প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী
Posted in প্রবন্ধদিব্যি সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চায়ের কাপ আর কাগজটা নিয়ে বসেছি, আচমকা কোত্থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া এসে কাগজটাগজ উড়িয়ে দিয়ে, কাপ থেকে চা চলকে ফেলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে দিল। কোনক্রমে নিজেকে সামলে সম্মুখপানে ঠাওর করে দেখি, বাগানে একটা ইয়াব্বড় উড়ন্ত চাকতি নেবেছে! আর তার ভেতর থেকে বড় বড় জানলার মত চোখওয়ালা, ঢ্যাঙা লম্বা, বিকটদর্শন এক জোড়া জানোয়ার বেরিয়ে আমার দিকেই থপ্ থপ্ করে এগিয়ে আসছে। আমি তো দেখেই থরহরিকম্প! জন্তু দুটো ক্রমশঃ আমার কাছ অবধি এসে কি একটা ইশারা করে বলল, "হিজিবিজিবিজিহিজি!" অমনি আমি দাঁতমুখ খিঁচিয়ে ভিরমি খেয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলাম।
জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, কোথাও কিচ্ছু নেই। চেয়ার, কাগজ, চায়ের কাপ সব যে যার মতই আছে, আমিই শুধু বোকার মত মেঝেতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছি। মনে কেমন একটা সন্দেহ হল। ধড়ফড় করে উঠে এক ছুটে বসার ঘরের আলমারি থেকে স্টিফেন হকিংয়ের একটা বই ধুলো ঝেড়ে তুলে নিলাম। অনেক বছর আগে রাজীব বলে আমার এক শ্যালক বইটা আমায় উপহার দিয়েছিল। ব্যাটা বড্ড জ্ঞান বিজ্ঞান আওড়াত; ভেবেছিল এইসব বই পড়িয়ে আমাকেও দলে টানবে। আমিও কম নই। বইটাকে সেই যে শো-পিস্ বানিয়ে তাকে তুলে রেখেছি, এই এতো বছরে ধুলোটা পর্যন্ত ঝাড়ি নি। আজকে ওই ঘটনার পর কেন জানিনা এই বইটার কথাই সবার আগে মনে হল। দেখি তো হকিং সাহেব এই বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে পারেন কিনা! ইটি বলে সত্যি কিছু হয় কি? বইটার নাম: Brief Answers to the Big Questions। দেখলাম বইটাতে দশখানা পরিচ্ছেদ আছে। ঈশ্বর আছেন কিনা, কি করে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল, ব্ল্যাক হোলের ভিতরে কি আছে, সময়ভ্রমণ সম্ভব কিনা, এই সব বিষয় নিয়ে এক একটা অধ্যায়। ধুত্তোর এতো কে পড়ে? লাফ দিয়ে চলে গেলাম তৃতীয় পরিচ্ছেদে যেখানে হকিং আলোচনা করেছেন অন্য গ্রহে বুদ্ধিমান জীব থাকার সম্ভাবনা নিয়ে। তাতে যা পড়লাম তা মোটের উপর এইরকম:
প্রাণ বলতে আমরা যা বুঝি তা নির্ভর করে কার্বন পরমাণুর ওপর। অথচ এই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াটি মোটেই সোজা ছিল না। ১৩৮০ কোটি বছর আগে যখন বিগ-ব্যাঙের মধ্যে দিয়ে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয় তখন অকল্পনীয় উষ্ণতার কারণে মহাবিশ্বে কোন মৌল উপাদান সৃষ্টি হয়নি। তখন ছিল শুধু প্রোটন এবং নিউট্রনের একটা স্যুপ। এরপরে ব্রহ্মাণ্ড একটু ঠাণ্ডা হলে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম সৃষ্টি হল। এই দুটি উপাদান থেকেই প্রথম নক্ষত্রের সৃষ্টি হল। এবং এই দুটি উপাদানকে জ্বালানি হিসেবে পুড়িয়েই প্রথম কার্বন, অক্সিজেন এবং লৌহ পরমাণুর সৃষ্টি হল ওই নক্ষত্রগুলিতে। হিসেবের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই কার্বন পরমাণু সৃষ্টি হত না, আর তাই প্রাণও সৃষ্টি হতে পারত না। যাই হোক, প্রথম প্রজন্মের নক্ষত্রগুলি কিছু সময় পরে সুপারনোভা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সেই মৌলগুলিকে ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিল এবং সেই উপদানগুলি থেকেই ক্রমশঃ নতুন নক্ষত্রের সৃষ্টি হতে থাকলো। আমাদের সূর্যের এবং সৌরমণ্ডলের গ্রহগুলির সৃষ্টি হল বেশ কিছুটা পরে, বিগ-ব্যাঙের প্রায় সাড়ে ন'শো কোটি বছর পরে। কিন্তু গ্রহের সৃষ্টি হলেই ত হল না, প্রাণ সৃষ্টির জন্য আদর্শ পরিবেশও তো দরকার। পৃথিবী যখন সৃষ্টি হয়েছিল তখন পরিবেশ এত বেশি উত্তপ্ত ছিল যে জীবন্ত কোষিকা তৈরি হওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। ধীরে ধীরে পৃথিবী শীতল হলে কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু কোন এক অজানা প্রক্রিয়ায় এমন এক ধরনের যৌগের সৃষ্টি করলো যারা নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সক্ষম ছিল। এদের বলা হয় RNA । এই সরলাকৃতির RNA থেকে আবার কাকতালীয়ভাবে উৎপন্ন হল জটিলতর গঠনের DNA, জীবনের মূল উপাদান। DNA অণুগুলো ভাঙাগড়া, পুনর্বিন্যাস এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে নানা রকমের এককোষী প্রাণীর সৃজন করলো। অনেক পরে এই এককোষী প্রাণী থেকেই বহুকোষী প্রাণীর সৃষ্টি হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়াটিই ঘটেছে একের পর এক চান্স বা সমাপতনের মধ্যে দিয়ে। বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন এই রকম কাকতালীয়ভাবে পর পর ঠিক ঠিক পরিস্থতি উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাব্যতা খুবই কম তাই পৃথিবীতে আদিম প্রাণ নিশ্চয়ই অন্য কোন গ্রহ কিংবা গ্রহাণু থেকে এসেছিল। হকিং অবশ্য তাঁদের যুক্তিকে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন যে, মহাবিশ্বের ভয়ংকর বিকিরণের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘকাল টিকে থেকে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাওয়া DNA র পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়, তাই প্রাণ নিশ্চয়ই পৃথিবীতেই সৃষ্টি। কোনভাবে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গিয়ে পৃথিবীতেই জীবনের সৃজন হয়ে থাকবে। কিন্তু সেই একই রকমের পর পর সমাপতন অন্য গ্রহে ঘটা খুবই অস্বাভাবিক।
এই বিষয়ে, হকিং দু'টি আশ্চর্য যুক্তি উত্থাপন করেছেন: উনি মনে করেন, যদি নিম্নস্তরের এককোষী বা বহুকোষী জীবন সৃষ্টির কথা ছেড়েও দেওয়া হয়, পৃথিবীতে বুদ্ধিমান প্রাণীর উদ্ভব কিন্তু আরো বেশি আশ্চর্য একটা ব্যাপার। সূর্যের মতো কোন নক্ষত্রের সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে সময়টা মোটামুটি ১০০০ কোটি বছর ধরা হয়। এই সময়কাল পৃথিবীর মত কোন গ্রহে উন্নত বুদ্ধির জীব সৃষ্টি হওয়া এবং সেই সৌরমণ্ডল ধ্বংসের আগে সেই বুদ্ধিমান জীবের অন্য কোন বাসযোগ্য নক্ষত্রলোকে বসতি স্থাপন করার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু পৃথিবীতে এককোষী প্রাণী সৃষ্টি হয় সাড়ে তিনশো কোটি বছর আগে, অর্থাৎ সৌরমণ্ডল সৃষ্টি হওয়ার মাত্র পঞ্চাশ কোটি বছর পর। যদি পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি আপনা আপনি হঠাৎ করে না হয়ে থাকে তাহলে উপলব্ধ সময়ের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যেই এককোষী প্রাণ উদ্ভূত কেন হলো? এদিকে কিন্তু এক কোষ থেকে বহুকোষী জীব সৃষ্টি হতে সময় লেগে গেল আরো প্রায় ২৫০ কোটি বছর। যেই একবার বহুকোষী প্রাণ সৃষ্টি হয়ে গেলো অমনি আবার আকস্মিকভাবে জীব সৃষ্টির পক্রিয়াটি ভয়ঙ্কর রকম ত্বরান্বিত হয়ে গেলো। কিছু লক্ষ বছরেই অগুন্তি রকমের প্রাণীতে পৃথিবী ছেয়ে গেলো। মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণী সৃষ্টি হতে লাগলো আরো মাত্র ১০ কোটি বছর — মহাজাগতিক সময়ের হিসেবে যা এক পলকের সমান। প্রশ্ন হল — যদিবা এককোষী জীব কোনক্রমে সৃষ্টি হল, বহুকোষী জীব আসতে এতখানি সময় কেন লাগলো? তাও যদি এলো তাহলে মানুষের মত এত জটিল জীব মোটে ১০ কোটি বছরের মধ্যে কি করে এসে গেলো? এসব সঙ্গতিহীন ব্যাপারস্যাপার দেখে হকিং সাহেব বিধান দিলেন: পৃথিবীতে প্রাণসৃষ্টি পূর্বনির্ধারিত কোন ঘটনা নয় বরং আচমকা ঘটে যাওয়া একটা কাকতালীয় ব্যাপার। যেহেতু বুদ্ধিমান জীবের উদ্ভব আরো কঠিন তাই অন্য কোন গ্রহে ব্যাকটেরিয়া জাতীয় প্রাণী থাকলেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকার আশা ক্ষীণ। এখানেই শেষ নয়, হকিংয়ের দ্বিতীয় যুক্তিটিকে বলা চলে দাবার মোক্ষম চাল। ওঁর মতে, যে কোন গ্রহকেই যে উৎপাত থেকে থেকে সহ্য করতে হয় তা হল asteroid বা গ্রহাণুদের হানা। পৃথিবীও এর ব্যতিক্রম নয়। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে এরকমই এক গ্রহাণুর সংঘাতে বিলুপ্ত হয়ে গেছিল ডায়নোসর সহ অসংখ্য প্রাণী। বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন এইরকম একটা মহাবিধ্বংসী গ্রহাণু হানা অন্যান্য গ্রহের ক্ষেত্রে গড়ে দুই কোটি বছরে একবার ঘটে। তার মানে, পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমরা উদ্বৃত্ত সময়ে বেঁচে আছি, যেটা একটা লাকি চান্স মাত্র। কিন্তু অন্য গ্রহের ক্ষেত্রেও যে এই চান্স কাজ করবে এমন কোন কথা নেই। অন্য কোন গ্রহ উচ্চ মেধার ইটি তৈরি করার মত সময় নাও পেয়ে থাকতে পারে। এই অবধি বলে থেমে গেলে বেশ নিশ্চিন্ত হতে পারতাম। কিন্তু শেষে হকিং সাহেব কেন যে দুধে একটু চোনা রেখে দিলেন বুঝলাম না। এতো কিছু বলেও পরিচ্ছেদের ঠিক শেষে উনি বলে বসলেন, "আমার আশা করি যে অন্য গ্রহে মানুষের মতোই উচ্চ সভ্যতার প্রাণী আছে। শুধু তারা এখনও পর্যন্ত আমাদের খুঁজে পায়নি এই যা।" আচ্ছা, এইভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে হয়? মনের অস্বস্তিটা যেতে যেতেও গেলো না। সকালে যা দেখলাম, সেটা হ্যালুসিনেশনই ছিল তো? নাকি সত্যি তেনারা এসেছিলেন? গুটি গুটি পায়ে আবার বারান্দায় ফিরে গিয়ে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিলাম। বেশ ফুরফুরে একটা হাওয়া দিচ্ছে। চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে মনের মধ্যে নানা কথা চলতে লাগলো। হকিং শেষে ওরকম কেন বললেন? উনি কি কোন ইঙ্গিত দিলেন? ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো, রাজীব একবার বলেছিল ফার্মি প্যারাডক্সের কথা। বিখ্যাত পদার্থবিদ এনরিকো ফার্মির নাকি বলেছিলেন, মহাবিশ্বে কোটি কোটি নক্ষত্র আছে, তাদের আবার কত কত পৃথিবীর মত গ্রহ আছে। যদি সেইসব গ্রহের মধ্যে সামান্য সংখ্যক গ্রহেও উন্নত সভ্যতার জীব থাকত তাহলে এতদিনে তারা আমাদের নিশ্চয় খুঁজে নিত। কথাটা হকিং সাহেবের ভয় ধরানো বাক্যগুলোর ঠিক উল্টো। যাক, অকারণেই ভয় পাচ্ছিলাম তাহলে। ইটি ফিটি বলে নিশ্চয়ই কিছু হয় না। মনে মনে বলছি বটে কিন্তু তেমন জোর পাচ্ছিনা, মনটা সেই খুঁতখুঁত করেই চলেছে। এতো বড় বড় সব বিজ্ঞানী, এঁরা কি আর ভুল বলবেন? কি জানি, হতেও তো পারে যে আমরা যেমন আমাদের সৌরজগতের সব গ্রহে এখনও পৌঁছতে পারিনি, ইটিরাও তেমনি তাদের সৌরমণ্ডল কিংবা নীহারিকাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি! আবার এমনও হতে পারে যে এতো বড় ব্রহ্মাণ্ডের কোন দিক থেকে তারা শুরু করবে তাই নিয়ে খেউখেই করে কোনো দিকেই আর তারা এগোতে পারেনি। আরে বাবা, ইটি হলেও, মানুষ তো!
"বাবু, আরেক কাপ চা দেব?" হঠাৎ বিশ্রী খ্যানেখ্যানে গলায় হাবুলের ডাকে আঁতকে উঠলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে মিটিমিটি হাসছে। দেখে গা-পিত্তি একেবারে জ্বলে গেল, "চা দিবি তো দে না! খামোখা ওরম চেঁচানোর কি আছে!" সে বেচারা থতমত খেয়ে চা বানাতে ছুটলো। আসলে, সকালের ওই ঘটনার পর মাথাটা বেশ গরম হয়ে আছে। দ্বিতীয় রাউন্ড চা খেয়ে পায়ে জুতোটা গলিয়ে একটু হাঁটতে বেরোলাম। একটু হাওয়া খাওয়া যাক। শরতের সকালে পাড়াগাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে, পুকুরের পাশ ঘেঁষে, আকন্দের ঝোপে ফুলের হাসি দেখতে দেখতে মনটা ভাল হয়ে গেল। হেরোম্ব ডাক্তারের পরিত্যক্ত বাড়িটা পার করে ভটচাজ্জি পাড়ার দিকে পা বাড়াতেই দেখি আকাশে এক ঝাঁক নীলকন্ঠ পাখি, শরতের নরম আলোয় তাদের ডানাগুলো ঝিকমিক করছে। ছেলেবেলায় বাবা বলতেন, "বর্ষার পর নীল আকাশে তুলোমেঘ আর নীলকন্ঠ পাখি একসাথে দেখা গেলেই বুঝবি দুগ্গা পুজোর আর দেরি নেই।" চেয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, প্রকৃতির সব কিছুই কেমন ঘড়ি ধরে নিয়ম করা। সবই যেন খোপে খোপে বসানো । নিয়মের সামান্য হেরফের হলেই পৃথিবীটা আর এইরকম হতে পারতো না। এই কথাটা যেই ভেবেছি, মনের মধ্যে যেন একটা আলোর ঝিলিক দিয়ে গেলো। তাই তো! এই সহজ কথাটা এতক্ষণ মাথায় কেন আসেনি! এই চেনা পৃথিবীতে এবং পুরো ব্রহ্মাণ্ডেই একটা প্যাটার্ন আছে। এই প্যাটার্নগুলোকেই আমরা বিজ্ঞানের সূত্র বলি। মানুষ ছাড়া প্রকৃতির সেই ভাষা কেউ পড়তে পারে না। মানুষ হিসেব কষে, ফর্মুলা বাঁধে, পরে মিলিয়ে দেখে অবাক হয় — সত্যিই তো বিশ্ব সেই ফর্মুলায় চলছে! ঠিক যেমন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র। মানুষ প্রকৃতির মনের কথা পড়তে শিখেছে তার বুদ্ধির জোরে, তার মস্তিষ্কের কারণে। তার মস্তিষ্ক সে পেয়েছে বহুযুগের বিবর্তনের ফলে, বিশেষ বিশেষ প্রাকৃতিক এবং সামাজিক অবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তার একটা বোধ তৈরি হয়েছে। আজকের বিজ্ঞান অবধি পৌঁছতে মানুষকে অনেকখানি পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ইতিহাসের বিশেষ কিছু ঘটনা না ঘটলে বিজ্ঞান আজকের এই অবস্থায় পৌঁছত না। মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ষষ্ঠীক সংখ্যাপদ্ধতি আবিষ্কার না করলে আমরা ঘড়ি পেতাম না। ঠিক সময়ে নিউটনের মাথায় আপেলগাছ থেকে আপেলটা না পড়লে আমরা মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব পেতাম না। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। বিজ্ঞানের সূত্রগুলো মহাবিশ্বের সব জায়গাতেই একই। অন্য কোন গ্রহে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে হয় এবং তাদের যদি চিন্তাশক্তির সাহায্যে প্রকৃতির সেই প্যাটার্নকে বুঝতে হয় তাহলে তাদেরও আমাদেরই মত একটা মস্তিষ্ক থাকতে হবে যা তাদের মাধ্যাকর্ষণ বা রিলেভিটির মত তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে সাহায্য করবে। সেই মস্তিষ্ককে আমাদের মত করেই অঙ্ক বুঝতে হবে। তাদেরও একটা ভাষাপদ্ধতি থাকতে হবে যা মাধ্যাকর্ষণের মত থিওরিগুলোকে ব্যাখ্যা করবে। আমরা জানি পৃথিবীতে মানুষেরই একমাত্র উন্নত ভাষা আছে এবং সেই কারণে মানুষের মস্তিষ্কের গঠন অন্যান্য বানরপ্রজাতির জন্তুর তুলনায় একটু হলেও আলাদা। বিবর্তনের আশ্চর্য ম্যাজিকে মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর আগে ভাষার শক্তি আয়ত্ত করেছিল। ভাষা বলতে এবং বুঝতে যদি হয় তাহলে ভিনগ্রহী ইটিদেরও মস্তিষ্কের গঠনশৈলী আমাদের মতই হতে হবে — একই রকমের স্নায়ুতন্ত্র, বিশ্বকে অনুভব করার মতো ইন্দ্রিয় ইত্যাদি। আমাদের মস্তিষ্ক যে পরিবেশ এবং বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এই অবস্থায় পৌঁছেছে ঠিক একই রকমের পরিবেশ এবং বিবর্তন ওই গ্রহেও হতে হবে। শুধু তাই নয়, যদি এই তত্ত্বগুলো আবিষ্কার করতে হয় তাহলে ভিনগ্রহীদের একটা পূর্বপ্রস্তুতি লাগবে অর্থাৎ তাদের বিজ্ঞানচেতনা থাকতে হবে। বিজ্ঞানচেতনার জন্য একটা সমাজব্যবস্থা থাকতে হবে যার ইতিহাস আমাদের পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে তুলনীয় হতে হবে। ঠিক ঠিক লোককে ঠিক ঠিক সময়ে জন্ম নিতে হবে। যে অবস্থার কারণে পৃথিবীর মেধাবী মনীষীদের মধ্যে জিজ্ঞাসা জন্মেছিল এবং যেসব অবস্থার কারণে তাঁরা সেই জিজ্ঞাসার সমাধান করতে পেরেছিলেন, জীবন এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে সেই ভিনগ্রহীদেরও একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি এবং বোধ থাকতে হবে। মোট কথা পৃথিবীর পরিবেশ এবং ইতিহাসের প্রায় পুনরাবৃত্তি না হলে ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকা অসম্ভব। একটা দু'টো ক্ষেত্রে কাকতালীয়ভাবে পুনরাবৃত্তি সম্ভব হলেও, সব ব্যাপারটা খাপে খাপে মিলে যাওয়াটা অলৌকিক বলেই মনে হয়। ইটি তাই একটি কষ্টকল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আসলে সহজ সত্যিটা আমরা সহজেই ভুলে যাই। ভুলে যাই যে আমাদের পৃথিবীটা অনন্য, অদ্বিতীয়। বিরাট অতলান্ত মহাশূন্যে ভেসে থাকা কোটি কোটি নীহারিকায় কোটি কোটি গ্রহ তারার মধ্যে এই ছোট্ট নীল বিন্দুতেই প্রকৃতির আশ্চর্য ম্যাজিক ঘটেছিল — প্রাণস্পন্দহীন মাটি-পাথরের একাংশ কালের পৌরহিত্যে হঠাৎ একদিন জেগে উঠেছিল! তাদেরই উত্তরসূরীরা একদিন প্রশ্ন করেছিল নিজের উৎস নিয়ে। তারাই আবার আজকে তাদের আদিম বাসভূমিকে অতিক্রম করে মহাবিশ্বের অপার দূরত্বকে জয় করার স্বপ্ন দেখছে! এই সুন্দর গ্রহের ভবিষৎ একমাত্র তাদেরই অনাগত প্রজন্মের হাতে।
খুবই ভালো একটি রচনা। পড়ে দারুণ আনন্দ পেলাম। লেখক বন্ধুকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই। পত্রিকা কে ধন্যবাদ।
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ
DeleteKhub sundor lekha hoyeche....aaro likhun aar amader porar sujog kore din....dhonnobad ritobak..
ReplyDelete