প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
বাঙ্গালির বিনোদন শিল্প ও বারাঙ্গনা কন্যারা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
আচ্ছা, যদি এরকম কল্পনা করিযে, আমাদের বিনোদন জগতে যদি পুরুষেরই একাধিকার থাকতো, তবে কেমন হ’ত ? নাট্যাভিনয়, সঙ্গীত কিংবা চলচ্চিত্রে যদি শুধু পুরুষেরই অধিকার থাকতো তবে কেমন চেহারা হত আমাদের বিনোদন জগতের ? অথচ এমনটাই তো ছিল আজ থেকে মাত্র দেড়শ’ বছর আগেও ।
উনিশ শতকের বাঙালির বিনোদন মানেইছিল বারবণিতা বিলাস । বিনোদন তখন অবশ্য আম মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে । জমিদারবাবুরা নানান উপলক্ষ্যে বাঈজী নাচ, আখড়াই, ঝুমুর, কবিগানের আসর আয়োজন করতেন দেদার টাকা উড়িয়ে আর প্রজারা তার ছিটফোঁটা ভাগ পেতেন মাঝেমধ্যে । উনিশ শতকের বাঙ্গালিবাবুদের বারাঙ্গনা বিলাস, রক্ষিতা পোষা,উপ-পত্নী রাখা এইসব কদর্য বৃত্তান্ত আমরা ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’, ‘নববাবু বিলাস’ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জেনেছি । উপ-পত্নীর সংখ্যা দিয়েই নাকি জমিদার বাবুদের মর্যাদার পরিমাপ হত । সেই অন্ধকার জগতের মেয়েদের কথা ইতিহাস কদাচই মনে রেখেছে অথচ আমাদের বিনোদন জগতের ইতিহাস নির্মাণ করেছেন অন্ধকার জগতের বা নীচের মহলের মেয়েরাই । আমাদের বিনোদনের তিন প্রধান অঙ্গ – থিয়েটার, সংগীত ও চলচ্চিত্র আজ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে বা উচ্চতর শিক্ষার অঙ্গণে পঠন-পাঠনের বিষয় । কিন্তু উনিশ শতকতো বটেই বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্তসম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েদের নাচ, গান, থিয়েটার করা সমাজেররক্তচক্ষুতে নিষিদ্ধই ছিল ।
আধুনিক কালে বাঙালির বিনোদন জগতে প্রথম আসে থিয়েটার, আঠেরো শতকের একদম শেষ লগ্নে ১৭৯৩এ । ব্যক্তিগত সঙ্গীত চর্চার স্তর অতিক্রম করে সঙ্গীত বিপনন সামগ্রী হয়ে উঠলো আরো ১১০ দশ বছর পরে ১৯০২এ, আর চলচ্চিত্র বাঙালির বিনোদন তালিকায় এলোএই সে দিন – আজ থেকে মাত্র একশ’ বছর আগে১৯১৩তে ।রুশ যুবক গেরেসিম লেবেডফ ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে বাংলাভাষার প্রেমে পড়েন । ইংরাজি নাটক ‘দি ডিসগাইস’ বাংলায় অনুবাদ করে বাঙালি অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে মঞ্চস্থ করেছিলেন । ১৭৯৫এর ২৭শে নভেম্বর । সেটিই বাঙালির প্রথম নাট্যাভিনয় । লেবেডফের ভাষা শিক্ষক গোলকনাথ দাস কলকাতার বারাঙ্গণা পল্লী থেকে অভিনেত্রী সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন । লেবেডফের থিয়েটার সম্পর্কে বেশি কিছু আর জানা যায় না। কারা ছিলেন প্রথম বাংলা নাট্যাভিনয়ের অভিনেতা-অভিনেত্রী ? ইতিহাস তার কোন লেখাযোখা রাখেনি । লেবেডফের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত ইংরাজরা তার থিয়েটারে আগুন লাগিয়ে ধ্বংশ করে দেয়, আইনের জালে জড়িয়ে দেউলিয়া করে তাকে ভারত থেকে বহিস্কার করে । কিন্তু ইতিহাসকে মুছবে কি করে ? গেরেসিম লেবেডফের নাম অক্ষয় হয়ে থাকলো বাংলা ভাষায় প্রথম নাট্যাভিনয়ের সূচনাকর্তা হিসাবে । আরো একটি কারণে সেই থিয়েটার ঐতিহাসিক স্বীকৃতির দাবি রাখে তাহ’ল বাংলা নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের অভিনয়ের অপরিহার্যতা,যার জন্য পরবর্তী আশি বছর সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল ।
কেমন ছিল বাঙালির সেই প্রথম অভিনয় ? জানার কোন উপায় নেই । শুধু এ’টুকু জানাযায় যে, সর্বস্বান্ত হয়ে ভারত থেকে বিতাড়িত হবার পর বন্ধু সাম্বারাস্কিকে একটা চিঠিতে লেবেডফ লিখেছিলেন “আমার বহুবিধ পরিশ্রমের মধ্যেও আমি নিরুৎসাহী ভণ্ড ও বন্য প্রকৃতির বাঙালিদের হাস্যরসাত্মক অভিনয় শিক্ষার আয়োজন করিয়াছিলাম।... দর্শকবৃন্দ অকপটভাবে ইহাতে পরিতৃপ্তি পাইয়াছিল...”।
লেবেডফের থিয়েটার বাংলা নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে কোন ধারাবাহিকতার সৃষ্টি করলো না বটে, কিন্তু থিয়েটারে নারী অভিনেত্রীর প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নটি স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল, যার নান্দীমুখ করে গিয়েছিলেন লেবেডফ নিয়োজিত সেই বারাঙ্গণা কন্যারা । এর পর ৩৮বছর বাংলা নাট্যাভিনয়ের কোন সংবাদ পাওয়া যায় না।১৮৩৫এর ৬ই অক্টোবর শ্যামবাজারের জমিদার নবীনচন্দ্র বসুর বাড়িতে ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাট্যাভিনয় আয়োজিত হয় । নবীনচন্দ্র লেবেডফের মতই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বারাঙ্গণা পল্লী থেকে নারী চরিত্রের অভিনেত্রী সংগ্রহ করেছিলেন । বারাঙ্গনা মেয়েদের নাট্যাভিনয়ে সুযোগ দেওয়ায় তখনকার রক্ষণশীল সমাজে নিন্দা-মন্দের ঝড় উঠলো, প্রবল আক্রমণাত্মক সমালোচনায় বিদ্ধ হলেন বাবু নবীনচন্দ্র । তবুও এই প্রয়াসের মধ্যে সমাজসংস্কারের যে বার্তা ছিল তা চিহ্নিত করতে পেরেছিল সেই সমাজেরই একটা অংশ । ‘হিন্দু পাইওনিয়ার’ পত্রিকা তার প্রতিবেদনে লিখেছিল “... এই নাটকে বিশেষ করিয়া স্ত্রী চরিত্রের অভিনয় খুব চমৎকার হইয়াছিল ...।আমাদের সমাজের স্ত্রীলোকদের মানসিক শক্তির এই মহান ও নূতন দৃষ্টান্ত দেখিয়াও যদি লোকে স্ত্রী-শিক্ষায় অবহেলা প্রদর্শন করেন, তবে তাঁহাদের হৃদয় কঠিন ও চিত্ত আবেগহীন বলিতে হইবে ...। এই সকল প্রশংসনীয় কিন্তু ভ্রমে পতিত স্ত্রীলোকদের চারিত্রিক উন্নতি করিবার এই প্রচেষ্টার জন্য নাট্যশালার স্বত্বাধীকারী বাবু নবীনচন্দ্র বসু ধন্যবাদের পাত্র” ।
এমন প্রশংসা সত্তেও রক্ষণশীলদের প্রবল নিন্দাবাদের চাপে নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের নিয়োগের সাহস করলেননা কেউ, নাটকের নারীচরিত্রগুলির অভিনয় পুরুষের দখলেই থেকে গেলো । কিন্তু নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের স্বাভাবিক অধিকারের প্রশ্নটিকে চাপা গেলো না, প্রবলভাবে উঠে এলো আরো ৩৮ বছর পরে, যখন আসরে নামলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত । ইতিমধ্যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, ধনাঢ্য জমিদারবাবুদের নাটমঞ্চ থেকে উদ্ধার করে থিয়েটার উন্মুক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে, বাংলা নাট্যাঙ্গণে প্রবল উপস্থিতি হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের ।
১৮৭২এ বাঙালির প্রথম রঙ্গালয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’প্রতিষ্ঠার পরের বছর ধনকুবের আশুতোষ দেব বা ছাতু বাবুর দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে একটি রঙ্গালয় খুললেন আর তাদের জন্য নাটক লিখে দেবার জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তকে অনুরোধ করলেন । মাইকেল সম্মত হলেন একটি শর্তে যে তাঁর নাটকের নারী চরিত্রগুলি মেয়েদের দিয়েই অভিনয় করাতে হবে । বেঙ্গল থিয়েটারের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাতেও মাইকেল থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের প্রস্তাব করেন । মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বারাঙ্গনাপল্লী থেকে জগত্তারিণী, গোলাপসুন্দরী, এলোকেশী ও শ্যামাসুন্দরী নামে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন । ১৮৭৩এর ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো আরনাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে সেইদিন থেকে শুরু হল থিয়েটারে নারীদের অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতাও । থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণের প্রথম প্রবক্তা মধুসূদন দত্ত এই যুগান্তকারী ঘটনা দেখে যেতে পারেননি । গোলাপসুন্দরীদের পথচলা শুরু হবার দেড় মাস আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯শে জুন ১৮৭৩) । রক্ষণশীলদের প্রবল নিন্দাবাদ সত্তেও নাট্যাভিনয়ে মেয়েদের স্বাভাবিক অধিকারকে আর ঠেকানো যায়নি । পরবর্তী ষাট বছরগিরিশচন্দ্র ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলাল বসু,অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, দানিবাবু, অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ভাদুড়ী, অহীন্দ্র চৌধুরীদের সঙ্গে গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, তিনকড়ি দাসী, কুসুমকুমারী, কৃষ্ণভামিনী, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, প্রভা দেবীরা বাঙালির থিয়েটার ভুবনকে আলোকিত করে গেছেন। তাঁদের অবিস্মরনীয় অভিনয় ও সংগীত প্রতিভার ঐশ্বর্য ইতিহাস হয়ে আছে ।
বিনোদন বিপণন সামগ্রী হয়ে ওঠার পর সম্ভ্রান্ত পরিবারের আলোকপ্রাপ্তা নারীরা বিনোদনের সৃষ্টিশীল জগতে এলেন । কিন্তু তার আগে থিয়েটার, সংগীত ও চলচ্চিত্র জগৎকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সমাজের অন্ধকার অংশ থেকেআসা মেয়েরা । থিয়েটারের কথাই প্রথমে বলতে হচ্ছে, কারণ সংগীতের বিপণন হওয়ার শুরুতে এবং চলচ্চিত্র শিল্পের উদ্ভবের শুরুতে নারী শিল্পীদের সরবরাহ হ’ত থিয়েটার থেকেই ।সংগীতে পারদর্শিতা ছাড়া থিয়েটারে জায়গা হত না । বিশ শতকের একদম শুরুতে এদেশে সংগীতের বিপনন শুরু হলে তাই থিয়েটারের মেয়েরাই আমাদের বিনোদনের এই নতুন মাধ্যমে ব্যবহৃত হলেন । তখনও মেয়েদের গান গাওয়া সমাজ অনুমোদন করতো না । ১৮৭৭এ টমাস আলভা এডিসনের বিস্ময়কর উদ্ভাবন ফোনোগ্রাফ যন্ত্র । কন্ঠস্বর ধ্বনিবদ্ধ করে আবার শোনার বন্দোবস্ত । তেরো বছর পরে ১৮৯০এ বিজ্ঞানী এমিল বার্লিনার কন্ঠস্বর ধ্বনিবদ্ধ করা ও শোনার পদ্ধতির আরো উন্নতি ঘটিয়ে উদ্ভাবন করলেন গ্রামফোন বা কলের গান । ১৮৯৮এ কলের গান ভারতে চলে এলো । কলকাতায় গ্রামফোন কোম্পানী বাংলাগান বিপণনের জন্য রেকর্ড করতে চাইলেন । কিন্তু গাইবে কে ?গ্রামফোন কোম্পানী প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা ও পরিচালিক অমরেরেন্দ্রনাথ দত্তর স্মরণাপন্ন হলেন । অমেরেন্দ্রনাথ সংগ্রহ করে দিলেন তাঁর থিয়েটারের দুইজন নাচের শিল্পী শশিমুখী ও ফণীবালাকে । থিয়েটারের নাচ-বালিকা, এই দুই বারাঙ্গণা কন্যাই বাংলা গানের প্রথম রেকর্ডশিল্পী । তারপর ২৫/৩০ বছর নীচের মহল থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পীরা – গহরজান, কৃষ্ণভামিনী, হরিমতি, কমলা ঝরিয়া, আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা থেকে কানন দেবীরা বাংলা গানের ভুবনকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে গেছেন ।শিল্পীর মর্যাদায় এঁরা সঙ্গীতজগতে লিজেন্ড হয়ে আছেন । আজ থেকে সত্তর পঁচাত্তর বছর আগে আঙ্গুরবালা গেয়েছিলেন ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা আমি যে পথ চিনিনা’ । তারও চল্লিশ বছর পরে ‘ছুটি’ ছায়াছবিতে প্রয়াতা প্রতীমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রিমেক করা সেই গান আজও আমাদের আচ্ছন্ন করে । খ্যাতিরশীর্ষ স্পর্শ করেও অন্ধকার জগৎ থেকে উঠে আসা এইসব শিল্পীরা কোনদিন মাটি থেকে পা সরিয়ে নেন নি । সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ইন্দুবালাখ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন, গ্রামোফোন কোম্পানীর ‘গোল্ডেন ডিস্ক’, ‘সঙ্গীত নাটক আকাডেমি সম্মাননা’ পেয়েছেন । কলকাতার রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর পদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গেয়েছিলেন ইন্দুবালা । দেশজোড়া খ্যাতি সত্তেও তিনি রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লী ছেড়ে অন্যত্র চলে যান নি । বলতেন ‘আমি রামবাগানের মেয়ে ... রামবাগানই তো আমায় সব কিছু দিয়েছে । অর্থ, সম্মান ভালোবাসা সব...’ । একদিকে দেশজোড়া খ্যাতির আলো আর অন্যদিকে রামবাগানের নিষিদ্ধ পল্লীর অন্ধকার । এই দুইএর মাঝেই সুরের আকাশে উজ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন ইন্দুবালা ।
এ দেশে যখন চলচ্চিত্র বা সিনেমা এলো, প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্রর নির্মাণ শুরু হ’ল তখন আমাদের সমাজ অনেক এগিয়েছে, বাঙালির রুচিবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে, নিষেধের বেড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভেঙেছে । ১৯১৩তে দাদাসাহেব ফালকে তৈরি করলেন ভারতের প্রথম কাহিনী চিত্র ‘রাজা হরিশচন্দ্র’। কিন্তু তার দশ বছর আগে ১৯০৩-এ এক বাঙালি যুবক হীরালাল সেন এমারেল্ড থিয়েটারের অমরেন্দ্রনাথ দত্তর উদ্যোগে ‘আলিবাবা’ নাটকটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রায়িত করেছিলেন । মর্জিনার ভুমিকায় ছিলেন তখনকার প্রখ্যাত অভিনেত্রী কুসুমকুমারী । নটী কুসুমকুমারীই অতএব এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র অভিনেত্রী । সে ছিল নির্বাক সিনেমার যুগ । সেলুলয়েডেশব্দ ধারণের কৌশল তখনও আয়ত্ত হয় নি । ১৯১৯এ তৈরি হল প্রথম বাংলা সিনেমা ‘বিল্বমঙ্গল’ ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বদলে যাওয়া আন্তর্জাতিক ঘটনাবলিবাঙ্গালির মনন ও যাপনভাবনায় বদল আনছিল ধীরে ধীরে ঠিকই, কিন্তু তখনও সিনেমা ছিল অন্ত্যজ, বাঙালি মেয়েরা সিনেমায় অভিনয়ের কথা ভাবতেই পারতেন না । নির্বাক চলচ্চিত্র, সংলাপের ভাষা শোনার ব্যাপার নেই । সুতরাং প্রথম প্রথমঅ্যাংলো ইন্ডিয়ান তরুণীরা অভিনয় করতেন বাংলা সিনেমায় । মেমসাহেবদের অভিনীত ‘নল দময়ন্তী’, ‘বিষ্ণু অবতার’, ‘কপালকুণ্ডলা’ দেখতে নাকি ‘হাউসফুল’ হয়ে যেত । বাঙালি দর্শক বেশিদিন সিনেমায় মেমসাহেবদের বাঙালি ললনা ভাবতে রাজি হবেন কেন? অতএব থিয়েটারে নীচের মহলের মেয়েরা ছাড়া আর গতি ছিল না। বাংলা সিনেমার সেই শৈশবে সিনেমায় এলেন মঞ্চের অভিনেত্রীরা – কুসুমকুমারী, শিশুবালা, নীরজাসুন্দরী, প্রভাদেবী প্রমুখ অনেকে ।
১৯৩১এ বাংলা সিনেমা কথা বলতে শুরু করলো । বাংলাচলচ্চিত্রের নির্বাক ও সবাক যুগের সন্ধিলগ্নে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছিল নীচের মহল থেকে আসা এক নিঃসম্বল, অসহায়া বালিকাকে, নাম তার কাননবালা, পরবর্তীতে যিনি কানন দেবী – বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম মহা নায়িকা । নির্বাক সিনেমার যুগে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক পাওয়া কানন বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকে এর অভিভাবিকা হয়ে উঠেছিলেন । নিষ্ঠা, সততা আর তন্ময় সাধনায় অবহেলার অন্ধকার থেকে দীপ্তিময়ী ব্যক্তিত্বে নিজের উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন কানন দেবী ।
বিনোদন শিল্পে মেয়েদের আসা শুরু হয়েছিল সেইদিন, যেদিন মাইকেল মধুসূদন দত্তর পরামর্শে বেঙ্গল থিয়েটারের দ্বার মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত হয়েছিল । সে কথা আগেই বলেছি । সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে কোন প্রাপ্তির আশায় আমাদের বিনোদন শিল্পের সূচনাপর্বে এসেছিলেন এইসব বারাঙ্গনা কন্যারা ?তাঁরা এসেছিলেন অন্ধকার জগতের গ্লানি অগ্রাহ্য করে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার তাগিদে । বাঙালির প্রথম বিনোদন মাধ্যম থিয়েটার সেইসব বারাঙ্গনা কন্যাদের কাছে অন্ধকার জগতের গ্লানিমুক্তির একটা অবলম্বন হয়ে দেখা দিয়েছিল । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন । এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, কুসুমকুমারী, তারাসুন্দরী, কৃষনভামিনী, প্রভাদেবীরা । বস্তুত নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার পুরোমাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । গিরিশচন্দ্র স্বীকার করেছেন বিনোদিনী না থাকলে তিনি ‘গিরিশচন্দ্র’ হতে পারতেন না । কিংবা, পেশাদারী থিয়েটারের শেষ লগ্নে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নাট্যকীর্তিতে অভিনেত্রী প্রভা দেবীর অবদান কে অস্বীকার করবে ? তাঁর ‘দুই পুরুষ’ নাটকের অভিনয় দেখে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন “গিরিশচন্দ্র গেছেন, কিন্তু আর এক সূর্যের আবির্ভাব হল – নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের । আর এক নতুন ধারার সৃষ্টি হল । সেই থেকে এই ধারারই বাহিকা হয়ে আবির্ভূতা শ্রীমতী প্রভা” । গিরিশচন্দ্র থেকে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার – বাংলা থিয়েটার শিল্পের নির্মাণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করেন নীচের মহল থেকে আসা এইসব অভিনেত্রীরা । গোলাপসুন্দরী থেকে পরবর্তী ৭০/৮০ বছরবাংলা থিয়েটারকে সমৃদ্ধ করেছেন, আলোকিত করেছেন এঁরাই ।
উনিশ শতকের ধনী বাবুদের পরস্ত্রী গমন,রক্ষিতা পোষা তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো,তাঁদের নারীলোলুপতা আর অনৈতিক জীবনযাপনের ক্লেদাক্ত বৃত্তান্ত আমরা জানি । কলকাতার নাগরিক জীবনের অঙ্গ স্বরূপ তখন কলকাতায় গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সম্ভ্রান্ত বাবুদের লালসার শিকার গর্ভবতী হয়ে অনেক তরুণী বিধবা আশ্রয় নিতেন গণিকালয়ে । ধনাঢ্য ব্যক্তির রক্ষিতারাও গর্ভবতী হয়ে পড়তেন । বারাঙ্গণা নারীরা স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের কন্যারা যেন এই গ্লানিময় জীবনের স্পর্শ না পায় । থিয়েটার তাদের সামনে গ্লানিমুক্তির পথ হয়ে দেখা দিল ।তখনকার সমাজের একটা ছোট অংশের সহানুভুতি তাঁরা পেয়েছিলেন । বিদ্যাসাগরের অনুগামী উপেন্দ্রনাথ দাস গোলাপসুন্দরীর বিবাহ দিয়ে সংসার পাতিয়েছিলেন ।
গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী থেকে ইন্দুবালা, কাননদেবী । সময়ের ব্যবধান বিস্তর । সমাজ মানসিকতাতেও বদল হয়েছে অনেক । কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরনের কাহিনী একই । সমাজের নিচের মহল থেকে বিনোদন শিল্পে আসা মেয়েদের তন্ময় সাধনা, অন্ধকার জগতের সব গ্লানি মুছে দিয়ে দীপ্তিময়ী ওয়ে ওঠার কাহিনি যুগে যুগে একই থেকেছে ।
আজ একুশ শতকের স্যাটেলাইট জগতে অতীতকে ফিরে দেখার আগ্রহ আমরা হারিয়েছি, সত্য । তবু এটাও সত্য যে আমাদের বিনোদন শিল্পের তিন প্রধান অঙ্গ থিয়েটার, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র শিল্পের নির্মাণে সমাজের নীচের মহল থেকে আসা শিল্পীদের অবদান অবিস্মরণীয়, এই কথাটা আমাদের মনে রাখতেই হবে ।
অসম্ভব সুন্দর লেখা দাদা । খুব শিখ্যনিয়।
ReplyDeleteঅসাধারণ। এত তথ্য লেখার মাধুর্য এতটুকু ক্ষুণ্ণ করেনি। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete