ছোটগল্পঃ অপর্ণা গাঙ্গুলী
Posted in ছোটগল্প
অনুপমা বোধ নিকেতন
অপর্ণা গাঙ্গুলী
'বলি অ অনুদি, অনুদি গো, এই দেখো, তোমার কাছে কারা এয়েচে l' পথের স্যালনে হেয়ার স্টাইল করা পুরুষ-ছাঁট মাথাটি তোলেন অনুদি .... 'কে রে ?' বাঁকাচোরা চশমাটি নাকের ডগায় বেশ করে বসিয়ে নেন, আর তারপরেই চোখে মুখে ফুটে ওঠে চেনার আভাস l
'অ তোরা, তা এদ্দিন বাদে দিদির কাছে যে ! কি মনে করে ?'
অনুপমা দস্তিদার l স্টেশন চত্তরে সব্বার অনুদি l কবে যে এই বরানগর স্টেশনে এসে ঘাঁটি গেড়েছিলেন বলা মুশকিল l এমন কি প্রায় ফসিল হয়ে যাওয়া আমিনা বিবি, সেও পর্য্যন্ত এসে ইস্তক অনুদি কে দেখছে l অনুদির নির্দিষ্ট জায়গাটি বদল হয়নি কোনো ভাবেই l শোনা যায়, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, এবং বউ, বিয়ের কিছু পরেই দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারান আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নাকি প্রায় জোর করেই বের করে দেন অনুদিকে, অলক্ষ্মী, অপয়া অছিলায় l ভাইদের সংসারেও ঠাঁই হয়নি অনুদির l আর সেই থেকেই ওই স্টেশন তাঁর ঘর বাড়ি l জীবনের উপর, আত্মীয় বন্ধুর উপর, তীব্র এক নির্জন অভিমানে তিনি আপন করে নিয়েছেন বিশ্ব সংসারকে l যার আপন কেউ নেই, তার সারা বিশ্ব আছে, এতে বিশ্বাস রাখেন অনু দি l ট্রেনের হুইসিল শুনে তাঁর ঘুম ভাঙ্গে, ঘুমুতে যান ট্রেনের 'স্বপ্নে আছ, স্বপ্নে বাঁচ, স্বপ্নে আছ, স্বপ্নে বাঁচ' শুনতে শুনতে l
এমনও হয় বইকি l তাই, দমে থাকার পাত্রী অনুদি নন মোটেই l
দিব্য চালান তাঁর প্রায় একলার স্টেশন-সংসার l প্রায় একলা বলছি কারণ অনুদির এক পুষ্যি আছে, শামিম l মা বাপের অপকম্মের শিকার, ফেলে দিয়ে যাওয়া এক ছেলে l মালতী আর তার স্বামী বুকে করে নিয়েছিল শামিম কে, বলেছিল, আর চারটে যদি খেতে পায়, এও পাবে l আর সঙ্গে সঙ্গে, অনুদি নিয়ে ফেলেছিলেন এই ছেলের পড়াশোনার ভার l আর নেবেন নাই বা কেন, এই বয়সেও ছাত্র পড়ান অনুদি l ওই যে বললাম না, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে, বউ, অনুদি, পড়াশোনায় ভালো ছিলেন l তাই ছেলে পড়িয়ে একটা পেট চালিয়ে নেন ঠিকই l
স্টেশনের কাছেই অনুদির শ্বশুর বাড়ি, ও রাস্তা মাড়ান না তিনি, বহুদিন l ওরা খবর নেয় না l পাগলী এক ননদ ছিল, সে মাঝে মাঝে আসত, দু দশ টাকা তাকে দিতেন অনুদি, খাবার কিনে খেতে l সে পাগলীও কয়েক বছর হলো মারা গেছে, খবর পেয়ে কষ্ট পেয়েছিলেন অনুদি l তা, আজ চলেছেন টুক টুক করে এক নম্বর বস্তির দিকে l মাথায় ছাতা, চড়াই পাখির মত ছোট্ট খাট্ট মানুষটি l ওখানে আছে বিল্টু আর সবুজ, দুই বিচ্ছু, অনুদির দুই ছাত্র l পঞ্চাশ, একশ যা দেয় ওদের বাবা মায়েরা তাই নেন তিনি, হাজার হোক, ওদের খাটনির পয়সা, অভাবের সংসার l আরো আছে হারান, মণিকা, সোনামণি, কমল, অমল, ওদের পড়ান, সকাল বিকেল, অন্য অন্য দিনে l এরা সবাই ওঁর চোখের মনি, কণ্ঠের হার আর অনুদি ওদের বড় আদরের, বড় আবদারের শিক্ষিকা l
হাঁটেন অনু দি, লাঠি ঠুক ঠুক, গ্রীষ্মের খরতাপে l আর ঠিক তখনই, উল্টো দিক থেকে শামিম এসে পড়ে তরবড় করে, এই এত্ত কাগজ কুড়িয়ে নিয়ে l সকাল সকাল ইস্কুল যাবার আগে ওই কাজটা করে শামিম l বাপ আকবর কে সাহায্য করার জন্যে l যা দু পয়সা পাওয়া যায় l আর পরিষ্কার কাগজ হলে তুলে রাখে তার অনুদির জন্যে l হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে শামিম, 'এই দেখো অনু দি, আজ একটা ম্যাগাজিনও তুলেছি, তোমার ভালো লাগবে, নয় গো ?' 'বেশ বেশ,' বলেন অনুদি, ছেঁড়া জীর্ণ ব্যাগের থেকে পাঁচটা টাকা বের করে দেন ছেলের হাতে l বলেন, 'যা বিজয়ের থেকে চা মুড়ি খেয়ে নে, ওকে বলা আছে l' দু আঙ্গুল মুখে দিয়ে জোরে একটা সিটি মারে শামিম আর তারপরই, চোখটা চিকচিকিয়ে বলে ওঠে, 'তোমার কাগজগুলো তোমার ঝোলায় রেখে দেব, অনু দি,' বলেই সাঁ সাঁ করে দৌড় দেয় স্টেশনের দিকে l
আহা খিদে পেয়েছিল, সস্নেহে বলে ওঠেন বৃদ্ধা মানুষটি l
ইদানিং আর অনুদি রান্না বাড়ার পার্ট রাখেন না l মালতি দু মুঠো দেয়, দু বেলা পড়িয়ে এসে মুখে দেন l মালতীকে ভালোবেসে, ধৈর্য্য ধরে, সই করতে শিখিয়ে দেন l আমিনা বিবিকেও l আর যত রাজ্যের ছেঁড়া সেলাই নিয়ে বসেন দুপুরে l কার জামার হুক নেই, বোতাম নেই, ছিঁড়ে গেছে, সব নিপূণ হাতে জুড়ে দেন অনুদি l আর ভাঙ্গা মন ! সেও কি কম জুড়েছেন এ যাবত ? সবাই এসে তাঁর কাছে দুটো কথা বলে শান্তি পায় l মনের দগদগে ঘায়ে জম্পেশ মলম লাগাতে পারেন যে তিনি l বলেন, 'আমাকে দ্যাখ তোরা, নিচে মাটি আর উপরে আকাশ, এই নিয়ে কত সুখে বাঁচি l' মালতী, কালী, আমিনা, হাসীনারা হাসে, 'তোমার মত হতে পারলুম কই দিদি, হলে তো বেঁচেই যেতুম l' আর একটি অদ্ভূত প্রবণতা অনুদির l একখানি বড় মার্কিনের কাপড়ে, রংবাহারি সুতোয় সেলাই করে লিখে রাখেন কিছু কথা, ডায়েরির মতন, এও এক নেশা l পরে অবসর সময়ে ভাঙা চশমা বের করে সেগুলি পড়তে বসেন l
অনুদি, মেয়ে, বৌদের স্টেশনে বসে খবরে কাগজ পড়ে শোনান l কোথায় ঝড় ঝাপটায় কত লোক মরলো, কোথায় খরতাপে প্রাণ হারালো কোনো গাড়ির চালক, কোন সিনেমার হিরোইন বিয়ে করে ফেলল কোন তারকা কে, কোন মানুষ প্রতিবাদী সত্যি কথা লিখল বলে মরতে হলো তাকে, এই সব সাত সতের খবরাখবর। আর হায় হায় করে ওঠে মেয়ে বউরা, 'কি যুগই পড়ল, গো l' অনুদি তাঁর ছোট ছোট চুলের কদম ছাঁট মাথাটি নাড়ান, টুকুর টুকুর হাসেন, 'তবে? ভালবাসা হলো সার বস্তু, খালি ভালোবেসে যাও সবাইকে, ঘৃণা আসলেই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে l এইটুকু তো সহজ কাজ মানুষকে ভালবাসা, সৎ কাজ করা, এ আর এমন কি !' কি বোঝে মেয়েরা জানা নেই, তারা সমস্বরে মাথা নাড়ে l আবার পরদিন, জল তোলা নিয়ে, ছেলে মেয়ে নিয়ে, স্বামী সংসার নিয়ে কোন্দল পাড়ে তারা আর অনুদিকে সালিশী মানে l আবার অনুদি তাঁদের বোঝান, শুভবোধ আনেন তাদের মধ্যে, মিলমিশ করিয়ে দেন, একটুকু বিরক্ত না হয়ে l কিছুদিন পরে, আবার সেই এক চর্বিত চর্বন l
এই ভাবেই মন্দাক্রান্তা ছন্দে চলতে থাকে বরানগর স্টেশনে, অনুদির লাল নীল সংসারের দিনগত কাব্যকাহিনী l
তা সেদিন হলো কি, হঠাৎ দুইজন ভদ্রলোক অনুদির নাম করে স্টেশনে খুঁজতে এলো l শামিম ওদের নিয়ে আসে l অনুদির ভাইয়েরা l চার ভাইয়ের এক বোন তিনি l ওরা থাকতেও অনুদি যে কেন কষ্ট করে স্টেশনে থাকেন, বুঝেই নেওয়া যাক l ওদের দেখেই এক ডাকেই চিনেছেন অনুদি, বহুদিন পর হলেও l বাড়ি পার্টিশন হবে, অনুদি যেন নিজের জায়গাটুকু ওদের নামে লিখে দেন l অনুদি কিন্তু এতে প্রমাদ গুনলেন l মানুষের ভালো চান বলেই, তিনি নরম মানুষ তো নন মোটেই l তা কেন দেবেন অনুদি ? কি আনন্দে ! বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদের পর, অনুদি দাবী করেন তাঁর একতলার একটি ঘর ও কলতলা l সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ট্যাক্স এর এক ভাগ তিনি দিয়ে দেন l জীর্ণ সুটকেসের ভেতর রাখা একটা ছোট বালিশের ভেতর থেকে, বেরোলো টাকা, বাকিটা পোস্ট আপিসের এক বহু পুরনো বই থেকে l অবাক হননি কেউই, তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় l স্টেশনের মেয়ে মধুর বিয়েতেও সাহায্য করেছেন অনু দি, যত্সামান্য, যা পেরেছেন।
ওরা ইচ্ছে করলেই অনু দিকে ফাঁকি দিতে পারত না, কারণ আইনের হাত বড় লম্বা, সবার সই ছাড়া পার্টিশন দু:সাধ্য ছিল l ওরা সেই সই নিতেই এসেছিল, বেঁকে বসলেন অনুদি, ন্যায় তাঁর কাছে বড় ব্যাপার আর কাগজ পড়ে পড়ে তাঁর সম্যক জ্ঞান রয়েছে l ওই ঘরটিতে তাঁর অধিকার, তাঁর বাপ পিতেমোর ভিটেতে মেয়েদের সমান অধিকার, জানেন অনুদি l তিনি পাড়ার দু:স্থ বালক বালিকা, যারা পড়তে পারে না, তাদের পড়ার ব্যবস্থা করবেন, তাঁরা সন্ধ্যাবেলা সেখেনে পড়বে, স্টেশনের আলোতে, রাস্তার আলোতে, আর তাদের পড়তে হবে না l শুভ বোধের চিন্তন গঠন করবেন অনুদি তাঁদের মধ্যে l স্বপ্ন স্বাকার হতে চলেছে বলে দু হাত মাথায় ঠেকিয়ে অনুদি প্রণাম জানান অদৃষ্টকে l কোথায় যেন পড়েছিলেন তিনি, স্বপ্ন দেখতে হলে স্বপ্নে বিশ্বাস রাখতে হয় l তাই তো করেছেন অনুদি, সারা জীবন তিলে তিলে বুকের অন্তরমহলে, সেই নরম সরম পারাবত স্বপ্নটাকে জিইয়ে রেখেছিলেন এতদিন ধরে l একটা ছোট জায়গা, যেখানে ছেলেমেয়েরা বাড়ির অশান্তি ভোগ না করে নিরিবিলিতে বই পড়বে, ভাবের আদান প্রদান করতে শিখবে, শুভ মনন গঠিত হবে তাদের l
'তুমি ওখেনে থাকবে? না অনুদি? এত দিনে তোমার স্টেশনে থাকার কষ্ট গেল গো l' বলে ওঠে মালতী l
কাগজে বেরোনো একটি কার্টুন দেখে কুল কুল করে হাসেন অনুদি l
তারপর কেমন উদাস হয়ে যান l আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন, 'না রে, এই খোলা আকাশটাকে না দেখলে, ঘুম আসবে না আর আমার l তোদের ছেড়েও মন টেঁকে না l'
কিছুদিন পর, কাগজ পত্র হাতে আসে অনুদির l বোর্ড লাগে দরজার বাইরে l
শামিম পেরেক ঠোঁকে, কাঠের বোর্ডের পর, সোনার আল্পনায় লেখা 'অনুপমা বোধ নিকেতন' l
আর পাড়ার লোকেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে l কেউ কেউ অবশ্য বলে, ঢং !
একটু পরে, দুপুরে নিরিবিলিতে যখন ডায়েরি সিলোবেন অনুদি, হয়ত বা পরম যত্নে তুলে রাখবেন তাঁর স্বপ্নপূরণের উপাখ্যানটিও l
0 comments: