ছোটগল্প - জয়িতা সরকার
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বৈজয়ন্তী
জয়িতা সরকার
কানপুরের এই কোঠায় যাকে দেখতে রইস মহল উপচে পড়ে সে আজিজান বাঈ। তার রূপের ছটায় আর নাচের তালে নবাবেরা উজার করে দেন তাঁদের খাজানা।
আজিজান জানে তার পায়ের ঘুঙুর কারো মেহতাজ নয়.. সে আপন মর্জির মালিক।
আজ যেন আজিজানের পায়ের ঘুঙুর কিছুটা শ্লথ। শামসউদ্দিন এসেছিলো আজ। এই যুবা সিপাহীকে দেখলেই আজিজান যেন নিজের মধ্যে থাকেনা, কি মেদুরতা আছে ওই দীর্ঘদেহীর চোখে তা ও নিজেও বোঝেনা।
খানদানী বাঈদের অন্দরমহলে চাইলেই কারোর প্রবেশাধিকার নেই।শামসউদ্দিন সেখানে ব্যতিক্রম। সে আজিজান বাঈ এর বিশেষ অতিথি।
পানের ডিবেটা এগিয়ে দিতে দিতে আজিজান একটু অভিমানী গলায় বলল, ‘‘জনাবের আজ এতদিন পর আমার কথা মনে পড়ল... এখন কি আসমানী বাঈকেই বেশি মনে ধরেছে? আমার ঘুঙুরের তাল কি কেটে গেছে জনাবের মন থেকে?’’
‘‘কি যে বলো জান, কানপুরের অবস্থা ভালো নয়। যে কোনো দিন ইংরেজ সিপাহীরা পুরা কানপুর দখল নিয়ে নেবে। নানা সাহেব খুব চেষ্টা করছেন ওদের আটকাবার, তাতিয়া টোপী, ঝাঁসির রানী সব্বাই মিলে চারদিক থেকে ব্রিটিশদের আটকানোর চেষ্টা করছেন। নানা সাহিব-এর খাস কিছু লোকেরাও এই অবস্থায় ওঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন।’’
সেদিনের মত মেহফিল আর জমল না।
আজিজানের মনে পড়ল, সেদিন এক ইংরেজ সিপাহীর কোঠায় এসে দুর্ব্যবহার। কোনও মতে দারোয়ান এসে ওকে কোঠার বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু পুরো কানপুর যদি ওদের দখলে চলে যায়...
বোরখায় নিজেকে ঢেকে বারকয়েক নানা সাহেবের আওয়াজ শুনেছে আজিজান, মুগ্ধ হয়েছে ওঁর কথায়। মনে মনে ভেবে রেখেছে, তেমন পরিস্থিতি হলে সেও পিছু হটবেনা।
শামসউদ্দিন যদিও বলেছে সে যেন নিজেকে রানী লক্ষ্মীবাঈ ভেবে ফেলার ভুল না করে।
সেদিন সারারাত জানালার পাশে বসে কেঁদেছিল আজিজান। হতে পারে সে তবায়েফ। কিন্তু নিজের মায়ের জন্য সেও জান খেলিয়ে দিতে পারে।
মঙ্গল পাণ্ডের ফাঁসির হুকুমে সারা দেশে যেন আগুন লেগে গেছে।ভারতীয় সিপাহীদের সঙ্গে যেখানে সেখানে ইংরেজ সেনাদের লড়াই বেঁধে যাচ্ছে।
নানা সাহিব কানপুরেও ইংরেজদের খিলাফ যুদ্ধের এয়লান করে দিয়েছেন।
শামসউদ্দিন বিদায় নিতে এসেছে তার জান এর কাছে।
কিন্তু একি?
তার সামনে যে দাঁড়িয়ে তাকে দেখে চোখ ঝলসে গেল শামসউদ্দিনের।
আগাগোড়া পুরুষের পোশাকে সজ্জিত আজিজান। কোমরের দুপাশে পিস্তল। মাথায় পাগড়ি।
‘‘আর দেরী নয়। যুদ্ধে যেতে হবে...’’ আহবান জানিয়ে ঘোড়ার রাশ টানল আজিজান।
পুরুষ সেনাদের ঘোর আপত্তি ছিল। খোদ নানা সাহিবও রাজী হননি।
রানী লক্ষ্মী বাঈ এর না'হয় রাজ্যের সওয়াল। কিন্তু আজিজান, ওর তো কোনো স্বার্থই নেই এই যুদ্ধে, তবে ও কেন জানের বাজি লড়িয়ে যুদ্ধ করতে চায়?
হেসেছিল আজিজান, জনাব তবায়েফ কারোর মা নয়, মেয়ে নয়, বহু, প্রেমিকা, কিচ্ছু নয়। কিন্তু এই দেশ তার মা, আর তার জন্য স্বার্থ ছাড়াই জান লড়ানোর ক্ষমতা কানপুরের তবায়েফরা রাখে।
সম্মুখ সমরে বীরের মত লড়ত আজিজান আর তার প্রমীলা বাহিনী।বিকেলে যুদ্ধে আক্রান্তদের সেবা আর রাত্রে নিজেদের মধুর কন্ঠে সেনাদের বিনোদন।
অচিরেই ফল মিলল। প্রাথমিক যুদ্ধে জয়লাভ করলেন নানা সাহিব।
শামসউদ্দিনের অবশ্য ততদিনে...ইন্তেকাল হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রেই।আজিজানকে যোগ্য সম্মান দিতে কসুর করেননি নানা সাহিব।
বিজয় মঞ্চে তাঁর আর তাতিয়া টোপীর পাশেই স্থান পেলেন আজিজান।
কানপুরের তবায়েফরা বুঝি এতদিনে তাদের যোগ্য সম্মান পেলেন।
কিন্তু এই বিজয় সাফল্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হলনা।
অনায়াসে তাদের পরাজিত করে কানপুরের আকাশে উড়ল ব্রিটিশ পতাকা।
এরপর আজিজানের কি হয়েছিল সে খবর অবশ্য ইতিহাসের পাতায় কোত্থাও লেখা নেই।
কেউ কেউ বলেন তাকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আবার কারোর কারোর মতে রাজপুতানার মহিষীদের মত এই মহিয়সী নিজেই আগুনে আত্মাহুতি দেয়।
ইতিহাস শুধু তাকে মনে রেখেছে সেই বীর যোদ্ধা হিসেবে, স্বার্থ ছাড়াই যে দেশ মায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছিল...।
আজিজান বাঈ স্মরণে মখমুর জলন্ধর একটি ভারী সুন্দর কথা বলেছিলেন...
"তেরে ইয়ালগার মে তমীর থি তখরীব না থি
তেরে ইসার মে তরঘীব থি তদীব না থি"
[তোমার যুদ্ধ দেশ গড়বার,
ভেঙ্গে ফেলবার নয়।
উঁচু মাথা নিয়ে নিজেকে সঁপেছো
ভয়কে হারিয়ে এনেছো দেশের জয়]
Khub valo laglo
ReplyDelete