1

রম্যরচনাঃ অমিতাভ প্রামাণিক

Posted in

রম্যরচনা




একান্নবর্তী
অমিতাভ প্রামাণিক



কেন যে লোকে বলে, যাহা বাহান্ন, তাহাই তিপ্পান্ন, তা এতদিনে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

পাকেচক্রে আমরা চক্রবর্তী। এবং আমাদের ফ্যামিলিতে গুণে গুণে ঠিক একান্নজন লোক। একান্নটা চক্রবর্তী একসঙ্গে থাকলে সেটা যে একান্নবর্তী পরিবার হবে, তা জানতে তো আর চলন্তিকা খুলে বসতে হবে না! কিন্তু সময় চিরকাল এক থাকে না। আমার বৌ পান্তু একসঙ্গে একজোড়া বাচ্চা নামিয়ে ফেললো। ফলে বাহান্নবর্তী হওয়ার বদলে আমরা তিপ্পান্নয় এসে ঠেকলাম।

আমার ঠাকুর্দা কালীপ্রসন্ন চক্কোত্তির চেহারা ছিল বিশে ডাকাতের মত। আশানন্দ ঢেঁকির মত শুধু ঢেঁকি কেন, উনি চেষ্টা করলে বোয়িং সেভেন ফোর সেভেন দুহাতে তুলে মাথার ওপর বনবন করে ঘোরাতে পারতেন। গ্রামেগঞ্জে সেসব করার দরকার হত না নেহাৎ, তাই করতেন না। দেখলেই মনে হত মা কালীর মত গোটা পঁচিশেক মুন্ডু নিয়ে উনি অনায়াসে লোফালুফি করতে পারেন। তার ভয়ে বাঘে গরুতে একঘাটে জল না হোক, আমার বাবা-কাকা-জ্যাঠা আর তাদের কাজিনরা চোখ বুজে, নাক সিঁটকে ছাগলের দুধে ভেজানো বাটিভর্তি খই খেতো সকালে ব্রেকফাষ্টে। ভীমরুলের মত চোখ পাকিয়ে ঠাকুর্দা সামনে বসে থাকতেন। তাঁর জীবিত অবস্থায় এ রুল কোনদিন ব্রেক হয়নি।

পান্তুর সঙ্গে আমার বিয়ের ঠিক দশ দিনের মাথায় ঠাকুর্দা দেহ রাখেন। অতখানি দশাসই চেহারা, কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারিনি, ঠিক যেন ভিরেন্দার সেহওয়াগের ট্রিপল সেঞ্চুরি মারার পরে সফ্‌ট ডিসমিশাল। সেদিন টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল সকাল থেকে। দুপুরে খাওয়ার পর বাড়ির বেড়াল কুকুরগুলোকে উনি মাছের কাঁটা-মাখা ভাত দেন উঠোনের এক কোণে। সেদিনও তাই করতে গেলেন। বৃষ্টিতে পিছল উঠোনে পা পিছলে উল্টে পড়লেন কাটা কলাগাছের মত। আর উঠলেন না। বেড়াল কুকুরগুলো পাভলভিয়ান রিফ্লেক্সে মিউ মিউ ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তারাও অবাক হয়ে খাওয়া দাওয়া ভুলে গেল। ভাগ্য ভাল ওরা ঠাকুর্দার পেছন পেছন আসছিল না, তাহলে মহাভারতে ঘটোৎকচের মৃত্যুর পরে যেমন তার শরীরের নীচে চাপা পড়ে কয়েক হাজার বাঁদরের সমাধি হয়েছিল, ওদেরও তাই হত।

পান্তুর ভালো নাম প্রেরণা। ঠাকুর্দা ওর নাম দিয়েছিলেন করালী। সেই নিয়ে কী রাগ পান্তুর! আচ্ছা, আজকালকার দিনে মেয়েদের নাম কখনো করালী হতে পারে? করালী শুনলেই কেমন ভয়ঙ্কর-দর্শন কাপালিক কাপালিক লাগে না? আর কেমন করলা করলা তিতকুটে ভাব? সাধের নাতবৌটির আরো বেশি সব্বোনাশ করার আগেই তাঁর যে ইহকালের লীলা শেষ হয়ে গেল, তাতে পান্তু তো বেঁচে গেলই, বাবা কাকারাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বাড়িতে জালায় ভরা যত খই ছিলো, ঠাকুর্দার শেষযাত্রায় সব রাস্তায় ছেটানো হল খুচরো পয়সার সাথে। তারপর থেকে ছাগলের দুধও কোনদিন এ বাড়িতে ঢোকেনি। 

এর পরের আড়াই বছরে আমাদের পরিবারে জনসংখ্যা বাড়েও নি, কমেও নি। একেবারে একান্নয় লেগে ছিল। পান্তু নাকি কলেজে অন্ত্যাক্‌সরী আর মেমরি গেমে বরাবর প্রাইজ পেয়েছে। আমাদের বাড়িতে নতুন বৌ হয়ে এসে মাত্র তিন দিনেই ও বাকি সকলের নাম মুখস্ত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। ঠাকুর্দার কল্যাণে নামগুলো কিছু কিছু ছিল বেশ জাঁদরেল। 

বাড়িতে যে নতুন মেম্বাররা এল, তার একটা ছেলে, একটা মেয়ে। যমজ ভাইবোন, কিন্তু পুরো আলাদা স্বভাব। ঠাকুর্দা নেই, আমিই দায়িত্ব নিয়ে ওদের নাম দিলাম স্বরলিপি আর স্বরবিতান। বছর চার পাঁচ যেতে না যেতেই বুঝতে পারলাম, ওদের খাবার-দাবারের ওপর টান খুব বেশি। গোটা চার-পাঁচ পদ না হলে ওদের খাবারে রুচি আসে না, একেবারে আমার ঠাকুর্দার স্বভাবই পেয়েছে। ব্যঞ্জনের প্রতি এই অত্যধিক পক্ষপাতিত্বের জন্য ওদের নাম থেকে স্বর-এর অবলুপ্তি ঘটলো। হয়ে গেল লিপি আর বিতান। কী আশ্চর্য্য, ওদের ডাকনামটাও এটাই রয়ে গেল, ওদের মায়ের মত প্রেরণা থেকে পান্তু-র মত কোন তদ্ভব শব্দে পরিণত হল না। মা-র মত পান্তুয়া খেতে ওরা এত ভালবাসেও না, বরং আলুকাবলি, ঘুগনি, প্যাঁটার মাংসের দিকেই ওদের নজর বেশি।

আমার ছোটকাকা পুণ্ডরীকাক্ষ পেশায় উকিল। ইস্কুলে পড়ার সময় ওর বন্ধুরা কেন, মাষ্টাররাও ওর নামের বানান ঠিকঠাক লিখতে পারত না। ভাগ্য ভাল যে ওর ডাকনাম পিন্ডি হয়ে যাওয়ার আগেই কে ওকে কেল্টু বলে ডাকতে শুরু করে। ঘন কৃষ্ণবর্ণের এই কাকাটির গানের গলা খুব ভাল ছিল। যাত্রায় বিবেকের রোলে ওকে খুব ভাল মানাতো, কিন্তু বিবেকানন্দ না রামমোহন কাকে ফলো করে ছোটকাকা ল’ পাশ করে উকিল হয়ে গেল। কালো কোট পরে যখন কাকা হাইকোর্টে ঢোকে, তখন কাকেরাও ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। ওদের সমবেত কা কা ডাক শুনলেই বোঝা যায় তা।

লিপি-বিতান আমার এই কাকার খুব ন্যাওটা হয়ে গেল। কাকা বাইরে থেকে যখনি আসে, ওদের জন্যে কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসে। সে মাটন রোল হোক কি মোচার চপ। বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যখন শোনা যায়, ‘আমি শ্রীশ্রী ভজহরি মান্না, ইস্তাম্বুল গিয়ে, জাপান কাবুল গিয়ে, শিখেছি দারুণ এই রান্না’, তখনি ওরা ছুটে চলে যায় কাকার ঘরে। মাঝে মাঝে কাকাকে পেশার খাতিরে বাইরে এদিক ওদিকেও যেতে হয়, তখন লিপি বিতানের মুখ ভার হয়ে থাকে। কাকা ফেরে কোন ক্লায়েন্টের বাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে পান চিবাতে চিবাতে – কালো রঙের দশাসই চেহারা অন্ধকারে মিশে থাকে – আর আমার তখন কাকার গানটা অন্যরকম মনে হয়। জাপান কা বুল, ইস্‌, তাম্বুল ক্ষেতে ঢুকে পড়েছে টাইপ। পান খেলেও কাকা অবশ্য পানাসক্ত নয়।

বেশ সুখে শান্তিতে আমাদের সংসার চলে যাচ্ছিল, ভোট আসলে সব পার্টির নেতা এসে আমাদের বাড়ি বলে যেত, আপনাদের একান্নটা ভোট তো আমরাই পাচ্ছি। আমরাও হেঁ হেঁ করে, তা আর বলতে, বলে ওদের বিদেয় করতাম। কাকাকে নেতা বানানোর চেষ্টাও করেছিল অনেকে, বলেছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আপনার অনেক কিছু দেওয়ার আছে। কিন্তু কাকা ওদের মুখের ওপরেই বলে দিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভয়ে বিয়েই করে উঠতে পারলাম না, আমি হব নেতা! শুনে ওরা আর এ পথ মাড়ায়নি।

কিন্তু সংসারের নিয়ম বড় বিচিত্র। কোত্থেকে কী হয়ে তিলকে তাল করে ভায়ে ভায়ে বিবাদের সম্ভাবনা দেখা দিল। চক্রবর্তী বংশের এই বক্রবর্তী ভাব আমাদের সবারই অজানা, অদেখা। কিন্তু সামনে যখন এসে গেল, লিপি বিতান বিষম ভয় পেয়ে গেল। ছোট্ট থেকে যা দেখে আসছে, শুনে আসছে, এ তো তা নয়!

ঘটনার সূত্রপাত, যেমন হয়, একটা অত্যন্ত মামুলি ও তুচ্ছ কারণে। গ্যাস সিলিন্ডারের দাম একলাফে দুশো বারো টাকা বেড়ে যাওয়ায় বড়বৌদি শমন জারি করল, কথায় কথায় গরম জল এখন আর পাওয়া যাবে না। এদিকে শীতের সকালে একটু গরম জল না পেলে চান করবে কী করে জনগণ? বড়বৌদি বলল, ঠিক আছে, মাথাপিছু হাফ বালতি আমি এইখানে রেখে দেব, তোমরা ম্যানেজ করে নিও। বড়দা সেই কথাটা ঠিকঠাক শুনতে পায়নি, সে পুরো বালতি সাঁটিয়ে দিয়েছে স্নানে। ব্যাস, সেজদা বেরিয়েছিল, দেরি করে ফিরে দেখে জল নেই। এদিকে বাড়ি ফেরার সময় তাকে আবার একটা পাগলা ষাঁড়ে গুঁতিয়ে দিয়েছে। গরম জল তো তার চাইই। সেসব তো অন্দরমহলের কেউ জানে না। বড়বৌদি বলল, মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না, পারব না। সেজদার মেয়ে বৃহন্নলা যখন বাবাকে বলল যে তার ভাগের জলটা বড়দাই খরচ করেছে, তখন রাগের মাথায় সেজদাও বেফাঁস বলে ফেলল, নিজের বেলায় তো –

এই সব মিলে মিশে বাড়ি থমথমে হয়ে গেল। সেজদার পায়ে চোট, এমনিতেই অফিস যেত না, এখন অন্য বাহানা দেখিয়ে গজগজ করতে লাগল। বড়দা সদাশয় মানুষ, বাড়ি ফিরে যতই ‘ও অহিরাবণ, আমার কথাটা শোন’ ইত্যাদি বলে সান্ত্বনা দিতে যান, সে ততই পেয়ে বসে। 

উপায় বের করল বাড়ির ছোট বৌ পান্তু। বাড়িতে নোটিশ জারি করে দিল, সামনেই ঠাকুর্দার দশম মৃত্যুবার্ষিকী। সকলকে বাধ্যতামূলকভাবে সেদিন সন্ধ্যেবেলায় উপস্থিত থেকে ঠাকুর্দার স্মৃতিচারণ করতে হবে। তার সঙ্গে কিছু খাবার বানাবে সব বউরা, খাওয়া হবে সবাই একসঙ্গে মিলে। কয়েকজন একটু কিন্তু কিন্তু করলেও ঠাকুর্দার কথা ভেবে রাজী হয়ে গেল।

এসে গেল সেই ডি-ডে। বাপরে বাপ, সারাদিন কী বৃষ্টি, কী বৃষ্টি! সমস্ত ধরণী রসাতলে যাওয়ার উপক্রম। প্রোগ্রাম বুঝি রসাতলে যায়! পান্তুর মুখ আষাঢ়ের মেঘের মত থমথমে। তাকে যে করালী নাম দিয়েছিল, মরালীর মত সেই নেচে নেচে এই আয়োজন করেছে, এখন সব পণ্ড হওয়ার উপক্রম হতেই তার মেজাজ তিরিক্ষে, একেবারে ব্রুস লী-র বোন কড়া লী!

অবাক কাণ্ড, সন্ধ্যে হতেই বৃষ্টিটা ধরে এল। বড়দার মেয়ে সঙ্গীতা যখন প্যাঁ পোঁ করে হারমোনিয়াম বাজিয়ে ঠাকুর্দার নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কালীকে প্রসন্ন করতে শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে সভার উদ্বোধন করল, তখন চেষ্টা করলে দু একটা তারাও আকাশে দেখা যেত। প্রোগ্রাম যতই এগোতে লাগলো, সবার মনের মেঘ ততই কেটে যেতে লাগল। সেজদার ছেলে নাকের নীচে ইয়াব্বড় মোচ লাগিয়ে ঠাকুর্দার নকল করে সবাইকে বেশ মাতিয়ে দিল। শোনা গেল, ওকে প্রেরণা দিয়েছে ওর নতুন কাকিমা। পান্তু এক কোণে ভেজা বেড়ালের মত মুখ করে বসে বসে বেশ এনজয় করছে, যেন কিস্যু জানে না এমন ভাব।

লিপি আর বিতান একেবারে কর্ণকুন্তীসংবাদের মত লম্বা একখানা নাট্য-আলেখ্য নামিয়ে দিলো। নাটকীয়ভাবে শুরু করলো, এবারে আপনাদের সামনে আমরা পরিবেশন করছি আমাদের নাটক – ঠাকুরদাদার প্রতি। শেষ হয়ে গেলে যখন জিজ্ঞেস করা হল, এ নাটক কার লেখা, লিপি চোখ গোল গোল করে বলল, শ্রীমতী প্রেরণা চক্রবর্তীর। পান্তু-র এত গুণ আমি নিজেও জানতাম না। ছোটোকাকা তার বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে যখন ছোটবেলার ছোট ছোট ঘটনা উল্লেখ করতে লাগল ধরা গলায়, সবার চোখে জল। 

খাওয়াদাওয়া হয়ে গেলে বড়দা বেশ ঘটা করে খবরটা সবার কাছে ভাঙলো, মেয়ে শ্রুতকীর্তি নামী স্কলারশীপ পেয়েছে, উচ্চশিক্ষার জন্যে সে বিদেশে যাবে। ছোটকাকা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, তোমাদের কেল্টুও এই ঘরে আর বেশিদিন নেই। হাইকোর্টে প্র্যাকটিশের সুযোগ এসেছে, আমাকে এবার কলকাতায় শিফ্‌ট্‌ করতে হবে। শুনে আমাদের সবার মন যুগপৎ ভালো আর খারাপ হয়ে গেল।

আবার আমরা একান্নজন হয়ে গেলাম। আবার আমরা পার্ফেক্ট একান্নবর্তী।


1 comment:

  1. রাধারমণ রায়ের একটা নাটক 'টাকার রঙ কালো' মঞ্চস্থ হয়েছিল আমাদের ছোটবেলায়, স্কুলে তখন ক্লাস নাইনে পড়ি, সেখানে লেখা ছিল মুদ্রা দোষের ইংরেজি Coin Defect, একান্নবর্তী পরিবারের ইংরেজি Fifty one families.
    অপ্রসঙ্গতঃ ঐ নাটকে একটা কবির চরিত্র ছিল, তার নাম ঞ র ফলা। 'ঞ' এর নীচে রফলা লিখতে পারলামনা। কিন্তু বইটাতে লেখা ছিল। তার একটা কবিতা এই রকম, স্মৃতি থেকে লিখছি.." নামে মনিকা ছিল মেয়ে এক; সে লিখত কবিতা। কবিতা উড়ত হাতির ঠ্যাংএ, বকের ছায়ায়। সেখানে নির্জীব ভিয়েতনাম লাফাত ব্যাং। তার পর একদিন মনিকা মরীয়া হয়ে উঠল, ছিঁড়ে উড়ে গেল বালিশ, মনিকা খুলল শাড়ি, খুলল ব্লা..." এর পএ কাজ ছিল দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন চীৎকার করবে 'থাক থাক কবিতা শেষ হয়ে গেছে, আর কিছু খুলতে হবেনা'। আপনার লেখা সেই পুরোন স্মৃতি ফিরিয়ে আনল।

    ReplyDelete