0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক



জল রেখা - ৭

নন্দিনী সেনগুপ্ত



‘ঠাম্মা, ঠাম্মা... আ- আ...’ ... দুদ্দাড় করে ছুটতে ছুটতে বাগান থেকে চীৎকার করতে করতে বাড়িতে ঢোকে নীরদা।

এষা সাধারণত দুপুরে ঘুমান না। গল্পের বই, বা একটু আধটু সেলাই-ফোঁড়াই... এসব নিয়েই কাটিয়ে দেন দুপুরটা। কিন্তু বয়স বাড়ছে, হয়ত বা ক্লান্ত হয়েই গড়িয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। কখন যে লেগে গিয়েছিল চোখ, টের পান নি। সুনন্দ বসবার ঘরে একা একাই তাস সাজিয়ে পেশেন্স খেলছিলেন। নীরদার হাঁকডাকে সচকিত হয়ে উঠলেন দুজনেই। এষা ছুটে এলেন উদ্বিগ্নভাবে। নীরদা ব্যাগ থেকে বের করলো সার্টিফিকেটের মত একটা কাগজ। ধরিয়ে দিল তার ঠাম্মার হাতে।

এষার জিজ্ঞাসুদৃষ্টির সামনে নীরদা চোখ বড় বড় করে বলে যায়, ‘সেই যে গো ঠাম্মা, তুমি যে আমায় পূজা পর্যায়ের গান শিখিয়ে দিয়েছিলে,... ‘তোরা শুনিস নি কি...’ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে আমাদের স্কুলে গানের কম্পিটিশানে আমি ফার্স্ট হয়েছি। হেডমিস্ট্রেস বড়দি আমাকে এই সার্টিফিকেট দিয়েছে’।

এষা খুশিতে উচ্ছল হয়ে জড়িয়ে ধরেন নীরদাকে। মনে হয় যেন এষা নিজেই জিতে এসেছেন এই প্রতিযোগিতা। সুনন্দও খুশিয়াল কণ্ঠে বলেন, ‘তাহলে তো এখুনি মিষ্টিমুখ করাতে হবে নীরুকে। বাড়িতে কি রসগোল্লা আছে? না থাকলে বল, যাই নিয়ে আসি’।

এষা কপট রাগ দেখিয়ে বলেন সুনন্দকে, ‘সত্যি, তোমার এই এক হয়েছে। আগে তো এত মিষ্টির কথা ভাবতেনা! যবে থেকে ব্লাড সুগার ধরা পড়েছে, যে কোনও ছুতোয় মিষ্টি খাবার কথা বল তুমি’।

সুনন্দ বলেন, ‘আরে কি মুস্কিল! আমি কি নিজে খাব বলে বললাম নাকি? আমি তো নীরুর জন্যই’...মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন এষা, ‘থাক, আর অত ভাষণ দিতে হবেনা। মনে যখন হয়েছে, নিয়েই এসো’।

সুনন্দ পাজামার ওপরে ফতুয়া পরে, পায়ে চটি গলিয়ে এগিয়ে যান। এষা আনন্দিত স্বরে বলে যান, ‘হ্যাঁরে নীরু, চল, এখন আর তাহলে তোর ভাত খেয়ে কাজ নেই। একটুখানি সাদা আলুর তরকারি করে দিই, তোর পছন্দের জিনিস, আর সঙ্গে কটা লুচি ভেজে দিই’। অনেকখানি এনার্জি পেয়ে গিয়েছেন এষা নীরুর এই ফার্স্ট হওয়াতে, গ্রীষ্মের বিকেলেও তাড়াতাড়ি হেঁসেলে ঢুকে ময়দা মাখতে শুরু করেন।

নীরদা চুপচাপ খেতে থাকে। এষা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। আস্তে আস্তে বলেন, ‘হ্যাঁ রে, সকালে আমাকে কি যেন বলবি বলছিলি তুই। আচ্ছা, খেয়ে নে নাহয়’। তারপর নিজের মনেই বলে যান এষা,... ‘আমি জানি রে, কলকাতা থেকে এখানে এসে তোর খুব অসুবিধে হচ্ছে। নীলের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে তোর, পুরানো স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের কথা মনে পড়ছে, তাছাড়া দেয়াসী তোকে যেমন দেখে শুনে যত্ন করে রাখত, তেমনটি আমি পারি কই? আমারও তো বয়স হয়েছে। সব কাজ সামলে তোর দিকে নজর দিতে পারিনা। তবে হ্যাঁ, দেখ তো, তুই নিজে এই কদিনে কত কাজ শিখেছিস। নিজের জামাকাপড় নিজে কাচতে শিখেছিস। পড়ার টেবিল গুছনো, জামাকাপড় গুছিয়ে আলনায় রাখা, এমনকি চা বানাতেও শিখে গিয়েছিস। তারপর, এই যে, আজ যে গানে ফার্স্ট হয়ে এলি, কি করে? না, এখানে তো তুই ভাল রেওয়াজ করেছিস রোজ স্কুল থেকে ফিরে। কলকাতায় থাকতে তো বিকেলে খেলতে বেরিয়ে যেতিস, সপ্তাহে একদিনও রেওয়াজ করতিস না। এত মিষ্টি গানের গলা তোর! রেওয়াজ না করলে নষ্ট হয়ে যাবে যে’।

নীরদা চুপ করে থাকে, সে কি করে বলবে ঠাম্মাকে যে তার কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না। তার প্রথম প্রথম খারাপ লেগেছিল, প্রথম কয়েকদিন নতুন স্কুলে মন বসছিল না। কিন্তু এখন সব সয়ে গেছে। অনেক বন্ধু হয়ে গেছে তার। সে রোজের পড়া রোজ করে, ক্লাসে পড়া বলতে পারে---তাই সব টিচাররাও ভালবাসেন তাকে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এই স্কুলে বিশাল মাঠ আছে একটা। গঙ্গার ধারের সেই মাঠে টিফিনের সময় সে তার বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে। যদিও নদীর ধারের পাঁচিল টপকে তাদের নদীর কাছে যাওয়া মানা, তবুও সেই মাঠে নদীর জোলো বাতাস সবসময় একটা খুশিমাখা আবেশ ছড়িয়ে রাখে। ভালো লেগেছে, ভালো লেগেছে তার। সে শুধু মাঝে একবার একটু কলকাতা গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসতে চায়, এটাই বলার ছিল তার। কিন্তু এখন কি যাওয়া যাবে? ঠাম্মা কি যেতে চাইবে? সে পুরোটা বোঝে নি, কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে কলকাতার বাড়িতে ঠাম্মাকে কেউ একজন আঘাত দিয়ে কথা বলেছে, তাই এখানে চলে এসেছে ঠাম্মা তাকে আর দাদুকে সঙ্গে নিয়ে। যেখান থেকে একেবারে চলে এসেছে, সেখানে কি একটুখানি গিয়ে সবার সঙ্গে দেখা করে আসা যায় না? জানে না নীরদা, ঠাম্মার কষ্ট হবে কিনা একবেলা কলকাতায় দেখা করতে যাওয়ার কথা বললে।

এষা জানেন যে ঐটুকুনি বাচ্চা মেয়ে হলে কি হয়, ওর মনে অনেক প্রশ্ন জেগেছে। কি করে বোঝাবেন ওকে কেন দুম করে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কি করে বোঝাবেন যে সংসারের কোনও কোনও বাঁকে ছেড়ে দিতে হয় হাল, ঢেউয়ের দোলায় ছেড়ে দিতে হয় নৌকার রাশ, নাহলে যে সবকিছু খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তিনি যে পদ্ধতিতে সংসারের কাজকর্ম চালাতেন, তা যদি নতুন প্রজন্মের কারো অপছন্দ হয়, সেক্ষেত্রে সবকিছু সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে আসা বড় প্রয়োজনীয়। অবশ্যই তিনি পেরেছেন, কারণ এই বাসস্থান, মাথার উপরে অতিরিক্ত এই ছাদটুকু হুগলীর বাড়ির ছিল বলেই। নচেৎ সুনন্দর পেনশনের টাকায় আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকা মুস্কিল হত তার পক্ষে। সর্বোপরি, তার এই সিদ্ধান্তে সুনন্দর ঐকান্তিক সহযোগিতা ছিল। নাহলে হয়ত অসম্মান সহ্য করেই মানিয়ে নিতেন কলকাতার বাড়িতে। এত সব জটিলতা, সাংসারিক মারপ্যাঁচ কি করে এষা বোঝাবেন নীরদাকে!

এইসব ভাবনার মাঝে সন্ধ্যা নেমে আসে। কাপড় বদলে ধূপ জ্বালিয়ে ঠাকুরের আসনের সামনে দাঁড়িয়ে শঙ্খে ফুঁ দেন এষা। লক্ষ্য করেন নীরদা যেন বড় চুপচাপ; কিছু না বলেই পড়তে বসে গেল। অন্যদিন বলতে হয় তাকে পড়তে বসার জন্য। নাহ, একটু নিশ্চিন্ত লাগে তার। মেয়েটা বড় হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নিজস্ব একটা দায়িত্ববোধ। কলকাতার বাড়ির হই-হট্টগোলের থেকে দূরে আসা হয়ত ভালই হল মেয়েটার জন্য। ঈশ্বরের কাছে শক্তি প্রার্থনা করেন তিনি, যেন সব দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারেন।

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন এষা, ঠিক যেন তার যৌবনে ফিরে গিয়েছেন তিনি। কলকাতার বাড়ির বসার ঘরে প্রবল আড্ডা চলছে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে তিনি গান করছেন, রবি তবলায় সঙ্গত করছে। সুনন্দ আর তার দু তিন জন বন্ধু, দিলীপ- ঠাকুরপোর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন। সুনন্দর খুব বন্ধু ছিলেন দিলীপ। গানের সঞ্চারিতে এসে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। এষা বুঝতে পারলেন একটা আওয়াজ হল, সেই আওয়াজে ভেঙে গেল তার ঘুম। চোখ খুলে দেখলেন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। কিন্তু আওয়াজটা কিসের? বাগানে আমগাছগুলিতে বেশ ফল ধরেছে, সেই ফল চুরি করতেই কি কেউ পাঁচিল টপকে লাফ দিল? স্পষ্ট ঝুপ করে একটা আওয়াজ শুনেছেন তিনি। নীরদা কিছুদিন হল আলাদা ঘরে ঘুমাচ্ছে, একা। হাত বাড়িয়ে দেখলেন সুনন্দ বিছানায় নেই। হয়ত বাথরুমে গিয়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পরে এবং সুনন্দ না ফেরায় এষার ঘুমের ঘোর একদম কেটে যায়। উঠে বাথরুমে গিয়ে আঁতকে ওঠেন। ভাগ্য ভাল যে কদিন আগেই এটাচড বাথরুমের ছিটকিনি ভেঙে গিয়েছিল। আজ করছি কাল করছি করে সারানো হয়নি। তাই দরজা খোলাই ছিল। সুনন্দ পড়ে গিয়েছেন বাথরুমের মেঝেতে। সম্ভবত অজ্ঞান, মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড এক। এষা ডাকেন, নীরদাকেই ডাকেন। নীরদা ক্লাস সিক্সে পড়লে কি হবে, লম্বায় সে প্রায় এষার মাথায় মাথায়। দুজনে মিলে সুনন্দকে ধরাধরি করে এনে শুইয়ে দেন বিছানায়। ক্ষত পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে, একটা পটি বেঁধে দিয়ে এষা ডেকে নিয়ে আসেন স্বপনকে। স্বপনের বাবা রতন আগে দেখাশোনা করত এই বাড়ির। রতনের মৃত্যুর পরে স্বপন বিশ্বস্ত সৈনিকের মত পাহারা দিয়ে রেখেছে এই বাড়ি এবং সংলগ্ন বাগান। সুনন্দ এবং এষাকে সে জেঠু – জেঠিমা বলে সম্বোধন করে। এই বাগানের জমিতেই ছোট একতলা একটা বাড়িতে সপরিবারে সে থাকে।

স্বপন এসে বলে, ‘জেঠিমা, জেঠুর জ্ঞান ফিরেছে ঠিকই, কিন্তু আমি বলি কি, একটা ডাক্তার দেখিয়ে নেওয়া ভাল। এই তো, কাছেই তিন কিলোমিটার দূরে সেন্টার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের আউটডোর শুরু হবে। খুব ভাল ভাল ডাক্তার আসেন। আমি একটা ভ্যানরিকশা নিয়ে আসি। জেঠুকে একটু কষ্ট করে নিয়ে চলুন। বাড়িতে কল দিলে আসতে আসতে এনারা আউটডোর সেরে অনেক বেলায় আসবেন। তার চেয়ে চলুন এখনই নিয়ে যাই’। এষা পুরোপুরি ফেলে দিতে পারেন না স্বপনের প্রস্তাব। সুনন্দকে বলেন, ‘পারবে’? সুনন্দ সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন। স্বপন ভ্যানরিকশা আনতে যায়। দ্রুত তৈরি হয়ে নেন এষা নিজে এবং সুনন্দকে সাহায্য করেন পোশাক পরতে। যাবার আগে স্বপনের স্ত্রী জবাকে বলে যান, নীরদা একা রইল, একটু যেন দেখে।

আউটডোরের চিকিৎসা নিয়ে এষার খুব শ্রদ্ধা ছিলনা কোনও দিন। কিন্তু ডাক্তারের ব্যবহার দেখে ভালই লাগলো। সুনন্দর স্টীচ এবং ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বাঁধা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াতে এষা কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু নার্স ফিরে এসে বলল, ‘ডাক্তারবাবু আপনাকে ডাকছেন’। এষা আবার ফেরত গেলেন ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার বললেন, ‘মিসেস মুখার্জি, আমার মতে ওনাকে আমরা অ্যাডমিট করে নিতে চাই। আমাদের এখানে এমনিতেই বেড খুব কম চাহিদার তুলনায়। তবুও অন্তত একবেলা আমরা ওনাকে অবজারভেশানে রাখতে চাই। কারণ ওনার প্রেসার ওঠানামা করছে, তাছাড়া আপনি বললেন যে ব্লাড সুগার আছে। এছাড়া হঠাৎ পড়ে গেলেন কেন, সেজন্য ইসিজি এবং কিছু টেস্ট করাতে হবে’। ডাক্তারবাবু যেন আরও কি কি বলেন, এষার মাথায় পুরোটা ঢোকে না ঠিক। শুধু বুঝতে পারেন সুনন্দকে ভর্তি করানো দরকার।

ভ্যানিটি ব্যাগের ছোট নোটবুকে লেখা নিরূপের অফিসের ফোন নম্বর ডায়াল করেন এষা আউটডোরের পাশের এসটিডি বুথ থেকে। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বুঝিয়ে বলেন নিরূপ যেন একবার বাড়িতে ফোন করে। স্বপনকে সুনন্দর কাছে বসিয়ে রেখে ফের বাড়ি থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আসেন এষা এবং নীরদাকে পইপই করে বুঝিয়ে আসেন যেন অচেনা কাউকে বাড়িতে ঢুকতে না দেয় সে। অবশেষে সুনন্দকে ভর্তি করিয়ে যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অস্নাত অভুক্ত এষা বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখেন বাগানের আমগাছের ছায়ায় আধো অন্ধকারে কে যেন বসে আছে পিছন ফিরে। এষা কাঁপা কাঁপা গলায় চীৎকার করে ওঠেন, ‘কে? কে ওখানে?’ সেই মূর্তি উঠে দাঁড়ায়। কাঁচাপাকা চুল দাড়িতে এষা ঠিক চিনতে পারেন না। দীর্ঘদেহী মানুষটি কাছে এসে দাঁড়ায়, মুখ নিচু। একবার শুধু বলে, ‘বৌঠান...’



এষা অস্পষ্টভাবে প্রায় ফিসফিস করে বলে ওঠেন,... ‘রবি, রবি... তুই!’

0 comments: