গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পসপ্তম পর্ব
সিরাজের প্রতি-আক্রমণ ও আলিনগর চুক্তি
কলকাতা কাউন্সিল কয়েকদিনের মধ্যেই ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।২৬শে জানুয়ারি ঠিক হল যে মেজর ক্লিপট্রিকের নেতৃত্বে এক সেনাবাহিনী গঠন করা হবে আভ্যন্তরীন সুরক্ষার জন্য। এছাড়াও দ্রুত কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেবার কথা ভাবা হল। ঠিক হল যে দেশি তাঁতিদের সুরক্ষা এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে যাতে তারা আবার কাজ শুরু করতে পারে। জমিদারদের বলা হল তারা যেন প্রচার করে যে তাঁতিদের সুরক্ষা এবং কাপড় উৎপাদন ও বিক্রির ব্যাপারে কোম্পানি পূর্ণ সহযোগিতা করবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং কর্মচারিরা যারা যুদ্ধের সময় নবাবের বাহিনীকে সাহায্য না করে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল তাদের সকলকে কোম্পানি এলাকায় ফিরিয়ে আনা হবে, তাদের বাড়ি সারানোর , সংসার চালানোর এবং আবার করে ব্যবসা শুরু করার জন্য সাময়িক সাহায্য করা হবে। যারা যুদ্ধের সময় নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে নবাবের বাহিনীকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করেছিল তাদের কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। কোম্পানি কর্মচারিরা যারা এতদিন বাড়ি ছেড়ে ছিল তাদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। মাসিক বেতন ছাড়াও এই ভাতার কারণ যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ বাসস্থানের সংস্কার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। চাকুরির শ্রেণী অনুসারে বিশেষ মাসিক ভাতার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল।
প্রেসিডেন্ট- ৩০০ টাকা
কাউন্সিল মেম্বার-১০০ টাকা
ছোট এবং বড় ব্যবসায়ী- ৭০ টাকা
অন্যান্যরা- ৪০টাকা
এই বিশেষ ভাতা কার্যকরী হল ১লা জানুয়ারি, ১৭৫৭ থেকে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে কলকাতা কাউন্সিল লন্ডনে কোম্পানির বোর্ডে জানালো যে বাঙলা থেকে অফিসারদের ইরাক পাঠানো হোক পারসি শেখার জন্য। পারসি শেখা অত্যন্ত জরুরি কারণ নবাবের সমস্ত নথিপত্র পারসিতে লেখা।স্থানীয় পারসি জানা লোকেরা যথেষ্ট শিক্ষিত নয় এই কাজের জন্য। কিন্তু আগে নবাবাকে সামলানো দরকার । কেবল ভাষা বুঝে কোনও লাভ নেই।
ব্রিটিশদের ১০ এবং ১১ই জানুয়ারির হুগলি আক্রমণ সিরাজকে অস্থির করে তুলল। তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা তার রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল। আর দেরি না করে সিরাজ রওনা দিল কলকাতার উদ্দেশ্যে। সঙ্গে বেছে নিল মিরজাফর আর রায়দুর্লভকে। এদিকে জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের আধিপত্য এবং দুর্ব্যবহার সহ্য করতে না পারলেও তার বিরুদ্ধে যাবার বিশেষ করে ব্রিটিশদের পক্ষে যোগ দেবার সাহস তখনও সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। সুতরাং দু’জনেই তখনও দু’নৌকায় পা দিয়েই চলতে থাকল। জগতশেঠ এবং উমাচাঁদ সিরাজের অতিবিশ্বস্ত জমিদার রণজিৎ রাইকে মধ্যস্থতার কাজে লাগিয়ে গত জুনের যুদ্ধের সময় সম্পত্তির যা ক্ষতি হয়েছিল তা উশুল করার জন্য একদিকে যেমন ব্রিটিশদের শরণাপন্ন হল আবার অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে গিয়ে সিরাজের অতি ঘনিষ্ঠ মোহনলালের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে কিছু সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হল।
অন্যদিকে ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে পেয়ে ব্রিটিশরা নতুন উদ্যমে সিরাজের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিল। কলকাতা থেকে উত্তরে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে হুগলির প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার ভিতরে সুরক্ষিত ক্যাম্প বানিয়ে সিরাজের বাহিনীর আসার প্রতীক্ষায় রইল ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী। মাদ্রাজ থেকে মেরামত হয়ে ফিরে এসেছে গোলা-বারুদবাহী জাহাজ মার্লবোরো। সুতরাং কামান বন্দুকের কোনও অভাব নেই। সিরাজের বাহিনী হুগলির উত্তরে নদী অতিক্রম করে এগিয়ে আসতে লাগল। আর একটা বাহিনী পুর্বদিকের তীর ধরে দক্ষিণে এগোতে থাকল। ক্লাইভের ভয় ছিল যে যখন নবাবের আর একটা বাহিনী পশ্চিমের তীর ধরে আসার সময় চন্দননগর অতিক্রম করবে তখন ফরাসি সৈন্যরা নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটল না। যদিও ইউরোপের যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছেছে তবুও গঙ্গাবক্ষে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল না ফরাসিরা। তা সত্ত্বেও অতিসাবধানি ক্লাইভ নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। পরিস্থিতি ব্রিটিশদের পক্ষে সুবিধাজনক থাকলেও সংখ্যার হিসাবে সিরাজের সৈন্য বেশি ছিল। ৩০শে জানুয়ারি রণজিৎ রাইএর উদ্যোগে ক্লাইভ সিরাজের কাছে শান্তির আবেদন জানাল। সিরাজ কিন্তু তার নিজস্ব ভঙ্গীমায় শান্তি আবেদনের প্রতি সমর্থন জানালেও অভিযান বন্ধ করার কোনও প্রতিশ্রুতি দিল না। সিরাজের বাহিনী এগিয়ে চলল অব্যাহত গতিতে। খাওয়াজা পেট্রাসের দৌত্যে দুই শিবিরে পত্র বিনিময় চলতে থাকল। ২রা ফেব্রুয়ারি কিছুক্ষণের জন্য অভিযান বন্ধ থাকায় মনে হল হয়ত সিরাজ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সাময়িকভাবে অভিযান বন্ধ রেখে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে। কিন্তু সেরকম কিছু ঘটল না। পরের দিন সিরাজের বাহিনী পূর্ণ গতিতে কলকাতার দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তার দু’ধারের গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগল। চতুর ক্লাইভ সিরাজের বাহিনীকে বিনা বাধায় এগিয়ে আসতে দিল। দুপুরের দিকে সিরাজের বাহিনী উত্তরের স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়িগুলোর ওপর আক্রমণ চালিয়ে এগিয়ে এসে এমন জায়গায় পৌঁছলো যার একদিকে জলাভূমি আর অন্যদিকে ব্রিটিশ নৌসেনা। ক্লাইভের ফাঁদে পা দিয়ে বেশ কয়েকজন সৈন্য প্রাণ হারাল আর বন্দি হল প্রায় পঞ্চাশজন। সিরাজ যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিল। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা এগিয়ে চলল। এরকমই ঘটে প্রতিবার। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার এ এক কৌশল। শহরের উত্তরে ব্রিটিশ ক্যাম্পের পূর্বে এবং দক্ষিণ-পূর্বে শ’য়ে শ’য়ে নবাবের সেনা জড়ো হল। ক্যাম্পের প্রায় অন্তর্গত একটা বাগানে সিরাজের সৈন্যরা নিষেধসত্ত্বেও অনুপ্রবেশ করায় ক্লাইভের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। বেশ কিছু সৈন্য নিয়ে ক্লাইভ আক্রমণ চালাতেই সিরাজের সৈন্যরা গোলা নিক্ষেপ করতে শুরু করল। প্রায় একঘন্টা ধরে যুদ্ধ এবং বেশ কিছু রক্তপাতের পর সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ক্লাইভ সৈন্যদের নিয়ে ক্যাম্পে ফিরে গেল।
পরেরদিন অর্থাৎ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সিরাজের মূলবাহিনী এগিয়ে গেলেও সিরাজ নিজে কয়েক কিলোমিটার পিছনে নবাবগঞ্জ নামে একটা গ্রামে কঠোর নিরাপত্তা সহযোগে বিশ্রাম করছিল। ক্লাইভকে চিঠি পাঠিয়ে নবাবগঞ্জে প্রতিনিধি পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাল সিরাজ। এই চিঠির জন্য গত দু’দিন ধরে অপেক্ষা করে ছিল ক্লাইভ। চিঠি পাবার সঙ্গে সঙ্গেই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে সিরাজের কাছে পাঠানো হল। নবাবগঞ্জে পৌঁছে জানা গেল সিরাজ অন্যত্র অবস্থান করছে। ব্রিটিশরা যদি গোপনে তাকে বন্দি করার জন্য নবাবগঞ্জে সৈন্য পাঠায় তাই শেষ মুহূর্তে স্থান বদল করে ফেলেছিল সিরাজ। নবাবগঞ্জ থেকে নবাবের সেনা পরিবৃত হয়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা সিরাজের কাছে পৌঁছে বুঝল যে প্রচুর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সিরাজ রয়েছে ব্রিটিশ ক্যাম্পের খুব কাছেই উমাচাঁদের বাগানবাড়িতে।
রণজিৎ রাই ওয়ালশ এবং স্ক্রাফটনকে রায়দুর্লভের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। রায়দুর্লভ প্রতিনিধিদের জানাল যে তাদের সন্দেহ হচ্ছে যে নবাবকে হত্যা করার কোনও পরিকল্পনা থাকতে পারে ব্রিটিশদের তাই তাদের সার্চ করে দেখা হবে যে লুকিয়ে তারা সঙ্গে করে পিস্তল নিয়ে যাচ্ছে কি না। এছাড়াও তারা সঙ্গে করে তরোয়াল নিয়ে যেতে পারবে না। ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা রায়দুর্লভের এই প্রস্তাবে সম্মত হল না। নবাবের অনুমতি নিয়ে রায়দুর্লভ এদের নবাবের কাছে হাজির করল। নবাবের পাশে বসে থাকা দীর্ঘ পোশাক এবং পাগড়ি পরিহিত বিশালাকৃতি রক্ষীদের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল তারা ব্রিটিশ প্রতিনিধিদের হত্যার নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। দুই প্রতিনিধি সিরাজকে জানিয়ে দিল যে শান্তি আলোচনা চলার সময় বিনা প্ররোচনায় ব্রিটিশ এলাকায় অনুপ্রবেশ করে নবাব ঠিক কাজ করেনি। নবাব প্রেরিত শান্তিপ্রস্তাব সে ক্ষেত্রে হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। এরপর প্রতিনিধিরা তাদের লিখিত প্রস্তাব সিরাজের হাতে তুলে দিল। ক্রুদ্ধ সিরাজ সেই প্রস্তাব ভাল করে না পড়েই পাশে বসে থাকা এক আধিকারিককে ডেকে বলল এদের দু’জনকে দেওয়ানের কাছে নিয়ে যেতে। প্রতিনিধিরা সভাকক্ষ থেকে বেরতেই উমাচাঁদ তাদের ডেকে সাবধান করে দিল এবং জানাল যে নবাবেরর কামান যে কোনও মুহূর্তে তাদের পথ আটকে দাঁড়াতে পারে। প্রতিনিধিদের সন্দেহ হল দেওয়ানের কাছে গেলে তাদের বন্দি করে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। সঙ্গে যারা এসেছিল তাদের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিতে বলে বড় রাস্তা দিয়ে না গিয়ে দু’জনে ঘুরপথে শিবিরে পৌঁছে গেল। ক্লাইভের কাছে তারা সবকথা বিস্তারিত ভাবে জানালো। সেই মুহূর্তে ক্লাইভ সিদ্ধান্ত নিল আর দেরি নয় কাল সকালেই হানতে হবে অতর্কিত আক্রমণ । ৫ই ফেব্রুয়ারি মাঝরাতে আগ্নেয়াস্ত্রসমেত ছ’শ সৈন্য জাহাজ থেকে নামল । তাদের সঙ্গে যোগ দিল সাড়ে ছ’শ ইউরোপিয়ান সেনা, এক’শ পদাতিক সৈন্য আর আট’শ সেপাই।ভোর হবার আগেই অভিযান শুরু করে দিল ক্লাইভ। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাইভের বাহিনী ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে উমাচাঁদের বাগানে পৌঁছে গেল। এদিকে মিরজাফরের নেতৃত্বে একদল সৈন্য উমাচাঁদের বাগানে রয়ে গেল সিরাজের নিরাপত্তার জন্য। বাকি সৈন্যরা কিছুটা অপরিকল্পিতভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইল। উমাচাঁদের বাগানে যেতে যেতেই ক্লাইভের কানে এল বিশাল দ্রুতগামী অশ্বারোহী বাহিনীর পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার আওয়াজ। কুয়াশায় কিছু দেখতে না পেয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করল ক্লাইভের বাহিনী। কিন্তু সিরাজের সৈন্যরা ক্রমাগত উল্টোদিক থেকে গোলাবর্ষণ করতে থাকল। বাগানের দক্ষিণ থেকে মাইলখানেক আগে রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে এবং রাস্তার পাশে ধানজমি। ধানজমির মাঝখানে আল দিয়ে জমি ভাগ করা আছে।সরু রাস্তা দিয়ে একটু এগোতেই নবাবের সৈন্যদের মুখোমুখি পড়ে গেল ব্রিটিশ সৈন্যরা। নবাবের সৈন্যদের আক্রমণ আর গোলার হাত থেকে বাঁচার জন্য পাশের ধানক্ষেতে নেমে পড়ল ব্রিটিশ সৈন্যরা। কিন্তু অসমতল ধানজমি আর আলে বাধা পেয়ে কামানগুলো টানাই সম্ভব হচ্ছিল না তাদের। এই সুযোগে গোলাবর্ষণ বাড়িয়ে দিল সিরাজের সৈন্যরা। পিছু হটতে হটতে ব্রিটিশ সৈন্যরা যখন নিজেদের দূর্গে পৌঁছলো তখন সকাল দশটা। সাতাশ জন সৈন্য এবং আঠারোজন সেপাই নিহত ও সত্তরজন সৈন্য এবং পয়ঁত্রিশজন সেপাই আহত হয়েছিল এই যুদ্ধে। নিহতদের মধ্যে ছিল দু’জন ক্যাপটেন। ক্লাইভের ব্যক্তিগত সচিব বেলসেরের একটি পা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল গোলার আঘাতে।
এই পরাজয়ে মনোবল ভেঙ্গে পড়ল ক্লাইভের সেনাপতিদের। ক্লাইভের মতো একজন অভিজ্ঞ এবং কুশলী সেনাধিপতি কী করে নিজের সেনাবাহিনীকে বিনা প্রয়োজনে এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিল সে কথা তারা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। নানা সন্দেহ তাদের মনে বাসা বাঁধতে শুরু করল। এমনকি মাদ্রাজ কাউন্সিলে ক্লাইভের সহকর্মিরা ক্লাইভের যুদ্ধ পরিচালনার দক্ষতা সম্বন্ধে অনেক প্রশ্ন তুলতে শুরু করল। কিন্তু ক্লাইভ যুক্তি দিল যে তারা যে ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকবে না সেটা সিরাজকে বোঝানোর জন্য অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। এই অতর্কিত আক্রমণ তাদের দিক থেকে কিছুটা বেশি ঝুঁকির হলেও তারা যে প্রয়োজনে বড় ঝুঁকি নিতে পারে সে কথাটা সিরাজের মাথার মধ্যে ঢোকানোর দরকার ছিল। আসলে ঘটেছিলও তাই। ক্লাইভকে আপাতত প্রতিহত করা গেলেও সিরাজের মধ্যে ব্রিটিশদের শক্তি সম্বন্ধে যে ভুল ধারণা ছিল সেটা কেটে গেল। এই যুদ্ধে সিরাজেরও কম ক্ষতি হয়নি।বাইশজন ভালো অফিসার, ছ’শ সাধারণ মানুষ, চারটে হাতি, পাঁচ’শ ঘোড়া এবং বেশ কয়েকটা বলদ ও উট নিহত হয়েছে এই যুদ্ধে। সিরাজ একেবারে সামনে থেকে দেখেছে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা। যে কোনও মুহূর্তে তার জীবন বিপন্ন হতে পারত সে কথা সে ভালোভাবেই বুঝে গেছে। সে বুঝেছে মুখে আস্ফালন করলেও তার সেনাপতিদের মুরোদ আসলে অনেক কম। নিজের অফিসারেরা ক্ষমা না চাইলে এবং ভবিষ্যতে আর ভুল করবে না এই প্রতিশ্রুতি না দিলে তাদের বহিষ্কারের আদেশনামায় সই করেই ফেলেছিল সিরাজ। এদের না তাড়ালেও এই সমস্ত দুর্বলচিত্ত ভীরু অফিসারদের দিয়ে যে ক্লাইভের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না সিরাজ এই যুদ্ধে সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ক্লাইভ হেরেছে তার নিজের ভুলের জন্য। এর জন্য তার সেনাপতিদের যে কোনও কৃতিত্ব নেই সে কথা সেনাপতিদের বলতে কসুর করেনি সিরাজ।
এমতাবস্থায় যা হওয়ার কথা তাই হলো। রণজিৎ রাইকে দিয়ে ক্লাইভের কাছে শান্তি আলোচনার প্রস্তাব পাঠাল সন্ত্রস্ত সিরাজ। ক্লাইভ সাগ্রহে সম্মত হলেও এ কথা জানাতে ছাড়ল না যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করেনি। একমাত্র যারা তাদের সামনে এসে গিয়েছিল বা সামনাসামনি আক্রমণ করেছিল নিজেদের বাঁচার জন্য তাদের হত্যা করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিলনা তার কাছে। চিঠি দেওয়া নেওয়া চলাকালীন ক্লাইভের প্রতি মানসিক চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সিরাজের দিক থেকে নিজের শক্তি ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের পরিকল্পিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ক্লাইভ শান্তির পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন রইল। অবশেষে ৯ই ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত হল ঐতিহাসিক আলিনগর চুক্তি। এই চুক্তিতে সিরাজ তার সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের জন্য কোম্পানির যা ক্ষতি হয়েছে তার সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে সম্মত হওয়া ছাড়াও কোম্পানির দূর্গ নির্মাণের ব্যাপারে সম্মতি দিল। এছাড়াও ব্রিটিশদের স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা বানানোতে তার যে কোনও আপত্তি নেই সে কথাও লেখা রইল এই চুক্তিতে। বাঙলায় করমুক্ত ব্যবসার অনুমতি ছাড়াও আটত্রিশটি গ্রামের মালিকানা লিখে দিল সিরাজ ব্রিটিশদের নামে। সিরাজের দিক থেকে মিরজাফর এবং রায়দুর্লভ এই চুক্তির সাক্ষী রইল। সিরাজের এই আকস্মিক এবং অপমানজনক পশ্চাদপসরণের আসল কারণ সকলের পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। ১১ই ফেব্রুয়ারি মিরজাফর এবং রায়দুর্লভকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে বেশ কিছু মাইল উত্তরে পিছিয়ে গেল সিরাজ এবং তার বাহিনী। ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার বার্তা সিরাজের আচার আচরণে বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ পেতে লাগল। ব্রিটিশদের সঙ্গে আরও কয়েকটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল পরের দিন অর্থাৎ ১২ই ফেব্রুয়ারি।
শান্তিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলাকালীন উমাচাঁদের মাধ্যমে ক্লাইভ সিরাজের কাছে জানতে চাইল যে চন্দননগরে ফরাসি উপনিবেশ আক্রমণের ব্যাপারে তার সম্মতি পাওয়া যাবে কি না। সিরাজ যদিও এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলনা কিন্তু সরাসরি এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান না করে জানাল যে যদি ফরাসিরা তাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে তবে তাদের বাধাদানের ক্ষেত্রে তার কোনও আপত্তি নেই। সিরাজ এ কথাও জানালো যে কুড়িজন ব্রিটিশ সৈন্যকে সে তার নিজের বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় এবং কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটসকে সে নিজের দরবারে স্থান দিতে পারে। সিরাজের কাছ থেকে চন্দননগর আক্রমণের ব্যাপারে কোনও সরাসরি আপত্তি না পেয়ে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণের সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলল। ১৮ই ফেব্রুয়ারি ক্লাইভের বাহিনী শুরু করল চন্দননগর অভিযান।
0 comments: