যেন অনাহারে মারা না যায় এটা দেখা জিলা কলেক্টরের দায়িত্ব। তার জন্যে দরকার হলে গোডাউনে পড়ে থাকা উদ্বৃত্ত চাল গরীবদের বিনে পয়সায় বিতরণ করতে হবে।
1 Food Security Act, 2013.
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এপিএমসি (এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেট কমিটি) এবং মন্ডী ব্যবস্থায় ফাটল ধরেছে এবং তাতে সংস্কারের আবশ্যকতা গত দু’দশক ধরেই অনুভব হচ্ছে। তাই ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি এবং এফ সি আই সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত হল শান্তাকুমার কমিটি (বিজেপি নেতা এবং হিমাচল প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)। এই কমিটি ২০১৫তে রেকমেন্ড করে যে কৃষকদের থেকে শস্য এফ সি আইয়ের গোডাউনে রাখার কাজটা রাজ্যসরকার এবং প্রাইভেট সেক্টরের হাতে তুলে দেওয়া হোক। সেই রেকমেন্ডশন মেনেই প্রথমে ১৪ এপ্রিল ২০১৬তে, আম্বেদকরের জন্মদিনে, প্রধানমন্ত্রী দেশের সমস্ত মন্ডীকে(প্রায় ৭০০০) ডিজিটালি যুক্ত করবার যোজনা ঘোষণা করে বললেন –এর ফলে বাংলার কৃষক কেরালায় ভাল দাম পেলে ডিজিটালি অর্ডার বুক করে ওখানে চাল পাঠিয়ে দেবে ।
এ’বছর কৃষিমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী জুন নাগাদ মাত্র ৯০০ মন্ডী এভাবে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে বাংলার চাল লাভজনক ভাবে দেশের অন্যপ্রান্তে বিক্রি হচ্ছে কিনা সেটা জানা যায়নি। 2 বর্তমান বিলগুলো কেন সিলেক্ট কমিটিতে না পাঠিয়ে বা কিসান সমিতি এবং বিরোধীদের সঙ্গে চর্চা না করে সাততাড়াতাড়ি পাশ করানো হল প্রশ্ন করলে সরকারের মন্ত্রী/মুখপাত্ররা বলছেন—এটা শান্তাকুমার কমিশনের সুচিন্তিত অনুশংসা মেনে করা হয়েছে। বেশি কচকচি করে সময় নষ্ট করার কি দরকার?
3 কোন সন্দেহ নেই যে কৃষি পণ্যের বিক্রির ব্যাপারে চালু ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার। এমনকি গত ২০১৯শের কংগ্রেসের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো বলছে—“Congress will repeal the Agricultural Produce Market Committee Act and make trade in agricultural produce—free from all restrictions’.
4 তাহলে আজ এত চেঁচামেচি কিসের? ‘তোর ভবনে-ভুবনে কেন হয়ে গেল আধাআধি’? আসুন বিলগুলো দেখি। থুড়ি, ওগুলো গত সেপ্টেম্বরে তাড়াহুড়ো করে সংসদের দুটো সদনে পাশ করানো হয়েছে এবং বলে রাখা ভাল যে রাষ্ট্রপতির মোহর লেগে ওগুলো এখন আর বিল নয়, পুরোদস্তুর আইন। তিনটে কৃষি বিল ও তাদের বৈশিষ্ট্যঃ
2 রবীশকুমার, এনডিটিভি, ২৪ সেপ্টেম্বর।
3 কৃষিমন্ত্রীর বিভিন্ন চ্যানেলে বক্তব্য, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০।
4 Ashok Gulati, Indian Express, 28 th September, 2020.
১ The Essential Commodities (Amendment) Bill, 2020
গোদা বাংলায় বললে ‘ আবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধন) বিল’, ২০২০। এতদিন চাল-গম-ডাল-তেল-পেঁয়াজ-আলু এসব একটা নির্ধারিত পরিমাণের বেশি মজুত করা যেত না । করলে সেটা কালোবাজারি বলে গণ্য হত এবং আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় পড়ত। এখন থেকে এর আগল খুলে দেওয়া হল। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে তখন সরকার এ নিয়ে মজুতের উর্দ্ধসীমা ঘোষণা করতে পারে। নইলে কোন দোকানে পুলিশ স্টক চেক বা গোদাম সার্চ করতে পারবে না। কবি সুকান্তের “শোনরে মালিক, শোনরে মজুতদার” পংক্তিটি আজ অর্থহীন। সরকারের বক্তব্য এর ফলে প্রাইভেট সেক্টর এবং বিদেশি প্রত্যক্ষ পুঁজি এখানে এসে কোল্ড স্টোরেজ বানিয়ে সাপ্লাই চেনকে কম্পিটিশনের মাধ্যমে আধুনিক এবং মজবুত করবে। অর্থাৎ সরকার ক্রমশঃ চাষির ফসল কেনা , এফসিআইয়ের গোডাউন বানিয়ে মজুত করা এসব থেকে হাত ধুয়ে ফেলবে। এর বিরুদ্ধমতে বলা হচ্ছে এর ফলে বড় ব্যবসায়ী এবং কর্পোরেট হাউস প্রথম বছর ভাল দামে চাষির থেকে কিনে বিশাল স্টক করবে। পরের বছর ঔদাসীন্য দেখিয়ে চাষিকে বাধ্য করবে কম দামে ফসল বেচতে।
২
Farmer’s Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020
বাংলায় বললে কৃষিপণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য (উন্নতি ও সুবিধে প্রদায়) বিল, ২০২০। এই বিলের বিরুদ্ধেই পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় বিক্ষোভ বেশি হচ্ছে। কারণ এই বিল অনুযায়ী চাষিরা তাদের পণ্য মন্ডীর বাইরে , জেলার বাইরে এমনকি রাজ্যের বাইরে অবাধে বিক্রি করতে পারবে। এবং ভিনরাজ্যের ব্যবসায়ী এসেও কিনে নিয়ে যেতে পারবে। ওদের সরকারকে কোন ট্যাক্স দিতে হবে না। আড়তিয়াদের মন্ডীকে ট্যাক্স দিতে হয় । তাই চাষিরা মন্ডীর বাইরে বড় এবং অন্য রাজ্যের ব্যাপারীর থেকে ভালো দাম পেলে স্বাধীন ভাবে বেচতে পারবে। ফলে আড়তিয়াদের কব্জা থেকে মুক্তি পাবে। গমচাষের মাধ্যমে সবুজ বিপ্লবের সুফল বেশি পেয়েছে--পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ । সেখানে মন্ডীর ও আড়তিয়াদের নেটওয়ার্ক অর্ধশতাব্দী ধরে সুসংগঠিত। প্রচূর লোক এই বিজনেসে এবং মন্ডীর চাকরিতে জড়িত। তাই এই এলাকায় বিক্ষোভ বেশি।
সরকার অস্বীকার করলেও এটা স্পষ্ট যে এই অবাধ ছাড়ের ফলে মন্ডীর এবং আড়তিয়াদের ব্যবসা মার খাবে। রাজ্যগুলো ট্রেডিং এর ফলে যে ট্যাক্স পেত তাও হারাবে।
৩
The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020 এটাকে এক কথায় বলা যায় দাদন দিয়ে কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং বা চুক্তিচাষ। ধরুন, এতে বড় বড় হাউস যাদের খাদ্যদ্রব্যের রিটেইল চেইন (যেমন ইজি ডে বা রিলায়েন্স) বা বিস্কুট কোম্পানি একটা গোটা গ্রাম বা এলাকার সমস্ত চাষিদের সঙ্গে আগাম চুক্তি করল যে ওদের জমিতে কোম্পানির শর্ত অনুযায়ী বিশেষ ফসল বুনতে হবে বা বিশেষ জাতের মুরগী বা দুধেল গাই পালন করতে হবে। উৎপন্ন পণ্য কী দামে ওরা চাষিদের থেকে কিনবে তাও চুক্তিপত্রে লেখা থাকবে । ফলে ফসল ফলানোর পর চাষি নিশ্চিন্ত। অতি-উৎপাদনে বাজারে দাম নামলেও কোম্পানি চুক্তি অনুযায়ী বেশি দামে কিনতে বাধ্য থাকবে।ফলে চাষি ঘরে বসেই হাতে হাতে ভাল টাকা পাবে। কোন চাপ নেই। সরকার দেখাচ্ছে এটা চাষিদের জন্য উইন-উইন সিচুয়েশন। এটা ইউপিএ -১ সরকারের সময় চেষ্টা করা হয়েছিল, বিশেষ সফল হয়নি। সরকার বলছে এর ফলে ফসল বাজারে বেচার রিস্ক চাষির নয় বড় কর্পোরেশনের।ওরা উন্নত বীজ দেবে, ট্র্যাক্টর দিয়ে ক্ষেতের পর ক্ষেত হাল জোতানোর কাজ করে দেবে এবং ফসল কাটার সময় হার্ভেস্টর লাগিয়ে রাতারাতি ক্ষেত সাফ! এতে লাভ প্রান্তিক ও ছোট কৃষকের। বিরোধী যুক্তি হচ্ছে চুক্তি যদি সমানে সমানে হয় তবে চাষির লাভ। কিন্তু সাধারণ চাষি কী ভাবে বিশাল কর্পোরেশনের সঙ্গে দরাদরি করে লাভদায়ক চুক্তি করবে? বিজেন্দর সিং এর সঙ্গে রিংয়ে নেমে বক্সিং লড়বে পাড়ার মাস্তান পোটকে ?
সচিনকে বল করবে আমাদের টেনিদা? হাঃ! পরে যদি পণ্যের কোয়ালিটি কম বা অন্য কোন অজুহাতে করপোরেশন না কেনে বা চাষিকে চাপ দিয়ে কম দামে বেচতে বাধ্য করে তার প্রতিকার কী? বিবাদ বা চুক্তিভঙ্গের স্থিতিতে চাষিরা কর্পোরেশনের সঙ্গে মামলা লড়বে? খাবে না উকিলকে ফীজ দেবে? এগুলো নতুন কিছু নয় , আগেও লাতিন আমেরিকার দেশে দেখা গেছে কীভাবে কফি, কোকো, তামাক এবং কলা ইত্যাদির চাষিরা আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে অসম চুক্তির ফলে পথে বসেছে।
আচ্ছা, আমাদের বঙ্গে দেড় বা দু’শতাব্দী আগে যে নীলচাষ হত, তখনও নীলকর সাহেবের দল চাষিদের অগ্রিম দাদন দিয়ে ধানের বদলে নীলচাষ করতে বাধ্য করত না? মানছি্, স্বাধীন ভারতে ওই তুলনাটা হয়তোএকটু বাড়াবাড়ি। আজ অমন হান্টার চালিয়ে জোর করে টিপছাপ দেওয়ানো যাবে না । কারও ঘর থেকে ক্ষেত্রমণিদের তুলে আনা যাবেনা। কিন্তু রাষ্ট্র যদি আইন ও প্রশাসনের শক্তি নিয়ে বিশাল কর্পোরেটদের পাশে দাঁড়ায় (যেমন ওদের মজুত করার একতরফা ছাড় দেয়া হয়েছে এবং মন্ডীর বাইরে কৃষিপণ্য কেনাবেচার জন্যে ট্যাক্সে ছাড় দেয়া হয়েছে) তাহলে সাধারণ কিসান কী করে সমানে সমানে পাঞ্জা লড়বে? এতে দু’পক্ষের মতভেদ হলে বিবাদ সমাধান বা ডিস্পিউট রেজোলুশনের পদ্ধতি নিয়ে কোন কথা এই বিলে নেই।
তাহলে সবমিলিয়ে দাঁড়াল কী?
তিনটে কৃষি সংস্কার বিলের প্রভাব বুঝতে হলে তিনটেকে একসাথে দেখুন।
সরকার পক্ষের দাবিঃ
এক, এই বিলগুলো সরকার -নিয়ন্ত্রিত মন্ডীর (পড়ুন এপিএমসি) একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে কৃষকদের সোজাসুজি প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির সুযোগ করে দিচ্ছে।
দুই, কৃষকদের বড় বড় কোম্পানিদের সঙ্গে লিখিত চুক্তির মাধ্যমে তাদের ফ্যাক্টরির জন্যে কাঁচামাল ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের আইনি পরিকাঠামো জোগাচ্ছে।
তিন, কৃষিব্যবসায়ীদের তাদের দরকার ও সুবিধেমত কৃষিপণ্য মজুত করার অনুমতি দিচ্ছে। আগের সরকারি নিয়ন্ত্রণ, স্টক চেকিং, মজুত করার উর্দ্ধসীমা সব তুলে নেয়া হচ্ছে।
বিলের বিপক্ষেঃ কৃষকদের আশঙ্কা
এক, বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে কৃষকদের চুক্তি এক অসম পাঞ্জা লড়া। দর- কষাকষির সুযোগ ও ক্ষমতা কৃষকের কোথায়?
দুই, কৃষকদের ভয় মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হবে।
তিন, অসংখ্য আড়তিয়া এবং মন্ডী কর্মচারি রোজগার খোয়াবে। কিন্তু কর্পোরেট হাউসের ব্যানারে বড় আড়তিয়ারা কার্টেল অথবা এলাকা ভিত্তিক/পণ্যভিত্তিক মনোপলি চালাবে।
চার, রাজ্য সরকারগুলো মন্ডীর ট্যাক্সের আমদানি খোয়াবে। কৃষি রাজ্যসরকারের এক্তিয়ারে আসে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এভাবে আইন পাশ করে রাজ্যের ক্ষমতা খর্ব করল কিছু বড় কর্পোরেট ঘরানার স্বার্থে।
5 আশংকাগুলো কি একেবারে অমূলক?
1. চাষীদের ফসল বিক্রির জন্যে স্থান-কাল-পাত্র চয়নের স্বাধীনতা থাকবে বটে, কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে দরাদরি করে ভালো লাভজনক চুক্তি করার মত জ্ঞান এবং সামর্থ্য ( আর্থিক এবং থিঙ্ক ট্যাঙ্ক) থাকবেনা বলেই মনে হচ্ছে।
2. মন্ডীর বাইরে কোন নিয়ন্ত্রণ কোন নিয়ম নেই। কোন ‘ক্ষোভ উপশমন ব্যবস্থা’ বা গ্রিভান্স রিড্রেসাল সিস্টেম নেই । এইসব আশংকার ফলেই ২৫ শে সেপ্টেম্বর থেকে অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ (এ আই কে এস) এর নেতৃত্বে ৩৫০টির বেশি কৃষক সংগঠন আন্দোলনে নেমে পাঞ্জাবে রেল-রোকো, দিল্লি-ইউপি রাজপথে রাস্তা রোকো আন্দোলন শুরু করেছে। বলছে তিনটে বিল ফেরৎ না নেয়া পর্য্যন্ত আন্দোলন চলবে।
ওদের মুখ্য অভিযোগ – এই তিনটে বিলে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস নিয়ে একটিও কথা না বলে কৃষকদের মাথার উপরে সুরক্ষার ছাতাটি কেড়ে নেয়া হয়েছে। যদি এমন কোন ধারা থাকত যে খোলা বাজারে যেই কিনুক চাষির থেকে সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম দামের কমে কেনা চলবে না তাহলে মনে হয় বিক্ষোভ এত ব্যাপক ও তীব্র হত না । কেউ কেউ সরকারি এবং বেসরকারি স্টাডির উল্লেখ করে বলছেন যে মাত্র ৭% কৃষক মন্ডী এবং এম এস পি’র লাভ পায়। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন যে ওই ৭% এর ৯০%ই বা অধিকাংশই পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের। তারা ওইএপিএমসি’র মন্ডী ব্যবস্থায় স্বচ্ছন্দ এবং সুরক্ষিত। আজ ভারতের কৃষি উৎপাদন জনসংখ্যার দরকারের চেয়ে কম নয়, বরং সমস্যা অতি-উৎপাদনের (ওভারপ্রোডাকশন) ফলে ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকের লোকসানের। দু’বছর আগে পাঞ্জাবে কিছু বিক্ষুব্দ কৃষকের রাস্তায় দুধ ঢেলে দেওয়ার দৃশ্য অনেকেই চ্যানেলে দেখে থাকবেন। এখানেই এমএসপি’র গুরুত্ব।
এম এস পি নিয়ে সরকারের “না- বলা –বাণী” এবং কিছু কথাঃ
5 যোগেন্দ্র যাদব। একাধিক চ্যানেলে ইন্টারভিউ, ২৪ সেটেম্বর, ২০২০।
ন্যুনতম সমর্থন মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) অর্থাৎ সরকার যে দামে কৃষকের বিভিন্ন অবিক্রীত শস্য কিনতে রাজি তার ভিত্তি কোন আইন নয়, বরং ‘কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস এন্ড প্রাইসেস (সি এ সি পি) এর রেকমেন্ডেশন, যার জোরে এটি ১৯৬৬-৬৭ থেকে শুরু হয়েছে। 6 আরম্ভ হয়েছিল গম নিয়ে, এখন তাতে ধান, গন্না, তেলতিসি সমেত যুক্ত হয়েছে আরও ২১টি আইটেম। খেয়াল করুন, গত কয়েক বছর ধরেই এই সব রাজ্যের কৃষকরা পথে নামছেন – মূলতঃ তাদের কৃষি এবং পশুপালনের উৎপাদনের নায্য দাম নির্ধারণের দাবিতে।
স্বামীনাথন কমিশনের রেকমেন্ডেশন অনুযায়ী ন্যুনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করার দাবিতে। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী উৎপাদন ব্যয়ের উপর ১৫০% প্রতিশত , মানে দাম খরচের চেয়ে ৫০% বেশি হবে) এম এস পি হওয়ার কথা। সরকার বলছিল—তাই তো করলাম।
কিন্তু এই বক্তব্যে ফাঁক ও ফাঁকি দুইই ছিল। আসলে রিপোর্টে দুটো কস্টের কথা বলা আছে –সি-১ এবং সি-২। পরেরটিতে মূল ব্যয়ের অতিরিক্ত কিছু আনুষঙ্গিক খরচ এবং শ্রমের প্রতীক মূল্য ধরা হয়েছে। সরকার হিসেব কষছে সি-১ নিয়ে, কৃষকদের দাবি সি-২র ১৫০% ধরে এম এস পি ঘোষণা করা হোক। ওই সমস্যা আজও অমীমাংসিত। এবং ওই বিলগুলোতে কোথাও এম এস পি নিয়ে একটি শব্দও নেই ।
ইউপিএ-২ সরকারের সময় শুরু হল দ্য ন্যাশনাল ফুড সিকিউরিটি অ্যাক্ট, ২০১৩ (এন এফ এস এ) যাতে সরকার আর্থিক হিসেবে দুর্বল নাগরিকদের রেশনের মাধ্যমে ২ টাকা কেজি দরে গম ও ৩ টাকা কেজি দরে চাল দিতে আইনগত ভাবে দায়বদ্ধ হল।
7
কিন্তু বর্তমান সরকারের তিনটি বিলে এম এস পি নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি। ঠিক যেভাবে নাগরিকতা সংশোধন বিল ২০১৯ তেও( সি এ এ) ওপার থেকে আসা মুসলমানদের নাগরিকতা দেওয়া নিয়ে কোন কথা বলা হয়নি। সরকারের ওই “না বলা বাণী”ই আতংকের কারণ।
তাই প্রধানমন্ত্রী যতই আশ্বাসবাণী দিন,মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপ্ত নাগরিকতা ছিনিয়ে নেওয়ার আতংক প্রকাশ পেয়েছিল শাহীনবাগ আন্দোলনে। একইভাবে “এম এস পি ধীরে ধীরে বন্ধ করা হবে” এই আতংক পাঞ্জাব/হরিয়ানা/ উত্তর প্রদেশ/ বিহার
6 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ সেপ্টেম্বর।
7 ঐ।
/তামিলনাড়ুর এবং মহারাষ্ট্রের কৃষকদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই ওরা পথে নেমেছে।
উপসংহারঃ
বিশিষ্ট কৃষি অর্থনীতিবিদরা কী বলছেনঃ
টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের (টি আই আই এস) নাবার্ড প্রফেসর অর্থনীতিবিদ আর রামকুমার সম্প্রতি হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এককথায় বলতে গেলে এই তিনটে কৃষি রিফর্ম বিলের তাৎপর্য্য হল ‘থ্রোয়িং দ্য বেবি উইথ বার্থ -ওয়াটার’--- জন্মজল ফেলতে গিয়ে শিশুটিকেও ছুঁড়ে ফেলা।
8 প্রধানমন্ত্রীর ‘ঐতিহাসিক ঘোষণা’কে কটাক্ষ করে রামকুমার বললেন যে এমন ঘোষণা উনি আগেও করেছেন, যেমন নভেম্বর, ২০১৬তে, ডিমনিটাইজেশনের সময়। তার ফলাফল আজকে গোপন নয়। কৃষি অর্থনীতিবিদ দেবেন্দ্র শর্মা সম্প্রতি বিভিন্ন চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন –এই কৃষির খোলাবাজারের মডেলটি নতুন কিছু নয় বরং ইউরোপ আমেরিকায় অনেক আগে থেকেই পরীক্ষিত একটি ব্যর্থ মডেল। এর ফলে ওদের দেশে কৃষকদের আমদানি বছরের পর বছর সমানে কমছে এবং কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। প্রথম বিশ্বের ওসব দেশে কৃষি এবং তার পণ্য রপ্তানি মূলতঃ সরকারি সাবসিডি নির্ভর। প্রতিবছর বিশ্ব ব্যাপার সংগঠন বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন প্রতিবছর রীতিমত বৈঠক করে এই ভর্তুকির পরিমাণ ঠিক করে।
9 দিল্লির জে এন ইউয়ের ‘সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ অ্যান্ড প্ল্যানিং’ এর অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিমাংশু’র বক্তব্য ভাবার মত। উনি বলছেন যদিও কৃষকদের মন্ডী ব্যবস্থার অদক্ষতা/ত্রুটি/আড়তিয়াদের কার্টেল নিয়ে প্রচূর ক্ষোভ রয়েছে তবু তারা এটাকে তুলে দেয়ার বদলে সংস্কারের পক্ষপাতী। কেন ? ওদের চোখে বর্তমান ইকো-সিস্টেমে আড়তিয়ারা গাঁয়ের কৃষকদের জন্যে ‘ তথ্য, খবরাখবর, বীজ-সার এবং কখনও কখনও বিনা কোল্যাটারাল সরল ঋণ পাওয়ার উৎস’।এছাড়া যেভাবে ওদের প্রতিনিধিদের , মন্ডী সংগঠনের বা রাজ্যসরকারের সঙ্গে কোন আলোচনা না করে বিলগুলো ওদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হল তাতে
8 হাফিংটন পোস্ট ইন্ডিয়া; ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০।
9 দেবেন্দ্র শর্মা, ২৪ সেপ্টেমবর, ২০২০।
ওরা ক্ষুব্দ। ওরা বলছে এই বিলগুলো কৃষকদের নয়, বড় কর্পোরেটদের কৃষিতে যা খুশি করার অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। এর আগে কৃষি উৎপাদন বা বিপণন নিয়ে যত সংস্কার হয়েছে তাতে সবসময় স্টেক-হোল্ডারদের মতামত নেয়া হয়েছে।
10 কিন্তু এবার কারও সঙ্গে কোন চর্চা বা সিলেক্ট কমিটিকে পাঠানো – সব এড়িয়ে একরকম গা-জোয়ারি করা হয়েছে। অবশ্য খোলা-বাজারের সমর্থক অর্থনীতিবিদরা যেমন প্রধানমন্ত্রীর ইকনমিক অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিবেক দেবরায় বা অশোক গুলাটিরা (Infosys Chair Professor at ICRIER) বলছেন—আজকে আর সেই সবুজ বিপ্লবের , মানে পাঁচ দশকের আগের পরিস্থিতি নেই । ওসব সংগঠন (এপিএমসি), মন্ডী তামাদি হয়ে গেছে। আসল কথা হল আজকের কৃষককে খাঁচা থেকে বের করে তার ইচ্ছেমত যেখানে ইচ্ছে যাকে ইচ্ছে পণ্য বেচার স্বাধীনতা দেওয়া।
দেবরায় সঠিক ভাবেই বলেছেন যে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, বিহার এবং কেরালার চাষিরা এপিএমসি বা মন্ডী ব্যবস্থা চান না , তাদের রাজ্যে এপিএমসি এবং মন্ডী নেই । (এটা ব্যাখ্যা করে কেন কিসানদের আন্দোলন কিছু নির্দিষ্ট রাজ্যেই সীমিত; বামপ্রধান কেরালা, ত্রিপুরা ও বঙ্গে কোন হেলদোল নেই) । তাতে ওদের কৃষকদের কোন ক্ষতি হয়েছে এমন তথ্য কোথায়?
আমার আপত্তি দুটোঃ
এক, ওদের লাভ হয়েছে এমন ডেটা কোথায়? বিহার এখনও কৃষকদের গড়পড়তা আয়ের হিসেবে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। এবার লকডাউনের সময় যে রিভার্স মাইগ্রেশন হল তার ডেটা বলছে দ্বিতীয় স্থানে বিহারের গ্রাম থেকে আসা কৃষক পরিবারের লোকজন, যারা রোজগারের টানে শহরমুখী হয়েছিলেন?
দুই, কৃষককে স্বাধীন করা হল।
বেশ, কিন্তু বক্সিং রিঙে কোন রেফারি থাকবে না ? বড় বক্সার ফাউল করলে কে দেখবে? এটা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? লকডাউনে প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও কর্পোরেট সেক্টর ছাঁটাই বা মাইনে কাটা বন্ধ রেখেছে কি ?
প্রখ্যাত কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং কৃষক সমস্যা নিয়ে গবেষক পি সাইনাথ বলছেন যে এই বিলগুলো এপিএমসি এবং মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস তুলে দিয়ে বিগ কর্পোরেটকে
10 হিমাংশু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০।
কিসানের কবজি মুচড়ে কমদামে ফসল কেনার অধিকার দিচ্ছে। ফলে কৃষক অদূর ভবিষ্যতে নিঃস্ব হবে।
11 তাহলে বিকল্প কী?
দেবেন্দ্র শর্মার মতে এভাবে সাধারণ কৃষকদের—যাদের প্রধানমন্ত্রীন’অন্নদাতা’ বলেন--কর্পোরেটের দয়ার পাত্র না করে ওদের দরাদরির ক্ষমতা বাড়ানো হোক। যেমন মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসকে আইন পাশ করে কৃষকদের ‘অধিকার’ বানিয়ে দেওয়া হোক, তবে ওরা স্বস্তি পাবে।
12 প্রোফেসর রামকুমারের ( টাটা ইন্সটিট্যুট অফ সোশ্যাল সায়েন্স) মতে এপিএমসি এবং মন্ডী সিস্টেমের দুর্বলতার সংস্কার প্রয়োজন, ওসব প্রাইভেট সেক্টরকে তোল্লাই দেয়া আইন নয়। যেমন বিহার ও কেরালায় এপিএমসি আইন নেই। মহারাষ্ট্র দু’বছর আগে সংশোধন করেছে। তাতে কি? আজ বিহারের কৃষকের আয় ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তালিকায় বেশ নীচের দিকে। এবং ওই অ্যাক্ট না থাকায় বিহার কেরালার বা মহারাষ্ট্রের কৃষিতে দেশি বিদেশি পুঁজিনিবেশ এবং আধুনিকীকরণের বন্যা বয়ে যায়নি।
তাহলে সরকার কী কী করতে পারে?
চাইলে অনেক কিছুই।
প্রথমে দরকার কৃষিক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ( ইনভেস্টমেন্ট) বাড়ানো। দেশের জনসংখ্যার ৫০% কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত, মোট জিডিপির ১৬% আসে কৃষি থেকে। কিন্তু সরকারের কৃষির জন্যে বাজেট বরাদ্দ জিডিপি’র মাত্র ১৫%।
এর মধ্যে পশুপালন মৎস্যপালন সব ধরা আছে।
13
মন্ডীতে ট্যাক্স কম করে কৃষকদের লাভ দিতে পারে।
কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং পুরোটাই খারাপ নয়। কিন্তু সরকার সেই কন্ট্র্যাক্টে থার্ড পার্টি হিসেবে সাইন করে কৃষক স্বার্থ দেখতে পারে , আশঙ্কা দূর করতে পারে, যেমনটি ছোট ও ক্ষুদ্র শিল্প এবং ব্যাবসায় ব্যাংক লোন দেবার জন্যে ১০০% গ্যারান্টি দিয়েছে।
11 পি সাইনাথ, দ্য ওয়্যার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২০।
12 দেবেন্দ্র শর্মা, ‘চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডে”, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২০।
13 Moneycontrol.com; June 30, 2019.
মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস নির্ধারণে স্বামীনাথন কমিটির রেকমেন্ডেশন পুরোপুরি মেনে সি-২ উৎপাদন ব্যয়ের উপর ১৫০% বৃদ্ধির কথা ভাবতে পারে ।
খাদ্য-সুরক্ষার প্রশ্নঃ
কিছু নিন্দুকের আশঙ্কা-- চড়া লাভের লোভে যদি বেশির ভাগ কৃষিজমি ফুড ক্রপ (ধান-গম-জোয়ার-বাজরা) ছেড়ে ক্যাশক্রপ বা ইন্ডাস্ট্রির কাঁচামাল তৈরিতে লেগে যায় (সেই নীলচাষের মত), তাহলে ভারত আবার খাদ্যসুরক্ষা হারিয়ে চাল-গম রপ্তানির বদলে ষাটের দশকের মত আমদানি করার দিনে ফিরে যাবে না তো? সেই ষাটের দশকেরআমেরিকা থেকে পিএল ৪৮০’র গম আর বাজরা?
পদী -ময়রাণীরা সব যুগেই থাকেন। কিন্তু সেই দুর্দিনে (ভগবান না করুন) আমরা নীলদর্পণের শিশুদের মত নেচে নেচে “ময়রাণী লো সই, নীল গেঁজেছ কই” বলার সাহস পাব তো?
( পরের কিস্তিতে থাকবে সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে অবিশ্বাস এবং দুই ইকোসিস্টেমের লড়াই)
0 comments: