0

ছোটগল্প - স্বাতী ব্যানার্জী

Posted in


ছোটগল্প


রাবণ
স্বাতী ব্যানার্জী



বিপদতারণবাবু কথা কম কাজ বেশী মন্ত্রে বিশ্বাসী। রোজের সংসারে যেটুকু না হলেই নয় উনি শুধু সেইটুকুই কথা বলেন। গিন্নি পর্যন্ত অভিযোগ করেন মহিলা মহলে, "ওর সাথে ঝগড়া করা আর দেওয়ালের সাথে কথা বলা একই জিনিস।" সকাল থেকে রাত অবধি কড়া নিয়মেই চলেন তিনি, খুব ভোরে উঠে প্রাতর্ভ্রমণ, ফিরে এসে স্নান। অবসরের পর থেকেই জলখাবার খেয়ে তিনি লেখালিখি নিয়ে বসেন। কিছু পত্রিকা আর ফেসবুকে লেখেন তিনি। সামান্য কিছু অনুরাগীও আছে তার। দুপুরে স্নান খাওয়া ঘুম, বিকেলে চা পান করে ফেসবুক নিয়ে বসেন। বেশ কয়েকটা গ্রুপের অ্যাডমিনের গুরু দায়িত্ব সামলাতে হয়। রাত্রে বাঁধা দুই পেগের পর দুটি রুটি আর ঘুম। সাত্ত্বিক জীবন।

এহেন বিপদতারণবাবুর বিপদ শুরু হল যখন ছোটো কন্যা তার শিশুপুত্রকে মা বাবার কাছে রেখে অফিস যাওয়া শুরু করল। ফলে প্রায় সম্পূর্ণ সময় বিপদতারণবাবু সম্ভব অসম্ভব সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগলেন।

"দাদা তুমি দৌড়াও? কেন? শরীর ভালো থাকে? তবে যে মা আর দিদুন বলে দৌড়াতে নেই, পড়ে যাবো? রচা কি? কেন দুধ দেয়না চা’তে? মা যে বলে দুধ খেলে শক্তি হয়? ঘন্টার মাথা কি? আমিও র দুধ খাবো। কি লিখছ? এখনও পড়ছো? কেন? পাশ করোনি? কোন মিস পড়ায় তোমায়? মিস নেই??? মিস চাই??? দিদুন দাদা কে একটা মিস ঠিক করে দাও, তাহলেই এবার পাশ করবে। কি লিখছ?কাজের লেখা? ও তো আপিসে লিখতে হয়, মা বাবা লেখে। তোমার আপিস নেই?? ছিল?? কোথায়? যাও না কেন? রিটায়ার কি? আমিও রিটায়ার করবো স্কুল থেকে। ও দাদা, তুমি ঘুমাচ্ছো??? (ধাক্কা মেরে) দাদা, ও দাদা, ঘুমাচ্ছো? ঘুমালে নাকি?? আমি তোমাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াবো??? লন্ডন ব্রিজ ইজ ফলিং ডাউন। দূর শালা কি?আমাকে একটা দূর শালা দাও। তাহলে একটা সিগারেট দাও। সিগারেট খেতে নেই? তাহলে তুমি বাবা মা কেন খাও? বড়রা খায়?হ্যাঁ মা খায় তো! আমিও তো বড়। এবার ওয়ান হবো। পেনে লিখবো এবার থেকে। তোমার বাকি পেনগুলো তো আমিই নিয়েছি। নাআআ ফেরত দেবো না। হারামজাদা কি? আমাকেও একটা হারামজাদা দাও! কেন, চুপ করবো কেন? দিদুন, দাদা আমাকে একটাও হারামজাদা দিচ্ছে না। কি খাচ্ছো লাল লাল? রাম? রাম তো ঠাকুর। তুমি ঠাকুর খাও? তুমি কি রাবণ? তবে তোমার নাম বিপদতারণ কেন? তুমি রাবণের বাবা? তবে কি মা রাবণ? নাকি বড়মাসির নাম রাবণ? তবে সবাই ওদের শ্রীদাত্রী আর বেদত্রয়ী বলে কেন? আমিও রাম খাবো। হাড় কি করে জ্বালায়?’’ইত্যাদি প্রভৃতি...

বিপদতারণবাবুর চিত্তে সুখ নাই। কোনও পরীক্ষার প্রশ্নপত্রকে এত ভয় জীবনে পাননি কুট্টুসকে দেখলে যত ভয় পাচ্ছেন। বিশেষত অ্যানুয়াল পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় এখন নাতি সারাদিন বাড়িতে। অনুশাসন নিয়ম মাথায় তুলে বিপদতারণবাবু পেগের সংখ্যা বাড়িয়েছেন। লেখা মাথায় উঠেছে। এমনকি গ্রুপের কাজও ঠিকমত করা হয়ে উঠছে না। স্বভাব শান্ত মানুষটি ক্রমশ খেঁকুড়ে হয়ে উঠছেন। দিবানিশি একটিই কামনা... মেয়ে যেন নাতি সহ বিদায় হয়। ঠারেঠোরে মেয়েকে বুঝিয়েও দিয়েছেন। শুধু গিন্নির প্রবল আপত্তি বলে বাস্তবে হচ্ছে না।

আজ সকালে কুট্টুস এর পাত্তা নেই। খুব খুশি হয়ে বিপদতারণবাবু সকালে দৌড়ে এসে চা খেলেন। জলখাবার দিতে এসে মোতির মা বলে গেল কাল রাত থেকে কুটুসের ধুম জ্বর। কিছুতেই কমছে না। ব্লাড টেস্ট হবে। দিদি আজ আপিস যায় নি। গিন্নি নাতির পাশ ছেড়ে নড়ছেন না। আজ দুটি ডাল ভাত মোতির মাই করবে।

নিশ্চিন্ত হয়ে বিপদতারণবাবু লেখা নিয়ে বসলেন। আত্মকেন্দ্রিকতা ও মানবপ্রেম বিষয়ে একটি লেখা একটি পত্রিকায় পাঠাতে হবে। খুব ভেবে চিন্তে লেখাটা লিখলেন। একঘর হয়েছে লেখাটা। মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল। দুপুরে মোতির মার রান্না খেয়ে তোফা ঘুম দিলেন। বিকেলে কিছু হাড়বজ্জাত সদস্যকে গ্রুপ থেকে বাদ দিলেন, এদের উদ্দেশ্যই হল অকারণে ঝামেলা পাকানো।

রাতে আজ ব্ল্যাক ডগটা নিয়ে বসলেন। মেয়ে বৌ খুব চিন্তিত, ডাক্তারও এল আরেকবার। মেয়ে জামাইকে ফোন করে ট্যুর ক্যান্সেল করে ফিরে আসতে বলল। মোতির মা আজ বাড়ি যায় নি। একটু বেশিই পান করা হয়ে গেল। রুটি খেয়ে শুয়ে পড়লেন।

কি এক অজ্ঞাত কারণে রাতে ঘুমটা ভালো হল না। সকালে দৌড়ানোর পর পার্কের অবসর প্রাপ্তদের গল্পে যোগ দিলেন। কানহাইয়ার ভবিষ্যৎ, মোদির বাজেট, জোট ভবিষ্যৎ পেরিয়ে আলোচনা এল অসুখে। শুনলেন ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের কথা, অনেকেরই পরিচিত মারা গেছে এই রোগে। মনটা ভারী হয়ে গেল অকারণে।

বাড়ি ঢুকতেই চাপা কান্না শুনতে পেলেন। মেয়ে কাঁদছে। সুরমা সাহস দিচ্ছে। জামাই ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। মোতির মাও ওখানে। চা হয় নি।

পায়ে পায়ে গেলেন নাতির ঘরে। অচেতন ছোট্ট শরীরটা বিছানায় মিশে গেছে। জ্বরে লাল কপালে হাত রাখলেন। শুনলেন জামাই অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে। এক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। বড্ড নিশ্চুপ ঘরটা। নাতির কপালে হাত রেখে যেন কুট্টুসের কথা শুনতে পেলেন। "তাহলে রাবণ কার নাম গো, কার নাম????"


0 comments: