0

পথে প্রান্তরে - শ্রাবণী দাশগুপ্ত

Posted in


পথে প্রান্তরে



সুহানী মন্দারমনি 
শ্রাবণী দাশগুপ্ত



দুপুর দুটো পনেরোয় কাণ্ডারী এক্সপ্রেসে হাওড়া থেকে দীঘা ফ্ল্যাগ স্টেশন। মাঝে কাঁথি, এখনও সেই কন্টাই লেখা – ছোট্টো এক টুকরো থামা এক মিনিটের জন্যে। দিনে চারবার যাতায়াত করা ভারতীয় ট্রেন সময়ে পৌঁছাল দেখে ভয়ানক অবাক হলাম। পাঁচটা দশেই সাঁঝের আভাস। স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে রাস্তাটা হাইওয়ে হলেও, চওড়া নয়। কালীপুজোর দিন, এদিক ওদিক দুচারখানা ছোটো প্যাণ্ডেল আলোয় সাজানো। বাজী পুড়ছে, পয়সা নয়। উদ্দণ্ড অসভ্যতা নেই। ভালো লাগছিল। দুধারে ম্যানিকিওর না করা সহজ সবুজ। অন্ধকার চেপে এসে অস্পষ্ট ও ছায়াময়। গায়ে গায়ে খুপরি দোকান, আলো টিমটিম। আধখেঁচড়া ইঁটের বাড়ি। গাড়ি যতো এগোয়, সড়ক শীর্ণ, এক আধটা গাড়ি, ট্রেকার, ভুটভুটি, মন্দারমনি-কাঁথি বা দীঘা-কাঁথি বাস। আরও কয়েকটা আঞ্চলিক নাম লেখা (শুনিনি আমি)। বেঁকে টেরে চলেছে পাশ কাটিয়ে, যেন বনপথ ধরে চলেছি। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলার পরে, সঙ্কীর্ণ কাঁচা রাস্তা – দুধারে জলা, লম্বা ঘাস। ওই ঘোর আঁধারে গা-শিরশিরে ভৌতিক অনুভূতিতে বিভোর হয়ে, আধঘন্টা আরও। তারপরে গুটিকয় হোটেল, আলো জ্বলে না। চালক বলেন, ওধারে লাইট নেই কোথাও। বড়ো হোটেলরা জেনারেটর চালিয়ে নিজেরা বন্দোবস্ত করেছে। নজরে এলো ‘সান সিটি’ লেখা সাইনবোর্ড’, ছোটো করে লেখা ‘রোজ ভ্যালি’। বিঘে বিঘে জমির ওপরে বিলাসবহুল সৈকতাবাস। এখন প্রায় জনশূন্য। পাঁচিলের আড়ালে ওয়াটার পার্ক থেকে রোপওয়ে, সব বন্ধ। গৌরী সেনের দল বিপাকে পড়েছেন যে! আলো জ্বলছিল অবশ্য। উজ্জ্বলতার পাশে বাকি অন্ধকার আরও গাঢ়।

প্রতিটা অতিথি আবাস সৈকতের ওপরে। মূল দরজার বাইরে পা ফেলতেই বালি, পরের সকালে দেখলাম। অমাবস্যা রাতের মোটা চাদর, তাই দেখতে পাই নি। সৈকতাবাসের আলোয় যতটুকু দৃশ্যমান ছিল, ব্যাস। কারণ বুঝলাম না ঠিক, শুনলাম সরকারের সহৃদয় আনুকূল্য মন্দারমনির ভাগ্যে জোটে নি এপর্যন্ত। তাই এ আঁধারে...। তা হোক, তবু বেশ লাগছিল। চটকহীন প্রকৃতির অবিকল রূপ দেখে ‘দিঠি জুড়ন গেলা’। বাইরে বসি। অবিরল ঢেউ গড়িয়ে আসার চেনা শব্দ কান ভরে। রিসর্টের গেটের বাইরে চারচালা দোকান। চটচটে শক্ত বেলাভূমির ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে গাড়ী, ট্রেকার, স্কুটার। তাদের আলো যতটুকু ও যতক্ষণ – ছুমন্তরে কিঞ্চিৎ দৃশ্য। আমরাও ওভাবে এসে পৌঁছেছি। জল এগিয়ে পায়ের পাতা ছোঁয় ছোঁয়। গোরু একপাল এদিক ওদিক ভূমিশয্যায়। জানি না কেন ওরা থাকে ওভাবে। 

ভেবেছিলাম সূর্যোদয় দেখব, ঘর ছেড়ে কোথাও বেড়াতে গেলেই যেমন ঘন বাসনা জাগে। অথচ ক্লান্তি মেটানো আরামের ঘুম চোখ ছেড়ে যেতে চায় না বড়ো। তাই একটু দেরিতেই, প্রায় সাতটা বাজে তখন। সূর্য আমাদের প্রস্তুতির জন্যে ‘গ্রেস টাইম’ দেয় নি। তবু জুড়িয়ে গেল চোখ। ঢেউয়ের খেলা খেলছে সমুদ্দুর, যেমন আবহমান খেলে থাকে। অযথা আসা যাওয়া, ছুঁয়ে দিতে চাওয়া। সে তো এক রকম। কিন্তু এই সৈকত! কত দূর অবধি মাটির আঁচল বিছিয়ে। তাতে সোনারঙ রোদ্দুরের নিভৃত আরাম। শুধু তাকিয়ে থাকা, তাকিয়ে দেখা। দুহাত আকাশে ছুঁড়ে উদার হওয়া, আর কিছু নেই। পেছনে ঝাউসারি সবুজ পাড়ের সীমানা গেঁথে। আমরা তিনটি অবধূতের মতো ভালো লাগা মেখে ঢেউ ছুঁয়ে বাতাসের গলায় কথা বলি। 

‘‘কি, যাবেন না কি মোহনার দিকে?’’ এক মানুষ পাশ থেকে এসে দাঁড়ালেন ভুটভুটি নিয়ে। লুঙ্গি-পরা। বেশ পরিপাটি চুল। আন্তরিক, পরিশীলিত কথক, যেমন গ্রামীনরা হন। শহর থেকে ‘বেড়াতে আসা’দের ছোঁয়াচে আধুনিকতার লেপনটি যথার্থ হয়েছে, অনেকখানি জীবিকার তাগিদেও। সেই ভোরে উনিই প্রথম – আর্লি বার্ড। ভাড়া ঠিক করে ওঠা গেল। গজগমনের মতো পা দোলাতে দোলাতে চলেছি। গমগমে সমুদ্দুর বাঁদিকে। অন্যদিকে অসামান্য বিস্তার নির্জনতার, সেইটেই আমাকে বেশি টানছিল। বালির ওপরে সূক্ষ্ম দানার আলপনা বালি দিয়েই, কাঁকড়া আর ঝিনুকের দেহনিসৃত। মানুষটি দেখালেন হাত ছুঁড়ে – ‘‘ওই যে দেখুন লাল কাঁকড়া।’’ আমরা নেমেছি যান থেকে। ছুটোছুটি করে হামলে পড়েছি, ‘‘ও মা! ও মা! তাই না কি? কই কই?’’ আমাদের অভিজ্ঞতায় বিশ্বের দ্বাদশ আশ্চর্য... ক্যামেরা রেডিই – এ্যাকশন, শুট্‌! ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলেম... ওরা মোটেই পোজ দিলে না। অসংখ্য পালাচ্ছে দৌড়াচ্ছে দেখছি অদূর থেকে। কাছে যেতে না যেতেই নিমিষে গুহাবাসী। আমাদের পরিচালক নিজের কথা শোনাচ্ছেন মনোরম টোনে... পয়সাকড়ি বেশ আছে ওঁর, জমিজমা কাছে, গ্রামে। দুই মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছেন, ওঁদের গ্রাম্য মুসলমান সমাজের রীতি দস্তুর। ছেলেরা পড়ছে। শুনছি আলাপন। আমরা শহরবাসী গুটিয়ে থাকি, এক হই না, আত্মীয় হই না। শুনি, ভালো লাগে, নিজেদের ভাঙি না। 

দূর সবুজের প্রান্ত থেকে বালিতে পায়ের ছাপ রেখে একটি অপু আসছে ছুটে... হাতে-ধরা লাল কাঁকড়া, আমাদের দেখাবে। সামনে এসে তুলে ধরে, ‘‘কিচ্ছু করে না, দেখো দেখো।’’ আমরা বোকা বোকা বিস্ময়ে মূক! 

কী দারুণ। দাঁড়া ছবি তুলি এবারে, একটাকে তো পাওয়া গেল। কাঁকড়া ছেড়ে দিয়েছে বালিতে, সেটি লজ্জায় আত্মহত্যার কথা ভাবছিল কি না, জানি না। দেখা হলো, ফোটো হলো, সব হলো। অপু বলল, ‘‘পয়সা দেবে বাবু, বিসকুট খাব?’’ আমাদের গুজগুজ - অস্বস্তি – দশ-বিশ টাকা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতেও পারি, তা বলে বাচ্চাটার এই ভিক্ষে শিক্ষে? 

‘‘এ্যাই, ইস্কুলে যাস না?’’ যেন ইস্কুলে গেলে সব সমাধান... সব ভালো, সব আলো জ্বলে জ্বলে উঠবে। 

‘‘যায় যায়, ওই যে দুপুরে খাবার দেয়,’’ আমাদের পরিচালক বলেন, ‘‘দ্যান বাবু, বড্ড গরীব, ওর বাপের জমিটমি নাই কিছু।’’ দেখে নিয়েছে আরও কয়েকটি অপু দুগ্‌গা পটু বিনি! ওদের সুতোতেও লাল কাঁকড়া। এসেছে এক সাথে, পয়সা দেবে, বিসকুট খাবো? পিছু ছাড়ে না কিছুতেই! খুচরো শেষ হয়ে আসে। বিস্কুটই তো? প্রশ্ন খোঁচায় – শৈশব... এই শৈশব...! এভাবেই শুরু? বিশাল উদার প্রকৃতির প্রান্তে এসে অনুদার হতে ইচ্ছে করে না। নিজেরাই তো কত খরচ করে রিসর্টে...। অদূরে নদীর মোহনা, বালির ওপরে দাঁড়িয়ে দেখি। অন্ধকার, কালো আর সমস্যাগুলো ভাসিয়ে দেবার মন নিয়ে আলো চোখে দাঁড়িয়ে থাকি। সপ্তডিঙা মধুকর চলেছে সারি সারি জলের ওপরে। মাছ-ধরা জেলে ডিঙি। কী অপরূপ প্রশান্তি সবখানে।

উলটো রাস্তা ধরে ফেরে ভুটভুটি। রিসর্টের সামনেই কারা ওয়াটার স্পোর্টস্‌-এর সরঞ্জাম গুছিয়ে বসেছে – এও ব্যবসা। আকাশে ওড়ো বেলুন চেপে, জলে নেমে স্কুটার চালিয়ে ভেজো, মোটর বোটে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচো! ইচ্ছে করছিল, একটু ভীতিও যে...। আপাতত চিন্তাটুকু যেন টলমলে, আমাদের যান এগোতে থাকে। সমুদ্দুরও ‘‘এই খেলবি? খেলবি না কি?’’ করে পাড়ের দিকে ঢেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সূজ্যিঠাকুর হেলাফেলায় আঁচ বাড়াচ্ছেন, কমাচ্ছেন। মেঘগুলো ভারী নেকী কি না! ওপাশ জুড়ে বৃহৎ মানে বিস্তৃত, মানে আলিশান ক্যাম্পাস ‘রোজ ভ্যালী সান সিটি’র। সব ভুলে তাকিয়ে, চোখ যায় ধাঁধিয়ে। উঁচু পাঁচিলের ভেতরে যন্তরমন্তর, খেলাখেলি। বাইরে বোল্ডার বসানো (যদিও ঢেউ কদাপি অত দূরে পৌঁছায় না)। সমুদ্রমুখী সারি সারি দোতলার বারান্দা। মন্দারমনি যে আদ্যোপান্ত পশ্চিমবঙ্গীয় গ্রাম, ভুলিয়ে দেবার যৎপরোনাস্তি চেষ্টা। মন্দির আছে, ঢুকে দেখার অনুমতি দিলেন না সিক্যুরিটি, বাইরে থেকে ‘নমো নমো গৌরী সেন’ বলে কপালে হাত ঠেকালাম। 

পাকস্থলী জানান দিচ্ছে, জাবনা দেবার আয়োজন করা দরকার। বিরতি দিয়ে রিসর্টে ফিরি। তার বর্ণন না করি, তবে এটুকু বলি, সামগ্রিকভাবেই প্রকৃতি-নির্ভর, বাহুল্যহীন ও অতি মননশীল পরিকাঠামো। ভালো লাগাটা সহজ হয়ে আপনা থেকে উঠে আসে। বাঙালী মালিকানা, সৌহার্দ্য ও অতিথিপরায়নতা কর্মীদের। কে বলে বাঙালী ব্যবসাবিমুখ? গত রাতে এখানে পরিচয় হয়েছিল এক নিবিড় আত্মমগ্ন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে। এক দলা এঁটেল মাটি, দুহাতের দশ আঙুল আর ছোট্ট এক ছেনী – একের পর এক সৃষ্টির মহিমায় মিশে আছেন। রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছেন, জানালেন বিনা অহমিকায়। কলকাতায় অবারিত গতায়াত – ‘সৃষ্টি’র দুর্গামূর্তি গঠন করেন। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নিলাম আর দু’চার কথা। শুনলাম চুপচাপ... দেখলাম ক্যাম্পাস জুড়ে তাঁর কাজ, মন জুড়নো। 

পায়ের যা অবস্থা আমার, ধকল সয় না। একটু পরেই জিরোন চায়। খানিক পরে বের হলাম, সমুদ্রস্নান করতেই। সমুদ্রের ঢেউ দেখে দূর থেকে ভাবি, ভারী হম্বিতম্বি – ‘‘এইও, আমাকে ভয় পাস না নাকি?’’ এরকম করে চোখ পাকাচ্ছে গাল ফুলিয়ে। এক পা এক পা সাহস করি আমরা। শক্ত মাটি পায়ের নিচে, বালি ভুসভুস না। এই ডুবল গোড়ালি, ওই দূর থেকে ঢেউ পাকাচ্ছে, আমরা পায়ের নিচে বালিমাটি আঁকড়ে। যেমন হয় পুরীতে – মাটি কখন সরে যায় পায়ের নিচ থেকে – ধরণী দ্বিধা, স্নানার্থীর তোয়াক্কা না করে! দূর, ও রকম কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। বাচ্চা বাচ্চা ঢেউ, গায়ে জোর নেই একফোঁট্টা। আবার পদক্ষেপ একটুকু, ইস্‌, জল হাঁটুও ছোঁয়নি! কিন্তু দেখাচ্ছে যেন একটা বিষম গোলমাল পাকাতে আসছে প্রায় সুনামির মতো। তীরের কাছে আহ্লাদীপনা, ‘‘এই চ’, কুমীরডাঙা?’’ অতএব বেশ দুর্দম নাবিকের সাহসে, হারিয়ে যাব অকুল অচিন্‌ পাথারে – ভেবে নেওয়া যাক। ব্যাপারটা প্রায় তেমন, এত নীরব, এত নিশ্চিন্দি, এত জনবিরল – এই স্বাভাবিক। যত ভাবি, দিক না দু’এক ধাক্কা, দিক না ফেলে, আছড়ে – নাঃ অনেক দূর অবধি শুধু কোমর জল। কলকাতার বর্ষাকালে একবার এরকম – ভেবেই রোমাঞ্চিত! এভাবেই তিনটি ঘন্টা নিশ্চিন্তে - খেলা খেলা সারা বেলা। বালিতে কালচে পলি, কাদা ঘুলিয়ে ওঠে জলের সঙ্গে। পায়ে সুড়সুড়ি জলজ লতাপাতার, স্টার ফিশ, শঙ্কর মাছের লেজ। অসংখ্য দেখেছি ভেজা বালিতে, অবশ্যই ক্ষুদ্রাকৃতি। আমার তনয়া আবার ‘pisces’, খুব জলবিলাসী। অনেক কষ্টে টেনেটুনে...। 

খাওয়ার পর দিবানিদ্রাটি ভেঙে বেরিয়ে দেখি, দিনের আলো নিভে এলো সুজ্যি ডোবে ডোবে। ঘোর ঘোর আঁধার নামছে। যেহেতু তীরে একফোঁটা আলো নেই, মানে কোনও ল্যাম্পপোস্টও, একটু পরে ঠিক ‘খাবো তোকে ঘচাং ফু’! আকাশ দেখে মনে হচ্ছে দশমীর সিঁদুর খেলা হয়ে গেছে একটু আগে – ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ’। আমরা ফাঁকতালে সান্ধ্য ভ্রমন সেরে নিই – হঠাৎ স্বাস্থ্য সচেতনতা। কতটুকু সময় আর? জল ছুঁয়ে চলে আসি, পাড়ে দাঁড়িয়ে চলমানতার আওয়াজ শুনতে পাই। ব্যাস। ট্রেকার, গাড়ি, স্কুটার নির্ভয়ে বালি পার হয়ে যায়, আসে। দেখি, তারপর রিসর্টে ঢুকে আসি। ঝাউবনে পাতা ঝিরঝির, অন্ধকারে তারা আকাশ, দূর থেকে গড়িয়ে আসা ঢেউ। মানুষ কতভাবে যে প্রকৃতির কাছে ঋণী!

যেখানে ছিলাম, বেশ কুঞ্জবন কুঞ্জবন ভাব। মৃৎশিল্পীর কাজ টেরাকোটার মূর্তি, ঝাউবন, মায়াময় আলো, এমন কি শান্তিনিকেতনের নাম দিয়ে অঞ্চল বিভাজন – ‘শ্যামলী’, ‘উদীচী’ – এরকম। রাত্তিরে প্রতিজ্ঞা নিয়ে শোয়া গেল, সূর্‍যোদয় দেখবই দেখব। 

সাড়ে পাঁচটায় দিগন্ত ছাপিয়ে আলো ফুটছে, ঢেউয়ের আনাগোনা তেমনই। তড়িঘড়ি গেটে এসে ন্যাকার মতো শুধোই, ‘‘এখানে কখন সূর্য ওঠে ভাই?’’ চরাচরে কোথাও সূর্য ওঠে, কোথাও ডোবে, এই দৈনন্দিনতা যতটা স্বাভাবিক, ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসলে, তার চেয়ে কোটি গুণ রহস্যাবৃত। আমরা দুটো ঘটনার সমন্বয় ঘটিয়ে সমস্তটুকু সহজ করে, আপন করে নিয়ে বলি, ‘‘ওঠ ওঠ, ভোর হলো যে!’’ সূর্য উঠে পড়ে। খোলা নীলের দিকে তাকিয়ে থাকি, ‘‘ক-খ-ন?’’ আরও অল্প দু’চার মানুষ ক্যামেরা নিয়ে...। কত জায়গায় কতভাবে এই দেখা, এই ভালো লাগা, ক্যামেরাবন্দী করে রাখা। অথচ ভাবছিলাম, সে কি আজ দেখা দেবে, না দেবে না? শেষ অবধি একটু একটু করে... ‘‘ওই ওই ওই যে! ওঁ জবাকুসুমসংকাশং কাশ্যপেয় মহাদ্যুতিম্‌।’’ জলে রঙ, আবার মুগ্ধ হওয়া, যেমন শহুরেরা চিরকাল হয়ে এসেছে।

এদিকে এপাড়ে, আগের সকালে যা যা দেখেছিলাম, ঠিক তেমন করে জাগছে জগৎ, গ্রাম, সমুদ্রতীর। ভুটভুটি, জল খেলার আয়োজন। 

চায়ের জন্যে প্রাণমন আকুলি বিকুলি। বেরনোর আগে খাই নি। বালির ওপরে ছোট্ট চালাঘর, আপ্যায়ন দু’হাত ছড়িয়ে। আশা করেছিলাম মাটির খুড়ি, বদলে কাগজের কাপ। আর দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রন (অবশ্য নিখরচায় নয়)। সে যাই হোক, ‘জানাবাবু’ জানাতে বলেছেন সকলকে – যদি কেউ মন্দারমনি বেড়াতে যান, ওঁর কাছে খাবেন। আমরা মৎস্যলোভী। মাছের ফিরিস্তি নিলাম। টাইগার প্রণ খাওয়াবেন, অথবা পমফ্রেট বা ভেটকি, যেটা পছন্দ। সঙ্গে কি? মানে, তরিতরকারী? বাচন শুধু মৌখিক নয়, শারীরিকও, হাত নেড়ে দেখালেন, ‘‘সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, আলুভাজা।’’ বারে বারে বললেন, ‘‘হোটেলে তো রোজই খেলেন, দেখেন না আমি কেমন খাওয়াই!’’ ভালো লাগল, তবু অনিশ্চিত, ‘‘মাছ টাটকা দেবেন তো?’’ 

আমার হাজারি-ঠাকুরের কথা মনে পড়ছিল কেন কে জানে!

যে যেমন দেখে, স্থান মাহাত্ম্য তার কাছে তেমন, এই স্বীকৃত সত্য। গোলাপের দিকে চেয়ে বললে গোলাপ সুন্দর, গোবর দেখে নাক সিঁটকে বোঝাই, ওটা গোবর। আমার হলো, ওই নীরব মুক্তিটুকুর আমেজ খুঁজে বুঁদ হয়ে থাকা। তবে, আমাদের দেশটা নির্জনতার কদর করে কই? অখ্যাত, অবিখ্যাত কোনও এক জায়গা সন্ধানী পর্যটকের আবিষ্কারে সার্থক হওয়ামাত্র হৈহৈ রৈরৈ, যতক্ষণ পর্যন্ত নাক মুখ কুঁচকে না উঠছে, ‘‘ছিঃ দীঘা! ওখানে কেউ যায় আজকাল?’’ ঘটনা এরকম। পর্যটকের ধাক্কাধাক্কি আর অশালীন ভীড়ে বেড়ানো মাটি। সৌন্দর্য ভোগের ত্র্যহস্পর্শ। আর যে জায়গা সরকারি দাক্ষিণ্যবঞ্চিত, সম্বল শুধু পর্যটক। যাক কচকচি। এরাজ্য তো আরও চমৎকার – দলনীতি, ভয়নীতি এবং ‘বরাভয়’-নীতির আঁতুড় তথা উপবন। 

রোদ্দুর বড্ড তেজী। এমনিতেও সমুদ্রে নামার পরিকল্পনা নেই, কারণ ফিরতে হবে। রিসর্ট চত্বরে এলোমেলো পদচারণা, বিল মেটানো, ইত্যাদি। এক প্রান্তে ওয়াচ টাওয়ার আছে, সেখানে উঠে আশপাশ দেখি। যারা জলে গেছে, হিংসে করি, ইস কি মজা! দোপহর কা খানা – ‘হাজারি ঠাকুরে’র হোটেলে। পরিপাটি ডাল-ভাত-ভাজা, লেবু-লঙ্কা-নুন। চিংড়িগুলো অসম্ভব টাটকা, যেমন বলেছিলেন, ফাঁকি দেন নি। চমৎকার ঝাল ঝাল রান্না – একেবারে ঘরোয়া। চালাঘরের মধ্যে রন্ধনশিল্পী, খুব সম্ভব পত্নী। উনুনে লোহার কড়াতে, কাঠের জ্বালে, বাটা মশলার রান্না... বাহুল্য নেই, কিন্তু এমন স্বাদু কেন, কারণ বুঝতে অসুবিধে হলো না। কি বলব ভেবে পাই না। ‘‘আবার যখন আসব, আপনার চালাঘর পাকাপোক্ত ও বড়ো হোটেল হয়ে যাবে।’’ শুনে বললেন, ‘‘সবাই বলেন এমনটা... আট বছর ধরে এখানেই আমি।’’

দীঘা থেকে ফিরতি ট্রেন। দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়া হল। শুরুতে একই পথ ওদিকে।

তখন ঝাঁ ঝাঁ দুপুর, সব স্পষ্ট, খুল্লম খুল্লা ভালো ও মন্দ। দুপাশে জলার মধ্যে দিয়ে মাটির সরু পথ দৃশ্য। সে রাতে গাড়িতে বসে ভয়ভয় করছিল, এবারে চোখ সরে না। কুঁড়ে, গোরু, মুরগী, ধানক্ষেত, ভাঙা কোঠাঘর যথাযথ। কিন্তু সুরে তালে মেলে না! ঘন বাঁশঝাড়ে বাধা পেয়ে মাটিতে আসার সুযোগ খুঁজছে রোদ। বিভূতিভূষণের গ্রামবাংলা মনে পড়ে, এমনটাই যেন। দুপা এগোতে না এগোতে বদলে যায় ছবি, ভোডাফোন বা ফেয়ারনেস ক্রিমের হোর্ডিং। ভাঙা পাঁচিলে বিজ্ঞাপন। বিতৃষ্ণায় জ্বলি।

চুপ কর, স্যাডিস্ট নাকি? বকুনি দিই নিজেকে। তাও ভাবনার ঘরে তালা পড়ে কই? শহর যবে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসতে শুরু করেছে, অনেক কিছু খোয়া গেছে গ্রাম থেকে – ‘বুক-ভরা মধু বঙ্গের বধু’ এখন টেলিভিশনের অখাদ্যি সিরিয়ালে। শহর গ্রামকে কুমীরের মতো আধা গিলে ছিবড়ে করে রেখেছে। উহার নাম ‘মফঃস্বল’! সব মালামাল এখন। বিরক্ত লাগে, ভালো লাগা উবে যায়, যত রাস্তা এগোতে থাকি।

ভর দুপুরে দীঘা। আকার প্রকার দেখে টের পাওয়া যায় সরকারী নেক নজর। দীঘা আগে বার দুই এসেছি, ঠিক আছে... উঁহু... মানে, ওই আর কি! থিকথিক বড্ড বেশি। দীঘা স্টেশন ছাড়িয়ে এগোয় গাড়ি। নিউ দীঘা - বিস্বাদ খিচুড়ি পরিবেশ। ভাঙাচোরা খোবলানো পাকা রাস্তা, চালাঘরে ঝিনুকের উপহার সম্ভার। একপাশে হোটেলগুলো, তাদের বিজ্ঞাপন পোস্টার, এই সব। দুঘন্টার ওপরে বসে থাকতে হবে। তারপর ট্রেন। পাড় বাঁধানো সমুদ্রের রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে বসি। লাউড স্পিকারে ‘আমার পূজার ফুল’ আরও এরকম গান প্রবল সরব – রসভঙ্গ আর নির্জনতার রক্তাক্ত বলিদান। চুপচাপ আমরা সমুদ্রমুখী। সিঁড়ি বেয়ে ভেজা বালিতে গেছেন অনেক মানুষ। আরও বাড়ছে। আইসক্রিমের গাড়ি, আইস-গোলা, কুলফির গাড়ি। রোদের দাপট কমে আসে ক্রমে। লাল গোলাটি কখন লুকিয়ে পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আর ছোটো দোকানের আড়াল খুঁজে। 

দীঘা স্টেশন। অবাক হই! ছোট্টোমতো, শিশু স্টেশন। ঝকঝকে তকতকে – অবিশ্বাস্য লাগে যেন। লোকসংখ্যার বাড়াবাড়ি না থাকলে সব সুন্দর, সব পরিচ্ছন্ন, সব পরিমিত। ট্রেনের অপেক্ষায় আমরা... ব্যাক টু হাওড়া।








0 comments: