0

গল্প - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in






ভূমধ্যসাগরের হাওয়াতেও অনবরত জীবন-মৃত্যুর ফানুস! হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা স্ট্রিপ থেকে ইসরায়েলের দিকে ছুটে এলো পর পর কতগুলো এরোপ্লেন। এই আক্রমণের কিছুক্ষণের মধ্যেই ইসরায়েলের পাল্টা আক্রমণ! ইসরায়েলের মিলিটারি কমান্ডারের ওয়ারলেস-বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো – ‘স্ট্রাইক! ডোণ্ট লুক বিহাইন্ড!’

প্রচন্ড শব্দ! গাজা শহরের ‘শোরেউক টাওয়ার’টা বালির পাহাড়ের মতো নিমেষেই ধ্বসে পড়লো। নাসিমা ভেঙে পড়া বিল্ডিং আর দাউদাউ আগুনের থেকে কিছুটা দূরে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে! পাশেই আলায়েনের রক্তমাখা শরীরটা। একটা অচেনা আঙ্কেল দৌড়ে এসে তার কাঁধে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! সবাই যেদিকে পালাচ্ছে সেদিকে ভাগ্‌!’

চার দিকে ধূলোর ঝড়। আগুনের হলকায় গায়ের চামড়া জ্বলে যাচ্ছে! বেশী কিছু বুঝে উঠবার আগে নাসিমা পালাতে শুরু করলো। ওদিকে ওর জিগরী দোস্ত আলায়েন যে রক্ত মেখে বারান্দায় শুয়ে আছে!



#

চারদিকে ভয়াবহ অবস্থা! ওরা থাকে শেরেউক টাওয়ারের একটা ফ্লাটে। গতকাল রাতে ঘুম আসার আগে নাসিমার নজরে এসেছিল - তার আম্মু আর আব্বুর মানসিক উত্তেজনা ভরা কথাবার্তা। যে কোন মুহূর্তেই এই গাজা শহরে আবার হামলা হতে পারে। এসব শুনতে শুনতে নাসিমা বিন্দাস ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

দিন-রাতের উত্তেজনা এ গাজা শহরে খুবই স্বাভাবিক! এর কারণ লুকিয়ে আছে ইহুদি-প্রধান ইজরায়েল, হামাস উপদ্রুত গাজা-স্ট্রিপ, প্যালেস্টাইন, আরব এসব দেশগুলোর দীর্ঘকালীন ইতিহাসে। শহরে আরো অনেকেরই মতোই নাসিমার আম্মা আব্বুরা আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটায়। অনেক রাত্রে তাদের চোখে ঘুম আসে না!

নাসিমার এখন ন’বছর। সামরিক অস্থিরতার জন্যে নাসিমাদের ইসকুল-টিসকুল সব বন্ধ! সেদিন ভোরের দিকে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে ওর মা-বাবা টিভির নিউজ দেখছিল। তারই ফাঁকে মেয়েটা কখন যেন নিজে নিজেই নীচে নেমে এসেছে। তাদের ‘শোরেউক টাওয়ার’ পাশেই আরেকটা বিরাট টাওয়ার। নাসিমা জানতো, ওখানে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে আলায়েন। দশ বছর বয়েসী ছেলেটা, ওর দোস্ত। এটা ওদের রোজকার খেলবার জায়গা!

নাসিমা মুসলমান। কিন্তু ওর দোস্ত আলায়েন ইহুদী। তার পূর্বপুরুষেরা ইজরায়েল, মক্কা, জেরুজালেম এসব জায়গা ঘুরে ওরা গাজা শহরেই পাকাপাকি বাসা বেঁধেছে। আলায়েন আর নাসিমা কাছেই একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। ওরা থাকেও পাশাপাশি দুটো টাওয়ারে।

গাজা শহরটাতে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ার তেতো গন্ধ! শুধু যুদ্ধ আর হানাহানি! হামাস কিংবা ইসরায়েলি হানাদারবাহিনীর সীমান্ত অনুপ্রবেশ লেগেই আছে!

এরই মধ্যে রোজকার মতো আলায়েন আর নাসিমা টাওয়ারের নীচের তালার ফাঁকা পেভমেন্টটাতে বসে খেলছিল। সামনের স্তুপ থেকে কিছু ইট পাথর জোগাড় করে ওরা দুজনে মিলে একটা দুর্গ তৈরী করেছিল। দুর্গের পাঁচিলে দুটো ছোট্ট ছোট্ট বন্দুকধারী সৈনিক আর একটা প্লাস্টিকের কামান।

খেলাঘরে বন্দুকধারী প্লাস্টিকের সৈন্যদুটোকে সাজাতে সাজাতে আলায়েন নাসিমাকে বলছিল – ‘বড় হয়ে তুই আমাকে বিয়ে করবি?’

খবরদারির ঢঙে নাসিমা বলে উঠলো – ‘তুই জানিস না? বাচ্চাদের বিয়ের কথা বলতে নেই!’

আলায়েন নাসিমার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘আজ তোকে বাবা-মা’দের একটা সিক্রেট গল্প বলবো। প্রমিস, কাউকে বলবি না!’

তখনই এরোপ্লেনের তীক্ষ্ণ গর্জন! এগিয়ে আসছে কয়েকটা বোমারু বিমান!

তীক্ষ্ণ গর্জন মাথার উপরে! ওরা দুজন চেঁচিয়ে বললো – ‘মেঝেতে শুয়ে পড়, জলদি‌ - জলদি!’ নাসিমা আর আলায়েন প্লেনের শব্দ শুনতে পেয়েই আত্মরক্ষার কায়দায় শুয়ে পড়েছিল গ্রাউন্ডফ্লোরের পেভমেন্টে। এরকমটাই স্কুলে ওদের ট্রেনিং দেয়া আছে।

গাজা শহরটা ততক্ষণে সতর্ক হয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! ভয়ঙ্কর আওয়াজ! কাঁপুনি দিয়ে পায়ের নীচে মাটি যেন দুফাঁক হয়ে গেলো!

বালির খেলাঘরের মতো ঝুরঝুর করে খসে পড়লো নাসিমাদের ষোলো তলার বিশাল ইমারত – ‘শোরেউক টাওয়ার’!

তখনই একটা আর্ত চিৎকার – আলায়েনের! বিস্ফোরণের সাথে সাথে ভাঙা রাবিশের টুকরো, বড়ো বড়ো পাথরের ঢেলা অনুভূমিক ছুটে এসেছিলো গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ওরা যেখানে খেলছিল।

একটা ট্রমাতে হতভম্ভ হয়ে পড়েছিল মেয়েটা! কিছুক্ষণ পরে দুহাতের কনুইতে ভর দিয়ে নাসিমা মাথা তুললো। দেখলো, ওর দোস্ত আলায়েনের শরীরটা জমিতে উপুর হয়ে পড়ে আছে। মাথা দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। নাসিমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর খেলার সাথীর হাত ধরে টানলো। একটু কেঁপে উঠে ফ্লোরে শুয়ে থাকা আলায়েনের শরীরটা স্থির হয়ে গেল।

প্রচন্ড উত্তাপে নাসিমার শরীরটা ঝলসে যাচ্ছে। রাস্তা দিয়ে লোকগুলো পালাচ্ছে। ওদেরই একজন দেখলো গ্রাউন্ডফ্লোরের মেঝেতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আর পাশেই একটা ঘুমন্ত বালকের রক্তাক্ত শরীর! লোকটা ভীতার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো। অচেনা আঙ্কেলটার হাতের স্পর্শ নাসিমার কাঁধে – ‘হেই লেড়কী, ভাগ্‌ ভাগ্‌ হিয়াসে! আবার বোমা পড়বে- মারা পড়বি।’

আলায়েনের দেহটাকে জমিনে একেলা ফেলে রেখে নাসিমা দিকশূন্যের মতো বেরিয়ে এলো বিল্ডিংটার পেভমেন্ট থেকে। কয়েক কদম এগোনোর পর নাসিমা বুঝতে পারলো তাদের নিজস্ব ফ্লাট সহ পুরো ‘শোরেউক টাওয়ার’টাই বসে গেছে। কোথায় তার আম্মু আর আব্বু? সে কিভাবে নিজের ঘরের দিকে ফিরে যাবে? সেখানে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে! তাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার রাস্তা জুড়ে ভাঙ্গা বিল্ডিংটার ডাউস আবর্জনা, ডেবরিস। মাথা উচু করে তাকালেও ফ্লাটের কোনো ব্যালকনি, জানালা কিছুই দেখা যাচ্ছে না! শুধু ধোঁয়া আর ধূলোতে ঢাকা একটা নোংরা আকাশ! যেন নাসিমা অন্য কোন একটা অচেনা শহরে হারিয়ে গেছে। ছুটন্ত মানুষদের ভীড়ে আবার মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেলো। নিজেদের ধ্বসে যাওয়া বিল্ডিংটার অদূরে দাঁড়িয়ে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগলো!

সমস্ত লোক সামনের দিকে ছুটছে। নাসিফা আবার দৌড় শুরু করলো।

অল্প কিছুক্ষণ ছুটবার পর ক্লান্ত হয়ে ও একটা ল্যাম্পপোষ্টের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লো। একজন দোকানদার সাটার বন্ধ করছিলো। সে তার বোতল থেকে ঢক্‌ ঢক্‌ করে জল গিলছিল। নাসিমার তেষ্টা পেয়েছে। তাকিয়ে তাকিয়ে সে দেখছিল ঐ লোকটার জল খাওয়া।

দোকানদারটা জল খাওয়া থামিয়ে নজর করলো। একলা দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটাকে! পরনে হাফ স্কার্ট। গায়ের গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে গেছে। মেয়েটা ড্যাব ড্যাব চোখে গিলছে দোকানদারের হাতে ধরা জলের বোতলটাকে।

‘কি দেখছিস? আকাশ থেকে বোম পড়েছে! আরো পড়বে! আমাদের গাজার শহরগুলোয় ইজরায়েলী মিলিটারিরা ঢুকে পড়েছে। তোর সাথে আর কে কে আছে?’

মেয়েটার মুখে কোন কথা নেই।

‘জল খাবি?’

নাসিমা মাথা নাড়লো! অচেনা মানুষটার হাত থেকে বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল গিললো।

‘বাড়ি কোথায়?’

‘শোরেউক টাওয়ারে! আম্মু আর আব্বুকে খুঁজে পাচ্ছি না! আমাদের বাড়িঘর আগুনে জ্বলছে!’

‘তোর বাবা-মা নিশ্চয়ই আগে আগে গেছে। একতালা স্কুল বাড়িতে শেলটার নিতে পারে। সামনে এগিয়ে যা, খুঁজে দ্যাখ। এই নে!’ দোকানদার আঙ্কেল হাতের থলে থেকে একটা ছোট্ট প্যাকেট মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো- ‘খিদে পেলে খাস! দেখছিস না? সবাই পালাচ্ছে। এখান থেকে জলদি ভাগ। সামনে স্কুল বাড়িটাতে বা অন্য কোথাও শেলটার পেলে ঢুকে পড়িস! যে কোনো মুহূর্তেই আবার বোমা পড়তে পারে!’

নাসিমা রাস্তায় নেমে সামনের দিকে আবার ছুটতে শুরু করলো। সে জানে না কোথায় তার নিরাপদ শেলটার। একটু আগে দেখা বীভৎস দৃশ্যগুলো সে তার মাথা থেকে মুছে ফেলতে পারছিল না! নাসিমার দুচোখ জলে ভরে এলো। মুহূর্তেই ও দাঁড়িয়ে পড়লো রাস্তায়।

তার পেছনে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল একজন বয়স্কা আন্টি। এই ফর্সা ফুটফুটে মেয়েটাকে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে জোরালো গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো - ‘এই মেয়েটা, কাঁদিস না মা! আমাদের মেডিটারিয়ান সী-তে আগুন লেগেছে! প্রাণে বেঁচে থাকলে সব কিছুই ফিরে পাবি। এখান থেকে সামনের দিকে পালা!’

নাসিমার মনটা তখনো পেছনে। যেদিকে ওদের শোরেউক টাওয়ার।

এতক্ষণে সে প্রায় দু কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে। সামনেই দেখা যাচ্ছে ওদের প্রাইমারী স্কুলটা। সামরিক সতর্কতা হিসেবে প্রায় এক সপ্তাহ আগেই বাচ্চাদের স্কুলটাকে নোটিশ দিয়ে তালাবন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সামনের গেটে তালা ঝুলছে। তখনও কিছু লোক স্কুলের গেট আর উচুঁ পাঁচিল টপকে একতালার ছোটো ছোটো ঘরগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে।

রাস্তায় মানুষগুলো সামনের দিকে নিরাপত্তার জন্যে ছুটছে। এদেশে কোন আশ্রয়টাই বা নিরাপদ?

রাস্তার ছুটন্ত সেই সব লোকগুলোর হঠাৎ কানে এলো - ঝক্কর ঝক্কর শব্দ। অনেক দূর থেকে একটা ট্যাঙ্কার শুঁড় উঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তেই রাস্তাটা আবার ফাঁকা। মানুষগুলো দোকান, পিলার, ঘরের দেয়াল, চৌবাচ্চার পেছনে। যে যার মতো জায়গা খুঁজে নিয়ে এদিকে ওদিকে লুকিয়ে পড়ছে।

সামনেই বিপদ, এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা খোলা নেই। ভয়ংকর একটা অবস্থা! আরো কয়েকজনের সাথে নাসিমা ডান দিকের একটা সরু রাস্তা ধরে টার্ণ নিলো। ধ্বসে যাওয়া দুটো বাড়ির ভগ্নস্তূপের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে। রাস্তাটার উপর পড়ে রয়েছে ইট, পাথর, ঘরের আধা-পোড়া সরঞ্জাম। এই সব উত্তপ্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নাসিমা ছুটছে। পাথর রাবিশ আবর্জনার উঁচুনীচু ঢাই তার চপ্পল ভেদ করে দু’পায়ের পাতাদুটো পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাটিতে নিভে যাওয়া আগুনের উত্তাপ। তার স্কার্টের নীচের দিককার অনাবৃত চামড়া আর মিহি পশমগুলো যেন এক্ষুনিই ঝড়ে পড়বে! এই উত্তাপ আর ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে সামান্য একটু এগোলেই, ওই তো দেখা যাচ্ছে পরিস্কার একটা মাঠ।

মাঠটা পেরিয়ে নাসিমা উঠে এলো আরেকটা মাঝারি সাইজের কংক্রীটের রাস্তায়। তার বাড়ি থেকে সে দৌড়ে দৌড়ে কতদূর এসে গেছে কে জানে? ও বসে একটু জিরিয়ে নিলো। এই রাস্তাটা পরিস্কার। দেখা যাচ্ছে দূরে একদল লোক। ওরা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের পেছন পেছনে আবার হাঁটা শুরু করলো নাসিমা। মাঝে অনেকটাই দূরত্ব। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় ঘেমে যাচ্ছে মেয়েটার শরীর। এই রাস্তার দুপাশে, এদিক ওদিকে ভাঙা ঘর বাড়ি।

হাঁটতে হাঁটতে নাসিমার মনে পড়ে গেল একে একে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো! একটা গুঁড়িয়ে যাওয়া ইমারত, তাদের ফ্লাটবাড়ী, টাওয়ারটা! তার নিত্যদিনের খেলার সঙ্গী আলায়েনের নেতিয়ে পড়া শরীরটা!

নাঃ, নাসিমা আর ভাবতেই পারছে না। ওর বেশ ক্ষিধে পেয়েছে। তার হাতে ধরা দোকানদার আঙ্কেলের দেয়া কেকের ছোট্ট প্যাকেটটা।

কত বেলা হলো? শহরের সমস্ত ঘড়িগুলো হয়তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। বেশ কিছুদিন এইসব এলাকায় লাইট আর জল আসবে না। কয়েকমাস আগেও তো ইজরাইলের এরোপ্লেন তাদের পাম্প হাউজ আর পাওয়ার হাউজে বোমা ফেলে গেছে।

সামনে লোকগুলোকে অনুসরণ করে নাসিমা ছুটে চলেছে। আর কতক্ষণ তাকে চলতে হবে?

তক্ষুনিই পেছন থেকে ওর কানে ভেসে এলো একটা গাড়ির শব্দ! ছুটতে ছুটতেই কৌতূহলবশত নাসিমা ঘাড়টা পেছনে ঘুরিয়ে নিল। চলন্ত ট্যাঙ্কারটা মাঝ রাস্তার উপর থেমে গেছে। ওটার ভেতর থেকে রাস্তায় নেমে পড়েছে উর্দি হেলমেট আর রাইফেলধারী একটা মিলিটারি।

উর্দিটা চেঁচিয়ে উঠলো – ‘ইয়েস গার্ল! গো ফরোয়ার্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ডোন্ট লুক বিহাইন্ড!’

নাসিমা কিভাবে পেছনে না তাকিয়ে থাকতে পারে? তার মনে হচ্ছে - পেছনে ফেলে আসা শোরেউক টাওয়ারটা তাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে! আলায়েন তাকে পেছন থেকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে। দূর থেকে সে শুনতে পাচ্ছে তার মায়ের গলার স্বর। মা তাকে ডাকছে, ‘নাসিমা, নাসিমা, কোথায় গেলি তুই?’

নিজের অজান্তেই মেয়েটার মাথা আর শরীরটা পেছনে ঘুরে গেলো।

আবার সেই উন্মত্ত মিলিটারীটার গর্জন – ‘ডোন্ট লুক বিহাইন্ড! ......ফায়ার!’

একটা মাত্র গুলির শব্দ!

আর্তনাদ করে নাসিমার শরীরটা রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। ছিটকে পড়লো এতক্ষণ হাতে ধরে থাকা তার হাতের কেকের প্যাকেটটা।

এই ভূমন্ডলের আরো অজস্র গোলাগুলির শব্দের মধ্যে এই মুহূর্তের শব্দটা উপরের ঘন বায়ুমন্ডলে মিলিয়ে গেলো।



#

সামনের রাস্তাটা একদম ফাঁকা। মিলিটারির ট্যাঙ্কারটা নাসিমার রক্তাক্ত দেহটাকে অবহেলায় পাশ কাটিয়ে অনেকটা দূরে মিলিয়ে গেছে।

পাশেই একটা মৃত মহাবৃক্ষ - সেখান থেকে উড়ে এলো দুটো পালক খসা জীর্ণ কাক। ওরা মেয়েটার রক্তাক্ত দেহটার কাছেই রাস্তায় পড়ে থাকা কেকটার পাশে বসলো।

কাকদুটো দেখলো – এইমাত্র নাসিমার গোলাপী প্রাণবায়ুটুকু আকাশে উড়াল দিচ্ছে!

আকাশে উড়াল দিতে দিতে ছোট্ট ন’বছরের নাসিমা কালো বোরখাতে মুখ ঢাকা একজন মুসলিম তরুণী হয়ে যাচ্ছে। মর্তলোক থেকে নাসিমাকে আকাশে উঠে আসতে দেখে আলায়েনের আত্মাটা এইমাত্র জীবিত হয়ে উঠলো। মুহূর্তেই সে ইহুদী পোষাক আর টুপিতে নিজেকে সুসজ্জিত করে নিলো। আলায়েন এখন আর সেই দশ বছরের বালক নয়। ভূমধ্যসাগরের লোনা হাওয়ায় সে একজন শান্তি প্রত্যাশী প্যালেস্টাইনী পুরুষ!

ধোঁয়াভরা আকাশটা। আলায়েন তার হাতের প্রিয় গোলাপ ফুলটাকে নাসিমার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। নাসিমাকে বলছে – ‘শুনবি না? বাবা-মা’দের সেই সিক্রেট গল্পটা?’

যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলে চলছে বোমারু বিমান আর হানাদারদের গোলাগুলি শব্দ! তারই মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় হাওয়ায় হাওয়ায় জাতিহীন বর্ণহীন ভেসে ভেসে চলছে একজন বালক আর একটা বালিকার সদ্য-নিষ্ক্রান্ত আত্মার কিছু আন্তরিক সংলাপ। তাদের সেইসব প্রেমময় সংলাপ, বিস্তীর্ণ পৃথিবীর মানুষ, তোমরা কি কিছুই শুনতে পাচ্ছো না?

0 comments: