2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - গৌতম দত্ত

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



এক বৈশাখে...
গৌতম দত্ত



শহুরে কলকাতায় পলাশ গাছ বেশ কমে গেছে। কিন্তু অগুন্তি কৃষ্ণচূড়া ভুলিয়ে দিয়েছে পলাশের সেই নেশা। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সবুজ পাতা ঘিরে আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া ফুলের বাহার কলকাতায় জানান দেয় যে বসন্ত চলছে। বাংলা ক্যালেন্ডার আজ আমাদের বাড়িতে অচল বললেই হয়, ইংরেজি ক্যালেন্ডারের একচেটিয়া দাপটে। তবু এই পলাশ আর কৃষ্ণচূড়ার আগুনে রঙ বাঙালীর মননে ধাক্কা মেরে জানিয়ে দেয় যে বসন্ত এসে গেছে আর এর পরেই আসতে চলেছে সেই কঠিন রুক্ষ গ্রীষ্মের দুটো মাস। একলা বৈশাখ মানে পয়লা বৈশাখ আর বেশী দেরী নেই। আমরা না চাইলেও একলাই সে আসবে আমাদের এই বাংলায়, তার প্রবল বৈভবে। আর তলে তলে শুরু হয়ে যায় বাঙালীর আর এক প্রাণের উৎসবের প্রস্তুতি পর্ব। 

বাঙালীর বারো মাসে তেরো পার্বন আজ শুধু বইয়ের পাতায় বা আধুনিক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাতায় আর শুধুমাত্র পুরোনো মানুষজনের স্মৃতিচারণে। ফাগুন পূর্ণিমার সেই দোল আজ হারিয়েই গেছে “হোলি”র আতিশয্যে। নেড়াপোড়া কি, তা আজকের প্রজন্ম জানেই না। কম্প্যুটার আর কম্‌পিটিশনের জগতে তারা যে আজ ঘরবন্দী! শহর আর মফঃস্বলের খেলার মাঠ আজ “প্রোমোটার” নামক এক শ্রেণীচরিত্রে’র কারণে উধাও। বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন উচ্চবিত্ত আবাসনের ছাদ ঘিরে গড়ে উঠছে “স্কাই ওয়াক”। আধুনিক মনের আধুনিক উপাচার। তবু এখনো চড়ক ঘোরে আমাদের এই কলকাতা শহরেও। মেলাও বসে সারা বৈশাখ মাস জুড়ে বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায়। আর সেই মেলায় আধুনিক অনেক কিছুর সাথে এখনো দেখা যায় সেই তালপাতার হাতপাখা কিংবা বেতের ফুলের সাজি। এরই মাঝে বেঁচে আছে আমাদের সেই পুরোনো দিনের সব স্মৃতি।

এই আজকের দিনে, মেনে যেদিন আমি এই লেখাটি লিখছি সেই ১৯শে মে বাঙলা ভাষার জন্যে উত্তাল হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যের বরাক উপত্যকা। ১৯৬১ সালের উনিশে মে, শিলচরে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাঙলার জন্য পুলিশের গুলিতে প্রাণ কেড়েছিল বাংলাভাষী ১১ জনের। এটা আমাদের গর্ব।

আর আমাদের বাঙালী জীবনে সবচেয়ে যে বড় ঘটনাটি ঘটেছিল এই বৈশাখে সেটা আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তাই ২৫শে বৈশাখ আমাদের জীবনে এক এগিয়ে চলার দিন। শ্রদ্ধায়, স্মরণে আর ভালবাসায় তাই বাঙালী এখনো তাঁকেই বরণ করে নেয় বাঙলার অন্যতম এক উৎসব হিসেবে। দূর্গাপুজো বাদ দিলে বাঙলা প্রিয় মানুষজন উন্মুখ হয়ে থাকেন এই দিনটার জন্যে। আবৃত্তি, গান, নৃত্য, নাটকের মূর্ছণায় এখনো ভেসে যায় শুধু আমাদের এই দুপারের বাংলা নয়, সারা বিশ্বের বাঙালীরা।

তবু এখানেই একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। কতটা আমরা নিতে পেরেছি আমাদের শয়নে-স্বপনে-জাগরণে’র একান্ত আপনজন এই রবীন্দ্রনাথের আদর্শ বা তাঁর লিপিবদ্ধ চিন্তাধারাকে। তাঁর একান্ত সৃষ্টি এই শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতী আজ সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসে কোনও এক অধ্যক্ষ মহাশয়ের পানীয়ের বিল সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশের হাত ধরে। যে ভাবনায় তিনি তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের সেই শিক্ষার জগৎ তা আজ কোথায় ? রাজনীতি, রাজনীতি আর রাজনীতির চাপ তার সর্বাঙ্গে। অহরহ নানান অজুহাতে সেখানে পড়াশোনার পরিবেশ আজ বিপন্ন। কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের বিশ্বকবির চোখে ভাষা সেই প্রাচীন ভারতের তপোবনের সমুজ্জ্বল ছবি। যা নির্মাণ করার জন্যে যখন যাঁকে প্রয়োজন তাঁকে ডেকে এনেছিলেন এই প্রাঙ্গনে শিক্ষাদানের জন্য শত আর্থিক বাধা সত্ত্বেও, সেই উজ্জ্বল গরিমা আজ কোথায় ! 

তিনি যে কতদূর খালি চোখে দেখতে পেতেন তাঁর অজস্র পরিচয় ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর লেখার ছত্রে ছত্রে। আমাদের সমাজে এখনো যেন বাস্তব যা তিনি লিখে গেছেন আজ থেকে কতো বছর আগে। তেমনই কয়েকটা পংক্তি আজ শোনাই আপনাদের। কতদিন আগে লেখা ‘রাজা ও রানী’ নাটকে –

সেখানে রানী সুমিত্রা জিজ্ঞেস করছেন দেবদত্ত’কে –


সুমিত্রা ।। আহা কে ক্ষুধিত ?

দেবদত্ত ।। অভাগ্যের দুরদৃষ্ট। দীন প্রজা যত

                      চিরদিন কেটে গেছে অর্ধাশনে যার

                    আজো তার অনশন হল না অভ্যাস,

                                    এমনি আশ্চর্য।

সুমিত্রা ।। হে ঠাকুর, একী শুনি।

                  ধান্যপূর্ণ বসুন্ধরা, তবু প্রজা কাঁদে

                                               অনাহারে ?

দেবদত্ত ।। ধান্য তার বসুন্ধরা যার।

                           দারিদ্রের নহে বসুন্ধরা। এরা শুধু

                    যজ্ঞভূমে কুক্কুরের মতো লোলজিহ্বা

                 এক পাশে পড়ে থাকে ; পায় ভাগ্যক্রমে

                      কভু ষষ্টি, উচ্ছিষ্ট কখনো। বেঁচে যায়

                         দয়া হয় যদি, নয় তো কাঁদিয়া ফেরে

                                    পথপ্রান্তে মরিবার তরে। ””



কি মনে হল ? এই সংলাপগুলো কি এখনও খুব একটা প্রাচীন বলে মনে হয় ? আমার তো হয় না সে যতই সংখ্যাবিচারে বোঝাতে চান না কেন। 

ভাবুন তো ‘রক্তকরবীর’ ভাবনাগুলো। আধুনিক যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রণার কথা লিখে গেছেন সেই ১৯২৫ সালে।ধরিত্রীর সব সম্পদ লুন্ঠনে সেই উন্মত্ত রাজা, কৃষি থেকে টেনে এনে, নিঃস্ব লোকগুলোকে দিয়ে সেই দুর্গম খনি থেকে সোনা আহরনে ব্যস্ত। তাদের রক্তের বদলে রাজা মেটাতে চায় তার ঐশ্বর্য্য সঞ্চয়ের বিকৃত লালসা। সারাদিন ধরে রাজার দল তাদেরকে শোষণ, শাসন, ব্যভিচার আর ষড়যন্ত্রে’র কলে পিষে পিষে নিংড়ে নেয় তাদের জীবনীশক্তি। আর তারপরে ছুঁড়ে দেয় আস্তাকুঁড়েতে। সেই সব শোষিত মানুষগুলোর আর তাদের নামে পরিচয় নেই। তারা শুধু সংখ্যা ! ৪৭ এর ফ কিংবা ৬৯ এর ঙ ! রাজার আমলাতন্ত্র চব্বিশ ঘন্টা ধরে তাদের ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ঘিরে রাখে। এই শোষন এই যন্ত্রণা থেকে কি আমরা এখনো এই একবিংশ শতাব্দীতেও মুক্ত হতে পেরেছি ? কি বলেন আপনারা ?

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আশাবাদী। তাই তো দেখি এর মধ্যেই বিশুপাগল আর নন্দিনী পারে ফুল ফোটাতে। ধানের ক্ষেতের সেই সবুজ দেখাতে রাজাকেও নন্দিনী বার করে আনে আর সেই অভেদ্য দূর্গ থেকে। এখন যখন শুনি কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিয্যৎ তখন সত্যিই ভয় করে। পারবো কি আমরা কৃষিভিত্তিক ভারতবর্ষকে অন্য দিকে জোর করে নিয়ে যেতে। নন্দিনী’রা আজ অসহায় রাজনীতির আবর্তে। 

আবার “কালের যাত্রা’য়” দেখি শূদ্ররা শাস্ত্র পড়ছে। দলে দলে ছুটে এসে তারা চাইছে রথের দড়ি ধরে টান দিতে। বলছে ‘রথ চালাবোই আমরা’। জীবনের মূল সমস্যা খাদ্য আর বস্ত্রের। বিজ্ঞান তার উন্নতি নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, আসল সমস্যা মানুষের বেঁচে থাকা। সেখানে জোগানদার হচ্ছে সাধারণ জনগনই। তাকে মেরে কিছুই বাঁচানো যায় না। তাদের জোরেই ঘোরে সভ্যতার চাকা। তাই তারা সচেতন হয়ে উঠে বলে ওঠে, ‘জয় আমাদের হাল লাঙল চরকা তাঁতের’। একথা রবীন্দ্রনাথ বারংবার বলে গেছেন তাঁর বিভিন্ন ভাবনার অনুষঙ্গে।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবার সময় কি এখনো আসেনি?









2 comments:

  1. অসাধারণ, অনবদ্য। এই ধরণের লেখা শুধু লেখকের সম্পদ নয়, আপামর বাঙালীর। প্রকাশকেরও দায়িত্ব এগুলি আরও বেশী করে প্রচার করা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সহমত। এধরণের লেখার প্রচার সময়ের দাবি।

      Delete