1
undefined undefined undefined

ছোটগল্প - বিবি বসু

Posted in


ছোটগল্প



দোলাচল 
বিবি বসু 



বাড়ি ফিরতে সাড়ে নটা হল সেদিন। তৃষার জন্মদিন ছিল। খুব রাত্তির হবে ভেবে তৃষার বাড়ি পৌঁছেই ড্রাইভার কাকুকে বিদায় দিয়েছিল শ্রী।

কাকু একটু গাঁইগুই করতে বলেছিল---‘ফিরে যাও দিকিনি। বয়স হয়েছে।তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ঘুম লাগাও।গাড়ির চাবি মায়ের হাতে দেবার সময় বোলো ---এটা ২০১৬। গভীর রাতেও ফোন খুলে ক্যাব ডাকা যায়। পার্টি চলাকালীন যদি ফোন করে বিরক্ত করে তাহলে ফোন বন্ধই রেখে দেব।’

কাকু বিলক্ষণ জানে তার গুড়িয়া রানীর জেদ---সেই নার্সারি ক্লাস থেকে গুড়িয়াকে নিয়ে ইস্কুল যাওয়া থেকে আজকের ২৪ বছরের ইঞ্জিনিয়ার গুড়িয়াকে নিয়ে অফিস যাওয়া। কাকু ‘আরে মেরা রানী গুড়িয়া---আপনা খেয়াল রাখনা’বলে বিদায় নেয়। 

জমিয়ে মজা হল। মদ তো তারা সেই আঠেরো থেকেই খায়।আজ এসেছিল আরেকটু নিষিদ্ধ জিনিস।বাপরে! একটান দিতেই মাথায় ঝিলমিল নদী বইছিল যেন। তার থেকে দু পেগ ভদকার পর দুটো tequila shots নিয়ে নুন, লেবু চুষে নেওয়া ভাল ছিল।

পার্টি জমে রঙিন---যাকে ওদের পরিভাষায় বলে fantabulous। মহুল এসেছিল পার্টি শুরু হবার ঘণ্টা খানেক পর। মহুল পড়াশুনোর নিরিখে শ্রীর থেকে বছর দুয়েকের সিনিয়র।একই কলেজের ছাত্র ছাত্রী দু’জনে। মহুল সদ্য পুরনো কোম্পানি ছেড়ে নতুন চাকরিতে যোগ দিয়েছে---চাপ বিস্তর---তাই দেরী।

শ্রী জানে মহুল কারণে, অকারণে শ্রীকে একলা পেতে চায়। মহুলকে দেখলেই শ্রীর ভেতরটা ছমছম করে---খুব ইচ্ছে করে নিবিড় ভাবে ধরা দিতে--- কিন্তু...

আজ প্রত্যেকেই জল আর ঘাসের যৌথ কৃপায় যখন কিঞ্চিৎ টালমাটাল, মহুল বারান্দার এক মায়াবী কোণ থেকে শ্রীকে ডাকে---স্খলিত পায়ে শ্রী এগিয়ে যায়। মহুল কথা বলতে থাকে অনর্গল---বলে চলে তার টুকরো টুকরো স্বপ্নের কথা। কিছুদিন চাকরী করে কয়েকজন মিলে একটা start up খুলবে। শ্রী যেন তার স্বপ্ন প্রোজেক্টে অবশ্যই থাকে---তারপর দুজনে একসাথে জীবন শুরু করবে।

নেশা দীপাবলির রঙ্গোলী আঁকে শ্রীর গহনে---স্বপ্ন ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কথার ফাঁকে মহুল ঘনিষ্ঠ হয়। এক হাতের বেড়ে জড়িয়ে ধরে শ্রীর কোমর।শ্রী ধরা দেয়। ধীরে ধীরে মহুলের আঙুল যখন আঁকিবুঁকি টানে তার অনাবৃত পিঠে, কেমন একটা অস্বস্তি শুরু হয় শ্রীর। আবছা, আবছা কি যেন সব ঘষা কাচের মতন ছবি,রাক্ষসের মতন দাঁত, নখ বার করে কদর্য হাসি হাসে।

মহুলকে ভাল লাগছে, কিন্তু অন্তরঙ্গ মুহূর্তে কি যে ঠিক হচ্ছে শ্রী ঠিক বুঝতে পারে না।মহুলের তপ্ত নিঃশ্বাস কানের কাছে বাজতেই শ্রীর শরীর অসাড়, কঠিন। ঠোঁট যখন ঠোঁটের স্বাদ চায়, শ্রী গুলি খাওয়া জন্তুর মতন ভয়ে কুঁকড়ে যায়।মনে হয় এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে।ছিটকে সরে আসে মহুলের নাগালের বাইরে।মহুল বিহ্বল, ভীষণ অপ্রস্তুত। বারবার মিনতি করে শ্রীকে।

শ্রী ভাষাহীন চোখ তুলে দেখে। কিন্তু জিভ শুকনো, বাক্য সরে না। কিছু কি বলার ছিল তার মহুলকে? খুব গোপন কিছু? কিভাবে বলবে?

শেষমেশ সকলের চোখের আড়ালে টুক করে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। না একদম একা ক্যাবে চেপে বাড়ি ফিরতে পারবে না সে এখন। নিজের সঙ্গে একা থাকা এই সময় অসম্ভব।নিজের সাথেই ছায়া যুদ্ধ করে করে সে বড় ক্লান্ত।১২ বছর তো খুব কম সময় নয়।

ঐ তো একটা ভলভো আসছে। ভিড় আছে বেশ কিন্তু শীততাপনিয়ন্ত্রিত। দিব্যি চড়া যাবে।অনেকের ভিড়ে মিশে যাক নিজের এই অদ্ভুত অস্বস্তি।না, সে কিছু মনে করতে চায় না, কিচ্ছুটি না। যবনিকা ফেলেছে অবচেতনে। কিন্তু তাও কেন সময়ে, অসময়ে নখ, দাঁত বের করে আড়াল হয়ে যাওয়া সেইসব দিন?

বাড়ি ফিরল। উদ্বিগ্ন মা দরজা খোলেন।মেয়ে ২৪ মা ৪৭। চামড়ার জলুসে সাতচল্লিশ চব্বিশকে হার মানায়। মা বলেন,‘মা গো, দেরী হবে বলেছিলে যে। এখন তো রাত দশটা বাজতেও ঢের দেরি। চলে এলে যে? শরীর খারাপ?’

‘দূর, থামো তো। সবেতে প্রশ্ন। utterly disgusting। ঘরে যেতে দাও।বিরক্ত করবে না একদম বলে দিলাম। দিদার সাথে বসে stupid soap দেখ গিয়ে।’

শ্রী ঘরে এসে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে। একে একে junk jewelery ছুঁড়ে ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে।ঘর অন্ধকার করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আকুল কান্না নামে দুচোখ বেয়ে। বালিশ সাক্ষী শুধু। শব্দ হলেই মা দরজায় ধাক্কা দেবে।

বেচারি মা, আজও জানে না---তাকে যৌবনে যোগিনী করেছে তারই আত্মজা। কত বয়স হবে তখন মায়ের? এই ৩৫ হবে। হ্যাঁ, হিসেব তাই বলছে।

টলমল পায়ে হেঁটে যায় সুইচ বোর্ডের দিকে। আলো জ্বালে। নিজের দিকে তাকায়।সত্যি কি খুব অন্যায় করেছে সে?

আলমারি খোলে। বের করে আনে তার অপকর্মের এক দলিল---একটা চিঠি। এক বছর আগে এসেছিল মায়ের নামে--- মুন্সিয়ারি থেকে। নিরুদ্দেশ হবার ১২ বছর পরে মা কে লেখা বাবার প্রথম চিঠি। বাবা লিখেছে---

মৃন্ময়ী,

১১ বচ্ছর হোল। নামগোত্রহীন হয়ে এভাবে আর বাঁচতে পারছি না গো।এতদিনে মেয়ের মুখে সবটাই শুনেছ নিশ্চয়। জানি আমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তবুও যদি ক্ষমা করতে পার, নিচের নম্বরে ফোন কোর।আমি অপেক্ষায় থাকব। আর চিঠি পাঠানোর এক মাসের মধ্যে যদি যোগাযোগ না করো জানব আমি চির ব্রাত্য।

আমি গভিরভাবে অনুতপ্ত।

এই ফোন নম্বরে ফোন করে আমার খোঁজ কোর--- +918521445745

আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাইছি।


ইতি

শুভময়


না, ১২ বছর আগেও ছোট্ট শ্রী জানত, আসল কথাটা তার অতি সাদাসিধা, সাধারণজ্ঞানহীন মা কে বলা যাবে না। কোনদিনও না।Paedophile শব্দটাই মায়ের আজও অজানা।জানলে, মা একদম ঝড়ে পড়া গাছের মতন ভেঙে পড়বে। এত বছর ধরে তাই শ্রী তার ছোট্ট বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছে কথার পাহাড়। রোজগার শুরু হবার পর counseling ও করাতে গিয়েছিল লুকিয়ে, লুকিয়ে।

জ্ঞান হবার পর থেকেই, বাবার হাতে নানাভাবে অত্যাচারিত হতে হতে, যেদিন বুঝতে পেরেছিল---বাবা আসলে একজন pervert---a despicable pedophile---সেদিন শ্রী রুখে দাঁড়িয়েছিল। অপরিণত শ্রীকে শৈশবে কুৎসিত ভাবে ব্যাবহার করেছে বাবা, তার বিকৃত যৌনতা চরিতার্থ করার জন্য।

সেদিন ছিল নীলষষ্ঠী। মা ছুটি নিয়েছিল। মা আর দিদা দুজনেই মন্দিরে গিয়েছিল একসাথে। বাড়ি ফাঁকা। বাবা এসে গায়ে হাত দিতেই শ্রী ফোন তুলে 100 ডায়াল করে। বিস্ময়ে বিমূঢ় বাবা একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করে। নীলের পাঠ শেষ করে মা আর দিদা বাড়ি ফিরলে, শ্রী অম্লান বদনে জানিয়েছিল---‘হঠাৎ একটা জরুরী ফোন আসায়, বাবা চট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। আমি ঘুমোচ্ছিলাম, আমাকে দরজা দিতে বলে। বলেছে বিকেল নাগাদ ফিরবে।’

তারপর অনেক বিকেল পার হয়। পুলিশ, হাসপাতাল, মর্গ, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন কিছুই বাদ যায় না।

প্রথম প্রথম বাড়িতে পুলিশ আর সাংবাদিকদের আনাগোনা লেগেই থাকত!উফ! কেন যে তার বাবা এককালে রঞ্জি অব্ধি খেলেছিল কে জানে? ধীরে ধীরে আনাগোনা বন্ধ হল। বাবার অফিসের লোকজনও আসা বন্ধ করল। মা কে ওইসব স্তোকবাক্য আর শুনতে হয় না---‘বউদি, আমরা আছি। ডাকলেই আসব। আপনি দুগগা বলে জয়েন করুন, কতদিন আর ছুটি নেবেন? একটা ফোন করলেই এই প্রণবেশ আর এই রত্না দৌড়ে আসবে জানবেন। আরে শ্রী কি আমাদের মেয়ে নয়?’

মাস দশেক পরে মা আবার অফিসে যেতে শুরু করল। এখন তো সব কাজ নিজে সামলায় চুপচাপ। সাজগোজ ও করে।কিন্তু রাত্তিরবেলা কেমন ভ্যাবলার মতন বারান্দার কোণে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।দিদা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মেয়ের মুখের দিকে---একাকীত্ব কি সেটা বুঝতে চায় বোধহয়।

বুকে পাহাড় নিয়ে বসে থাকে শ্রী। এই চিঠি কি মা কে দেওয়া উচিৎ ছিল তার?

না, না! যে লোকটা ওর শৈশব ভয়াবহ করে তুলেছে, যার বিকৃত কাম আজও ওকে কোনও সম্পর্কে স্বাভাবিক হতে দেয় না, তাকে আবার এক ছাদের তলায় ফিরিয়ে নেওয়া? অসম্ভব। অতি প্রার্থিত যুবকের স্পর্শেও শ্রী কুঁকড়ে যায় আজও।কোনওদিন স্বাভাবিক হতে পারবে না সে---কোনওদিন কাউকে আপন করতে পারবে না।

কিন্তু মা? মা তো কিচ্ছুটি জানে না। বাবাকে হয়ত তেমনি গভীর ভালবাসে আজও।

কি করবে শ্রী? এক বছর আগে আসা চিঠিটা কোলে নিয়ে দূর আকাশের দিকে বোবা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে! 



1 comment: