ব্যক্তিগত গদ্য - অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
Posted in ব্যক্তিগত গদ্য
ব্যক্তিগত গদ্য
আমার জীবনে সাদা দাড়ির যুবকটি
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
না, আমি জীবনস্মৃতি লিখতে বসিনি। আমি অতি নগন্য মানুষ। আমার জীবনের স্মৃতি কেউ পড়বে, এটা আমি আশা করি না। তবু আমি বলে মিলায় আমি। জীবনটা যখন আমার, কিছু স্মৃতি তো আছেই। সেই পুরনো দিনের কথা ভাবতে গেলে মনে আসে উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষার দিনটা। বিজ্ঞানের ছাত্র আমি। জয়েন্ট-এর প্রিপারেশন করতে করতে বাংলা পরীক্ষার কথা ভুলেই গেছিলাম। এক রাত পড়ে পরীক্ষার হলে। প্রশ্নপত্র হাতে পেয়ে প্রথমে তো মাথাতেই আসছে না কোথা থেকে এসেছে প্রশ্নটা। সেদিনও উদ্ধারকর্তা একজনই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। 'পল্লী গ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন' করতে গিয়ে কবিগুরু বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত - এবার ফিরাও মোরে। ছোটবেলায় পড়া কবিতাটা থেকে লিখে গেলাম - এই সব শান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা। ডাকিয়া বলিতে হবে মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে। ...উতরে গেলাম বাংলা পরীক্ষা সেই যাত্রায়। এবার ফিরাও মোরে অবশ্য আমায় মাধ্যমিকেও প্রচুর সাহায্য করেছে। সেই সময় বেঙ্গল বোর্ড-এ 200 মার্কস-এ 153 পেয়েছিলাম বাংলা পরীক্ষায়। আর সাত নম্বর পেলে পত্র লাভ হত। ভাবসম্প্রসারণ - আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। বসুন্ধরা কবিতার উপকার - জলহীন ফলহীন আতঙ্ক পাণ্ডুর উষর মরুক্ষেত্রে মরীচিকার প্রেতনৃত্য। মৃত্যুঞ্জয়ও সাথ দিয়েছে অনেক। রে রুদ্র তব সঙ্গীত আমি কেমনে গাহিব কহে দাও স্বামী। ...প্রকৃতির বর্ণনায় তো পুরোটাই রবিঠাকুরের অবদান। অথবা গানের লাইন। নগরে গ্রামে কাননে দিনে নিশীথে নম প্রাণ উচ্ছসিত আজই... আবার সেই রবীন্দ্রনাথ। ইংলিশ essay-তেও কম উপকার পাইনি। The Religion of Man এর অনুসরণ এ আমার লেখা - Man's History is made not by the heroic deed men did but by the number of hurdles they overcame... যাই হোক সে অনেক পুরনো স্মৃতি।
হৃদয় আছে যার সেই তো ভালোবাসে। কথায় বলে বাঙালি ছেলে কবিতা না লিখলে আর প্রেম না করলে নাকি জীবন সফল হয় না। আমার যৌবনের প্রথম লগ্ন, তখনো মোবাইল ফোন আসেনি। প্রেমপত্র লিখতে বসেছি। কিন্তু কি যে লিখি! মাথায় তো ঘুরছে কনসেনট্রেটেড সাল্ফিউরিক অ্যাসিড বা মেকানিক্স-এর প্রবলেম।
আবার সেই ধার করলাম রবীন্দ্রনাথ থেকে। প্রহর শেষে আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস / তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ। তারপর? সূচনা তো লিখে ফেললাম। বাকিটা? এবার ধার দিল শেষের কবিতা। পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী...।
যাই হোক, পথ চলতে চলতে পেরিয়ে এসেছি অনেকটা পথ। কারিগরী বিদ্যাতেও একটু আধটু সফলতা পেয়েছি। Indian Engineering Service ভারতীয় কারিগরী পরীক্ষার কঠিনতম (সম্ভবত) অথবা অন্যতম কঠিন পরীক্ষায় সফল হয়েছি। কিন্তু আজও ইচ্ছে করে কাব্য গড়ার কারিগর হতে। নতুনকরে ভাবতে। তাই রবীন্দ্রনাথের গান... নদী আপন বেগে পাগল পারা...গাইতে গাইতে মনে হয় এটা কি নদীর আত্মকথা না বিবর্তনবাদ? আমি সদা অচল থাকি গভীর চলা গোপন রাখি...? এ তো ডারউইন-এর বিবর্তনবাদ। তাহলে নদীর আপন বেগ আসলে জীবন পরিবর্তনের স্রোত। যা সব সময় চলেই যাচ্ছে। অথবা অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলো...? এখানেও বিজ্ঞানের ছটা। নতুন করে ভাবায়। জানি তার পণ্যবাহী পোত কালের তরঙ্গ স্রোতে রেখা মাত্র চিহ্ন রাখবেনা। এত বড় ভবিষ্যৎ বাণী অভাবনীয়।
আজ কম্পিউটার-এ এতটাই অসহায় যে বাংলা লিখতে গেলেও টাইপ করার জন্য ভুল বানান ঠিক করতে পারিনা বা মনেরমত শব্দ লিখতে পারিনা। সবই কম্পিউটার কন্ট্রোল করে। এটা আমার সীমাবদ্ধতা। তবু তারই মাঝে মনে পড়ে একটা দিন -পঁচিশে বৈশাখ। হে নূতন দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক জায়গায় বলেছিলেন - বন্ধুদের আড্ডায় গান গাইতে গেলে প্রথমেই মনে আসে রবীন্দ্রসঙ্গীত। আজ বম্বে কাঁপিয়ে ভারত নাচিয়ে যখন গায়ক গায়িকাদের - হাল মে পানি নেহি মিলতা হ্যায় - তখনও সেই রক্ষাকর্তা রবীন্দ্রসঙ্গীত। আমার যেটুকু সাহিত্যের জ্ঞান, দর্শন বোধ, তার প্রায় সবটাই একজনের অবদান - রবীন্দ্রনাথ। অতি নগন্য আমি। আমার এই চলার পথে, সদ্য পার হয়ে আসা পঁচিশে বৈশাখ স্মরণে তাই জানালাম সেই সাদা দাড়ির চিরযুবক রবীন্দ্রনাথকে আমার প্রণাম।
0 comments: