1

প্রবন্ধ - পলাশ কুমার পাল

Posted in


প্রবন্ধ



সংরক্ষণে ছড়া
পলাশ কুমার পাল



"ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি
                    চামে কাটে মজুমদার
                                  ধেয়ে এলো দামোদর...."

ছোটবেলায় ঠাকুমার মুখে শোনা সে ছড়া। অনেকেরই শৈশব কেটেছে ঠাকুমার কোলের কাছে শুয়ে এইরূপ নানা ছড়া এবং নানা রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ায়। ঠাকুমার পাখার হাওয়া এবং চাঁদের জোত্‍স্না ছিল সোনার কাঠি এবং রূপোর কাঠি; যা রূপকথা আজ।

আজ ঠাকুমার 'মা'-কে বাদ দিয়ে ঠাকুর বানিয়ে ভক্তি-শ্রদ্ধা ঢালা হচ্ছে, ভালোবাসার কার্পণ্যতাকে ঢাকতে। ফলত সে সব ছড়া হারিয়েছে সংস্কৃতি থেকে। তবে নতুনভাবে ভক্তি এসেছে পাঠ্যসূচীতে। সংরক্ষণের ব্যবস্থা; ঠাকুমা-দাদুদের যেমন বৃদ্ধাশ্রম সংরক্ষণ করছে। আর এই পাঠ্যসূচীর চাপে দমবন্ধ হওয়া শিশুকে সংরক্ষণ করছে এইসব ছড়া। নতুন শিক্ষাব্যবস্থার নতুন দিক।

সভ্যতার বিবর্তনে নিজেদের আরও বেশি সভ্য করার নেশায় ভুলে যাচ্ছি সভ্যতার সীমাকে। অতিরিক্তের নেশায় মাতাল হওয়ার মতোই বিবর্তনের যুগে আমরা সভ্যতায় বুঁদ হয়ে পরছি সর্বচেতনাকে কালিমা লিপ্ত করে। অর্থ-সম্মান-প্রয়োজনীয়তার মতো গুটি কয়েক ঘুঁটিকে আগলাতে আগলাতে দাবার মতোই সাজিয়ে নিচ্ছি গোটা সমাজ। ফলত জীবনের কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে কানামাছি-বৌবসন্তীর মতো নানা খেলা; যে খেলায় শৈশব হাসত আপন স্ফূর্তিতে খোলা আকাশের মতো কল্পনায়, বাতাসের মতো মৃদুহাসিতে...

আর এই হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় ছড়ার এগিয়ে যাচ্ছে বিলুপ্তির দিকে। যে ছড়া মানুষের কল্পনাপ্রসূত মজার ছন্দকথন; যা মানুষকে হাসাত, জীবনের মাঝে জীবন হয়ে উঠত এবং শিশুদের কল্পনায় সম্পৃক্ত হয়ে শিশুমনকে আনন্দে জারিত করে মনকে বিস্তৃতি প্রদান করত উদার হৃদয়ের উত্‍স-পথে। বর্তমানে আত্মকেন্দ্রিকতার বৃত্ত চেতনমনের সেই সভ্যতাকে দখল করে বসেছে। ফলত ছড়া হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে বৃক্ষছেদনের মতো...

এই হারানোর একমাত্র কারণ কি কেবল আত্মকেন্দ্রিক মন? আমি বলব এর প্রত্যক্ষ কারণ আত্মকেন্দ্রিক মন হলেও পরোক্ষ কারণ হারিয়ে দেওয়া দাদু-ঠাকুমার ছন্দ। আধুনিক থেকে পুনরাধুনিকের পথে কবিতা যেমন ছন্দ হারিয়ে ফেলেছে, তেমনই পরিবার থেকে অস্তিত্বহীন হয়ে পরছে দাদু-ঠাকুমারা। একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনের জোয়ারে একাকী মানুষ নিজের স্বার্থের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের রাশিকে সাজাতে সাজাতে পরিবারের মধ্যে বৃদ্ধের মুখ্য শিকড়টাকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট। ফলত শিকড়হীন পরিবার পারিবারিকতাকে হারাচ্ছে; হারাচ্ছে আনন্দ... আর নবপ্রজন্মকে দিচ্ছে ভবিতব্য মরুভূমির পাঠ; যেখানে জল নেই। কেবল বালি আর বালি... এই বালি আর বালির মধ্যে উদ্যানরূপ আধুনিকতা। অন্যভাবে বললে; গৃহপ্রবেশের সময় পুরানো অ্যালবাম, তাক, তক্তা বা আলমারির মতো পণ্যগুলোকে যেমন অবাঞ্জিত মনে করি, এই 'আধুনিকতা' নামক নতুন ঘরে গৃহপ্রবেশের সময় তেমনই বৃদ্ধদের প্রতি মনোভাবও একইরকম হয়ে পরছে আজ। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষার দেখানদারি চাকচিক্য সমাজ-দোকানে থাকলেও কর্মী হিসাবে অন্তরলোকে কেবল একটা বৃত্ত বেড়ে উঠছে। শূন্য। তাই দ্রব্য-গুণের নীচতাকে ঢাকতে সামনে কাঁচ ও আলোর মোহময়ী সজ্জা; খদ্দেরের কাছে নিজেদের জাতটাকে উচ্চ করতে। আর নানা অজুহাতের গল্পকাহিনীর ট্রাজেডি হয়ে বৃদ্ধরা সংরক্ষিত হতে থাকে আশ্রমে। সেখানেও আবার নতুন ব্যবসার মুখশ্রী। ফলে সংরক্ষণের নামে বৃদ্ধত্ব পঙ্গুত্বের নামান্তর। সেখানে কোনো ছড়া নেই, নেই আনন্দ! অথচ তাঁরই সন্তান-সন্তনি সুখী হয়ে উঠছে গৃহকোণে, সন্তানকে লালন-পালন করছে পণ্যের মতো। পুরানো অ্যালবাম বিতাড়িত করে নতুন অ্যালবামে ঘর সাজাচ্ছে। পণ্যের মতো তাদের গুণমান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষাঙ্গনে ঢুকিয়ে দিচ্ছে শিশুমনের টুঁটি টিপে। শিশুমন যেন ইঁদুর-দৌড়ে নেমে পরছে। দৌড়াচ্ছে... রুদ্ধশ্বাসে দম বন্ধ করা দৌড়ে হাঁফাতে হাঁফাতে শৈশব মরছে... এখানেই দার্শনিক রুশোর পরিবেশ থেকে শিশুশিক্ষার ভাবনা ধাক্কা খাচ্ছে। ধাক্কাই বা বলব কেন! এভাবে বলা যায় যে, শিশুরা এই প্রতিযোগিতার পরিবেশে প্রতিযোগী হয়ে ওঠার শিক্ষা পাচ্ছে। একটা নিটল গদ্য। নিরস!

তাদের পদ্য হয়ে ওঠা মাঠ-খেলা-ছড়া-দাদু-ঠাকুমা সব কোথায় হারাচ্ছে! লোকসংস্কৃতি তেমন শিক্ষার অজুহাতে বিলুপ্ত প্রায়। বংশ পরাম্পরায় বা সমাজ পরম্পরায় বা সংস্কৃতি পরম্পরয় যে সব বার-ব্রত এবং তারই সহযোগী ছড়া প্রচলিত হয়ে আসছিল প্রজন্মের ক্রমে; বৃদ্ধদের একঘরে করার সাথে সাথে সেগুলো একবৃত্তের মধ্যে ক্রমশ ছোট হয়ে পরছে... ছড়া শোনাবার মতো , আদর দেওয়ার মতো শিশুদের সঙ্গীর অভাব দেখা দিচ্ছে।

অন্যদিকে ছড়ার অভাব মেটাবার জন্য শিক্ষাঙ্গন নিজেদের মতো ফাঁদি জাল পাতছে। পাঠ্যসূচীতে মজার ছবি ও ছড়ার উপস্থাপনায় এক মোহময়ী ডাক, যেখানে শিশুর ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকে পদদলিত করে পিতা-মাতা মাখো মাখো হয়ে উঠছে। তিনবছরের শিশুর খেলার মাঠে বাবা-মা'র স্বপ্নরা অট্টালিকা হাঁকাচ্ছে... শিশুঘাস মরে যাচ্ছে, মানসিক উষ্ণায়নে সমাজ সভ্যতা স্লোগান তুলছে নতুন পৃথিবী গড়ার... আদেও কি এটাই সুস্থ পৃথিবীর অভিমুখে অগ্রগতি?

প্রশ্নের উত্তরে কবিতার উত্‍সমুখে যেতে হয়। মুখে মুখে প্রচলিত গাঁথা-কাহিনী-ছড়া থেকে ক্রমবিবর্তনে কবিতা এসেছে। কিন্তু তার প্রাথমিক ধাপ ছিল ছড়া। ছন্দ-মিল যুক্ত কিছু কথন। পরবর্তীতে ক্রমে ক্রমে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন চিত্রকল্প, অলংকার, চমকপ্রদ শব্দ বা নানারূপ ছন্দ। যেগুলো সেই পদ্যগুলোকে সহজপাচ্য থেকে কঠিন করেছে এবং পাঠকে ভাবনার গভীরে টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই গভীরতার মধ্যেও ছন্দের ঝংকারে লেখক-পাঠকে একাত্মতা তৈরি হয়ে যেত। কিন্তু আজ সেই ছন্দই নেই!

বরং আপন আপন মনের জ্ঞানগর্ভ গবেষণাধর্মী যুক্তি উঠে আসছে গদ্যের মতো। ভালো, কিন্তু ভালো নয়। কারণ এটাকে আমরা গদ্য বলি না। অজুহাত দিই গদ্যছন্দের যুক্তিতে। আসলে কবিতাগুলো এখানেই হার মানে, ঐ 'গদ্য' শব্দের ঋণগ্রস্থতায়। আসলে ছন্দে গদ্য বলে কিছু হয় না। অথচ কবির নাম রমরমাচ্ছে গদ্যকথনকে কবিতার নামান্তরে... আসলে সময়ের ধারা! যে ধারাতে শিক্ষা বা পরিবার নতুনপন্থী।

নীতিপথের থেকে যুক্তিপথ বড় হয়ে উঠছে... আর যুক্তির ঘুঁটিতে ঘুঁটিতে শিক্ষা নিজের চারিপাশে বলয় তৈরি করে নিচ্ছে... শিশুদের ছবি এবং ছড়ায় ভুলিয়ে পাঠের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে... ছড়াগুলো এই অর্থে একপ্রকার ঐ বৃদ্ধদের মতোই সংরক্ষিত হচ্ছে। লোকসংস্কৃতিহীন ছড়া। শিশুগুলোও তাই। একটা কৃত্রিম পরিবেশে বসবাস। সেখানে মন নয়, দেহই রয় সহ্যের খাতিরে বা সময়ের ধারায়...

"ঘুমপাড়ানি           মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো,
খাট নেই            পালঙ নেই
চৌকি পেতে বসো।"

এই ছড়ার কথনের মতো অসহায় হয়ে খাট ও পালঙের অভ্যাস ত্যাগ করে চৌকিকেই যেন মানিয়ে নিচ্ছি আজকাল।

"খোকা ঘুমালো         পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে         ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?"

সময়ের উঠানে, খেয়ে নেওয়া ধানের মতো হারিয়ে যাওয়া শৈশব বা ছড়া বা বৃদ্ধদের কী উত্তর দেব? বা কোন খাজনায় মেটাব তাদের শূন্যস্থানে?

আবার লক্ষ্য করলে দেখব, ঘুমপাড়ানি এইসব ছড়া যেমন মাতৃমুখ থেকে হারিয়েছে, তেমনই ঐ ছড়াগুলোর মধ্যে 'চৌকি' বা 'খাজনা' বা 'বর্গী' -এই শব্দগুলোও বর্তমানে অপ্রচলিত প্রায়। ফলত বইয়ে ছড়া পাঠে শিশুরা কেবল মূল্যায়নের ফলাফলে মান্যতা পাচ্ছে, হৃদয়ে হয়তো নয়। সমাজে তো নয়ই!

বলতে গেলে মূল্যায়নই এখন সবকিছুর মাপকাঠি। সেখানে বৃদ্ধ শিশু বা ছড়া কেউই বাদ যায় না। বাদ যায় না ঠাকুরও। ঠাকুরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করি, পূজা করি। বিনিময়ে কিছু পাওয়ার আশাও করি। না পেলে সেই ভক্তি-শ্রদ্ধা সব অদৃশ্য হয়ে নিজেদের ভিতরের মুখ কর্কশ হয়ে প্রকাশিত হতে থাকে।

শিশুরা মূল্যায়নে ভালো ফল না হয়ে উঠলে পিতা-মাতার বিরাগের কারণ হয়। অন্যদিকে ছড়ার মূল্যায়ন শেষ হলে বা অতিক্রান্ত হলে ছড়াগুলো মন থেকে হারায়। কারণ সেগুলো লোকসামাজিক নয়। অন্যদিকে প্রয়োজন মিটলে বা প্রতিষ্ঠাকে ছুঁলে সন্তানরা বৃদ্ধদের আশ্রমে পাঠান। অথচ সবই নেপথ্যের কৌশল। প্রকাশ্যে কেবল অজুহাত! ঠাকুরমাকে ঠাকুর বানানোর মতো; যেখানে প্রজন্মের ধারক ও বাহক 'মা'টা গৃহহারা হয়।

অথচ কানকাটা অন্ধের মতো সময় হাঁটতে থাকে... অন্ত্যমিলে নতুন ছড়া হয় ছন্দহীনতায়, যা পাঠকের কাছে ছিড়ি(শ্রী)-হীন; অথচ ছড়া। আবার শিশুরা সময়ের শিশ্(শিস্) হয়ে ওঠে 'উ'কারের উপশমকে কষ্টে রূপ দিয়ে... একটা খেলা। শিশুমাটির তালকে চাপড়ে চাপড়ে মূর্তি বানানোর খেলা! সংরক্ষণের মতোই। তবু প্রচলিত গতি এই শিশু-ছড়া-বৃদ্ধের, নতুন অন্ত্যমিলে... বলা যায় প্রয়োজনগ্রস্থ ছড়া; সংরক্ষণে ছড়া! হৃদ্যতাহীন বাত্‍সরিক এক আশ্রমিক পদ্য, যা প্রাণহীন।


1 comment:

  1. boddo pessimistic laglo bhai.etota hotashajonok lekha asha kori ni.tomar sob lekhai pori tai bolchi briddhasrom proyojon onoswikarjjo je sob sontanera bideshe onek somoy baddho hoyetader baba ma ke Ashrome jete hoy.songir khojeo kokhono.ar ekhon onek ma,baba shisuder space dite shikhe gechen.amio amar meyeke purodostur space di.bhalobasar denapaona concept ta boddo cliched bhalobasa ontor theke ase,hiseber nirikhe noy.likhe jao style bhalo tomar.

    ReplyDelete