0

অণুগল্পঃ পলাশ কুমার পাল

Posted in

অণুগল্প




নির্বাক
পলাশ কুমার পাল



‘সোনা দুধটা খেয়ে যা! আয় বাবা! আয়’ -প্রতিমার ডাকে অহম সাড়া দেয়। অনেক আদরের এই অহম। বয়স মাত্র চার বছর। দুষ্টুমিতে মাকে অস্থির করে তোলে। একমাত্র পুত্র সন্তান। তাই মা আদর করে 'সোনা' বলেই ডাকে। একলা দেয়ালবন্দি জীবনে প্রতিমার একমাত্র সঙ্গ অহম। স্বামী অধীরবাবু একটি স্কুলের শিক্ষক। সকালে বেড়িয়ে যায়, সন্ধ্যায় ফেরে। সারাদিন প্রতিমা অহমের সহচর্য ও লেখনীতে ডুবে থাকে। কিছু লেখাও বেড়িয়েছে নামিদামী পত্রিকায়। বিশেষ করে সমাজ নারীর অবস্থান বিষয়ক প্রবন্ধটি খুবই জনপ্রিয়। এতকিছুর মাঝেও কিছু শূন্যতা তাকে আড়াল করতে চায়।

অহম ছুটে আসে রেলিঙের কাছ থেকে। শহরের দেয়ালে দেয়ালে চাপা পরা শৈশবের একটুখানি খোলা ঠিকানা ঐ রেলিঙ।যার সামনে একটু ফাঁকা পরিসর, দত্তবাবুদের উঠোন। সাবেকী আমলের সম্পত্তি বলে ঘিঞ্জি শহরেও তাদের খোলামেলা স্থান।

‘কী করছিলিস এতক্ষণ?' দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে প্রতিমা জিজ্ঞাসা করে।

‘মা! জানো, অমি পুতুল নিয়ে কি সুন্দর খেলছে।' দুধ খেতে খেতে অহম বলে।

আমিও তোকে একটা ওরম পুতুল কিনে দেব। তখন তুইও ওর মতো খেলবি!'

‘কিন্তু ও তো ওর বোনের সঙ্গে খেলা করে। আমার তো বোন নাই!..' মায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরে।

বেশ! তোর জন্য একটা বোনও এনে দেব!.....', বলেই প্রতিমার মুখটা চুন হয়ে যায়। হাতের গ্লাসটা পরে যায়। অবশিষ্ট দুধটুকু ছিটকে পরে মেঝেতে। অহম বলে ওঠে, 'কি হলো মা?'

প্রতিমা একটা রঙীন বল অহমের দিকে এগিয়ে দেয়- 'যাও সোনা, তুই বলটা নিয়ে খেলা করগে যা!'

কথার মধ্যিখানে আড়াল তুলতে চায়। তারপর গ্লাসটা তুলে ভিজে কাপড়ে দুধটা মুছে নেয়। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চায়। তবু বারবার ছেলের করুণ স্বর ভাসে 'আমার তো বোন নাই!' নিজেই নিজের কাছে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে যে খুনী। ভবিষ্যতের নিরাপত্তার খোঁজে অহমের দুটো বোনকে সে গর্ভেই নষ্ট করেছে। মেয়ে হলে তো বিয়ের পর দূরে থাকবে। তাই ছেলেই ভালো। অহমের বাবারও ইচ্ছা ছিল পুত্র সন্তানের। যাকে অতিযত্নে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে উপার্জনী করে তুলবে। আর বৃদ্ধ বয়সে সে তাদের দেখাশোনাও করবে। সমাজের আর সকলের মতো এই একটুকরো পরিবারের কামনা ছিল এটাই।

টিকটিক শব্দে টিকটিকি ডেকে ওঠে। প্রতিমা ন্যাগরা ফেল হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢোকে। আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে একটু গোছায়। আবারও অহম ছুটে এসে মায়ের হাত ধরে- 'কবে বোনকে এনে দেবে? বলোনা!' একটু থতমত খায় প্রতিমা। এলোমেলো আঁচলটা গুছিয়ে নেয়। 'এনে দেব , সোনা!', বলেই আয়নায় একবার নিজেকে দেখে। সেও তো একদিন নারীদের প্রতি সমাজের অবহেলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল। লেখনীতে নিজেকে জাহির করেছিল বীরঙ্গনা নারীরুপে। অথচ তার ইচ্ছাতেই গর্ভপাত! পর্দার আড়ালে ফেলে আসা অতীত জেগে ওঠে স্পর্ধা ভরে। আর দর্পণে চিনতে পারে না নিজেকে। সামাজিক ছোঁয়াচে রোগে সেও মুখোশ। মা হয়ে কোনোদিনই সে তার সন্তানকে সন্তান হত্যারকথা বলতে পারবে না। এক নিষ্ঠুর সত্য মিথ্যার গভীরে তলিয়ে থাকবে চিরকাল। বাস্তব-ঘোমটার আড়ালে পৈশাচিক সত্যের অলংকার ঢেকেই থাকে। প্রতিমা অন্তরে দগ্ধ হয়। নিঃসঙ্গতার কারণ আজ সে খুঁজে পায়।

কলিং বেল বেজে ওঠে। প্রতিমা দরজা খোলে। অধীর ঘরে ঢুকেই ব্যাগ রেখে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে। ব্যাগ থেকে ব্যাটবল বেড় করে বলে, 'জানিস, তোর জন্য আজ কি এনেছি? এই দেখ!'

ব্যাটবল দেখে অহম খুশী হয়- 'ভালোই হয়েছে! বোন আসলে, আমরা দুজনে এই ব্যাটবল খেলব!'

অধীর অবাক হয়- 'বোন?'

হ্যাঁ, মা তো বলেছে আমায় একটা বোন এনে দেবে! খুব মজা হবে। তাই না বাবা?'

অধীর আলতো করে ঘাড় নেড়ে নির্বাকচোখে প্রতিমার দিকে তাকায়। অহমের আত্মহারা খুশীর অগোচরে চার চোখের মুকাভিনয় হয়ে যায়। পাশেই রান্নাঘরের মেঝেতে একটা পিঁপড়ে কতগুলো মরা-পিঁপড়কে ঠোকরায়।

0 comments: