ছোটগল্পঃ সুভাষ মিত্র
Posted in ছোটগল্প
মূল্যবোধ
সুভাষ মিত্র
সাল টা আশীর মাঝামাঝি, একটি পারিবারিক ব্যাপারে প্রায়ই আদালতে যেতে হত, আলিপুর আদালতে দু’জন ছোটো বেলার উকিল বন্ধু আছে, সঞ্জয় আর সুবীর, ওরা দু’জন খুড়তুতো জাঠতুতো ভাই।
বাবা সদ্য গত হয়েছেন, মা খুবই অসুস্থ, বছর দেড়েক হল আমার বিবাহিত জীবন, উত্তরাধিকার সার্টিফিকেট-এর জন্য অনেক হ্যাপা পোয়াতে হয়েছে, আমার ক্লাসমেট সঞ্জয় সবরকম সাহায্য করছে।
একদিন কোর্টে ডেট ছিল, যথারীতি হাজিরা দিলাম, শুনলাম ম্যাজিস্ট্রেট সে দিন আসবেন না, আদালতে এ রকম প্রায়ই হয়। সঞ্জয় কে বললাম, চল্ সুবীর এর সঙ্গে একটু দেখা করে যাই, কিছু না হোক, এক কাপ চা তো খাওয়া যাবে, আর ব্যস্ত না থাকলে কিছুক্ষণ গল্প করা, এই আর কি। সময় টা কাটানো।
সুবীর এর চেম্বার এ গেলাম, মুহুরি বসতে বলল, স্যার এখুনি আসবেন, জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, যে সেদিন কোনও এজলাসে সওয়াল নেই, চেম্বারেই থাকবেন, তবে একজন মক্কেল আসতে পারে, আপনারা বসুন। কুড়ি মিনিট অপেক্ষার পর সুবীর চেম্বার এ ফিরে এলো, আমরা তো চলে যাবার কথা ভাবছিলাম। সুবীর যেতে দিল না, বহুদিন দেখা হয় নি, বলল চা খাবি? আমি বললাম শুধু চা? যা হোক চায়ের সঙ্গে টা ও এলো। জিজ্ঞাসা করল কোনও তাড়া নেই তো? তাহলে বস, এক মক্কেল আসবে, শাঁসালো মক্কেল, একটা জটিল মামলার পরামর্ষ করতে, শুনে যা, এই এলো বলে, সময় হয়েছে।
আমরা সেই পুরানো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছি, মুহুরি এসে খবর দিল, মক্কেল এসেছে, একই পরিবারের তিনজন, ভিতরে পাঠাতে বলল, আমাদের ছোটো করে বলল, শুধু শুনবি, আর আমি যা বলব বুঝে নিবি।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মক্কেল সপরিবারে হাজির, সুশ্রী সৌম্যদর্শন তিনজন, বাবা, মা, ছেলে, দেখলে মনে হবে, ভগবান একে অপরের জন্য সৃষ্টি করেছেন। অতি নম্র, নিষ্পাপ। যথারীতি আপ্যায়নের পর কাজের কথা আরম্ভ হল। মক্কেলের প্রথম কথা, দেখুন দাদা, যে গেছে সে তো আর ফিরে আসার নয়, পাঁচ কান যেন জানাজানি না হয়। যে ভাবে হোক এ যাত্রা উদ্ধার করতেই হবে। যত যা লাগে দেবো।
আমি আর আমার বন্ধু ঠিক কি ঘটেছে বুঝলাম না, দু’জনে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম, সুবীর বলে বসলো, মিস্টার রয়, আমি আমার পুরানো এক মক্কেলের
মারফৎ আপনার নাম জেনেছি, যে আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে, কিন্তু সঠিক কিছু বলেনি, বলেছে আপনার কাছে সব বিস্তারিত ভাবে জানতে, আপনাকে সব খুলে বলতে হবে, না হলে আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়তে হবে, যদি সবকিছু খুলে বলেন, আমার পক্ষে মামলা সওয়াল করতে সুবিধা হয়, বোধহয় সমীর বাবু আপনাকে সে কথা বলে দিয়েছেন, ওনার সুপারিশেই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছি।
মিস্টার রয় একবার আমাদের দিকে একটু দেখে আমতা আমতা করতে দেখে সুবীর বলল, চিন্তা নেই ওরা আমার সহকারী, আপনি সব কিছু আদ্যপ্রান্ত দ্বিধাহীন ভাবে বলতে পারেন।
মিস্টার রয় বলতে আরম্ভ করলেন, “ দেখুন আমার বিদেশের সঙ্গে আমদানি রপ্তানির ব্যাবসা আছে, আমার অফিস নভি মুম্বাই তে, সল্টলেকে আমার নিজের বাড়ি, পরিবারে আমরা তিনজন, আমি, এই আমার স্ত্রী, আর এই ছেলে,
ছেলে একটি বিদেশী ব্যাঙ্ক এর জোনাল ম্যানেজার, চেন্নাই তে পোস্টিং, আমার টাকার কোনও অভাব নেই, আমার স্ত্রী মাঝে মাঝে মডেলিং করে, ওর সখ, আমার ছেলের এক বন্ধুর বাড়ি বালিগঞ্জে, ছেলে যখন কোলকাতা আসে তখন বালিগঞ্জে বন্ধুর বাড়িতে রোজ যাওয়া আসা করে, ছেলের বাল্যবন্ধু। ওই বন্ধুর বাড়িতে আমার ছেলের সঙ্গে একটি মেয়ের আলাপ হয়, মেয়েটিকে আমার ছেলের ভাল লাগে, গত পাঁচ বছর আমার ছেলের সঙ্গে মেয়েটির মেলামেশা। আমি আগে এসব জানতাম না, একদিন গত বছরে ছেলে আমাকে মেয়েটির কথা জানায়, আমি তখন ছেলে কে একদিন মেয়েটিকে আমাদের বাড়িতে আনতে বলি, শুনেছিলাম মেয়েটি মুরলীধর এ পড়ে, একদিন আমার ছেলে রবিবার আমাদের গাড়িতে মেয়েটিকে আমার সল্টলেকের বাড়িতে নিয়ে আসে, মেয়েটি দেখতে খারাপ নয়, খুব আহামরি সুন্দরী ও নয়, খুব নম্র ও লাজুক, আমার ও ভালো লেগেছিল, নাম মিতালি।
প্রথমে নাম টা শুনে চমক লাগলো, যে মিতালি কে জন্মাতে দেখেছিলাম সে নয় তো? আবার মনে হোল দূর, এসব কি ভাবছি, মিতালি কত আছে, যাক আবার মিস্টার রয় ঘটনা বলতে শুরু করলেন, একদিন মিতালির বাড়িতে সপরিবারে দেখা করতে গিয়েছিলেন, অভিজাত পারিবার, মেয়ের দাদু স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন, একান্নবর্তী পরিবার, ভালই লেগেছিল।
প্রথম পর্যায়ে বিবাহের কথাবার্তা হয়েছিল, কিছুদিন পরে আবার একদিন দিন স্থির করা হল পাকা কথা বলার, পাকা কথার দিন, খুব সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে বিয়ের দিন ও দেনাপাওনা বিষয় ঠিক হয়ে গেল। ঠিক হোল দশ ভরি সোনা আর বিয়ের বেনারসি ছাড়া আর কিছু চাহিদা নেই। উভয় পক্ষই খুশী, যথারীতি বিয়ের দিন বেশ জাঁকজমক সহকারে বিবাহ কাজ সম্পন্ন হল, পরে পরে বৌভাত, দ্বিরাগমন সবই সুষ্ঠুভাবে কেটে গেল।
দুই বছর ভালোভাবে কেটে গেল, মিতালি তখন অন্তঃসত্বা, পুত্রবধূর সময়মত ডাক্তারের পরামর্শ, সময়মত ঔষধ খাওয়ানো, চেকআপ, কোনও ত্রুটি রাখা হয় নি, আমার স্ত্রীর একটাই ইচ্ছা পুত্রসন্তানের, আমরাও আশা করে ছিলাম তাই হবে, কিন্তু যেদিন পুত্রবধূ সন্তান প্রসব করলো, নারসিংহোম থেকে খবর পেলাম কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে, আমি সেইমাত্র নারসিংহোমের সঙ্গে যোগাযোগ করে কন্যাসন্তান সরিয়ে ফেললাম, সুযোগটা নিলাম, তখন পুত্রবধূ অ্যানেস্থেসিয়ার ঘোরে আচ্ছন্ন, সেন্স ফিরলে বলা হয়েছিল মৃত সন্তান প্রসব করেছে, টাকার জোরে অন্য বিভাগ থেকে একটি মৃত সন্তান দেখানো হয়েছিল। এরপর আমরা পুত্রবধূকে বাড়ি নিয়ে এলাম, কিন্তু কোনও ভাবে রহস্যটি একটু ফাঁস হয়ে গেছিলো, মেয়ের বাড়ির আত্মীয়রা এই নিয়ে বেশ জল ঘোলা আরম্ভ করতে শুরু করল, আমরা একটু ভয় পেয়ে গেছিলাম, পুত্রবধূ সুস্থ হলে যদি পুলিশ কেস করে আদালতে পুত্রবধূর বয়ান নেয়, এটাই ভয় হয়েছিলো।
ওদিকে পুত্রবধূর পরিবারের সকলে উকিলের পরামর্শ আরম্ভ করেছে, শোনা যাচ্ছিল আদালতেরও শরণাপন্ন হবার ব্যাবস্থা আরম্ভ করছে, আমরা প্রমাদ গুনলাম, কি করা যায়, কিছু ঠিক করতে পারছি না, আমার এক ব্যাবসায়িক বন্ধুকে ফোন করলাম, পুলিশ মহলে ওর বেশ জানাশোনা আছে, পরামর্শ দিল, একমাত্র উপায় প্রমাণ লোপাট কোরে দে, আমার মাথা তখন ঠিক কাজ করছিল না, কথাটা মনে ধরল, পরের দিন খুব সকালে ভোর হওয়ার আগে কিচেন এ গ্যাস ওভেন এর বার্নার বেশ কিছুক্ষণ খুলে রাখলাম, দেখলাম বেশ গ্যাসের গন্ধ, কিচেন-এর জানালা গুলি বন্ধ রেখেছিলাম, স্ত্রী এবং পুত্র কে বলেছিলাম তোমরা উঠবে না। পুত্রবধূ সবে টয়লেট থেকে বেরিয়েছে, অতি শান্ত গলায় বললাম, বৌমা তোমার শাশুড়ির কাল রাত থেকে জ্বর, আমাদের তিনজনের একটু চা করতে পারবে? পুত্রবধূ রাজি হয়ে কিচেন-এর দিকে গেল, আমি খুব মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম, পুত্রবধূ একবার গাসের গন্ধ পেয়েও দেখলাম বার্নারে চায়ের জল চাপিয়ে লাইটার জ্বালাতেই একটি ফ্ল্যাশ, পুরো শাড়ীটা জ্বলে উঠল, একটি চিৎকার, তখন শাড়ীটা পুরো জ্বলছে, খোলার চেষ্টা করছে পারছে না, কয়েক মিনিট পর আমি কিচেন-এর দিকে এগিয়ে লোক দেখান চিৎকার করে স্ত্রী কে ডাকলাম, চিৎকার শুনে ছেলে ও উঠে এলো, ততক্ষণে নিম্ন এবং ঊর্ধ্বাঙ্গ অনেকটা পুড়ে গেছে, কিচেন-এর সব জানালা খুলে দিলাম, জল দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফোন করে এম্বুল্যান্স ডেকে পুত্রবধূ কে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হসপিটাল-এ পৌঁছালাম, তখন ও সামান্য জ্ঞান ছিল, এমারজেন্সি থেকে বেড, বার্নট কেস, আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে, ভিতরে পুলিশ, ডাক্তার মিলে পুত্রবধূর শেষ বয়ান নিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হোল না, এক ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ।
বেয়াই বাড়ি নাছোড়বান্দা, নারসিংহোম থেকে চাপে পরে কিছু কথা পুলিশ কানে এসেছে, এখন আরম্ভ হয়েছে, আমরা যে কোনও সময় গ্রেপ্তার হতে পারি, আপাতত আমরা টিটাগড় এ আমার এক বন্ধুর আশ্রয়ে আছি, বাড়ি ফিরতে পারছি না, বাড়ির উপর পুলিশ এর নজরদারি চলছে। সব কিছুই এখন
আপনার হাতে, যে ভাবে হোক বাঁচান, যত টাকা লাগে দেবো, টাকার চিন্তা করবেন না।
সুবীর নির্বিকার, বলে ফেলল কিছু ভাববেন না। আমি যে ভাবে বলব সেই সেই ভাবে চলবেন, শুধু আমার সঙ্গে সময় সময় যোগাযোগ রেখে চলুন, আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিয়ে যান, পুলিশ সামলানো, প্রাথমিক মামলা সাজান খরচ
বাবদ, পঞ্চাশ হাজার, এখন, পরে মামলা চলাকালীন যখন যা লাগবে বলব, আপাতত নিজের বাড়ি এখন ফিরবেন না, আমি না বলা পর্যন্ত।
আমাদের সামনে মক্কেল পঞ্চাশ হাজার নগদ বান্ডিল দিয়ে দিল, চোখে মুখে কোনও অনুতাপ নেই, আমি হতভম্ব।
মক্কেল চলে যেতে আমি সুবীর কে বললাম, এই নৃশংস মামলা তুই নিলি? তোর বিবেকে আটকাল না?
উত্তরে সুবীর বলল, ওকালতি একটি ব্যাবসা, এখানে টাকার খেলা চলে, টাকা দিলে দিন কে রাত, রাত কে দিন করা যায়।
আমি বললাম, এই মামলা তুই জিতবি? উত্তরে সুবীর বলল, না হলে কি এমনি আশা দিলাম? যাক দেখলি তো মহরত-এ কেমন এল। তোরা কি খাবি বল, কোথায়ে খাবি, চল আজ গ্র্যান্ড ফিস্ট হয়ে যাক।
ঘৃণা তে আমার যেন গা বমি লাগলো, সঞ্জয় আমাকে ওঠার ইসারা করল, সুবীর কে বললাম, আজ একটু দরকার আছে, বড় দেরী হয়ে গেছে, আর একদিন আসব, সুবীর একটু হেসে বলল, চাকরি করে তোরা কত উপায় করিস? আমাকে দ্যাখ কম সময় অফুরন্ত লক্ষ্মী, ভাগ্য চাই। আমাদের গা টা ঘৃণায় রি রি করে উঠল।
দুটি পরিবার, এক পরিবার সন্তান হারিয়ে শোকে হাহাকার করছে, আর এক পরিবার টাকার জোরে গর্হিত ঘৃণ্য অপরাধ করেও ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রমাণ করবে তারা নিরপরাধ।
এটা কি প্রকার সামাজিক মূল্যবোধ?
0 comments: