0

ধারাবাহিক - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in





ধারাবাহিক



দিনমণি - ২
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়





(অখ্যাত এক গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ হইতে এক বালক গৃহত্যাগ করে। এই গৃহত্যাগের সহায়িকা ছিলেন পরিবারের আশ্রিতা, অনাথা এক বৃদ্ধা রমণী। বালকটির পিতামাতা অপেক্ষাও তিনি ছিলেন আপন। কে এই বালক?

পরবর্তী অংশ...)



(২) 

ভট্টাচার্য্য পরিবারটির বর্তমান কর্তা হইলেন শিবতোষ ভট্টাচার্য্য। শিবতোষ ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। মাত্র ছয়মাস বয়সে তাঁহার পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যু ঠিক কি কারণে হইয়াছিল, তাহা অজ্ঞাত। কেহ বলেন গুপ্তঘাতকের হস্তে, কেহ বলেন বিষপ্রয়োগে হত্যা আবার কাহারও মত হইল অতিরিক্ত পরিশ্রমের জন্য অল্পবয়সেই স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছিল। প্রকৃত কারণ এখনও অজানাই রহিয়া গিয়াছে। শিবতোষের বয়স এক্ষণে প্রায় চল্লিশ বৎসর, কিছু কম/বেশী হইলেও হইতে পারে। 

শিবতোষের পিতার মৃত্যু হইলে মাতাঠাকুরাণী পিত্রালয়ে গিয়া বসবাসের পরিবর্তে শ্বশুরালয়ে থাকিয়া একাকী পুত্রসন্তানকে মানুষ করিয়া তুলিয়াছিলেন। তখনকার কালে বিবাহের পর পিত্রালয়ে যাওয়া এবং তথায় বসবাস করা নিন্দনীয় ছিল। মাতাঠাকুরাণীর শ্বশুরালয়ে বসবাসের সিদ্ধান্তে শিবতোষের মাতামহও অসম্মতি প্রকাশ করেন নাই, বরং কন্যার বিবেচনায় সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। জামাতা বাবাজীবনের বয়স মাত্র ত্রিংশতি বৎসর হইয়াছিল। জামাতার এইরূপ অকাল মৃত্যুতে দুঃখ পাইলেও তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত লইতে বিলম্ব করিলেন না। শিবতোষের মাতুলালয়ও উচ্চ বনেদী পরিবার। অল্পবয়স্কা কন্যার দেখভাল করিবার জন্য মাতামহ কুড়িজন লাঠিয়াল পাঠাইলেন যাহারা রক্ষণাবেক্ষণ করিবে, উপরন্তু তাহাদের দ্বারা প্রয়োজনে কৃষিকার্য্যও চলিবে। কন্যাটি ধনী গৃহের ঘরণী হইয়াছিল। জমিজমাও ছিল, তাহা হইতে আয়ও মন্দ হইত না। 

শিবতোষ নিজে একমাত্র সন্তান হইলেও বয়সকালে পিতা হইলেন অনেকগুলি সন্তানের। তাঁহার চারি পুত্র, দুইটি কন্যা। দুইটি কন্যারই শিশু বয়সেই মৃত্যু হইয়াছে। কন্যা সন্তানের উপর শিবতোষের তাই বড় ভালবাসা। কিন্তু ঈশ্বর আর তাঁহাকে কন্যাসন্তান দেন নাই। শিশুকাল হইতেই নিঃসঙ্গ অবস্থায় কেবলমাত্র মাতাঠাকুরাণীর সাহচর্য্যে দিন কাটিয়াছে, এক্ষণে শিশুপুত্র গুলির কলরব বড় ভাল লাগিত। গৃহস্থ আশ্রিতদের সন্তানগুলির প্রতিও শিবতোষের ভালবাসা ছিল। তিনি সন্তান দিগের জন্য গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করিলেন, শরীরচর্চার জন্য শিক্ষক রাখিলেন। কিন্তু গৃহের বাহিরে পুত্রদিগকে বিদ্যাশিক্ষা লাভের জন্য উচ্চ বিদ্যালয়ে যাইবার অনুমতি দিলেন না।

শিবতোষ মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন তাহা বলা মুশকিল। অনেক বৈপরীত্য ছিল তাঁহার মধ্যে। পণ্ডিত বংশের সন্তান বলিয়া বেদ, উপনিষদ, সংষ্কৃত সাহিত্যে অনুরাগ ছিল, পড়াশুনা করিতেন। প্রত্যহ বাটীস্থ মন্দিরে দেবসেবার সময় উপস্থিত থাকিতেন। অন্যদিকে, রাগ ছিল ভয়ানক। সকল সময়ে তাহা প্রকাশ করিতেন না বটে, কিন্তু রাগিলে কখনও কখনও মাত্রাজ্ঞান ছাড়াইয়া যাইত। জমিজমা থাকিলেও তাহা প্রয়োজনে বিক্রয়ও করিতেন, তখনকার কালে জমিজমার মালিকেরা কেহ চাকুরি করিতেন না, শিবতোষও করেন নাই। তাহার উপর শিবতোষ ছিলেন পণ্ডিত বংশের সন্তান, চাকুরি করিতে মানে লাগিত। সুতরাং সাংসারিক প্রয়োজনে জমি বিক্রয় করিতে হইত। জমি–জমা ইত্যাদি লইয়া চিন্তা ভাবনা করা, কৃষিকার্য্যের জন্য জমির উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি, জমিকে ধরিয়া রাখিবার ইচ্ছা এইসবের কোনটিই তাঁহার ছিল না, রাখিতে পারিতেনও না। পূর্বপুরুষের জমিজায়গা পৈতৃক সূত্রে পাইয়াছিলেন, সামান্য কিছু জমি-বাড়ি ব্যতীত আর কিছুই অর্জন করিতে হয় নাই বলিলেই চলে। স্বছন্দে চলিয়া যাইতেছিল, তাহাই যথেষ্ট বলিয়া মনে করিতেন। সঙ্গীতে অনুরাগ ছিল, বাটিতেও পুত্র-কন্যাদিগের জন্য সঙ্গীতের শিক্ষক নিযুক্ত করিয়াছিলেন। মধ্যে মধ্যে গৃহে কীর্তনের আসর বসিত। দুই-একবার তৎকালীন নামকরা গায়িকাও দুর্গোৎসবের সময় গৃহে আসিয়া গান গাহিয়া গিয়াছেন।

বাহিরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বলিতে পথিক কিংবা পড়শী যাঁহারা অন্যান্য গ্রাম হইতে আসিতেন, কিংবা অন্যত্র গমনের সময় গ্রামের উপর দিয়া যাইতেন, তাঁহাদের নিকট খবর পাইতেন। পরবর্তীকালে শিবতোষ একখানি বড় রেডিও খরিদ করিয়াছিলেন, যাহা ব্যাটারি দ্বারা চলিত এবং তাহা দ্বারা গ্রামের সকলকে গান শুনাইতেন। তাহার জন্য ত্রিতলের ছাদে একখনি চোঙ্গা লাগানো হইয়াছিল।

শিবতোষের বৈঠকখানায় বাহিরের লোকের ভিড় লাগিয়াই থাকিত। দু-চার কথার স্তুতি শুনিলেই উক্ত ব্যক্তিটির জন্য কিছু করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিতেন। তাহা বুঝিয়া অনেকেই তাহাকে স্তুতি করিতে লাগিল। নানাজনে নানা পরামর্শ দিতে শুরু করিল। গৃহে লোকসমাগম লাগিয়াই আছে, তাহাদেরই পরামর্শে এইসময় শিবতোষ এক কান্ড করিয়া বসিলেন। এক বৎসরের মধ্যে পরপর দুই পুত্রের বিবাহ দিলেন। পুত্রগণের বয়স তখন যথাক্রমে, জ্যেষ্ঠটির ষোল, মধ্যমটির মাত্র নয়। জ্যেষ্ঠটি সবে পরীক্ষায় পাশ দিয়াছেন। দুই পুত্রের মাঝখানে কন্যা সন্তান দুটির জীবনলীলা সাঙ্গ হইয়াছিল। পুত্র ও পুত্রবধুদিগের দ্বারা গৃহ পূর্ণ হইল বটে, কিন্তু তাহারা বালক বালিকা মাত্র। ফলস্বরূপ গৃহে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল, আয় কমিল।







কিয়ৎকাল পরের কথা। দেশ তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ারে ভাসিয়া যাইতেছে। সুদূর এক গ্রামেও তাহার ঢেউ আসিয়া লাগিল। ভট্টাচার্য্য পরিবারে বসবাসকারী যুবক, কিশোর, বালকদিগের মনেও তাহার রেশ লাগিয়াছে। সকলেই কিছু করিতে চাহে। গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথ ছিলেন এই পরিবারের বালকদিগকের শিক্ষক। শিবতোষ গৃহশিক্ষার ব্যাপারে কাহাকেও বাধা দেন নাই। সকাল ও সন্ধ্যায় নিজ পুত্রগণ এবং গৃহে আশ্রিতদের সন্তান মিলিয়া অনেকগুলি বালক গৃহশিক্ষকের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করিত। কিন্তু বালিকাদের জন্য বাহিরে বালকদিগের সঙ্গে একত্র বসিয়া পাঠ লইবার ব্যবস্থা তখনও হয় নাই। তাহারা অন্দরে কিছু কিছু শিক্ষালাভ করিত। সামান্য বিদ্যাভ্যাস ছাড়া সাংসারিক পাঠই বেশি ছিল। 

ক্ষেত্রনাথ বুঝাইলেন বিদ্যাশিক্ষা অর্জন না করিলে কিছুই করা যাইবে না, আগে তাহা করা চাই। কিন্তু কিরূপে? ক্ষেত্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের কথা বলিলেন। সম্প্রতি রাজাদের ইস্‌কুলে ইংরাজি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা চালু হইয়াছে, কিন্তু তাহা বিদেশী রাজার নহে, স্থানীয় দেশীয় রাজাদের তত্ত্বাবধানে রহিয়াছে। রাজপরিবারের এক রাজকুমার বিলাত হইতে বিদ্যাশিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন, তিনিই উৎসাহী হইয়া এই বিদ্যালয় খুলিয়াছিলেন। স্বদেশের ছাত্রেরা যাহাতে ইংরাজি ভাষায় শিক্ষালাভ করিতে পারে তাহার জন্যই এই ব্যবস্থা। দেবগ্রাম সেই রাজার রাজত্বের সীমানার অভ্যন্তরে, সুতরাং তথায় ভর্তি হইবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। যদি তাহাতে ভর্তি হওয়া যায়, উত্তম শিক্ষা লাভ করা যাইবে। এ তল্লাটে ওইটিই সর্বাপেক্ষা উত্তম বিদ্যালয়। গৃহত্যাগী বালকটিকে গৃহশিক্ষক ক্ষেত্রনাথ অত্যন্ত ভালবাসিতেন। কিন্তু তিনি জানিতেন, শিবতোষ এই বাটিতে অবস্থিত কাহাকেও গৃহের বাহিরে যাইতে অনুমতি দিবেন না। 

শিবতোষের মধ্যম পুত্র প্রিয়তোষ তখন পরীক্ষায় পাশের পর চাকুরির জন্য নানান জায়গায় চেষ্টা করিতেছিলেন। পাশের পরীক্ষাটি উচ্চবিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সহিত কথা বলিয়া সেখান হইতেই দিয়াছিলেন। শিবতোষের প্রথম পুত্রটিও একই ভাবে পরীক্ষায় পাশ দিয়াছিলেন। শুধুমাত্র বড় পরীক্ষায় পাশের জন্য বিদ্যালয়ে কয়েকটি দিন পরীক্ষা দিয়া আসা, ইহাতে শিবতোষ আপত্তি করেন নাই। ইংরাজি শিক্ষা পুত্রটি গৃহে শিক্ষক ক্ষেত্রনাথের নিকট করিয়াছিলেন। মেধাবী ছাত্র, সুতরাং চাকুরি পাইবেনই এই ধারণা ছিল। তাহারই জন্য প্রস্তুত হইতেছিলেন। কয়েক বৎসর পূর্বে জ্যেষ্ঠর সহিত তাঁহারও বিবাহ হইয়া গিয়াছে মাত্র নয় বৎসর বয়সে। বধূটি শিবতোষের বন্ধু কন্যা। বন্ধুটি অকাল মৃত হইলে তাহার কন্যাটির কি ব্যবস্থা করিবেন, ইহা ভাবিতে গিয়া নিজ পুত্রের সহিত বিবাহ দিয়া শিবতোষ তাহাকে গৃহে আনিলেন। পুত্র ও কন্যা উভয়েরই বয়স তখন নয় বৎসর। কন্যাটি বোধকরি কয়েক মাসের ছোট হইবে। এইরূপ বিবাহে গৃহিণী অসম্মতি প্রকাশ করিলেন, রূষ্ট হইলেন, শেষে কাঁদা-কাটা আরম্ভ করিলেন, কিন্তু শিবতোষের ইচ্ছাতে বাধা দিতে পারিলেন না। গ্রামস্থ সকলে বিস্মিত হইল কারণ তখন সমবয়স্ক পাত্র-পাত্রীর বিবাহ কেহ চিন্তাও করিত না। কিন্তু শিবতোষের মুখের উপর কথা কে কহিবে? অতএব বিবাহ হইল। 

মধ্যম পুত্র প্রিয়তোষ তখন চাকুরি পাইলে নিজ খরচে ভ্রাতাদের দায়িত্ব লইবে, মনে এইরূপ ভাবনা ভাবিয়া রাখিয়াছিল। পিতার খামখেয়ালীপনার জন্য ভ্রাতাদের যাহাতে আর এইরূপ অবস্থার সম্মুখীন হইতে না হয়, তাহার জন্য সে বদ্ধ পরিকর। কিন্তু ইতিমধ্যে একটি পুলিশের ওয়ারেন্ট আসিয়া সমস্ত উলট-পালট হইয়া গেল। জ্যেষ্ঠ পুত্র রণতোষের নামে পুলিশের ওয়ারেন্ট বাহির হইয়াছে। এক জংশন ষ্টেশনে রেললাইনে বোমা ছুঁড়িবার কার্যে বিল্পবীদের সহিত নাকি তাহার যোগসাজস ছিল। গৃহে পুলিশের আনাগোনা শুরু হইল। তন্ন তন্ন করিয়া সমস্ত অট্টালিকা, স্থানীয় পুকুর, দেবালয় এমনি কি শৌচাগারও খুঁজিতে বাকি রহিল না। কিন্তু তাহাকে পাওয়া গেল না, সে ফেরার হইয়াছে। ঠিক এই বিপর্য্যয়ের মুখে বালকটিও গৃহ ছাড়িল। 



গৃহত্যাগী বালকটি শিবতোষের চতুর্থ ও কনিষ্ঠ পুত্র জ্ঞানতোষ। 





(ক্রমশঃ)

0 comments: