ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিকঅধ্যায়-৫
জন্মান্তরের ধারণাটি সম্ভবতঃ দেওয়ানি আদালতের অবদান; এতে বাদী-প্রতিবাদী দু’পক্ষেরই মরার সময় কোন আফসোস থাকে না যে ওদের মামলাটি শেষ হয় নি । ওরা নিশ্চিন্ত হয়ে মরে যে রায় শোনার জন্যে আগামী জন্ম তো হাতে আছেই ।
বৈদ্যজীর বৈঠকখানার বাইরের চাতালে এখন যে লোকটি বসে আছে ও বোধহয় সাত বছর আগে একটি দেওয়ানি মোকদ্দমা শুরু করেছিল; তাই ওর মুখে বারবার গতজন্মের পাপ, ভাগ্য, ভগবান, আগামী জন্মের প্রোগ্রাম এইসবের দোহাই শোনা যায় ।
লোকে ডাকে ‘ল্যাংড়া ‘বলে। কপালে কবীরপন্থী তিলক, গলায় তুলসীমালা, ঝড়জলে পোড়খাওয়া দড়িপাকানো চেহারা, রোগাটে শরীর ,পরনে মেরজাই । ওর একটা পা হাঁটুর নিচের থেকে বাদ দেওয়া, একটা লাঠির ভরসায় চলে। চেহারায় পুরনো দিনের সেইসব খ্রীস্টান সাধুসন্তের ভাব যারা নিজের হাতে নিজের পিঠে রোজ একশ’ ঘা চাবুক কষাতো।
শনিচর ওর দিকে ভাঙের গেলাস এগিয়ে দেয় । ‘ নাও ভাই ল্যাংড়া , খেয়ে ফেল। এতে ভারি ভারি জিনিস পড়েছে’।
ল্যাংড়া চোখ বুজে না বলল আর একটু পরেই ওদের মধ্যে তর্ক বেঁধে গেল যার বিষয় গড়িয়ে চলল ভাঙের গরিমা থেকে বাদাম-মুনাক্কা খাওয়ার লাভ, ক্ষণভঙ্গুর জীবন হয়ে ভোগ এবং ত্যাগ গোছের দার্শনিক প্রশ্ন পর্য্যন্ত। শেষে শনিচর অন্য হাতটি আন্ডারওয়ারে মুছে সব তর্ক উড়িয়ে দিয়ে সাংসারিক বিষয়ের প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে গজগজ করতে করতে বলল-- খাবে তো চোঁ চোঁ করে মেরে দাও, নইলে এই কাঁচকলা!
ল্যাংড়া একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজল যার মানে আত্ম-করুণা থেকে খাই খাই সবই হতে পারে । শনিচর ওকে রেহাই দিয়ে এক বাঁদর- লাফে সোজা বৈঠকখানার ভেতরে গিয়ে পড়ল। এটা দেখলে ডারউইন সাহেবের বিবর্তনবাদ নিয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয় ।
বেলা দশটা। বৈঠকখানায় প্রিন্সিপাল সাহেব, ক্লার্ক, বৈদ্যজী, রংগনাথ সবাই উপস্থিত। শনিচর এবার ভাঙের ওই গেলাসটাই প্রিন্সিপালের দিকে এগিয়ে দিয়ে একই কথা বলল—‘খেয়ে নিন মাস্টারসাহেব, এতে ভারি ভারি জিনিস পড়েছে’।
প্রিন্সিপাল বৈদ্যজীর দিকে তাকালেন, ‘ কলেজের কাজ ফেলে এসেছি। এটা সন্ধ্যে পর্য্যন্ত মুলতুবি রাখলে হয় না’?
বৈদ্যজী স্নেহমাখা গলায় বললেন—সন্ধ্যেবেলা আবার খাবেন ‘খন।
‘কলেজ ছেড়ে এসেছি যে ‘!
রূপ্পনবাবু কলেজ যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বেরোচ্ছেন। রোজ যেমন হয় – ধুতির খুঁট গলায় উঠেছে, পরনের বুশশার্ট ময়লা, কিন্তু দামি্ তাই চলতে পারে । পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল , মুখে পান, হাতে একটা মোটা বই, সিভিক্স ক্লাসে পড়ার জন্যে । বইটার নাম ‘জেবী জাসুস’ বা ‘পকেট ডিটেকটিভ’। পকেটে নীল-লাল দুটো ঝর্ণাকলম— দুটোতেই কালি নেই । হাতে রিস্টওয়াচ যা দেখলে পেত্যয় হয় যে জুয়ো খেললে ঘড়িও বন্ধক রাখা যায় আর বন্ধকী দামি ঘড়ি জুয়োয় হারলে দশটাকায় বাজেয়াপ্ত করা যায় ।
রূপ্পনবাবু বেরিয়ে যেতে যেতে প্রিন্সিপাল সাহেবের কথাগুলো শুনে ফেলেছিলেন। বাইরে থেকেই বললেন—কলেজ তো আপনি কবেই ছেড়ে দিয়েছেন, খালি কলেজই আপনাকে ছাড়ছে না !
প্রিন্সিপাল বিষম খেলেন। তাই হেসে উঠলেন, বললেন—বলেছেন বটে খাঁটি কথা !
শনিচর লাফিয়ে উঠে ওনার হাত চেপে ধরে বলল—তাহলে এই কথার খাতিরে হয়ে যাক এক গেলাস!
বৈদ্যজী প্রসন্নমুখে প্রিন্সিপাল সাহেবের ভাঙ খাওয়া দেখছিলেন। খাওয়া শেষ করে প্রিন্সিপাল বললেন—সত্যিই এতে ভারি সব জিনিস মেশানো হয়েছে।
বৈদ্যজী বললেন—ভাঙ তো নামমাত্র রয়েছে; আছেও আবার নেইও । আসল হল দ্রব্যগুণ—বাদাম, মনাক্কা আর পেস্তা। বাদাম বুদ্ধি এবং বীর্য বৃদ্ধি করে । মনাক্কা হজম করায়। এতে এলাচিও পড়েছে । এর প্রভাব শীতল । ফলে বীর্য ফাটে না , গাঢ় এবং জমাট হয় । আমি এই পানীয়ের একটি ছোট প্রয়োগ রঙ্গনাথের উপরও করছি।
প্রিন্সিপাল ঘাড় উঁচু করে কিছু বলব বলব করছিলেন, কিন্তু বৈদ্যজী থামেন নি , ‘কিছুদিন ধরে ওর জ্বর হচ্ছিল, শক্তি ক্ষীণ, তাই এখানে আনিয়ে নিয়েছি। রোজ একটি নিয়ম করে দিয়েছি । পুষ্টিকর খাবারে বাদাম খাওয়া, দু’পাতা ভাঙ। দেখবে--ছ’মাস পরে ফিরে যাওয়ার সময় কেমন চেহারা নিয়ে যায়।
কলেজের ক্লার্ক বোলে উঠল—ছুঁচো হয়ে এসেছিল, গণ্ডার হয়ে ফিরে যাবে নিঘঘাৎ, —দেখে নিও চাচা’!
ক্লার্ক যখনই বৈদ্যজীকে চাচা বলে ডাকে, প্রিন্সিপাল সাহেবের আফসোস হয় উনি কেন এতদিনেও বৈদ্যজীকে বাপ বলতে পারেন নি ! উদাস মুখে উনি সামনে পড়ে থাকা ফাইল গুলো উলটে পালটে দেখতে লাগলেন।
ততক্ষণে ল্যাংড়া দরজা পর্য্যন্ত এসে গেছে। শাস্ত্রে শূদ্রের আচরণের যেমন বিধান, ল্যাংড়া সেটা মেনে
চৌকাঠে প্রায় মুর্গী হয়ে বৈদ্যজীকে প্রণাম করল। দেখা গেল যে আজও আমাদের এখানে শাস্ত্রের বিধান সবার উপরে এবং জাতিভেদ তুলে দেওয়ার সব চেষ্টা হয় ভন্ডামি নয় রোমান্টিক বাতুলতা মাত্র । ল্যাংড়া ভিক্ষে চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল—তো যাই বাপু?
বৈদ্যজী বললেন—যাও ভাই, তুমি ন্যায়ের জন্যে লড়াই করছ, করে যাও । এতে আমি আর কী সাহায্য করব বল’?
ল্যাংড়া সহজভাবে বলল, ‘ ঠিকই বলেছ বাপু; ন্যায়ের লড়াই—তুমি কি করবে? যখন কোন সুপারিশ-টুপারিশের দরকার হবে, তখন নাহয় তোমার চৌকাঠে নাক রগড়াবো’।
আর একবার প্রায় মাটি পর্য্যন্ত ঝুঁকে প্রণাম করে লাঠির সাহায্যে ঝুলতে থাকা একটা পা’ সামলে ও চলে গেল। বৈদ্যজী জোরে হেসে উঠলেন। বললেন—এর হল বালকবুদ্ধি।
বৈদ্যজী কখনও সখনও হাসেন। রংগনাথ অবাক হয়ে দেখছিল হাসলে বৈদ্যজীর চেহারা কেমন নরমসরম হয়ে যায় , নেতার চেহারা বদলে গিয়ে ভালমানুষের মত দেখায়। এক নিষ্ঠাবান মহাপুরুষের বদলে ওনাকে এখন ধূর্ত বদমাসের মত লাগছে।
রঙ্গনাথ শুধোয়—ওর কিসের লড়াই?
প্রিন্সিপাল সাহেব সামনে ছড়িয়ে থাকা চেকবুক, ফাইল—যার অজুহাতে উনি মাঝে মাঝে সকালবেলায় এখানে ভাঙ খেতে আসেন—গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন। থেমে গিয়ে বললেন—এর তহসীল অফিস থেকে একটা দলিলের নকল নেয়ার ছিল। কিন্তু এ গোঁ ধরেছে যে একপয়সা ঘুষ দেবে না আর নিয়ম মেনেই নকল আদায় করবে। এদিকে নকল দেয়ার ক্লার্কও গোঁ ধরেছে যে একপয়সা ঘুষ নেবে না এবং কায়দাকানুন মেনে নকল দেবে। এই ওর ধর্মযুদ্ধ ।
রঙ্গনাথ ইতিহাসে এম এ। অনেক যুদ্ধের কারণ ওর পড়া আছে । আলেকজেন্ডার ভারত দখল করবে বলে হামলা করল। পুরু দখল করতে দেবে না –তাই প্রতিরোধ করল। ব্যস, যুদ্ধ শুরু। আলাউদ্দিন বলল—পদ্মিনী চাই; রাণা বলল—দেব না । ব্যস, যুদ্ধ লেগে গেল। সমস্ত লড়াইয়ের গোড়ায় একটাই কারণ। একপক্ষ বলে অমুকটা নেব , অন্যপক্ষ বলে দেব না । ব্যস, লড়াই শুরু।
এখানে তো ল্যাংড়া বলছে --নকল নেব, কিন্তু নিয়ম মেনে । নকল-ক্লার্ক বলছে—নকল দেব, কিন্তু নিয়ম মেনে । তবু লড়াই!
রঙ্গনাথ প্রিন্সিপাল সাহেবকে এই ঐতিহাসিক ধাঁধার মানে জানতে চাইল। বদলে শুনতে হল অবধী ভাষার একটি প্রবাদ, যার সরল মানে হল—‘হাতি আসে, ঘোড়া যায় , উট বেচারা হুমড়ি খায়’। এই প্রবাদটি সম্ভবতঃ কোন চালু চিড়িয়াখানা নিয়ে বলা । কিন্তু রঙ্গনাথ এটুকু টের পেল যে ইশারা কোন সরকারী দপ্তরের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং কত গভীর—তা’ নিয়ে । তবু ও ল্যাংড়া এবং নকলবাবুর মধ্যে চলতে থাকা ধর্মযুদ্ধের কোন থই পেল না । শেষে প্রিন্সিপালসাহেবের কাছে নিজের অবুঝ সমস্যাটি পেশ করে ওনাকে একটু খোলসা করতে অনুরোধ করল ।
উত্তরটা দিল ক্লার্ক।
‘ এসব হল ‘গঞ্জহা’দের (গঞ্জওয়ালাদের) চোঁচলে, মানে প্যাঁচ-পয়জার; সহজে বোঝা দায়,--‘
ল্যাঙড়া থাকে পাঁচ কোশ দূরের এক গাঁয়ে। বিবি মরেছে; ছেলেটার ওপর এমন রাগ যে ওর জন্যে মরা বললেই হয় । ভক্ত মানুষ; কবীর ও দাদুর ভজন গাইত। হল কি , গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে একদিন এক দেওয়ানি মামলা দায়ের করে বসল।–
‘ মামলাটার জন্যে একটা পুরনো রায়ের নকল দরকার ছিল, তাই শুরুতে তহসীল অফিসে একটা দরখাস্ত দিল। সেটায় কিছু ত্রুটি ছিল; খারিজ হয়ে গেল। এবার দ্বিতীয় দরখাস্ত। কিছুদিন পরে তহসীল অফিসে আবার গেল—নকল চাইতে। নকলনবিস ব্যাটা মহাচালু; পাঁচটাকা চাইল। ল্যাঙড়া বলল—ঘুষের রেট তো দু’টাকা। লেগে গেল তর্ক। দু-চারজন উকিল কাছেই ছিল। ওরা প্রথমে নকলনবীসকে বোঝাল—ভাই , দু’টাকায় মেনে নাও; বেচারা ল্যাংড়া যে ! নকল পেয়ে তোমার গুণ গাইবে। কিন্তু ব্যাটা একচুল নড়বে না । বুক চিতিয়ে বলল—মরদের এক কথা । মুখ থেকে যা বেরিয়েছে তাই নেব।
‘এবার উকিলের দল ল্যাংড়াকে বোঝাতে গেল। নকলবাবুরও ঘর-গেরস্তি আছে । মেয়েদের বিয়ে বাকি, তাই বাধ্য হয়ে রেট বাড়িয়েছে। তুমিই মেনে নাও , পাঁচটাকা দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দাও। কিন্তু সেও ঘাড় বাঁকা করল। বলল—আজকাল এই হচ্ছে। মাইনের টাকা যায় মদ-মেয়েছেলের পেছনে তারপর মেয়ের বিয়ে দিতে ঘুষ! নকলবাবু চটে গেল। বলল,’এই কথা! যাও, ঘুষ নেব না; নকল দেব কায়দাকানুন মেনে’। উকিলের দল বোঝালো,‘এমন কোর না , ল্যাংড়া ভক্ত মানুষ, ওর কথা ধরতে নেই’। কিন্তু ওর রাগ সেই যে চড়ল, আর নামল না ।
‘সত্যি বলতে কি লঙ্গড় খুব একটা ভুল বলেনি।এদেশে মেয়ের বিয়ে দেয়াও চুরি করার ওজুহাত হয়ে যায়। এক ব্যাটা ঘুষ নেয় তো আরেকজন বলতে শুরু করে—বেচারা!কী আর করে? বড় পরিবার, মেয়েদের পার করতে হবে তো!
সমস্ত বদমায়েশির শেষ যুক্তি হল মেয়ের বিয়ে, বুঝলেন?
‘যাই হোক, লঙ্গড় আর নকলবাবুর মধ্যে ভারি হাঙ্গামা বেঁধে গেল। তা’ ঘুষটুষের মামলায় হুজ্জত-হাঙ্গামা হয়েই থাকে। আগেকার দিনে পাকা কাজ হত। লোকজন ছিল এককথার মানুষ। একটা টাকা ধরিয়ে দাও, পরের দিন নকল তৈরি।আজকাল চাকরিতে সব স্কুল পাশ করা নতুন নতুন ছেলেপুলে ঢুকে লেনদেনের রেট খারাপ করে দিয়েছে। এদের দেখাদেখি পুরনো লোকেরাও বেগড়বাঁই শুরু করেছে। ফলে ঘুষ দেয়া আর ঘুষ নেয়া—দুটোই বড্ড ঝঞ্ঝাট।
‘এবার লঙ্গড়েরও মেজাজ চড়ে গেল।ও গলার কন্ঠি ছুঁয়ে বলল-ঠিক আছে বাবু, তুমি যখন নিয়মকানুন মেনে চলবে তো আমিও তাই। এবার তোমায় একটা কাণাকড়িও দেব না। আমি দরখাস্ত দিয়েছি, আজ নয় কাল আমার পালা আসবেই।
'এবার লঙ্গর গিয়ে তহসীলদার সায়েবকে সব খুলে বলল। তহসীলদার প্রথমে একচোট প্রাণখুলে হেসে নিল। তারপর বলল,সাবাশ লঙ্গড়। তোমার আর ও’সব লেনদেনের ঝামেলায় পড়তে হবেনা। নম্বর আসুক, নকল ঠিক পেয়ে যাবে। পেশকারকে ডেকে বলে দিল-দেখ, লঙ্গড় বেচারা চারমাস ধরে ভুগছে। এবার যেন সবকিছু নিয়মমত হয়, ওকে যেন কেউ কষ্ট না দেয়।পেশকার বলল, সরকার! এই লঙ্গড় ব্যাটা মহাখ্যাপা। আপনি আর এর ব্যাপারে নাই এলেন।
‘তখন লঙ্গড় পেশকারের উপর খেপে উঠল। দু’জনের মধ্যে তর্জা বেঁধে গেল। তহশীলদার কোনরকমে এদের সামলালেন।
‘লঙ্গড় জানে যে নকলবাবু কোন-না-কোন অজুহাতে ওর দরখাস্ত খারিজ করে দেবে। দরখাস্ত হল পিঁপড়ের মত, যখন ইচ্ছে যে কেউ খারিজ করে দিতে পারে। এর জন্যে কোন বিশেষ কসরত করতে হয়না। যেমন ফীসের টিকিট কম লাগানো হয়েছে, প্রাপ্তকর্তার ঠিকানায় ভুল আছে অথবা অমুক কলম খালি রয়ে গেয়েছে—এসব লিখে নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দাও। তারপর নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ত্রুটি শুধরে না নিলে দাও দরখাস্ত খারিজ করে।
‘তাই লঙ্গড়ও কোমর বেঁধে লেগে পড়ল। ও ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে নিজের গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আস্তানা গাড়ল। খেতখামার,ফসল, হাল-বলদ সব ভগবানের ভরসায় ছেড়ে এসেছে। ওর রোজকার কাজ হল সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত তহশীল অফিসে নোটিশ বোর্ডের আশেপাশে চক্কর লাগানো। ওর ভয় যে হতে পারে ওর দরখাস্তের কোন ত্রুটির ব্যাপারে কোন খবর নোটিশ বোর্ডে টাঙানো হল, কিন্তু ওর চোখ এড়িয়ে যাওয়ায় শোধরানোর তারিখ পেরিয়ে গেল আর দরখাস্ত খারিজ হয়ে গেল! একবার এমনই হয়েছিল বটে।
‘ও নকল পাওয়ার সমস্ত নিয়ম কানুন শিখে নিল।ফীসের পুরো চার্ট ওর মুখস্থ। দেখুন, মানুষের যখন কপাল খারাপ হয়, তখনই তার থানা-আদালতের চক্কর লাগানোর দিন আসে। এখন লঙ্গড়েরও ভাগ্য বিমুখ। কিন্তু ব্যাটা এদানীং এমন করে তহসীল অফিসের পেছনে লেগেছে যেন নকল আদায় করেই ছাড়বে’।
রঙ্গনাথ নিজের জীবনে খুব একটা বোকামি করেনি। কাজেই ওকে এ লাইনে অভিজ্ঞ বলা উচিত হবেনা।লঙ্গড়ের কাহিনীটি ওর মনে গভীর প্রভাব ফেলল, তাই ওর মনে হল ‘কিছু একটা করতে হবে’। কিন্তু কী করা উচিত তা নিয়ে ওর মনে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই।যাহোক, ভেতরে ভেতরে ছটফটানি অসহ্য হয়ে ওঠায় ও বলে উঠল—‘ এসব ভারি অন্যায়। কিছু একটা করা উচিত’।
ক্লার্ক শিকারী কুকুরের মতন ঝাঁপিয়ে কথাটা লুফে নিল। ‘কী করবে তুমি রঙ্গনাথ বাবু? কে কী করবে?যার ছেঁড়ে, শুধু তারই জ্বলে।সবাই যদি নিজের নিজের ভার বয়ে নেয়, সেটাই অনেক। অন্যের ভার কে বইতে পারে? ভাইয়া, হরেদরে দাঁড়াল এই যে তুমি তোমার দাদ ওপাশ দিয়ে চুলকে নাও তো’ আমি আমারটা এ’পাশ দিয়ে, ব্যস্’।
ক্লার্ক উঠে দাঁড়াল। প্রিন্সিপাল সায়েব ঘরের এপাশ ওপাশ একনজর দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,’বদ্রীভাইয়াকে দেখছি না যে?’
বৈদ্যজী মুখ খুললেন,’ একজন কুটুম ডাকাতির ঘটনায় ফেঁসে গেছে। পুলিশের লীলা বোঝা দায়, জানই তো। বদ্রী গেছল ওখানেই, বোধহয় আজ ফিরবে’।
শনিচর চৌকাঠের কাছে বসেছিল। ঠোঁট গোল করে সিটি বাজানোর মত শব্দ করে বলল,’ যতক্ষণ না আসে ততক্ষণই মঙ্গল’।
প্রিন্সিপল সায়েব ভাঙের নেশায় ভুলে গেছেন-আরাম হারাম হ্যায়।
উনি এবার একটা বড়সড় তাকিয়া টেনে নিয়ে গুছিয়ে বসে বললেন,’কী ব্যাপার হে’?
শনিচর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল,’ কো-অপারেটিভে গবন মানে, পয়সার হিসেবে গন্ডগোল হয়েছে।বদ্রীভাইয়ার কানে পৌঁছলে সুপারভাইজারকে জ্যান্ত চিবিয়ে খাবেন’।
প্রিন্সিপাল ভয় পেলেন। উনিও গলা নামিয়ে বললেন,’ তাই নাকি’?
শনিচর মাথা নীচু করে ফুসফুসিয়ে কিছু বলা শুরু করল।এদের দু’জনের কথাবার্তা চলছিল পার্শী থিয়েটারের সেই অখিল ভারতীয় স্টাইলে যাতে স্টেজে একজন পাত্র আরেকজনকে কিছু বলে যা ওর পাশে দাঁড়ানো তৃতীয় ব্যক্তি শুনতে পায়না, অথচ একশ’ গজ দূরের দর্শক ও শ্রোতারা সব শুনতে পায়; এবং হলের সমস্ত জনতা বুঝতে পারে এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে, ব্যতিক্রম শুধু ওই দ্বিতীয় পাত্র যাকে কথাটা বলা হল।
সংক্ষেপে, ব্যাটা শনিচর আমাদের গোপন কথাটি বলার যে চিরন্তন শৈলী তার অনুকরণ করে প্রিন্সিপাল সায়েবকে কিছু বলতে শুরু করল।
কিন্তু বৈদ্যজী কঠিন স্বর। -কী মেয়েদের মত গুজগুজ করছ? কো-অপারেটিভে তছরূপ হয়েছে তো কার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে? কোন ইউনিয়নে এসব হয় না?
একটু দম নিয়ে তারপর উনি কাউকে বোঝানোর ভঙ্গীতে বললেন—দেখ, এতদিন আমাদের ইউনিয়নে কোন গবন বা তবিল তছরূপ ঘটেনি, তাই লোকে আমাদের সন্দেহের চোখে দেখত। ভাল হল গবন হয়েছে, এখন তো বলা যাবে যে আমরা সৎলোক, যা ঘটেছে তা জানিয়ে দিয়েছি।কিচ্ছু লুকোই নি।
লম্বা শ্বাস নিয়ে উনি কথাটা শেষ করলেন।– যা হবার তা ভালই হল। একটা কাঁটা বেরিয়ে গেল, চিন্তা দূর হল।
প্রিন্সিপাল সায়েব তাকিয়ায় পিঠ দিয়ে পাথরের মত বসেছিলেন। এবার একটা এমন মন্তব্য করলেন যা সবাই জানে।– মানুষ আজকাল বড্ড বেইমান হয়ে গেছে।
এই কথাটি বড় উপকারী, সবার দরকারে লাগে। সব ভালোমানুষেরা দিনে তিনচার বার খাওয়ার পরে মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট গেলার মত এটার ব্যবহার করে থাকেন।কিন্তু ক্লার্কের কথাটা গায়ে লাগল। ও পালটা দিল, ‘সবাই সমান নয়। আমাদের কলেজে তো আজ পর্য্যন্ত এ’রকম হয় নি’।
বৈদ্যজী ওর দিকে পরম সুহৃদের মত তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন—কলেজে গবন আমি
আসলে কো-অপারেটিভে গবন হয়েছে গমের গুদামের স্টকে। ওঁর ইশারা সেদিকে।
এটা উনি ঠাট্টা করে বললেন। ব্যস্, প্রিন্সিপাল হেসে উঠলেন। একবার হাসির হররা ছুটলে তাতে তাল দেয় ভাঙের নেশা।উনি হাসতেই থাকলেন।কিন্তু ক্লার্কের ব্যক্তিগত খোঁচা নিয়ে সন্দেহ যায়নি।ও বলে উঠল,’ কিন্তু চাচা, কলেজে তো গন্ডা গন্ডা গোবরের ভান্ডার। সবক’টার মাথায় গোবর পোরা’।
এতে সবার হাসি। শনিচর ও রঙ্গনাথও তাতে যোগ দিল। হাসির ঢেউ বাইরের চাতাল অব্দি ছড়িয়ে গেল। দরবারে বসে থাকা কিছু ফালতু লোকও না বুঝে হেসে উঠল। ক্লার্ক চোখের ইশারায় প্রিন্সিপালকে বলল—এবার উঠলে হয়।
আমাদের সভ্যতার গৌরবময়ী ট্র্যাডিশন হল আসল কথা দু’চার ঘন্টা আলাপ ও তর্কের পর শেষ সময়ে বলা হয়।তাই বৈদ্যজী এবার প্রিন্সিপালকে শুধোলেন—আর কিছু?
‘কিছু না, ওই খান্না মাস্টারের ব্যাপারটা। পরশুদিন ক্লাসে কালো চশমা লাগিয়ে পড়াচ্ছিল। আমি ওখানেই ওকে ‘ফিক’ করে দিয়েছি। বাচ্চাগুলোর মাথা খাচ্ছিল। আমি বললাম, শোন হে,তোমাকে আমি এখানেই রগড়ে ‘ফিতা’ বানিয়ে দিতে পারি’।
প্রিন্সিপাল নিজেকে অনেক সামলাচ্ছেন, কিন্তু রাগের মাথায় ওঁর কথাবার্তায় যেখানে সেখানে ‘ফ’ ঢুকে পড়ে।
বৈদ্যজী গম্ভীর।
‘এমন করা উচিত হয়নি। বিরোধীদেরও সম্মান করতে হয়। দেখ, প্রত্যেক বড় নেতার এক-একজন করে বিরোধী থাকে। সবাই নিজের নিজের পছন্দসই বিরোধী বেছে নেয়। এই হল গণতন্ত্রের নিয়ম। আমাদের নেতারা কত ভদ্রভাবে নিজের বিরোধীদের মোকাবিলা করেন।বিরোধীরা ওদের বকবকানি চালিয়ে যায় আর নেতারা ওদের কথায় কান না দিয়ে চুপচাপ নিজের চাল চেলে দেন।কেউ কারও কথায় চলেনা।এই হল আদর্শ বিরোধ; আমাদেরও ওই কায়দায় চলতে হবে’।
রাজনীতির এসব মৌলিক নীতির ক্লার্কের উপর কোন প্রভাব পড়েনি। বলল,’ এসবে কোন কাজ হয় না। খান্না মাস্টারকে ভাল করে চিনি। ইতিহাসের এম এ, কিন্তু নিজের বাপের নাম বলতে পারবে না। কোন কম্মের নয়, শুধু দলাদলিতে উৎসাহ। ছাত্রদের নিজের ঘরে ডেকে জুয়ো খেলায়।ওর একটাই ওষুধ—ধরুন ঠেসে, লাগান দমাদ্দম!
এই কথায় বৈদ্যজী আরও গম্ভীর, কিন্তু লোকের উৎসাহ বেড়ে গেল।কথা ঘুরে গেল জুতো মারার পদ্ধতি আর প্রথার দিকে। শনিচরের উৎসাহ দেখে কে! ‘ যখন খান্নাকে দনাদ্দন-দনাদ্দন দেয়া হবে তখন আমাকে ডাকতে ভুলো না।অনেকদিন কাউকে জুতো পেটা করি নি। আমিও দু’চার ঘা দেব’।
একজন ফাটা জুতো তিনদিন জলে ভিজিয়ে রাখলে পেটানোর সময় চমৎকার শব্দ বেরোয় আর দূর-দূরান্তরে লোকেরা টের পায় যে আজ জুতোপেটা চলছে।আর একজন বলল, যদি লেখাপড়া জানা লোককে পেটাতে হয়, তাহলে ‘গোরক্ষক’ জুতোই ভাল। মারও পড়বে, কিন্তু বেশি অপমান হবে না। চাতালে বসা আর এক পন্ডিতের পরামর্শ হলঃ জুতো মারার সবচেয়ে ভাল উপায় হল এক দুই করে গুনে গুনে জুতো লাগাও কিন্তু নিরানব্বইয়ে পৌঁছে আগের গুণতি ভুলে আবার এক থেকে পেটাতে শুরু কর। চতুর্থজন মাথা নেড়ে সায় দিল—এটাই সঠিক পদ্ধতি। তাই আমি আজকাল এক থেকে একশ’ অব্দি গোনা শিখছি। (চলবে)
0 comments: