3

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক 



বানরায়ণ, পর্ব ৭
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়





সৈন্যশিবিরের দ্বিতীয় দিনে বুঝতে পারলাম কেন এদের এরকম রীতিনিয়মহীন ভাবে শিকার করতে হয়। এখানকার যেটা সব চাইতে উপভোগ্য ব্যাপার, সেটা হলো খাওয়াদাওয়া। এই সব খাবার আমরা কস্মিনকালে খাইনি। কত রকমের যে মাংস, তার ইয়ত্তা নেই। হরিণ, বনবরা, বনকুঁকড়ো, ময়ূর, গোরু, মোষ, ভেড়া, ছাগল... যার যেমন পছন্দ, যার যেমন রুচি খাও। যেমন তাদের স্বাদ, তেমনি তাদের খোশবাই! কি যে মশলা দিয়ে তৈরি, কে জানে? সঙ্গে যে চালের ভাত, তেমন চাল আমরা চোখেও দেখিনি কখনও। সাদা ধবধবে, আর কি সুগন্ধ। প্রত্যেকটা ভাতের দানা আলাদা করে ফেলা যায়। সঙ্গের অন্যান্য নিরামিষ পদগুলোও অনবদ্য!

যারা কিছুদিন আগে থেকে আছে শিবিরে, তারা বলছিলো এরা যেমন খাওয়ায়, তেমনি খাটায়। সেটাও দ্বিতীয় দিনই টের পেলাম। ভোর থেকে উঠেই শুরু হয়ে গেলো ব্যায়াম। প্রথমে দৌড়, লাফ, গাছ বাওয়া। তাতে তো আমার মহা ফূর্তি। সবার আগে আগে ছুটে, লাফিয়ে, গাছের মগডালে চড়ে আবার তরতর করে নেমেও এলাম, অনেকে গাছ অবধি পৌঁছনোরও আগে। পরিদর্শকদের কাছ থেকে বাহবাও পেলাম।

কিন্তু তারপর যেটা আরম্ভ হলো, সেটা আমার পক্ষে রীতিমতন কষ্টকর। এদের ভাষায়, অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ। যে যেমন অস্ত্রে স্বচ্ছন্দ, তাই নিয়ে অনুশীলন। আমার সমস্যা হলো, আমি কোনও অস্ত্রেই খুব একটা পটু নই। একটু আধটু তীর ছুঁড়তে জানি। আমার শরীরে যতটুকু শক্তি, তাতে বর্শা খুব বেশি দূরে যায় না। আর বাদবাকি যা সব নতুন অস্ত্র এরা দিচ্ছিলো, সে সব আমার ব্যবহার করার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ সেগুলো চালাতে প্রচুর শক্তি প্রয়োজন। তবে সেই সব অস্ত্রের মধ্যে কয়েকটা আমার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। আমরা সাধারণত যে কাঠ বা পাথরের অস্ত্র ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, এগুলো তা দিয়ে তৈরি নয়। কয়েকটা বর্শা দেখলাম, আমাদের বর্শার থেকে অনেক বড়, আর ফলাগুলো পাথরের নয়। কি যেন এক মসৃণ, চকচকে পদার্থ দিয়ে তৈরি। দেখেই বোঝা যায় পাথরের থেকে ধার অনেক বেশি। আর কয়েকটা অস্ত্র দেখলাম, দেখতে অনেকটা আমাদের মাংস কাটার পাথরের ছুরির মতন। তবে আকারে অনেক বড়। প্রায় চার-পাঁচটা ছুরি লম্বালম্বি বসালে যত বড় হয়, তত বড়। সেই বর্শার ফলার মতন চকচকে মসৃণ বস্তু দিয়ে তৈরি। দেখেই বোঝা যায়, ফলাটা অসম্ভব ধারালো। তখনও জানতাম না, একে বলে অসি। আর যা দিয়ে ওই বর্শার ফলা আর এই অসি তৈরি, সে পদার্থ জাতে ধাতু। তার নাম ইস্পাত।

ওই সব অস্ত্র অবশ্যই আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছিলো না। ওগুলো যাদের হাতে ছিলো, তারা প্রশিক্ষিত সৈনিক। আমাদের দেওয়া হয়েছিলো কাঠের তৈরি ছোট ছোট অসির সংস্করণ। সেই অসি নিয়ে আমি মাহারুর সঙ্গে খানিকক্ষণ ছদ্ম যুদ্ধ করার পর বুঝতে পারলাম, এ জিনিস আমার জন্য নয়। মাহারুর শরীর আমার চেয়ে বড়, গায়ে জোরও আমার চাইতে ঢের বেশি। তার অসির ঘা গুলো যখন আমার গায়ে পড়ছিলো, ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছিলাম। মাহারুই একটু পরে বললো, ‘‘তুই যা ঋচিক। এ তোর কম্মো নয়।’’

এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে ব্যথার জায়গা গুলোতে হাত বোলাতে বোলাতে দেখলাম, মাঠের এক্কেবারে মধ্যিখানে যে লাল রঙের বিশাল তাঁবুটা, সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন এক বিরাটকায় পুরুষ। সঙ্গে আরও কয়েকজন আছে। তারাও নেহাৎ ছোটখাট নয়। কিন্তু ইনি যে তাদের সবার থেকে আলাদা, সেটা বলে দিতে হয় না। পোশাক-আষাক ছাড়াও চেহারা আর ব্যক্তিত্বেও স্বতন্ত্র। দেখলাম, ইনি বাইরে আসতেই সবাই কেমন তটস্থ হয়ে উঠলো। যারা অনুশীলন করছিলো, তারা আরও মনোযোগ দিয়ে করতে লাগলো। যারা পরিদর্শন করছিলো, তারা আরও সতর্ক হয়ে উঠলো।

আমরা নতুন লোক। কাউকে চিনি না ভালো করে। সেটা সবাই বুঝতে পারছিলো। তাই পাশ থেকে একজন নীচু স্বরে বললো, ‘‘ইনি সেনাধ্যক্ষ গবাক্ষ। এই শিবিরের কর্তা।’’

শুনে আমরাও তটস্থ হয়ে গেলাম। সেনাপতিরই এমন চেহারা, তো রাজা না জানি কেমন হবেন। সম্ভ্রমে মনটা ভরে উঠলো। যত পারি, যা পারি শিখে নিতে হবে এই সুযোগে, এই সব মানুষদের সান্নিধ্যে। অবশ্য আমাদের মতন চুনোপুঁটিরা এঁদের সান্নিধ্য কতখানি পাবে, সেটাই প্রশ্ন।



সেনাশিবির আমার ভালোই লাগছিলো। নিয়মিত ব্যায়াম, অনুশীলন, অস্ত্রাভ্যাস, প্রচুর গল্পগুজব, নতুন নতুন জিনিস জানা, আর এন্তার চর্ব্য-চোষ্য‌-লেহ্য-পেয়।

আমরা সৈন্যদলে যোগদান করার পর যে পাঁচ দিন শিবিরে ছিলাম, সেই পাঁচ দিনে অনেক কিছু জানতে পারলাম। জানতে পারলাম, বিন্ধ্যপাহাড়ের এপাশে, যেদিকে আমরা থাকি, সেই গোটা অঞ্চলটাকে এদের ভাষায় বলে দাক্ষিণাত্য। সেই দাক্ষিণাত্য যেখানে শেষ হয়েছে, সেই কুমারিকা থেকে শুরু অথৈ জলের পারাবার, সমুদ্র। সেই সমুদ্রের মাঝখানে রাবণরাজার লঙ্কাদ্বীপ। রাবণ যে সে রাজা নয়। তার ভয়ে গোটা দাক্ষিণাত্য কম্পমান। বিন্ধ্যের উত্তরে, যে জায়গাটাকে এরা আর্যাবর্ত বলে, সেখানেও তার প্রবল প্রতিপত্তি। সে জ্ঞানী, গুণী, প্রবলপরাক্রম যোদ্ধা। কিন্তু সে অত্যাচারী, নারীলোলুপ। বহু নারীর নাকি সে সর্বনাশ করেছে। বলাৎকার করেছে তাদের উপর।

এই ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝলাম না আমরা। কোনও মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সঙ্গমের জন্য তার উপর জবরদস্তি করা যায় নাকি? কই, অরণ্যের প্রাণীরা তো করে না এমন! আমরা তো তাদের চাইতে বুদ্ধিমান বেশি...

সে যাই হোক, একটা বেশ অদ্ভূত কথা শুনলাম। এই রাবণ নাকি কিষ্কিন্ধ্যার পূর্বতন রাজা বালীর বন্ধু ছিলো। দুজনেই মহাশক্তিধর, বলদর্পী। বালী আর তার ভাই, এখনকার রাজা সুগ্রীবের মধ্যে যে বিবাদটা কি নিয়ে হয়েছিলো, সেটা ঠিক বুঝলাম না। শুধু জানলাম, নির্বাসিত, অত্যাচারিত সুগ্রীবের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আরেক নির্বাসিত রাজপুত্র রামচন্দ্রের, এবং রামচন্দ্র বালীকে হত্যা করে সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজপদে প্রতিষ্ঠিত করেন। তারপর সুগ্রীব সেই সাহায্যের প্রতিদান দেন নিজের লোক পাঠিয়ে সীতাকে লঙ্কায় খুঁজে বার করে, এবং এখন সসৈন্য চলেছেন বন্ধুপত্নীকে উদ্ধার করার জন্য।

আরও শুনলাম, সীতার মতন আরও অনেক নারী নাকি বন্দিনী আছেন রাবণের অবরোধে। এতদিন কারও ক্ষমতা হয়নি তাঁদের উদ্ধার করে আনার। কিন্তু এইবার রাবণ বিরাট বড় ভুল করেছে। যাঁকে হরণ করেছে, তিনি নাকি স্বয়ং জগজ্জননী, ত্রিভুবনের প্রভু রামচন্দ্রের প্রাণপ্রিয়া সীতা। এই পাপেই রাবণের বিনাশ হবে। তার সোনার লঙ্কা ছারখার হবে... ইত্যাদি, ইত্যাদি।

কেন যে এরা বারবার রামচন্দ্রকে ত্রিভুবনের প্রভু বলছে, সেটা শুধু বুঝতে পারলাম না। অযোধ্যার নির্বাসিত রাজপুত্র, যিনি নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি, তিনি ত্রিভুবনের প্রভু? হবেনও বা হয়তো। আর্যাবর্তের সভ্য মানুষদের রীতিনীতি আমি কতটুকুই বা বুঝি?



শিবিরে তৃতীয় দিন একটা ঘটনা ঘটলো। বিন্ধ্যারণ্যের বহু গ্রাম, বহু নগর থেকে প্রচুর লোক এসেছে রাজকীয় বাহিনীতে যোগ দিতে। তারা কেউ কেউ সুসজ্জিত, বোনা কাপড়ের পোষাক পরা। আমাদের পরণে চামড়ার কৌপীন। বোনা কাপড় যে আমাদের গাঁয়ে কেউ পরে না, তা নয়। সর্দারের আছে একখানা। ঠাকুর্দারও আছে একটা। বচ্ছরকার দিনে পরে। কিন্তু ওই অবধিই। আর কারও নেই। তাই এই সব সাজগোজ করা সভ্য মানুষদের চোখে আমরা জংলী, অসভ্য।

তা, তাতে আমাদের আপত্তি ছিলো না। কারণ আমাদের মতনই বেশি। তাই দু’একবার ‘‘জংলী ভূত’’ জাতীয় কথা কানে ভেসে এলেও আমরা পাত্তা দিইনি। গণ্ডগোলটা হলো তৃতীয় দিন, রাতে খাওয়ার সময়। সেদিন আরও অনেক কিছুর সঙ্গে ছিলো সজারুর মাংস। সজারু মারা সহজ নয়, তাই এ মাংস দুর্লভ... এবং অতি সুস্বাদু। আমাদের জঙ্গলের মানুষদের খুব প্রিয়। তো সেই মাংস অল্পই ছিলো। আমাদের পাহান পেটুক মানুষ। প্রথম থেকেই নজর রেখেছিলো ওটার উপর। যখন নিতে গেলো, কোথা থেকে এক বোনা কাপড় পরা শহুরে বাবু এসে পট করে বাকি সবটা ঢেলে নিলো নিজের পাতে।

ব্যস! আর যায় কোথায়! পাহান পাগলা হলে কি হয়? চোখ-কান খুব খোলা। ও নিশ্চই খেয়াল করেছিলো, এই লোকটা ওই সব কথা বেশি বলে। এবার একেবারে চড়াও হয়ে গেলো লোকটার উপর। চিৎকার চেঁচমেচি, গালাগালির ফোয়ারা! মারামারি এই লাগে কি সেই লাগে! আমরা জঙ্গলের লোকরা অন্যের ঝগড়ায় খুব একটা মাথা গলাই না। জঙ্গলের সেই রকমই নিয়ম। কিন্তু যখন দেখলাম ও লোকটার সঙ্গে আরও কতগুলো কাপড় পরা লোক এসে জুটেছে, আর সবাই মিলে পাহানকে ঠ্যাঙানোর উদ্যোগ করছে, তখন আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম পাহানের পিছনে। অবশ্যই আমরা দলে ভারি।

ব্যাপারটা মারামারি অবধি পৌঁছলো না। তার আগেই লাঠিধারী পাথুরে মুখ পাহারাওয়ালারা এসে হাজির হলো। কিন্তু ততক্ষণে কাপড় পরা শহুরে বাবুরা এটা বুঝে গেছে, যে আমাদের ঘাঁটালে বিপদ আছে। এবং গোটা বিষয়টা যে শিবিরের কর্তৃপক্ষ খুব উদার মনে গ্রহণ করেনি, সেটা বুঝলাম পরের দিন সকালে। আমাদের সবাইকে কড়া ভাষায় সাবধান করে দেওয়া হলো। এর পর আর কোনও গোলমাল হলে তাতে জড়িতদের কঠিন শাস্তি হবে। সৈন্য শিবিরে শৃঙ্খলাই প্রথম এবং শেষ কথা, ইত্যাদি, ইত্যাদি...

সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হলো, পরের দিন শিবির গুটিয়ে ফেলা হবে এখান থেকে, এবং রওনা হওয়া হবে কুমারিকার উদ্দেশ্যে। পথে কিষ্কিন্ধ্যার উপকন্ঠে দু’দিনের বিরতি নেওয়া হবে। সেখান থেকে সোজা সমুদ্রের উপকূলে।

খানিকক্ষণ আগের বকুনি ভুলে উত্তেজনায় বুক কেঁপে উঠলো! সেই প্রথম অনুভব করলাম সুদূরের হাতছানি কাকে বলে। সামনে অজানা ভবিষ্যৎ। একা হলে হয়তো একটু ভয় করতো। কিন্তু আমাদের গ্রামের চিরপরিচিত মুখগুলোর পাশাপাশি আছে আমাদের নতুন বন্ধুরাও। এই দীর্ঘ যাত্রায় যে আমরা একে অন্যের ভরসা, সহায়, সে কথা গত রাত্রে্ প্রমাণ হয়ে গেছে। আর আমাদের ভয় কি? যা বিপদ আসবে, একসঙ্গে বুক চিতিয়ে মোকাবিলা করবো!

সে রাতেও উত্তেজনায় আমাদের কারও ঘুম আসলো না।








3 comments:

  1. কি অসম্ভব সুন্দর ডিটেলিং। যেন যুগটাই উঠে এসেছে...

    ReplyDelete
  2. সজারু আর ময়ুর ছাড়া আর সব মাংসই আমি খেয়েছি। কিন্তু এই "বানরায়ন" সে সবের থেকে অনেক বেশি সুস্বাদু আর উপাদেয় !!



    '

    ReplyDelete
  3. দু’জনকেই প্রচুর, প্রচুর ধন্যবাদ... বানরায়ণকে আরও উপভোগ্য করে তোলার প্রতিজ্ঞা রইলো।

    ReplyDelete