0

ছোটগল্পঃ ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প 





কাথাঁকাহিনী 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায় 



সুভাষিণীর সম্পদ বলিতে তাঁহার তিনখনি কাঁথা। সারা বৎসর তাহাদিগকে কাচিয়া, শুকাইয়া, রোদে দিয়া, ঝাড়িয়া, পাট করিয়া, পুনরায় রোদে দিয়া শুকাইয়া, ঝাড়িয়া, পাট করিয়া বিবাহের সময় পাওয়া টিনের ছোট একটি তোরঙ্গে তুলিয়া রাখেন। তিনখানি কাঁথাই নানান কারুকাজে পরিপূর্ণ। 

কাঁথা তিনখানি তিনরকমের, তাহাদের নামও তিনটি। একখানি কাঁথার চারিপার্শ্বে সুন্দর মোলায়েম কারুকাজের পাড় বসানো, ভিতরে অতীব সুন্দর কাজ করা। সুভাষিণী তাহার নাম দিয়াছেন, ‘বেগমবাহার’। একখানিতে সারা কাঁথা জুড়িয়া গাছ আর টিয়াপাখির ঝাঁক, অনেকটা নক্‌সী কাঁথার ন্যায়, সুভাষিণী তাহার নাম দিয়াছেন, ‘তোতাবাজার’। সারা কাঁথা জুড়িয়া তোতাদের রাজত্ব, তাই। আর একখনি কাঁথা হালফ্যাশনের বাবুদের মতো। কোথাও লাল, তো কোথাও সবুজের কাজ। কোথাও কাল সূতার কাজ, তো তাহারই পাশে হলুদের ছোঁয়া, যেখানে যেমন ইচ্ছা সেলাই হইয়াছে। কোন রকম রং বা কারুকাজের নিয়ম মানামানি নাই। আজিকালকার বাবুদিগের মতো, যাহার যাহা খুশী, তাহাই করিতেছে। সুভাষিণীদের সময় এরূপ বেনিয়ম ছিল না। তখন গৃহস্থের সঙ্গে সঙ্গে বাহিরে আর এক গৃহস্থ রাখিবারও একটা নিয়ম ছিল। এখনকার ছেলেছোকরা বাবুদের মতো বেহিসাবী নহে। সুভাষিণী এই কাঁথাটির নাম দিয়াছেন, ‘নতুনবাবু’। 

বাহিরের লোকজন, যাহারা সুভাষিণীর আত্মীয় বা কুটূম্ব নহে, তাহাদের গৃহে পাত্রপক্ষের কন্যা দেখিতে আসিবার সময়, বিবাহের আশীর্বাদের সময় কিংবা এইরূপ কোন অনুষ্ঠান হইলে সুভাষিণী কাঁথাগুলিকে দিয়া থাকেন। বিনা পয়সায় নহে, তাহার জন্য কিছু অর্থ তিনি লইয়া থাকেন। এমত কারণে সুভাষিণীকে দোষারোপ করিতে পারা যায় না। তিনি তাহা না করিবেনই বা কেন? সুভাষিণীর খোরপোষ যোগাড় হইবে কিসে? ত্রিসীমানায় তাহার নিজের বলিতে কেহ নাই।

কাঁথাগুলি লইয়া যাইবারও একটি নিয়ম আছে। যদি পুত্রের বিবাহ হয়, তবে ‘বেগমবাহার’ লইতে হইবে, বেগমবাহার পাতিয়া বৌরাণী তাহার উপরে বসিবেন। যদি কন্যাপক্ষকে দেখিতে অর্থাৎ পছন্দ করিতে আসার ঘটনা ঘটে, তাহা হইলে ‘তোতাবাজার’ কে লইয়া যাইতে পারেন, কারণ ইহা তোতা খরিদের ন্যায়। তোতাদের বাজারে একটি তোতাকে পছন্দ করিয়া একপ্রকার কিনিয়া লইতেই আসা। এখন কোন্‌ তোতা হরে-কৃষ্ণ বলিবে আর কোন্‌ তোতা গালি দিবে তাহা কেহ বলিতে পারে না। শুধু ‘ ‘নতুন বাবুকে ‘ তিনি হাতছাড়া করিতে চাহেন না। ‘নতুনবাবু’ সুভাষিণীর প্রাণ, তাহাকে কোনমতেই প্রাণে ধরিয়া কাহাকেও দিতে পারেন না। সুভাষিণীর এই জন্মের যত আশা-আকাঙ্খা, যাহা কোনওদিন পূর্ণ হইবার আশা নাই, যাহা কোনওকালে পূর্ণ হইবার আশা ছিল না, তাহা সব যেন ‘নতুনবাবুর’ মধ্যে লুক্কায়িত। তবে মনে হইতেছে এইবার হালফ্যাশানের কন্যাদের বিবাহে পাত্রকে বসিবার জন্য ‘নতুনবাবু’কে বরাসন হিসাবে দিতে হইবে। একমাত্র তাহা হইলেই ‘নতুনবাবু’ ঠিক কাজে লাগিবে। ইহাকে লইয়া সুভাষিণীর মনে কি আছে, তাহা আমরা বলিতে পারি না। 

কাঁথাগুলিকে রোদে দিবার সময়, কোন অংশ নতুন করিয়া সংষ্কার করিবার সময় সুভাষিণী তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া থাকেন, যেন আপনার সন্তান, যেন আপনার সখী। সারাদিনে ইহাদের ভাবনাতেই তাহার কাটে। তখন কেহ সামনে পড়িয়া কিছু জিজ্ঞাসা করিলে সুভাষিণী যেন কুভাষিণী হইয়া উঠেন। 

আজিকে সুভাষিণী সকালে উঠিয়াই ‘তোতাবাজার’কে লইয়া পড়িয়াছেন। তাহাকে একপ্রস্থ ঝাড়িয়া-ঝুড়িয়া, ঠিকমত পাট করিয়া রাখিয়াছেন। বৈকালে বকুলতলার ঘোষেদের গৃহে তাহা লইয়া যাইবে। ব্রজমোহনের কন্যা ননীবালাকে আজ দেখিতে আসিবার কথা। তোতাবাজারের উপর বসাইয়া কন্যাকে দেখাইবেন। বাস্তবিক পক্ষে কাঁথাগুলি দেখিতে এতই সুন্দর যে ইহা দেখিলে দামী কার্পেট বলিয়া মনে হয়। দামী গৃহে এমন দামী জিনিসের আদর তাহারা না বুঝিলে আর কেইই বা বুঝিবেন! বৈকালে ব্রজমোহন লোক পাঠাইলে তাহারা কন্যা দেখিবার সময় সুভাষিণীকে আলাদা করিয়া নিমন্ত্রণ করেন নাই। তাই লইয়াই বিস্তর গোলযোগ ...আমাদিগের সেসব কথায় কাজ নাই। কিন্তু ননীবালার কি হইল...!


(২)

বকুলতলার ঘোষেদের ছোটতরফের ব্রজমোহনের পিতা রাধামোহন আর সুভাষিণীর স্বামী অমূল্যচরণ ছিলেন পরম বন্ধু, আবার তাহাদিগের মতো শত্রুতাও আর কাহারও ছিল না। সকালে গ্রামের মাঝপাড়ায় দুজনের দেখা হইলে শুরু হইত শুভেচ্ছা আর হাসি বিনিময়। সন্ধ্যায় তাহা শেষ হইত বাপ-পিতামহকে গালিগালাজ আর শাপ-শাপান্তর করিয়া। সেই গালি গালাজের মধ্যে সন্তানের মৃত্যুকামনাও ছিল। অমূল্যচরণের কোন সন্তানাদি ছিল না, তাই তাহাকে এরূপ কথা বলিলে অমূল্যচরণ বগল বাজাইয়া পাড়ার মধ্যে নাচিয়া বেড়াইতেন, যেন ইহাতে তাহার কিছু যায় আসে না। ব্রজমোহনের পিতা, রাধামোহন তখন বিপাকে পড়িয়া গৃহদেবতার নামেও গালিগালাজ শুরু করিতেন। এই শত্রুতা কতখানি সত্য আর কতখানি লোক দেখান, তাহা কেহ বলিতে পারে না। কিন্তু গালিগালাজের জের কখনও কখনও এতদূর হইয়াছে যে, গ্রামের সকলে মিলিয়া তাহাদিগকে ধরিয়া দুইদিকে টানিয়া লইয়া গিয়াছেন। রাধামোহন সন্তানের পিতা, সুতরাং, তাঁহারই রাগ বেশি হইত। দু-একবার তাঁহাকে ঘরে শিকল দিয়া বন্ধ করিয়াও রাখিতে হইয়াছে বিবাদ থামাইবার জন্য। অমূল্যচরণের কোন সন্তানাদি ছিল না। সম্পর্কে এক ভ্রাতৃপুত্র আসিয়া তাহার মৃত্যুর পর সুভাষিণীর নিকট থাকিতে শুরু করে এবং সুভাষিণীর যৎসামান্য যাহা কিছু গহনা এবং অর্থ ছিল, লইয়া পলায়ন করে। সেই অবধি সুভাষিণী আর কোন আত্মীয়-কুটুম্বের মুখ দর্শন করেন নাই, একাই রহিয়াছেন।

অপরদিকে, ব্রজমোহনের পিতা রাধামোহন অমূল্যচরণের মৃত্যুর পর একেবারেই স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। পরম সুহৃদ অথবা পরম শত্রু বিনা জীবনযাপন যেন অসহনীয় হইল। প্রকৃতপক্ষে রাধামোহনও আর বেশিদিন বাঁচেন নাই। রাধামোহনের মৃত্যু হইলে ব্রজমোহন তাঁহার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। অমূল্যচরণ নাই, তাহার কূলেও কেহ নাই, সুতরাং ঝগড়া কিংবা বন্ধুত্ব কোনকিছুই আর অবশিষ্ট রহিল না।

বহুদিন পর সুভাষিণীর দূরবস্থা দেখিয়া ব্রজমোহনই তাঁহার পিতাঠাকুরদিগের বন্ধুত্ব এবং শত্রুতা স্মরণ করিয়া সুভাষিণীর নিকটে আসেন। তাহাতে ব্রজমোহনের সহিত সুভাষিণীর কিছু রফা যে হইল এমত বলিতে পারি না, কিন্তু সুভাষিণী তাঁহাকে দেখিলে আর মুখ ঘুরাইয়া লইতেন না। সেই ব্রজমোহনের কন্যাই আমাদিগের ননীবালা। তাহাকেই অদ্য তোতাবাজারের উপর বসাইয়া পাত্রপক্ষের নিকট দেখাইবার কথা।


(৩)

পাত্রপক্ষ ননীবালাকে পছন্দ করিলেন। যেন গ্রামে গ্রামে রটি গেল সেই বার্তা। সুভাষিণীর কানে তাহা আসিয়া পৌঁছাইলে তিনি সগর্বে আপনার কাঁথার সুখ্যাতি করিতে লাগিলেন। সুভাষিণীর মতে, কাঁথার গুণ আছে, তাহার জন্যই ননীবালাকে পাত্রপক্ষ পছন্দ করিয়াছে। নহিলে ননীর আর কি এমন রূপ, কি এমন গুণ ইত্যাদি...। 

সন্ধ্যার প্রাক্কালে ননীর বাপ ব্রজমোহন সুভাষিণীর কাছে আসিয়া নীচু গলায় কিসব বলিলেন, আমরা তাহা শুনিতে পাই নাই, কিন্তু সুভাষিণী যেন তেলে-বেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন। কি, তাহার কাঁথা ননীর নামে চালানো, এত বড় আস্পর্দা! শুধু তাহাই নহে, পাত্রপক্ষ কাঁথাটি লইয়া যাইবে, শহরে সকলকে দেখাইতে চাহে ভাবী বৌ ঠাকুরাণীর হস্তশিল্প বলিয়া। সুভাষিণী যেন অকূল পাথারে পড়িলেন। ব্রজমোহনের এতদিনের সাহায্য, উপকার সকল কিছুই তাহার চক্ষে বিষ মনে হইতে লাগিল। ব্রজমোহন যে তাঁহাকে ঠকাইয়া এগুলি হস্তগত করিতে চাহে, তাহাও বলিলেন। অনেকদিন পর সুভাষিণী পুনরায় কুভাষিণী হইলেন।

সুভাষিণী বিস্তর চক্ষের জল ফেলিলেন, তাহার পর গঞ্জনা দিলেন, শেষে মৌন হইলেন। ননীর বাপ বুঝাইলেন। মা এক গোলা ঘোমটা টানিয়া মৃদুস্বরে অনেক বলিলেন। কিন্তু অনুরোধ-উপরোধেও তাঁহাকে টলাইতে পারিলেন না। একটি কাঁথার মূল্য যে একটি কন্যার বিবাহের চেয়েও বেশি, এ তাহারা বুঝিতে পারিলেন না। 

পরদিন প্রত্যুষে ননী আসিয়া সুভাষিণীর গৃহের দ্বারে কড়া নাড়িল। বাপ-মা তাহাকে পাঠাইয়াছে, যদি ননীর কথায় বৃদ্ধার রাগ প্রশমিত হয়। ননীবালা কড়া নাড়িয়া, হাঁকিয়া-ডাকিয়া বৃদ্ধা সুভাষিণীর কোন সাড়া পাইল না। ক্রমে ভিড় জমিল। গ্রামের মাতব্বরেরা গৃহের কপাট ভাঙ্গিয়া দেখিল তাহার ‘নতুনবাবু’কে জড়াইয়া বৃদ্ধা সুভাষিণী অঘোরে ঘুমাইতেছেন, আর একখানি কাগজের ওপর কাঁথা দুইটি জড়ানো অবস্থায় রাখা আছে, কাঁথার উপর শতছিন্ন একখানি চেলী, বোধকরি উহা সুভাষিণীর বিবাহের সময়ের।

সুভাষিণীর ঘুম আর ভাঙ্গিল না...


0 comments: