0

স্মৃতির সরণী - সুতপা পাত্র

Posted in

স্মৃতির সরণী


তপ্তদিনের কথা
সুতপা পাত্র


মন বলে চল, ‘আম কুড়োতে যাই’। উত্তর আসে কালবৈশাখী কই যে আম কুড়োতে যাবি? সত্যিই তো! আ চৈ চৈ আ চৈ চৈ কালবৈশাখী গেল কই? কালবৈশাখী কী তাহলে কালের গর্ভে সেঁধিয়ে গেল? তাহলে চল না তাকে আমরা খুঁজে বের করতে পারি কিনা দেখি? দাদু বলে নাতনিকে, চল না দিদিভাই একটু হেঁটে আসি বিকেলে । আমি বলি, না দাদু, এত গরমে আর যে সেজেগুজে বেরতে পারিনে। দাদু বলে, তাই বললে কী হয়? তোমাদের বয়সে আমরা কত খেলাধুলা করতাম, পরিশ্রম করতাম, আর তোমরা এখনই এত ঝিমিয়ে পড়ছ! আচ্ছা বাবা আচ্ছা! চলো, বেরোচ্ছি। দাদু-নাতনি হাঁটতে বেরোয় বৈশাখী বিকেলে। বাইরে বেশ হাওয়া দিচ্ছে। এই বছর এপ্রিল থেকেই বিশাল গরম পড়ে গেছে, এখনই তাপমাত্রা ৪০-৪২ ডিগ্রি, তবে এর মাঝে একটাই স্বস্তি যে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমান খুব কম, প্রায় নেই বললেই চলে। তাই, বিকেল থেকে রাত্রি বেশ বাতাস বয়। দুপুরবেলায় খুব কষ্ট হলেও বিকেলের পর কষ্টটা একটু কম লাগে। হাঁটতে হাঁটতে আসি মাঠের সামনে, সবুজ মাঠ, ছেলেরা একদিকে ক্রিকেট আরেকদিকে ফুটবল খেলছে। পাশে কতগুলো বাচ্চা ছোঁয়া-ছুঁয়ি খেলছে। 

ওদের খেলা দেখতে দেখতে চোখ চলে যায় বহুদূরে। হাত কাটা ফ্রক পরে বাচ্চা মেয়েটা দৌড়াচ্ছে আর মাঝে মাঝে পেছন ঘুরে দেখছে আর বলছে আমাকে ধরতে পারে না, পারে না। আবার দ্রুত পট পরিবর্তন - বাচ্চা মেয়েটা এবার কুমীর; চার-পাঁচজন সমস্বরে চেঁচাচ্ছে, কুমীর তোমার জলকে নেমেছি, কুমীর তোমার জলকে নেমেছি। বাচ্চা মেয়েটা ধরার চেষ্টা করছে, পারছে না । আসতে আসতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে । মা এসে ডাক দেয়, ‘বুনি ঘরে চল, অনেক খেলেচিস, এবার হাত-পা ধুয়ে পড়তে বসবি চল’। খেলা সাঙ্গ হয়। ঘেমে-নেয়ে যে যার ঘরে যেতে থাকে। দাদু পাশ থেকে নাতনিকে বলে, কী রে, চল? এবার বাড়ি ফিরি নইলে তোর মা তো আবার চিন্তা করবে। হ্যাঁ, দাদু চলো। 

বাড়ি ফিরে আসি। বেশ ঘেমে গেছি, গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দোতলার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াই। ঝাপসা ছবিটা আসতে আসতে আবার স্পষ্ট হয়- ওই তো দেখতে পাচ্ছি, বসে আছি হাঁটু মুড়ে, পেছন থেকে চোখদুটো বাঁধা, পাশ থেকে শুনছি, ডাকছে ‘আয় তো আমার বকুল’, কে যেন এসে কপালে টুক করে ঠোকা দিয়ে চলে গেল-‘সিঁদুর টোকাটুকি’ । চোখ খুলতেই সব ভোঁ-ভাঁ, সম্বিৎ ফিরে আসে। দেখি গোল থালার মত পূর্ণিমার চাঁদ নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। আচ্ছা, ঠিক কত বছর হল? ১০, ১৫, ২০ করে ২৩ বছর...। বাতাসেরা মৃদু সুরে ফিস ফিসিয়ে ওঠে-‘তখনও কী এমন গরম পড়ত রে’? আমি বলি-পড়ত বই কী! আবার ফিসফিসানি- ‘কী করতিস তখন’? কী করতাম? কী করতাম? ভাবতে থাকি...। তবে শোন...

আমরা যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম, নতুন ক্লাস শুরু হত এপ্রিলের মাঝমাঝি থেকেই আর গরমের ছুটি পড়ত মে তেl ফলে, এই সময়টাতে ক্লাস করতে হতl আধ ঘন্টার টিফিন পিরিয়ডে লুকোচুরি, কুমীরডাঙা, খো-খো এসব খেলতামl কাঁচরাপাড়া রেলওয়ে মিক্সড প্রাইমারি স্কুল, যার পেছনেই ছিল রেল লাইনl চারিদিকে বাউন্ডারী দিয়ে ঘেরা স্কুল-কম্পাউন্ডের ভেতর ছিল একটা খেলার মাঠ, টিনের একটা শেড আর বোধহয় ছিল মরচে পরা একটা দোলনা আর একটা স্লিপl স্লিপের ওপর কাউকে চড়তে দেখলেই আন্টিরা তেড়ে আসতোl যদি কেউ পড়ে গিয়ে আঘাত পায় তাই স্লিপে চড়া ছিল বারণl স্কুল শুরু হত বেলা ১০ টা থেকে, প্রেয়ার হত শেডের তলায়, গরমে ঘামতে ঘামতে সবাই একসাথে গলা মেলাত 'গড ইস ইন হেভেন'! প্রেয়ার শেষে ক্লাস শুরু হত। স্কুলের ভেতর যে খেলার মাঠটা ছিল আবার টিফিন টাইমে সেখানে সবাই জড়ো হতাম। মাঝে মাঝেই দেখতাম কেমন দুরন্ত গতিতে রেলগাড়ি ছুটে যাচ্ছেl সব থেকে মজা হত যখন মালগাড়ি যেত, ছেলে-মেয়েরা সবাই গার্ড কাকুকে টাটা করলে, উনিও হাসিমুখে আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তেনl আর সেই মাঠের প্রান্তসীমায় ছিল দুটো বড় কৃষ্ণচূড়া গাছl এই এপ্রিল মে মাসে লাল ফুলে মাটি ছেয়ে থাকতl কৃষ্ণচূড়ার একটা পাপড়ি থাকে যেটা সাদা আর লালের ছিটেয় ভরা……আমরা মেয়েরা কখনো টিফিন পিরিয়ডে খেলা ফেলে ফুল কুড়োতে যেতাম আর সেই বিশেষ বর্ণময় পাপড়িটা যত্ন করে তুলে ব্যাগের মধ্যে রাখতামl আরো একটা জিনিস করতাম কৃষ্ণচূড়া ফুলের বৃত্যংশ নখের উপর লাগিয়ে কৃত্তিমভাবে বড় নখ বানাতামl আমাদের স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে কে.জি.বি ক্লাস রুমের পাশে ছিল একটা বকুল গাছ, তার তলায় দারুণ কুমীর ডাঙা খেলা জমতl এছাড়া এই গরমকালে টুপটাপ করে সারাদিন অজস্র বকুল ফুল ঝরত, একটা মিষ্টি গন্ধে ছেয়ে থাকত চারিদিকl মাঝে মাঝে সেই বকুলফুলগুলো কাঠিতে গুঁজে গুঁজে বকুলকাঠি বানাতাম l কই গো কই গো কই ?/ আমার বকুল ফুল কই? / সেই ছোট্ট বেলার পুতুল খেলার বকুল ফুল কই?.....সত্যি সেইসব বকুল ঝরানো দিনগুলি সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে l 

ধীরে ধীরে প্রাইমারি ক্লাসের গণ্ডি ছাড়িয়ে পা দিলাম হাই স্কুলেl কাঁচরাপাড়া ইন্ডিয়ান গার্লস হাই স্কুলl উঁচু ক্লাসে ওঠার সাথে সাথে টিফিন পরবর্তী পিরিয়ডের সংখ্যাও পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেতে লাগলোl ক্লাস সেভেন-এইট থেকে টিফিনের সময় আর বিশেষ খেলাধুলা করা হত না, গরমের ছুটি পড়তেও দেরী আছে, সেই মে মাসের লাস্ট উইকেl তাই বাইরে ঘোরাঘুরি না করে স্কুলের তিনতলার বিল্ডিং য়ের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতাম গ্রিলে হাত দিয়েl স্কুল বাউন্ডারির পেছনেই ছিল হাইন্ড মার্সের মস্ত মাঠ। যেখানে ক্রিকেট, ফুটবলের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত আর সেই মাঠের দুপাশে রাস্তা ধরে ছিল সারি সারি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, আর জারুলের সমারোহl দারুণ অগ্নিবাণে বসুন্ধরা যখন দগ্ধ, চারিদিক রুক্ষ শুষ্ক, তারই মাঝে লাল-হলুদ, আর আসমানী রঙের বাহারি সমাহারl দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে দেখতাম কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম উল্লাস কেমন মিশে গেছে রাধাচূড়ার হলুদ আঁচলে আর আগুন-রাঙা লাল-হলুদের মাঝে জারুলের বেগুনি প্রভা যেন স্নিগ্ধতার এক বর্ণিল প্রকাশ l 

গ্রীষ্মের ছুটি পড়তে পড়তে মে মাস হয়ে যেত। গ্রীষ্মাবকাশে আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হত না। ফলে গ্রীষ্মের দুপুরগুলো ছিল নিরলস, কর্মহীন। নাইন-টেনে ওঠার আগে টিউশনপাতি, পড়াশোনার বিশেষ চাপ ছিল না। তাই দুপুরবেলাগুলো কাটত গল্প বই পড়ে, ঘুমিয়ে। নিস্তব্ধ নির্জন দুপুরে পথঘাট থাকত জনশূন্য তারই মাঝে শোনা যেত আইসক্রিম ওয়ালার টিং-টিং ঘণ্টি। বনবন আইস্ক্রিম। ১ টাকায় পেপসি, দু-তিন টাকায় লাল-হলুদ, সাদা হরেক রঙের কাঠি আইসক্রিম পাওয়া যেত। তারই লোভে ছেলের দল ভিড় জমাত। মা তো কিছুতেই কিনে দিতে চাইত না, ধারণা এই আইস ক্রিম খেলে নির্ঘাত পেট খারাপ করবে। তবুও কখনো কখনো উপরোধ-অনুরোধে একআধটা জুটে যেত। এখন তো ঠেলা গাড়িতে আর আইসক্রিম বিক্রি হতে দেখিনা, এখন তো আইসক্রিম পার্লারের যুগ এসেছে। কোনও কোনও দিন ভর দুপুরে লোডশেডিং হয়ে বসে থাকত। তখন জানলাগুলো খুলে দিতাম, মাঠের দিক থেকে গরম হাওয়া ঘরে আসত। শুয়ে থাকাই যেত না, ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে যেতাম। কখনও কখনও মা তাল পাখার বাতাস দিত। ঘণ্টা খানেক পর যখন কারেন্ট আসতো ফ্যানের হাওয়ায় প্রাণ জুড়িয়ে যেত। 

এক একদিন বিকেলবেলায় আকাশ কালো করে ধেয়ে আসত ‘কালবৈশাখী’। প্রচণ্ড সে ঝড়ের দাপটে গাছপালা মথিত হত। দগ্ধ মত্ত পৃথিবী যেন তার পুঞ্জীভূত সবটুকু তেজ বিকিরণ করে প্রলয় নৃত্যে মেতে উঠত। আমরা যে কোর্য়াটারে থাকতাম তার চারপাশে অনেক আমগাছ ছিল, ঝড় উঠলেই ছেলেমেয়েরা সব হৈ হৈ করে আম কুড়োতে যেত। আমার মা কিছুতেই ঝড়ে বেরোতে দিত না। তাই উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঝড় দেখতাম। আকাশের রঙটা কীভাবে পালটে যায়......চারিপাশে এক অদ্ভুত ঝোড়ো গন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে গুরুগম্ভীর মেঘের বজ্রনিনাদ, কালো মেঘের ফাঁকে বিদ্যুৎ রেখার ঝিলিক...। তারপরেই শুরু হত বৃষ্টি। প্রচণ্ড দাবদাহের পর এই বৃষ্টি অমৃত ধারার মত উত্তপ্ত ধরিত্রীর বুকে নেমে আসত। আর শিলাবৃষ্টি হলে তো কথায় নেই, মাথায় গামছা বেঁধে উঠোনে শিল কুড়োতে নামতাম। বৃষ্টির শীতল স্পর্শে রুক্ষ ধরিত্রী সজীব হয়ে উঠত। পরদিন সকালে উঠে দেখতাম কেমন মিষ্টি নরম রোদ উঠেছে আর আমাদের উঠোনটা ঝরা পাতায় ছেয়ে গেছে। ফাঁক পেলে রাস্তায় বেরিয়ে আমগাছের তলাগুলো একবার দেখে আসতাম, যদি কোনো আম পড়ে থাকে। ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন থাকলে দুএকটা আম পেয়েও যেতাম। তাইই কুড়িয়ে নিয়ে এসে চুপচাপ মায়ের ঝুড়িতে রেখে দিতাম। মার যেহেতু এই আম কুড়ানো ব্যাপারটায় আপত্তি ছিল, তাই বাধ্য হয়েই এই লুকোচুরি। মা বলত বাবা বাজার থেকে কাঁচা আম কিনে নিয়ে আসবে। কিন্তু কেনা আমের চেয়ে কুড়িয়ে আনা আমের যে মজায় আলাদা। যাইহোক, শেষ অবধি ওই কুড়িয়ে আনা ছোট ছোট আমগুলোর সদগতি হত চাটনি করেই...।

গ্রীষ্মকালে দুপুরবেলায় লোড শেডিং হলে যেমন কষ্ট হত, তেমনি ঝড়ের সময় কারেন্ট অফ হলে দ্বিগুন মজা হত। তখনও জেনারেটারের লাইন আসেনি আমাদের কোর্য়াটারে। সন্ধ্যে হয়ে যেত, পড়তে বসতে হত না। চুপচাপ অন্ধকারে থেকে ঝড়-বৃষ্টি উপভোগ করতাম। অনুভব করতাম অন্ধকারেরও এক অপার রহস্য আছে। ধীরে ধীরে অন্ধকারের রহস্যে বুঁদ হয়ে যেতাম। কোনও কোনওদিন আবার প্রাকৃতিক গোলযোগ না থাকলেও কারেন্ট অফ হত, এক-দু ঘণ্টার জন্য। আহ! কী মজা। বই না খুললেও কেউ কিছু বলবে না। এই সময়ে কখনও কখনও মাঠে এসে বসতাম মায়ের সাথে। আশেপাশের কোর্য়াটারের জেঠু-জেঠিমারা, দিদিরাও এসে বসত। মাঠে বসে হাওয়া খেতাম। জ্যোৎস্না রাত হলে তো কথাই নেই। চারিদিক জোৎস্নার মায়াবী আলোয় এক অপার্থিব জগত রচনা করত। এখন তো ঘরে ঘরে ইনভার্টার, তাই আজকের বালক-বালিকারা আর অন্ধকারের সেই সৌন্দর্য-রহস্য কোনটারই স্বাদ পায় না। 

বাতাসের ফিসফিসানি কখন থেমে গেছে, অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে চারপাশে। কী যেন নেই, কী যেন নেই। সত্যিই তো হারিয়ে গেছে, যা হারিয়ে গেছে তা আর ফিরে পাবার নয়। হারিয়ে গেছে সেই দিনগুলো যখন গরমকালের বিভীষিকার থেকেও গ্রীষ্মকালের যে নিজস্ব একটা রূপ আছে, তারও যে একটা মাধুর্য্য আছে, তা চেতনায় ধরা পড়ত। আমার গ্রীষ্মকাল তাই মিশে আছে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িতে, কালবৈশাখীর ঝড়ে, আম কুড়ানোর মজায়। আমার গ্রীষ্মকাল লেগে আছে বকুল ফুলে, সিঁদুর-টোকাটুকিতে, লোডশেডিংয়ের আলোআঁধারিতে। সবাই বলে আগের থেকে তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে, কিন্তু আমার মনে হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে এখনকার যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা হল আজকের কসমোপলিটান যুগে গ্রীষ্মকালকে উপলব্ধি করার উপদানগুলো চারিপাশ থেকে উধাও হয়ে যেতে বসেছে। ‘কালবৈশাখী’ তো প্রায় অভিধানে ঢুকে পড়েছে! 

স্কুল ছেড়েছি অনেকদিন হল, কোয়ার্টার ছেড়েও চলে এসেছি বহুকাল। এখন আমার গ্রীষ্মের দুপুর কাটে ল্যাবের এসিতে।... এখনও হয়তো সেই স্কুল মাঠটার চারপাশে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে লাল-হলুদ-বেগুনি সব কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া জারুলের দল.......অতীত সব সময়ের সাক্ষী হয়ে আমার বৈশাখবেলার সব কথা নিয়ে।

0 comments: