1

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



নজরুলের গান : গানের নজরুল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



ক্যালেন্ডারের সেই তারিখটা, ২৫শে মে এলে তাঁর জন্মদিনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, কতটা মনে রেখেছি নজরুলকে? কি ভাবে মনে রেখেছি নজরুলকে কিংবা আদৌ মনে রেখেছি কিনা, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন আমাদের থাকতেই পারে। কিন্তু একটা উচ্চারণে বোধকরি কোন ভুল নেই যে বাঙালির – অন্নদা শঙ্কর রায়ের অমর পংক্তি “আর সবই ভাগ হয়ে গেছে শুধু, ভাগ হয়নিকো নজরুল”। পণ্যায়নের সর্বব্যাপী থাবার নীচে নজরুল-সৃষ্টি ততটা আলোচিত নয় এই প্রজন্মের কাছে। পাড়ায় পাড়ায় নজরুল জয়ন্তী পালন বন্ধ হয়েছে অনেকদিন, নজরুলের গানেও দীক্ষিত হচ্ছেন না একালের সংগীত শিল্পীরা। এই সবই সত্যি। আবার এটাও সত্যি রবীন্দ্রনাথ নামক মহাসাগরের পর বাঙালির সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির সৃষ্টিভূমিতে নজরুল ছাড়া আর কাকেই বা পেলাম ! রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন একচল্লিশের ৭ই অগস্ট, আর নজরুলের অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়ে ঐ দিন থেকেই। নজরুলের কবিতার কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু নজরুলের বাকরুদ্ধ হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও অন্তত বাংলা গানের ক্ষেত্রে নজরুলকে সরিয়ে দেবার মত কাউকেই তো পেলামনা !

বস্তুত গানের নজরুল এক বিস্ময়কর প্রতিভা। কাব্যের নজরুলের নির্মোহ আলোচনা কম হয়নি। রবীন্দ্র-উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাস মনে করেছিলেন “তাঁর কবিতা চমৎকার, কিন্তু মানোত্তীর্ণ নয়” । অবশ্য একথাও জীবনানন্দ বলেছিলেন যে “... এরকম পরিবেশে হয়তো শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না কিংবা জন্মায়, কিন্তু মনন প্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতার প্রয়োজন। নজরুলের তা ছিল না”। নির্ভুল মূল্যায়ন। শৈশব থেকে দারিদ্রের মুখোমুখি হয়ে মাত্র ৯বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল তাঁর বহুমুখী সৃজনশীলতা পাখনা মেলার মত আকাশের সন্ধান পেলেন না। ১৯১৯ থেকে ১৯২৮ - নজরুলের কাব্যজীবনের এই ৯ বছরের সময়কালেও কবেই বা সুস্থিতি পেয়েছিলেন তিনি! করাচির সেনানিবাসের পাট চুকিয়ে ফিরে এলেন ২০বছর বয়সে, দেশ তখন উত্তাল। সদ্যগঠিত কম্যুনিষ্ট পার্টির সংঠন, কৃষক সমিতি, সাংবাদিকতা, স্থায়ী থাকার জায়গা নেই, উপার্জনের ব্যাবস্থা নেই । কাব্যসাধনার জন্য সুস্থিতি পাবেন কি করে ? এর সঙ্গে ছিল পত্রিকা সম্পাদনার ধকল, মৌলবাদী হিন্দু – মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আক্রমণ, কারা বরণ। তথাপি বিস্ময়কর এই যে কি অমিত ঐশ্বর্য দান করে গিয়েছেন সেদিনের তরুণ প্রজন্মের কাছে। দেশ ও সমাজ প্রেম তাঁর কাব্যে মুক্তকন্ঠ সুস্পষ্টতা পেয়েছিল। সমবয়সী ভিন্ন ধারার কবি জীবনানন্দ দাস যেমন বলেছিলেন “ভাষা, ভাব, বিশ্বাসের আশ্চর্য যৌবন রয়েছে এই কবিতাগুলির ভিতর”। 

সুস্থিত হলেন তখন যখন তিনি ‘গানের নজরুল’। যখন তিনি সুরের রাজা হয়ে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ নির্মাণের প্রস্তুতি সারছেন। গান তাঁর ঝোড়ো জীবনেরও প্রধান সঙ্গী ছিল। গান তো নয় – দেশাত্মবোধের চারণমন্ত্র। ১৯১৯এ নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেছিলেন “আমরা যখন যুদ্ধে যাবো, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখন তাঁর গান গাইবো”। গান তিনি ছেলেবেলা থেকেই গাইতেন, সুর করতেন। ১৯২০তে করাচির সেনানিবাস থেকে ফিরে আসার পর গান শুনিয়েই জয় করে নিয়েছিলেন কলকাতার বিদগ্ধ মহলকে। সভা-সমিতি কিংবা ঘরোয়া সাহিত্য আড্ডায় তাঁর গানই থাকতো প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্রে। নানান বিদগ্ধজনের স্মৃতিকথায় নজরুলের আপনভোলা গানপাগল মূর্তিটির ছবি লেখা আছে। মুজফফর আহমেদ লিখেছেন ‘কারখানার শ্রমিকরা পর্যন্ত ডেকে নিয়ে যেতেন নজরুলকে’। বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন ‘নজরুল যে ঘরে ঢুকতেন সে ঘরের সবাই ঘড়ি দেখতে ভুলে যেতেন’। অথচ প্রথাগত কোন সংগীত শিক্ষা তাঁর ছিল না। বাল্যেই পিতৃহারা, লেটোর দলে গান গাওয়া, পাঊরুটির কারখানায় কাজ করা কিংবা রেলের গার্ড সাহেবের ঘরে ফরমাস খাটা নজরুলের সামনে সে সুযোগ আসেনি। যেমন ছিলনা তাঁর কোন প্রথাগত ছাত্রজীবন। লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো বাউণ্ডুলে নজরুল বাংলার মাটি থেকে তামাম লৌকিক সুর আত্মস্থ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সাংগীতিক প্রতিভার পটভূমি কিভাবে নির্মিত হয়েছিল তার কোন লেখাজোখা নেই। নজরুল স্মৃতির সবচেয়ে বিশ্বাস্য সূত্র মুজফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন যে কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রসংগীতই তাঁর পরিবেশনের শীর্ষস্থানে থাকত। তিনি নজরুলকে ‘রবীন্দ্র সংগীতের হাফেজ’ বলতেন। চুরুলিয়ার বাউণ্ডুলে কৈশোর জীবনে কিংবা করাচির সেনা নিবাসে রবীন্দ্রনাথের গান কি করে আয়ত্ব করেছিলেন নজরুল, এ বড় বিস্ময় ! বাল্য ও কৈশোরে শুধু লেটোর দলের গানই নয়, কবিগান, ঢপ, কীর্তন, আখড়াই, ভাদু, মনসার গান, কাওয়ালি, ঝুমুর, পাঁচালি, ইত্যাদি লোক আঙ্গিকের গান তিনি আত্মস্থ করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘গানের নজরুল’কে নির্মাণ করেছিল । 

১৯২৮এ নজরুল কাব্যজগৎ থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে চলে এলেন গানের ভুবনে। গ্রামফোন কোম্পানীর মাসমাইনের গীতিকার–সুরকার-কম্পোজার-ট্রেনার সব দায়িত্ব। গ্রামফোন কোম্পানীর বাংলা গান রেকর্ডিংএর প্রধান। ১৯৩৩এ প্রকাশিত রুবাইৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভুমিকায় নজরুল জানালেন “কাব্যলোকের গুলিস্তান থেকে সংগীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার নির্বাসন হয়ে গেছে”। সংগীতের সবক’টি বিভাগই নজরুলের জাদু স্পর্শের ঐশ্বর্য পেয়েছিল। নানান বাদ্যযন্ত্রের পারদর্শিতা, গান গাওয়া, গান লেখা, সুর করা, থিয়েটার ও সিনেমার সংগীত পরিচালনা এমনকি একটি সিনেমায় ভক্ত ধ্রুব চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। মাত্র এগারো বছরের সাংগীতিক জীবনে অবিশ্বাস্য তিন হাজারেরও বেশি গান লিখেছিলেন আর তাঁর গানের রেকর্ডের সংখ্যা ১৭০০। রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান, প্রেম সংগীত, ছোটদের গান, কীর্তন, আগমণী, শামা সংগীত, গজল, কাওয়ালি, ইসলামি গান – সব ধরণের গান। 

একথা বললে অতিউক্তি হবে না যে, নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভাকে ভর করেই গ্রামফোন কোম্পানী বাংলা গানের বিপণন ব্যবসাকে প্রথম পোক্ত করতে পেরেছিল। এদেশে প্রথম গান শোনার যন্ত্র বা কলেরগান আসে ১৯০০ সাল নাগাদ এবং ১৯০২এ প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড হয় তখনকার থিয়েটার দলে সখীর নাচের দলের দুই বালিকাকে দিয়ে। পরিশীলিত গায়ন রুচি তৈরী হতে লেগে গেছে আরো বিশ/পঁচিশ বছর। তখন বাংলা গান বলতে কিছু রাগাশ্রয়ী গান, চটুল দেহতত্বের গান, কীর্তন, ভজন, ইত্যাদি। বাঙালির গান শোনার কান সবে তৈরী হতে শুরু করেছে। কলকাতা বেতার ব্যবস্থা সবে শুরু হয়েছে - ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট, বাংলা চলচ্চিত্র তখনও নির্বাক। ঠিক এই সময়েই অসামান্য সাঙ্গীতিক প্রতিভা নজরুলকে ‘শিকার’ করলো গ্রামফোন কোম্পানী। নজরুলেরও স্থায়ী উপার্জনের প্রয়োজন ছিল। কলের গানের বণিক নিংড়ে নিলো নজরুলকে। সেই সময় নজরুলের লেখা এবং তাঁর প্রশিক্ষণে গান রেকর্ড করার জন্য লাইন পড়ে যেতো, কারণ তাঁর রচনা ও সুর মানেই ছিল সেই শিল্পীর অবধারিত সাফল্য ও লোকপ্রিয়তা। তিরিশের দশকে সেকালের প্র্মুখ শিল্পীরা – আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া, কাশেম মল্লিক, আব্বাসউদ্দীন, যুথিকা রায়, মৃণালকান্তি ঘোষ, ধীরেন দাস, ফিরোজা বেগম, সুপ্রভা সরকার এবং আরো অনেকেই নজরুল গানের সার্থক শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। এঁরা সকলেই নজরুলের প্রশিক্ষণে গ্রামফোনে গান গেয়েছেন। বস্তুত রবীন্দ্রগানের বাইরে আধুনিক বাংলা রেকর্ডের গানে কাব্যের লাবণ্য ও পরিশীলিত গায়ন ভঙ্গি প্রথম নিয়ে এসেছিলেন নজরুলই। চল্লিশ থেকে ষাট দশক পর্যন্ত যে সময়কালকে আমরা বলি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ। সেই স্বর্ণযুগের গানের জলসায় তিনি নেই। কিন্তু সংশয়ের যায়গা নেই এই স্বর্ণযুগের প্রস্তুতিপর্ব সারা হয়েছিল নজরুলের হাতেই।

রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন – বলেছিলেন ‘বাঙালি সুখে দুঃখে আমার গানই গাইবে, এ গান তাদের গাইতেই হবে’। নজরুলও তেমনই আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন। ১৯৩১এ জনসাহিত্য সংসদের অধিবেশনের ভাষণে নজরুল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি। সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে”। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ও সুর সংরক্ষণের বন্দোবস্ত ছিল, শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের গান পেয়েছে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কিন্তু নজরুলের গানের ক্ষেত্রে তা হয়নি । নজরুলের বহু গানের কথা ও সুর হারিয়ে গেছে, অনেক নজরুল ভক্ত তাঁর গানকে নিজের গান বলেও চালিয়ে দিয়েছেন একথাও শোনা যায়। নজরুলের অনভিজাত দিলখোলা জীবন যাপনই এরকম সুযোগ করে দিয়েছিল। দু খিলি জর্দাপান খাইয়েই নাকি গান লিখিয়ে নেওয়া যেত তাঁকে দিয়ে। 

গানের জগতে নজরুল ছিলেন মাত্র বারো বছর, আর এই অল্প সময়কালেই, বিপণনযোগ্য বাংলা গানের ভুবনকে শাসন করেছেন, ধারে কাছে কেউ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথও নয়। সত্য বটে, নজরুলের গানে রবীন্দ্রনাথের গানের মত আলোক সামান্য নান্দনিক স্পর্শ ছিল না। তাঁর গান ছিল স্বতস্ফূর্ত, সরল, আবেদনে প্রত্যক্ষ আর তাই শিক্ষিত, অশিক্ষিত সকলকেই স্পর্শ করে তাঁর গান। আধুনিক বাংলাগানের ক্ষেত্রে নজরুল জনপ্রিয়তার শিখরে উঠলেন আর এই সূত্রেই বাংলার বিদগ্ধ মহল ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছ থেকে পেলেন উপেক্ষা। তাঁরা অনেকেই দূরে সরে গেলেন। গ্রামফোন কোম্পানীর বেতনভোগী চাকুরে, বণিক কোম্পানীর নির্দেশমত হালকা চটুল গানের নির্মাণও তাকে করতে হয়েছিল পেটের দায়ে। বাংলা সংগীতের ভাণ্ডারকে নজরুল ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন, কিন্তু গ্রামফোন কোম্পানীর বানিজ্যিক স্বার্থ মেটাতে গিয়ে কম মূল্য চোকাতে হয়নি নজরুলকে। সেই মূল্য তাঁর সমাজসচেতন গণমুখী কাব্যচেতনার সঙ্গে চির বিচ্ছেদ। ইসলামী গান, বাংলা গজল গানের জন্য বিরূপ হয়েছিলেন হিন্দুরা, তাঁর কবিবন্ধুরা আর শ্যামা সংগীত রচনার জন্য বিধর্মী আখ্যা পেয়েছিলেন মৌলবাদী মুসলিমদের কাছ থেকে। গানের নজরুলের কাছ থেকে তাঁর বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া বা রেকর্ড কোম্পানীর দাসত্ব মেনে নেওয়া নজরুলকে গ্লানিবোধে আক্রান্ত ও বিষাদগ্রস্ত করেছিল সেকথাও আমরা জানি। রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি পত্রে নজরুল লিখেছিলেন “গুরুদেব, বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার ওপর হয়তো প্রসন্ন কাব্যলক্ষী হিজ মাস্টার্স ভয়সের কুকুরের ভয়ে আমাকে ত্যাগ করেছেন। কাজেই সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি। ... আমার এক নির্ভিক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একবার বলেছিলেন যাকে বিলিতি কুকুরে কামড়েছে তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয়। সত্যি ভয় হবারই কথা, তবু কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমার কিন্তু সে শক্তি নেই, আমি হয়ে গেছি বীষ জর্জরিত নির্জীব”। (সূত্র – ‘অঞ্জলী লহ মোর সংগীতে’ / অরুণ কুমার বসু , ‘পুরশ্রী’ পত্রিকা, জুলাই ১৯৯৯)। আর্থিক অসাচ্ছল্য, পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু, নিকটজন ও কবিবন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া, স্ত্রী প্রমিলার পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া নজরুলকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু সেই ক্লান্তি, বিষাদের বিন্দুমাত্র ছায়াপাত তাঁর সংগীত সৃষ্টিতে পড়েনি। শুধু অফুরন্ত দিয়ে গেছেন বাংলা গানের ভাণ্ডারে। ভেতরের ক্ষয় গোপন করে শুধু রাশি রাশি দিয়ে গেছেন।

গ্রামফোন রেকর্ডের গান নিশ্চিতভাবেই ‘গানের নজরুলের’ সামগ্রিক পরিচয় নয়। তাঁর জাগরণের গান, যৌবনের গান প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে প্রবাদের মত হয়ে আছে। সেখানে আজও তাঁর আসন অটল। নজরুলের সচেতন সৃষ্টির সময়কালই তো মাত্র ২১বছরের – ১৯২০ থেকে ১৯৪১। ১৯৪২এর অগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে তিনি যখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তখন তাঁর বয়স সবে বিয়াল্লিশ। ফুলের জলসায় নীরব কবি বেঁচেছিলেন আরো ৩৫ বছর। ১৯৭৬এর ২৯শে অগস্ট নজরুলের দেহাবসান হয়। সে তো তাঁর দেহের মৃত্যু। নজরুল ইসলাম বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের মর্যাদায়। বাংলার শেষ চারণকবি নজরুলের গান কিংবা গানের নজরুল সম্পর্কে কথা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে উপসংহার টানি এই নিবন্ধের – “...দুঃখের পথে আর এক পাথেয় নজরুলের গান। বুকভরা, কন্ঠভরা গান। অপরাজিত প্রাণের আনন্দিত উদার জলোচ্ছ্বাস – রাত্রির সীমান্তে প্রভাতী পাখির কলধ্বনি” । (‘নজরুল স্মৃতি’)


1 comment: