ধারাবাহিক - বিশ্বনাথ রায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
‘যাবনী-মিশাল ভাষা’র সন্ধানে - অন্তিম পর্ব
বিশ্বনাথ রায়
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ জুড়ে ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত বাংলা ভাষা গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে শ্রমজীবী মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে চাষা-ভুসো, জেলে, মাঝি-মাল্লাদের মুখের ভাষা হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে উর্দু জানা এক শ্রেণীর মৌলবি ধর্মীয় উর্দু ভাষা হিসাবে এর প্রচলন করেন। আমাদের অনুমান, পরবর্তীকালের সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারগুলিতেও মুখের ভাষা হিসাবে এর চলন হয় – যেমনটি দেখা গিয়েছিল ভুরশুট ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলিতে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, আরও স্পষ্ট করে বললে দ্বিতীয়ার্ধের আগে কোনও মুসলমান কবি কাব্যভাষা হিসাবে নিজেদের রচনায় এর ব্যবহার করেননি। সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবির তো বটেই, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের হায়াত মামুদ পর্যন্ত সকলেই মধ্যযুগের খাঁটি মান্য বাংলাভাষায় কাব্য রচনা করেছেন।
‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে দক্ষিণ রাঢ়ে ভুরশুট অঞ্চলে মুসলমান কবিদের বিশিষ্ট কেন্দ্রের’ উল্লেখ করেছেন সুকুমার সেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘‘ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ অবধি এই অঞ্চলের লেখকরাই ইসলামি বাঙ্গালা সাহিত্যে প্রাধান্য করিয়া গিয়াছেন।’’ ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য’ বা ‘মুসলমানী পুঁথি সাহিত্যের’ আদি রচয়িতা শাহ্গরীবুল্লাহর বাসস্থান ছিল বালিয়া পরগনার বর্তমান হাওড়া-হুগলি জেলার সীমান্ত অঞ্চলে অবস্থিত হাফেজপুরে। আহমদ শরীফ তাঁর ‘বাঙালী ও বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে তিনজন গরীবুল্লাহর উল্লেখ করেছেন। এঁদের একজন ‘ফকির’, একজন ‘মুনশী’ আর একজন ‘বেপারী’। ফলত গরীবুল্লাহ সমস্যায় এঁদের কাব্যরচনার কাল নিয়ে স্বাভাবিক বিতর্ক আছে। আমরা আগেই বলেছি, হাফেজপুরের ফকির গরীবুল্লাহর কোনও কাব্যেই রচনাকাল নেই। তবে কয়েকটি রচনার অভ্যন্তরীয় প্রমাণ থেকে মনে হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নবাবি আমলের বিলীয়মান সময়ে তাঁর কাব্যগুলি রচিত হয়েছিল। তাঁর ‘জঙ্গনামা’ ব হোসেন মঙ্গলের ‘শেষ ভণিতায়’ শাহা নেজামের নাম উল্লেখ আছে –
গরীব কহেন শাহা নেজামের পায়।
কেতাব মাফিক এত্তা দূরে হইল সায়।।
এই ‘শাহা নেজাম’ হলেন ‘নবাব মীর জাফরের পুত্র নাজিমুদ্দৌলা’ বা নজমুদৌল্লা। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে মীর জাফরের মৃত্যুর পর তাঁর এই নাবালক পুত্র ইংরেজের পুতুল-নবাব ছিলেন ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মাধ্যমে কোম্পানি নিজে শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত। সুতরাং এই কালসীমায় (১৭৬৫-১৭৭২) যে কাব্যটি রচিত হয়েছিল তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
‘ইউসুফ-জেলেখা’ কাব্যেও পরোক্ষে নবাবি আমলের উল্লেখ করেছেন গরীবুল্লাহ –
আল্লা তালা সালামৎ রাখিবে বাদশারে।
সের সালামৎ রাখ বাদশার উজীরে।।
* * * * *
ইউসুফ জেলেখার গীত পালা হৈল সায়।
লেহ ভাই আল্লার নাম দিন বহে যায়।।
গরীব ফকির কহে কেতাবের বাত।
নায়েকের তরে আল্লা বাড়াওও হায়াৎ।।
এই সূত্রেই ড. সুকুমার সেনের মন্তব্য:
‘‘বাদশার উল্লেখ হইতে মনে হয় যে নিবন্ধটি কোম্পানির অধিকারের পূর্বে অন্তত পক্ষে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে লেখা হইয়াছিল।’’
আমাদের অনুমান কোম্পানির অধিকার পূর্ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ বলতে ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দের শেষদিক থেকে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কালসীমা। কেননা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সুবেদারি নিয়ে এই সময়কার রাজনৈতিক টানাপোড়েনে দিল্লির বাদশাহ্ দ্বিতীয় শাহ আলম ও তাঁর উজির শুজাউদ্দৌল্লার প্রভাব ছিল গভীর। সম্রাট শাহ আলমই ইংরেজ কোম্পানিকে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ান নিযুক্ত করে ফরমান জারি করেছিলেন ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট। বাংলায় তাঁর নামাঙ্কিত মুদ্রাও চলেছিল অনেকদিন পর্যন্ত। এইসব থেকে মনে হয় ১৭৬০-১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই গরীবুল্লাহর ‘ইউসুফ-জেলেখা’ কাব্যটি রচিত হয়েছিল, যার মধ্যে উল্লেখ আছে সমকালীন বাদশাহ ও তার উজীরের কথা।
দ্বিতীয়ত, ভুরশুট পরগনার সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি সৈয়দ হামজা (১৭৩২-১৮০৮) গরীবুল্লাহকে কবিতার গুরু বলেস্বীকার করে নিয়ে তাঁর অসম্পূর্ণ কাব্য ‘আমীর হামজা’র দ্বিতীয় খণ্ড লিখে সমাপ্ত করেন ১৭৯২-১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে। এই প্রসঙ্গেই সুকুমার সেন জানিয়েছেন ‘‘গরীবুল্লাহর জীবৎকাল ১৭৯২ অব্দের অন্ততপক্ষে বিশ-পঁচিশ বছর আগেই হইবে।’’ সুতরাং অষ্টাদশ শতা্ব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ছয়-এর দশকেই তাআর কাব্যগুলি রচিত হয়েছিল বলে গবেষকরা অনুমান করেছেন। মাহবুবুল ইসলাম লিখেছেন, গরীবুল্লাহর ‘‘জীবনকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে (কারও মতে ১৭৬০-১৭৮০) কাব্য সাধনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়।’ এই ‘কারও মত’টি হল আহমদ শরীফ-এর। তিনি স্পষ্টতই লিখে্ছেন –‘‘কৃষ্ণরাম, ভারতচন্দ্র প্রমুখ হিন্দু কবিদের ‘মিশ্রভাষা’ প্রয়োগের অনুকরণে ফকির গরীবুল্লাহ ১৭৬০ থেকে ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তাঁর কাব্যগুলো রচনা করেন।’’
‘মিশ্রভাষা’, ‘দোভাষী রীতি’ বা রায়গুণাকর কথিত ‘যাবনী মিশাল’ বাংলা ভাষায় মুসলমানি পুঁথি সাহিত্যের ‘যথার্থ প্রবর্তক’ হিসাবে গরীবুল্লাহর নাম করেছেন আহমদ শরীফ। তাঁর হাতেই যে এই সাহিত্য শাখার সূচনা হয়েছিল এবং তিনিই যে মুসলমানি পুঁথি সাহিত্যের আদিকবি, এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য নেই। এই সাহিত্যধারার অন্যতম কবি ভুরশুট পরগনার উদনা-নিবাসী সৈয়দ হামজা গুরু গরীবুল্লাহর পথ ধরেই যশস্বী হয়েছিলেন। আমরা আগেই বলেছি, অষ্টাদশ শতাব্দীর ভুরশুট-মান্দারনকে কেন্দ্র করে তার আশেপাশে ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে একদল শায়ের বা কবির আবির্ভাব ঘটেছিল, যাঁদের লেখা মসলমানি প্রণয়োপাখ্যান, যুদ্ধকাব্য, পীরগাথা ও নানা ধর্মশাস্ত্রই সাহিত্যধারার অন্তর্গত। বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের এই ‘পুঁথি সাহিত্য’ সৃষ্টিতে দক্ষিণরাঢ়ের লেখকদেরই প্রাধান্য ছিল। এক্ষেত্রে প্রায় সকলেই গুরু মেনেছেন শাহ গরীবুল্লাহ ও তদীয় শিষ্য সৈয়দ হামজাকে। এই অঞ্চলের কবি মহাম্মদ মুনশী পূর্বসুরিদের স্মরণ করে লিখেছেন –
ছৈয়েদ হামজা আরা সাহা গরিবুল্লা।
এ দোনো শায়ের ছিল আলম উজালা।।
(– উম্মর উম্মিয়ার নকল ও ভোজের বাজী)
এছাড়াও ভুরশুট ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অন্যান্য বিখ্যাত কবি মালে মোহম্মদ, মুহম্মদ দানেশ, মুহম্মদ খাতের (বালিয়া), মুহম্মদ মুনশী, মুনশী আয়জাদ্দিন, বেলায়েত হোসেন, দায়েম উল্লাহ (বালিয়া) প্রমুখ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত কাব্য রচনা করে গেছেন।
আমাদের প্রশ্ন, হঠাৎ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে গরীবুল্লাহ ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা বিশেষ একটি অঞ্চলে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় নিয়ে ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত বাংলা ভাষার বিশেষ একটি রীতিতে কাব্য রচনা করতে গেলেন কেন? এর প্রত্যক্ষ দু’টি কারণ আছে বলে মনে হয়। প্রথমত ভুরশুট-মান্দারন ও দক্ষিণ রাঢ়ে মুসলমান সমাজে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে এই ভাষা প্রচলিত থাকলেও কৃষ্ণরাম, ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, বিদ্যাপতি শ্রীকবিবল্লভ-এর মতো দু’চার জন কবি প্রয়োজন মতো অল্প বিস্তর তার ব্যবহার করেছেন, কিন্তু ‘যাবনী মিশাল’ ভাষায় সম্পূর্ণ কাব্য কেউ লেখেনি। তাহলে অ্ষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শাহ গরীবুল্লাহ হঠাৎ করে তা শুরু করলেন কেন? আমাদের মনে হয় এর প্রথম কারণটি ঐতিহাসিক। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে বহিঃশত্রু ইংরেজদের কাছে পলাশীর যুদ্ধে হেরে গিয়ে সাড়ে পাঁচশো বছরের ইসলামি শাসন ব্যবস্থার পতনের পর মুসলমান সমাজ আত্মশক্তিতে দুর্বল হয়ে দিশাহীন অবস্থায় নিজেদের ধর্ম-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও ভাষাকে বেশি করে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল। বেন্টিঙ্কের সময় থেকে রাজভাষা আরবি-ফারসির গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে ইংরেজির প্রচলন শুরু হলে শিক্ষিত মুসলমানরাও যাবনী মিশাল ভাষার সাহিত্যকে মেনে নেয়। ফলত যুদ্ধকাব্য বা জঙ্গনামা, রোম্যন্টিক কেচ্ছা (কিস্সা), ইসলামি শাস্ত্র ও সামাজিক রীতিনীতি বিষয়ক ‘পুঁথি’ গুলি তাদের মনের খোরাক হিসাবে জনপ্রিয়তা পেতে থাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই গোটা উনিশ শতক জুড়ে। বিশ শতকের প্রথমা্ধ পর্যন্ত এর রেশ থেকে যায় গ্রামীন মুসলমান সমাজে। পরাজিত জাতি হিসাবে বিজয়ী ও শাসক ইংরেজদের প্রতি বিদ্বেষ থেকেই ইংরেজি শিক্ষা ও পাশ্চাত্য ভাষা-সাহিত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন রেখে অন্ধভাবে মধ্যযুগীয় রীতিতেই মুসলমানি সাহিত্যের মকশো করে যান তাঁরা। এমনকি হিন্দুয়ানির ছোঁয়াচ আছে মনে করে বিশুদ্ধ মান্য বাংলাভাষাকেও পরিহার করতে থাকেন। এর বড়ো দৃষ্টান্ত সৈয়দ হামজা। তাঁর প্রথম কাব্য ‘মধুমালতী’ (১৭৮৮) মধ্যযুগীয় শিষ্টভাষায় লেখা হয়েছিল বলে একেবারেই জনপ্রিয়তা পায়নি। এর পরেই তিনি গরীবুল্লাহর অনুসরণে ‘যাবনী মিশাল’ ভাষায় লিখতে শুরু করে খ্যাতিমান হন।
এ আসলে ইতিহাসের পুনারবর্তন। ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের পরবর্তীকালে পরাজিত হিন্দুরা যেমন জয়ী ও শাসক মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবে আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলতে দেবতার পায়ে ধর্না ও ধর্মের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানদের অবস্থাও হয়েছিল তদ্রূপ। চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অজস্র লৌকিক দেব-দেবীর মাহাত্ম্য জ্ঞাপক মঙ্গলকাব্যের যে পুচ্ছানুসরণ কিংবা যুদ্ধকাব্য হিসাবে রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ যেমন হিন্দু পাঠক-শ্রোতদের নিস্তার করেছিল, তেমনি মুসলমানি পুঁথি-সাহিত্যও ছিল আত্মশক্তিতে দুর্বল মুসলমানদের আশ্রয়স্থল। এইসব কাব্যও তাই মঙ্গলকাব্যের ছাঁদে, পাঁচালিলর ঢঙে লেখা হয়েছিল দু’শো বছর ধরে একই আখ্যানের অনুবর্তনে।
দ্বিতীয় কারণটি ভুরশুট অঞ্চলের কবিশ্রেষ্ঠ রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র কর্তৃক ‘যাবনী মিশাল’ ভাষার সাহিত্যিক স্বীকৃতি। পলাশীর যুদ্ধের পাঁচ বছর আগে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে অন্নদামঙ্গল কাব্যটি রচিত হবার পরে পরেই তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে ও গোটা বঙ্গদেশেই ছড়িয়ে পড়ে। ‘আরবী-ফারসী-হিন্দুস্থানী’ মিশ্রিত ‘যাবনী মিশাল’ বাংলা ভাষাতে যে প্রসাদগুণ সম্পন্ন কাব্যস সৃষ্টি হতে পারে – একথা ঘোষণা করে হাতে কলমে তা প্রমাণ করে দিয়েছিলেন ভারতচন্দ্র। আমাদের ধারণা, ভুরশুট অঞ্চলের ভূমিপুত্র গরীবুল্লাহর কাব্যভাষার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হয়েছিল এই ‘যাবনী মিশাল’ বাংলা। ণিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ভারতচন্দ্রের সাফল্য তাঁকেএই ভাষায় কাব্য-রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। মনে রাখতে হবে জীবনের প্রান্তসীমায় ‘হাতেমতাই’ রচনার সময় (১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ) সৈয়দ হামজাও ভারতচন্দ্রের জন্মস্থান পেঁড়ো-বসন্তপুরে কিছুকাল অতিবাহিত করেন। এখান থেকে গরীবুল্লাহর বাসস্থান হাফেজপুরের দূরত্ব ছিল সামান্যই। মুসলমান ‘সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্র’ ভুরশুট-মান্দারন অঞ্চলের মুখের ভাষাকে প্রথম থেকে নিজের কাব্য-কবিতায় সার্থক ভাবে ব্যবহার করতে থাকেন ভারতচন্দ্র। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে গোটা উনিশ শতক জুড়ে বিদ্যাসুন্দরের দৌলতে বাংলা সাহিত্য জগতে ভারতচন্দ্রের লোকপ্রিয়তা বলতে গেলে ‘ব্র্যান্ড নেম’ হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং একই অঞ্চলের প্রতিবেশী কবি গরীবুল্লাহ তাঁর ভাষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হবেন না, এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না। অষ্টাদশ শতকেই একদিকে হ্যালহেড, লেবেডফ, ফরস্টার যেমন তাঁর গুণমুগ্ধ হয়েছিলেন, তেমনি তাঁর যাবনী মিশাল ভাষাকে অবলম্বন করে তলে তলে গড়ে উঠেছিল নতুন এক সাহিত্যধারা, যা ছিল সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের প্রাণের সম্পদ। প্রায় দুশো বছর ধরে শতাধিক কবি (শায়ের) যে বিশিষ্ট একটি ভাষায় কয়েক শত বাংলা কাব্য লিখেছেন, সেই ভাষার নাম নিয়ে একালে বিতর্ক প্রচুর। ‘মিশ্রভাষা’, ‘দোভাষা’, ‘এছলামি বাঙ্গালা’ বা ‘ইসলামি বাঙ্গালা’, ‘মুসলমানী বাংলা’, ‘খোট্টাভাষা’, ‘ফারসী বাঙ্গালা ভাষা’, ‘Musalman Bengali’, ‘Boatman’s Language’ – কত নামকরণই তো হয়েছে। কিন্তু সেকালেই সেই অষ্টাদশ শতকেই এই বিশিষ্ট ভাষার স্বরূপ নির্ধারণ করে প্রকৃত নামকরণটি করে গেছেন ভারতচন্দ্র – ‘যাবনী মিশাল’ বাংলা ভাষা। এই নামকে অস্বীকার করলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়।
আর একটি নির্মম সত্য স্বীকার করা ভালো। আচার্য সুকুমার সেন ছাড়া হিন্দু সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও সমালোচকেরা প্রথম থেকেই যাবনী মিশাল ভাষায় লেখা ‘মুসলমানী পুঁথি সাহিত্য’কে অবহেলা করেছেন। এর কাব্যরস বা সাহিত্যগুণ যাই হোক না কেন, ইতিহাসগত কারণে দেড়শো বছর ধরে লক্ষ লক্ষ পাঠক-শ্রোতার মনের তৃষ্ণা মেটানো কাব্যগুলিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা একেবারেই ঠিক হয়নি। দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘‘মুসলমানী কেচ্ছার কলুষ স্রোতের মুখে পড়িয়া বঙ্গসাহিত্য কলুষিত হইয়াছিল’’ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন – ‘‘The Literature in Musalmani Bangali has no merit…’’। অথচ রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ মুসলমানী পুঁথি সাহিত্যের গুরুত্ব স্বীকার করে বিশ্বভারতীর গ্রন্থাগারে তার সংরক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন ও বৃহৎ গ্রন্থাগারগুলিতে এই বিরাট সাহিত্যধারার প্রায় কিছুই রক্ষিত হয়নি। কিন্তু মুহম্মদ শহীদুল্লাহ একেই ‘বাংলার মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য’ বলে অভিহিত করেছেন।
যে ঐতিহসিক কারণে কবিওয়ালাদের রচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধিক্ষণকে ধারণ করে আছে, সেই একই কারণে মুসলমানী পুঁথি সাহিত্যকেও স্বীকার করা উচিত। এর একটি ধারা তো লোকসাহিত্য হিসাবে বিবেচিত হতেই পারে। মিলনজ্ঞাপক ‘সাহিত্য’কে নিয়ে এই বিভেদ ও মেরুকরণের অভ্যাস ত্যাগ করার সময় হয়েছে বাঙালির।
সমাপ্ত
0 comments: