1

গল্পঃ শমিতা চ্যাটার্জী

Posted in

গল্প


চেনা –অচেনা 
শমিতা চ্যাটার্জী 



শরৎ শেষ হতে চলেছে, গত দুদিন বৃষ্টি হওয়ায় ঠান্ডাটা জাঁকিয়ে পড়েছে, আজ সকাল থেকেই মেঘ সরে গিয়ে মাঝে মাঝেই মিষ্টি রোদ্দুর দেখা দিচ্ছে। দু দিন জ্বরের পর মায়ের শরীরটা আজ একটু ভালো, তাই ঝিনুক মাকে বারান্দার চেয়ারে বসিয়ে কাশ্মীরী শালটা বেশ করে জড়িয়ে দিল। এই দুদিন নীচের বাজারে যাওয়া হয়নি, কয়েকটা জিনিস আনতে আজ ঝিনুককে একবার নীচের বাজারে যেতেই হবে। কালো জিনসের ওপর বাদামী রঙের সোয়েটার চাপিয়ে মাথায় কাশ্মীরী নকশা করা স্কার্ফটা বেঁধে ঝিনুক নেমে এলো রাস্তায়। 

শহর থেকে অনেকটা উঁচুতে একটা টিলার ওপর এই সরকারি ডাকবাংলো, বাবা প্রিয়ব্রত সেন সরকারি অফিসার। স্ত্রী সঞ্চিতা ও একমাত্র মেয়ে ঝিনুককে নিয়ে এখানে দিন পনেরোর ছুটি কাটাতে এসেছেন। দর্শনে এম.এ. পাশ করে ঝিনুক কলকাতার একটা নামকরা প্রাইভেট স্কুলে সবে জয়েন করেছে। ফর্সা রঙ, উচ্চতা সাধারণ বাঙালী মেয়েদের থেকে একটু বেশী ও সুন্দর নিটোল গড়ন, চোখে হালকা নীল কাঁচের রীমলেস চশমায় ঝিনুকের ব্যাক্তিত্ব যেন আরও বেশী চোখে পড়ে। 

হাতে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ফাঁকা পাকদণ্ডী রাস্তা দিয়ে নামতে নামতে বড় বড় গাছের সারি আর দু-পাশে সবুজের মাঝে নাম না জানা বুনো ফুলের মধ্যে দিয়ে বেশ লাগছে হাঁটতে। সমতলে এখন স্কুল-কলেজের পূজোর ছুটি চলছে, তাই পর্যটকেরও ভিড় বেশ। নীচে নেমে এসে একটা মলে গিয়ে জিনিসগুলো পছন্দ করে কিনে বেশ ক্লান্ত হয়েই বেরিয়ে এলো ঝিনুক। 

বাইরে এসেই চোখে পড়লো রাস্তার উল্টো ফুটপাথে ছোট্ট একটা পাথরের গয়নার দোকান। ঝিনুক সাজগোজ বিশেষ করে না, শুধু কানের দুলের প্রতি একটু ঝোঁক আছে, নানান পোশাকের সাথে মানানসই দুল পরতে ভালোবাসে। বেশ দেরি হয়ে গেছ, তবু গয়না কেনার লোভে রাস্তা পার হয়ে চলে এলো দোকানটায়। সকালবেলায় খদ্দের পেয়ে বৃদ্ধা দোকানির মুখ উজ্জল হয়ে উঠলো। এটা সেটা দেখতে দেখতে বেশ কটা পাথরের দুল কিনে ফেললো ঝিনুক। এবার বাড়ী যেতে হবে, রোদটাও বেশ চড়া হয়েছে, রাস্তায় নেমে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ডের দিকে একটু এগোতেই দূর থেকেই ভিড়টা চোখে পড়ল। আজও অনেক নতুন পর্যটক এসেছে, স্থানীয় লোকেরও জমায়েত। কাছে গিয়ে শুনলো কি একটা দাবি নিয়ে এখানকার সব ট্যাক্সি ইউনিয়ন ধর্মঘট ডেকেছে। ঝিনুক এখন কি করবে! হাতের প্যাকেট দুটোও বেশ ভারী হয়েছে, এগুলো নিয়ে ওর পক্ষে তো হেঁটে অতটা ওপরে ওঠা সম্ভব নয়! আগে জানলে আজ বাজারে আসতোই না। ভিড়ের পাশ কাটিয়ে পাশের একটা ফুলের দোকানে শেডের নীচে ব্যাগদুটো নামিয়ে একটু দাঁড়ালো ঝিনুক। 

হঠাৎ চোখে পড়ল এক সুঠাম যুবক মন দিয়ে ফুল পছন্দ করে যাচ্ছে। বছর সাতাশ আঠাশ বয়স হবে, শ্যামলা গায়ের রঙ, বেশ লম্বা, মাথায় এলোমেলো ঘন চুল, চোখে সানগ্লাস, দেখে তো বাঙালী বলেই তো মনে হচ্ছে। ফুল কিনে যুবকটি বেরিয়ে এলো, তারও চোখে পড়ল চিন্তিত মুখে একপাশে দাঁড়ানো ঝিনুকের দিকে। আপাদমস্তক ঝিনুককে দেখে ভাবলো, মেয়েটি বোধহয় একলা, সঙ্গে লাগেজ নেই আর পাশে রাখা জিনিসপত্র বোঝাই ব্যাগ দুটো দেখে বুঝলো আজকের আসা পর্যটকদের কেউ নয়, স্থানীয় বাসিন্দা তো মনে হচ্ছে না, নিশ্চয়ই আচমকা ট্যাক্সি স্ট্রাইকের জন্য ঝামেলায় পড়েছে। একবার জিজ্ঞেস করে দেখাই যাক, যদি কোন সাহায্য করতে। একটু কাছে গিয়ে বলল, নমস্কার, টুরিস্ট মনে হচ্ছে ! এই গোলযোগে ফিরতে পারছেন না, তাই তো? আমি এই শহরেই থাকি, যদি কোন সাহায্য চান তো ---- । 

ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঝিনুক। অন্য সময় হলে এ রকম গায়ে পড়া কথায় হয়ত রাগই হতো, কিন্তু এখন তো ফিরিয়েও দিতে পারছেনা। মনের দোটানায় কি বলবে ভেবে পেলো না ঝিনুক। এবার যুবকটি যেন একটু শাসনের সুরেই বলে উঠলো, সারা দিন কি দোকানে দাঁড়িয়েই কাটবে? আমার ওপর কি বিশ্বাস হচ্ছেনা? আরে,আমি কোন ক্রিমিনাল বা ডাকাত নই মশাই, নেহাতই ছাপোষা ইস্কুল মাস্টার। আমার একটা ঘোড়া আছে, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। ঝিনুক তখনো মনস্থির করতে পারছে না দেখে সে এক গাল হেসে বলল, বেশি ভেবে লাভ নেই, আমি কিন্তু তাহলে চলে যাব। চলুন, চলুন, আর যদি খুব ঋণী মনে হয়, এক কাপ চা বা কফি খাওয়ালেই সব শোধবোধ হয়ে যাবে। তা এখানে উঠেছেন কোথায়? যুবকটির নির্মল হাসি আর সপ্রতিভ বাচনভঙ্গীতে ঝিনুক আর না বলল না, ঠিকানাটা বলল। 

--- এটা ধরুন তো প্লীজ, বলে যুবকটি ওর সদ্য কেনা গোলাপ আর রজনীগন্ধার স্তবকটা ঝিনুকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওর ভারী ব্যাগ দুটো তুলে নিয়ে এগিয়ে গেল পার্কিং লটের দিকে, ঝিনুকও ওকে অনুসরণ করল। 

--- আমি সাগর, সাগর মুখার্জ্জী, পার্কিং লটে একটা বাইকের কাছে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল যুবক বলল।

--- আমি ঝিনুক সেন, বাবা-মার সঙ্গে কদিনের জন্য গ্যাংটক বেড়াতে এসেছি।

--- বেশ, বেশ, নিন, উঠে পড়ুন, সাগর বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল, সাবধানে ধরে বসবেন। এভাবে অপরিচিতের সাথে বাইকে ফেরা! একটু সঙ্কোচই লাগছে ঝিনুকের, কিন্তু উপায় নেই, উঠে বসল একটু ব্যাবধান রেখে। রোদ ঝলমল আকাশ, শান্ত নির্জন পাহাড়ি পাকদণ্ডীর রাস্তা ধরে বাইক ছুটে চলল। ঝিনুকের মনে একটা অদ্ভুত অনুভুতি খেলা করছে। 


ঝিনুকের দেরী দেখে প্রিয়বাবু আর সঞ্চিতা এতক্ষণ উদ্বিগ্ন মুখে বসে ছিলেন বারান্দায়। মেয়েটা সেই কখন গেছে, অনেক বেলা হয়ে গেল! হঠাৎ দেখলেন একটি বাইক এসে দাঁড়াল, এক যুবকের সঙ্গে ঝিনুক নামছে। ঝিনুক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সাগর বাইক স্ট্যাণ্ড করে এগিয়ে এলো। বাবা-মায়ের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে ঝিনুক কিছু বলার আগেই সাগর বলতে শুরু করল, নমষ্কার, আমি সাগর মুখার্জ্জী। গত চার বছর ধরে আমি এখানেই আছি, একটা মিশনারী স্কুলে ইংরেজি পড়াই, স্কুলের কাছেই একটি বাড়ী নিয়ে একাই থাকি, আদতে কিন্তু উত্তর কোলকাতার পাক্কা ঘটী। সৌভাগ্যক্রমে দুম করে আজ ট্যাক্সি স্ট্রাইক হয়ে গেল, আর আপনাদের মেয়েকে নিরাপদে পৌঁছে দেবার ছুতোয় আর একদিন এসে একটু কফি খাওয়ার লোভে চলে এলাম। কি, ভালো করিনি! 


সকলে হেসে উঠল ওর কথায়, প্রথম পরিচয়ের কোন জড়তা নেই, সাবলীল কথাবার্তা।

--- বেশ করেছ, সত্যিই বেশ চিন্তা হচ্ছিল ওর দেরি দেখে, প্রিয়বাবু ও হেসে বললেন, কফি তো খাওয়াতেই হবে। 

ওটা পাওনা রইল, আজ দেরি হয়ে গেছে। অনেক কাজ পড়াশুনা সব রয়েছে, বলে সাগর উঠে পড়লো। 

--- আমরা তো এখানে নির্বান্ধব, তাই সময় পেলেই চলে এসো, কফি ও গল্পে সময় ভালই কাটবে। প্রিয়বাবু আন্তরিক গলায় বললেন। 

--- সম্মতি জানিয়ে হাত নেড়ে বাইক স্টার্ট করে চলে গেল সাগর। 

সাগরের গমন পথের দিকে অপলকে চেয়ে আছে ঝিনুক, একবারও ফিরে তাকালো না সে। তার ভাল লেগে গেছে সুদর্শন ও সপ্রতিভ যুবকটিকে। হঠৎ মনে পড়ল, সাগরের দেওয়া ফুলের স্তবকটা তখনো ওর হাতেই রয়ে গেছে। 

এ ক’দিন রোজই সন্ধ্যেবেলা সাগরের আসা বাঁধা হয়ে গেছে, কখনো বাবার সাথে দাবা খেলা, তাতে তর্ক-বিতর্ক, চুরি কারচুপি সবই হতে থাকে, হৈ চৈ বাঁধিয়ে দেয় সাগর। কখনও আবার ঝিনুক কে জোর করে গান করানো, কবিতাপাঠ, এই সবও চলতে থাকে। সঞ্চিতা দেবীও বেশ খুশী, তাঁর অনেকদিনের পুরানো কথা, গান স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। চর্চা না করা গলায় উনিও ঝিনুকও সাগরের সাথে গলা মিলিয়ে গুনগুন করে ওঠেন --- বেশ কাটছে সন্ধ্যেগুলো। 

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় প্রিয়বাবুর সাথে দাবা খেলার সময় সঞ্চিতা সাগরকে বললেন, তোমার ফ্যামিলির কথা তো কখনও কিছু বল নি সাগর! একা একা থাকো এই পাহাড়ি দূরদেশে! তাঁরা কি সব কোলকাতাতেই থাকেন? 

সাগর থমকে গেল। খেলা থেকে মুখ তুলে একটু যেন নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দু বছর আগে কেদারনাথ পাহাড়ে যে ভয়ঙ্কর প্রলয় হয়েছিল, সে বছর আমার বাবা, মা আর ছোট বোন বেড়াতে গিয়েছিল। সেই প্রলয় থেকে তারাও রক্ষা পায়নি। নিজের চেষ্টায় আর সরকারি সাহায্যে দু মাস ধরে কোথাও খুঁজতে বাকি রাখিনি, কিন্তু কোন হদিসই পাই নি ওদের। 

এমন মর্মান্তিক ঘটনার কথাটা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। এই সদা হাসিখুশি প্রাণবন্ত যুবকটির মনের মধ্যে যে এত ব্যথা লুকিয়ে আছে তা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি! পরিবেশটা ভারী হয়ে গেল। 


সকাল থেকেই ঝিনুকের মনটা বড় উতলা আজ। পরশু থেকে সাগরের পাত্তা নেই, মোবাইলেরও সুইচ অফ। একা একা কি করছে কে জানে! কি করে কাটছে ওর সন্ধ্যেগুলো! ভেবে পায় না ঝিনুক। প্রিয়বাবু ও সঞ্চিতাও চিন্তা করছেন খুব। কি যে হল ওর! 


কাল সন্ধ্যে থেকে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছে। সকালে আকাশের একদিকে কালো মেঘ একটু দানা বাঁধলেও অন্যদিকে মিষ্টি রোদে ভরে উঠেছে, বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। ঝিনুক তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়ল সাগরের ঠিকানায়। খুব দূর তো নয়, বাজারের উল্টো দিকে ঘুরে ঘুরে একটা রাস্তা উঠে গেছে পাশের উঁচু টিলায়, সাগর বলেছিল, মিশনারী স্কুল আর তার পাশ দিয়ে যে ঢাল নেমে গেছে সেদিকেই ওর বাসা। স্থানীয় লোকদের জিজ্ঞেস করে সঠিক বাড়ীর সামনে পৌঁছে গেল ঝিনুক। ছোট একতলা কটেজ টাইপের বাড়ী, গেট পেরিয়ে একটা ছোট লন আর ফুলের বাগান, পাঁচ ছটা সিঁড়ি উঠে সামনে গোল বারান্দা। গেটটা খোলাই রয়েছে দেখে ঢুকে পড়ল ঝিনুক। বারান্দায় উঠে ডাকবে কিনা ভাবতে ভাবতেই মাঝ বয়সী এক পাহাড়ী মহিলার ডাকে চমক ভাঙলো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জিজ্ঞেস করল, কার খোঁজে এসেছো দিদিমনি? ঝিনুক সাগরের কথা বলতেই ওকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলো। একটা মাঝারী মাপের ঘর, হালকা বেতের সোফা, সেন্টার টেবিল, আর দেওয়াল জুড়ে বইয়ের আলমারিতে রাশি রাশি বই। ওদিকে পর্দা দেওয়া একটা ঘর, মনে হয় বেডরুম; একপাশে কিচেন আর টয়লেট। সব কিছুই খুব রুচিসম্মতভাবে সাজানো গোছানো, তকতক করছে। সাধারণ ব্যাচেলরদের ঘরের মত অগোছালো নয়। 

সাগর ভিতরেই ছিল, উঠে এল। উসকোখুসকো চুল, এক মুখ দাড়ি, চোখের কোল বসে গেছে, সাগরকে দেখে চমকে উঠল ঝিনুক। 

--- একি চেহারা হয়েছে দুদিনে তোমার! ঝিনুক না বলে পারলো না। 

--- আর বোলো না! সেদিন ফেরার পথে বৃষ্টিতে ভিজে রাত থেকে খুব জ্বর, কে আর সেবা করবে! এই মাসী আছে তাই বেঁচে আছি। 

--- একটা খবরও তো আমাদের দাওনি, ঝিনুকের গলায় অভিমান, আমরা সবাই খুব চিন্তা করছিলাম। তোমার মোবাইলও অফ! বাবা-মা খুব ভাবছেন। 

--- সে আর এক কাণ্ড! প্রথমত এদিকে টাওয়ার খুব ডিস্টার্বড, তার ওপর চার্জারটা খুঁজেই পাচ্ছিলাম না, আজ পেলাম খাটের নীচে। 

মাসীকে কফি করতে বলে সাগর ও ঝিনুক গল্প করতে লাগলো।

কত কথাই না হল! সাগরর ছেলেবেলা, কলেজ জীবন, বাবা, মা বোনের সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া --- আরো কত কি! স্বল্পভাষী ঝিনুকও মন খুলে বলল তার জীবনের ঘটনা, ছোট ছোট সুখের স্বপ্ন আর কিছু নিজের মনের কথা। মাত্র কিছু সময়ের মধ্যেই ঝিনুকের মনে হল সাগর যেন তার কত দিনের চেনা! আর দুজনের পছন্দ-অপছন্দেরও কি অদ্ভূত মিল! 

--- আজ আর জ্বর নেই, সাগর বলল, কাল তোমাদের ওখানে যাব। 

সাগরের নানা বিষয়ের বই-এর দেখে ঝিনুক অবাক! আর কত বিভিন্ন বিষয়ে অর জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে খুব ভাল লাগল ওর। বলল, আমার বই পড়তে খুব ভাল লাগে, কটা বই নিয়ে যাব? 

--- নিশ্চয়ই, তোমার যতগুলো ইচ্ছা নিয়ে যাও। সাগর নিজেই উঠে ঝিনুককে কয়েকটা বই বেছে দিলো। 

সাগরের রুচি, রসিকতা ও সৌন্দর্যবোধ ঝিনুক যত দেখছে তত আকৃষ্ট হচ্ছে। নিজেকে সংযত করতে চোখ চলে গেছে জানালার বাইরে পাহাড়ের গায়ে, যেখানে মেঘ নেমে আসছে পাহাড় কে সাদা চাদরে আবৃত করে, যেন আড়াল করে রাখছে মনের গোপন বাসনাটুকু। 

--- বেলা বাড়ছে, এবার আমায় যেতে হবে, বলে ঝিনুক উঠে দাঁড়ালো।

--- চল, আমি বাইকে দিয়ে আসছি তোমাকে।

--- আরে, না না, এই শরীর নিয়ে তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না, আমি হেঁটেই চলে যেতে পারব। ঝিনুক বেরিয়ে পড়ল, সাগর ওকে রাস্তা অবধি এগিয়ে দিয়ে গেল। 

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কত কথাই মনে পড়ছে ঝিনুকের। প্রতীকের কথা বেশী মনে পড়ছে। প্রতীক রায়, ঝিনুক যে তার বাগদত্তা, তবু কেন সাগরের প্রতি সে এত আকৃষ্ট হচ্ছে! 


শুক্রবার, সকাল বেলাতেই সাগর চলে এসেছে ডাক বাংলোয়, কাল আর পরশু সাগরের স্কুলে দুদিন ছুটি। গল্প করার লোক এসে যাওয়ায় প্রিয়বাবু তো ভীষণ খুশী। চা জল খাবার খেতে খেতে বারান্দায় বসে সবাই মিলে ভালোই আড্ডা জমেছে। 


--- আপনারা বেশ কিছুদিন তো হয়ে গেল এখানে এসেছেন, কিন্তু কোথাও তো বেড়াতেই গেলেন না! সাগরই কথাটা তুললো। 

--- যেতাম, কিন্তু এখানে আসার পরই মায়ের শরীরটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় আমাদের আর কোথাও যাওয়া হয়নি, ঝিনুক বলল। 

--- এখন তো মাসীমা বেশ ভালোই, যান, সবাই মিলে কোথাও বেড়িয়ে আসুন, আমি সব ব্যাবস্থা করে দেব, সাগর জানাল। 

সাগরের প্রস্তাবে সবাই রাজি।

--- কিন্তু তোমাকেও যেতো হবে সঙ্গে, তবেই যাওয়া হবে, প্রিয়বাবু বিচারকের মত ভারি গলায় রায় দিলেন। 

ঠিক হলো আগামীকাল ওরা ছাঙ্গু লেক দেখতে যাবে। যাবার সব ব্যাবস্থা সাগরের ওপরই ছেড়ে দিলেন প্রিয়বাবু। ঝিনুক ও খুব খুশী, ওরও বাড়ীতে বসে একঘেয়ে লাগছিল। ওদের কথার মাঝেই একটা ফোন এল।, প্রতীকের ফোন; ঝিনুক উঠে ভিতরে গেল। 

--- একটা সুখবর তো দেওয়াই হয় নি তোমাকে, প্রিয়বাবু বললেন, আগামী ফাল্গুনেই ঝিনুকের বিয়ে ঠিক হয়েছে, প্রতীক রায়, আ রিয়েল জেম! কলকাতার ছেলে বিদেশে পড়াশুনা করে এখন একটি বিদেশী কোম্পানীতে একেবারে উঁচু পোষ্টে আছে, ওর বাবাও নাম করা ব্যবসায়ী। এখান থেকে ফিরেই আমাদের তোড়জোড় শুরু করতে হবে, তোমাকেও কিন্তু আসতে হবে সাগর। তুমি তো এখন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছ, তাই না! 

--- অবশ্যই যাব, সাগর হেসে উত্তর দিল, সাত দিন আগেই ছুটি নিয়ে চলে যাব, গায়ে হলুদ থেকে ফুলশয্যার শেষ অবধি দারুণ আনন্দ করব দেখবেন। 

কথা বলে ফিরে এল ঝিনুক, ভাবলেশহীণ মুখ। প্রতীক রোজই একবার করে ফোন করে, একটা যেন শুকনো কর্তব্য, কথার মধ্যে কোথাও যেন মনের ছোঁয়া নেই, যেন বড় বেশী যান্ত্রিক। 


পরেরদিন খুব ভোরে উঠে সকলে বেশ তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিল। ঠিক সময়ে সাগরও একটা ভাড়াগাড়ি নিয়ে হাজির। একটা বাস্কেটে ফল, কেক ও বেশ কিছু শুকনো খাবার প্যাক করে এনেছে সাগর, সঞ্চিতাও ফ্লাস্কে কফি ভর্তি করে নিয়েছেন। কুয়াশা সরে গিয়ে সোনালী রোদ ঝলমল করছে, সকলের মন খুশীতে ভরা। প্রিয়বাবু ও সঞ্চিতা দেবী উঠে পড়েছেন গাড়িতে, 


--- ঝিনুক, ক্যামেরা নিতে ভুলনা কিন্তু, সাগর মনে করিয়ে দিল, সব ছবি তুলে রেখো, স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে, সঙ্গে আমিও, পরে আবার কখনো তোমার সাথে দেখা হবে না হয়তো! বেশ মজা করে বললেও কথাটা বলতে গিয়ে একটু যেন স্বর কেঁপে গেল সাগরের। ঝিনুকও কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ল। 


গাড়ী ছুটে চললো আঁকাবাঁকা পথ ধরে, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। কখনো পাহাড়ের পাকদন্ডি বেয়ে উঠে চলেছে খাড়াইয়ে, এক পাশে অতল খাদ; কখনো বরফে ঢাকা সাদা পাহাড়কে ঘিরে মেঘের খেলা। সাগর গান গেয়ে উঠল --- মন মোর মেঘের সঙ্গী--। সবাই গলা মেলাল তার সাথে। 


রাস্তায় মাঝে মাঝেই ঝর্ণা চোখে পড়ছে, পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে, কোথাও রাস্তার মাঝেও সেই জল তিরতির করে বয়ে চলেছে; এবার একটু বিরতি দরকার, ব্রেকফাস্ট সেরে নিতে হবে।

একটা বড় ঝর্ণা দেখে সাগর গাড়ী থামাতে বলল। রাস্তার ধারে অনেক উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসছে। পাহাড়ী কোন এক বালিকার মতই ছন্দে ছন্দে নুপুরের তালে নেচে চলেছে এ পাথর থেকে সে পাথরে। সবাই নেমে এল গাড়ি থেকে। 

--- চলুন, ওটার কাছে গিয়ে বসি একটু, সাগর বলল। 

--- আমরা আর অত দূর পাথর ভেঙে যেতে পারবোনা বাপু, রাস্তার ধারে এই কালভার্টের ওপরেই বসি, এই বলে প্রিয়বাবু কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বাঁচাতে মাফলারটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিলেন গলায় ও মাথায়৷ সঞ্চিতাও মাথায় শালটা ভাল করে জড়িয়ে খাবারের বাস্কেট নিয়ে সেখানেই বসে পড়লেন 

--- আমি যাব ওই ঝর্ণার কাছে কাছে, বলেই ঝিনুক বাচ্চা মেয়ের মত ছুটল ঝর্ণার দিকে, অগত্যা সাগরও লম্বা লম্বা পা ফেলে ওর পিছু নিল। 

কাছে গিয়ে থমকে গেল দুজনে, উফ! কোন উঁচু থেকে জল নেমে আসছে! সাদা ফেনার মত এসে পড়ছে নিচে, সেই জলের ছিটে লাগছে ঝিনুকের গায়ে, 

--- তুমি কি আমার সাথে আসতে চাও ঝিনুক? চলে এসো, পাথরের ওপর পা রেখে এগিয়ে যেতে যেতে বলল সাগর, এরকম কাছ থেকে আর দেখতে পাবেনা, ভয় পেয়োনা, সতর্ক থাকো, পাথর কিন্তু বেশ পিছল। 

--- আমার হাতটা ধর ঝিনুক, আমি ঠিক তোমায় সামলে রাখব, হাতটা বাড়িয়ে দিল সাগর। 

ঝর্ণার একেবারে কাছে পৌঁছে সাগরের হাত শক্ত করে ধরলো ঝিনুক, একটু ছোঁয়ায় সাগরের দেহ-মনে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। আবার স্বাভাবিক সাবলীল দুজনেই৷ নাঃ! কি ভাবছি আমি! ঝিনুক তো এখন একজনের বাগদত্তা, তবু কাছে পেলে ভালো লাগছে ওকে, ওর সঙ্গ এত মধুময় করে তুলছে আজকের এই দিনটাকে! না আর কিছুতেই এইসব ভাববো না, একটু অন্যমনষ্ক হয়েই এগিয়ে গেল আরও কয়েকটা পাথর টপকে ঝিনুকের হাত ধরে জলের আরও খানিকটা কাছে। এক আঁজলা ভরে জল নিয়ে সাগর ঝিনুকের হাতে দিয়ে বললো, হিমালয়ের কোন গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসছে এই জল, নাও মেখে নাও, তোমাকে আরও সুন্দর ও নির্মল করবে। 

ঝিনুক কিছু বলবে কি? শুধু অবাক হয়ে শুনলো ওর কথাগুলো, দেখলো ওর মায়াবী চোখের আকুতি। ভাবল, ঠিক এই রকমই তো একটা মন পেতে চেয়েছিলাম আমি, এই রকম সরল মন, যে ভালবাসতে জানে, কিন্তু প্রতীকের কাছে তো এরকম পাই না। একটা সমুদ্র বা জঙ্গলের চেয়ে, বিলাসবহুল রেসট্যুরেন্ট প্রতীকের কাছে অনেক প্রিয়; মেঠো পথে গোধুলির রঙ মেখে শালবনের মাঝখানে রাখালিয়া বাঁশী শোনার চেয়ে প্রতীক তো নামী দামী এ সি গাড়ী ছুটিয়ে, ধুলো বাঁচিয়ে চলে যেতে চায় কোন রিসর্টে কদিন সুখে আর বিলাসিতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিতে। 

দিনের পর দিন প্রতীকের সাথে যখনই দেখা হয়েছে, প্রতিপদে ঠোক্কর খেয়েছে ঝিনুক। ঝর্ণা থেকে ফিরার পথে এই সব কথাই উতলা করছে ঝিনুককে। তবে কি প্রতীকের সাথে আমি সুখী হব না! যত সাগরকে দেখছি কেন আমার মনে হচ্ছে, আমি এরকমই তো চেয়েছিলাম! 


একটু অন্যমনষ্ক হয়ে ফিরতে গিয়ে হঠাৎ পিছল পাথরে সামলাতে না পেরে পা স্লিপ করে গেল ঝিনুক, আর একটু হলে পড়েই যেত। সাগর কাছেই ছিল, চট করে ওকে ধরে নিল নিজের বুকের মধ্যে। এক লহমা স্থির হয়ে রইল দুজনে, সাগর ভুলে গেল ঝিনুক তার নয়। কয়েক মাস পরেই তো সে অন্যের হতে চলেছে, তবু কেন তার এত নিজের মনে হল ঝিনুককে বুকের মাঝে পেয়ে! যেন কত আপন! ঝিনুকও স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ সব ভুলে সাগর কে অপলকে দেখছে, বুকের মাঝে এই স্থানটা যেন ওর একান্ত নির্ভর যোগ্য, পরম নিশ্চিন্তের, একেবারে কাছের। সময় যেন হঠাৎ থমকে গেছে! 


একটু পরে দুজনেই সামলে নিল নিজেদের, সাগর সহজ করার জন্য হেসে বলে উঠলো, এখন পড়ে গেলে কি কান্ডই না হতো বল তো! খোঁড়া হলে আর আমার বিয়েই হত না আর। 


--- আরে কেউ না করলে এই হতভাগা তো রয়েইছে! হাঃ হাঃ, তুমি কানা খোঁড়া হলেও আমার আপত্তি নেই ঝিনুক। গলা ছেড়ে হাসতে হাসতে বলল সাগর। এসো, আমার হাত ধরে চলো, অচেনা পাথরে পা রাখার সময় সতর্ক থেকো। জীবনের ক্ষেত্রেও এটা মনে রেখো, প্রতিপদে সন্তর্পনে পা ফেলো, জীবনটা তোমার ঝিনুক, কোনো দায়বদ্ধতার জন্য নিজের সুন্দর ইচ্ছাগুলোকে মেরে ফেলে জীবনটা নষ্ট হতে দিওনা। 

ঝিনুক এমনিতেই কথা কম বলে, তার ওপর সাগরের কথা শুনে ভাবল, ও কি আমার আমার চোখের ভাষা পড়তে পারছে, মনের কথা কি সব ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে! আমি যে প্রতি পদে প্রতীকের সাথে ওকে তুলনা করে ফেলছি! আমি যে জিতিয়ে দিচ্ছি সাগরকে ও কি তা বুঝে ফেলছে!

ফিরে এলো ওরা। সঞ্চিতা চিন্তা করছিলেন, ওরা আসাতে নিশ্চিন্ত হয়ে ফ্লাস্কে আনা কফি ও কেক বের করে দিতে শুরু করলেন। বললেন, যা ঠান্ডা এদিকে, এই খাবারগুল আর গরম গরম কফি খেয়ে নাও।

কিন্তু ওদের আর খাওয়ায় মন নেই, কি এক অব্যক্ত চিন্তায় দুজনেই একটু অন্যমনস্ক। যে উচ্ছলতা নিয়ে দুজনে গিয়েছিল, ফেরার পরে কেমন যেন চুপচাপ দুজনেই, সহজ হতে পারছেনা যেন। 

প্রিয়বাবু তো ওদের দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন, আরে কি করলে বল ওখানে তোমরা? ঝর্ণার একেবারে কাছে গিয়েছিলি নাকি রে ঝিনুক? নিজেকে সামলে নিয়ে কফি ও কেক খেতে খেতে সাগর বিস্তৃত বর্ণনা দিল, তারপর খাওয়া শেষ হলে বলল, এবার আর দেরি নয়, চলুন গাড়ীতে বসে গল্প হবে, ছাঙ্গু লেক পৌঁছতে এখনও একঘন্টার মত লাগবে। 


পাশাপাশি বসেছে সাগর আর ঝিনুক। একটু নীরবতা, একটু স্পর্শ, কখনো বা একটু কথার মাঝে ওদের গাড়ী ছুটে চললো আরও উঁচু পাহাড়ী রাস্তা ধরে। বাইরের মনোরম দৃশ্য আর মনের মধ্যে সঙ্কোচ, রোমাঞ্চ খেলা করছে দুজনের মধ্যে। সাগর কত কথাই না বলে চলেছে, ওর এখানে আসার নানান অভিজ্ঞতা, রাস্তায় ধ্বস নেমে কি রকম বিপদ হয়েছিল ইত্যাদি। 


এক সময় এসে পৌঁছল ওরা ছাঙ্গু লেকের সামনে। সমুদ্রতল থেকে ২৪০০ ফুট ওপরে ঠান্ডাটা অনেক বেশী, বরফের মত কনকনে হাওয়া বইছে, কিন্তু কি মনোরম শোভা, নীল আকাশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে লেকের জলও নীল। চারিদিকে বরফে ঢাকা পাহাড় যেন লেকটাকে কোলের মধ্যে আগলে রেখেছে।


আগে থেকেই অনেক গাড়ী এসে দাঁড়িয়েছে, এই সময়টা পর্যটকদের ভিড় একটু বেশী থাকে। সারি সারি ছোট ছোট টিনের ছাদ দেওয়া উল আর পশমের নানা রকম জিনিসের কাঠের দোকান ঘর, কয়েকটা ইয়াক ঘুরছে, তাদের সাজিয়ে লোকে সওয়ারির খোঁজে এদিক ওদিক দেখছে। ইয়াকে চড়ে লেকের চারপাশটা ঘুরে দেখা যায়, কিন্তু ঝিনুক কিছুতেই চড়বেনা ওর তো দেখলেই কেমন ভয় করছে। সাগর হাঁটতে হাঁটতে ততো ওকে ইয়াকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দ্রুত চলার জন্য ওরা একটু বেশীই এগিয়ে যাচ্ছে ওরা, প্রিয়বাবু ও সঞ্চিতা তো আর ওদের মত হাঁটতে পারছেন না, তার ওপর এতক্ষণ গাড়িতে বসে প্রিয়বাবুর হাঁটুর ব্যাথাটাও বেড়েছে। 


কোথা দিয়ে দু ঘন্টা কেটে গেল, বেশ খিদে পেয়েছে সবার। ছোট ছোট দোকানে মোমো আর নানা রকম খাবার পাওয়া যাচ্ছে দেখে সাগর সকলের জন্য অর্ডার দিয়ে সামনে এসে বসলো। গরম গরম মোমো ও স্যুপ আর সঙ্গে কফি। খোলা আকাশের নীচে এইরকম পরিবেশে, বরফ কনকনে হাওয়া গায় লাগিয়ে বেশ উপভোগ করল সবাই। 

আপনারা একটু বসুন আমি ড্রাইভারকে খুঁজে নিয়ে আসি, ওরা তিনজন তখনও কফির স্বাদ নিচ্ছে আয়েস করে। তিনজনই সাগরের ব্যবহারে ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ। প্রিয়বাবু তো খুশীতে বলেই ফেললেন, বড় ভাল ছেলেটি, ওকে পেয়ে যে আমার কি ভালো লাগছে! আমাদের মধ্যে যেন প্রাণ এনে দিয়েছে। সঞ্চিতাও সায় দিলেন ওঁর কথায়, তবে মনের মধ্যে একটা শঙ্কা দেখা দিচ্ছে, সাগর ও ঝিনুকের ঘনিষ্ঠতা কি বাড়ছে ক্রমশ! প্রতীকের সাথে তো সাগরের তুলনাই হয়না। প্রতীক উচ্চ শিক্ষিত, বিদেশের ডিগ্রীধারী সম্ভ্রান্ত পরিবারের একমাত্র ছেলে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সাগরের কিই বা আছে? পরিবারও নেই, একা এখানে একটি সাধারণ স্কুলের শিক্ষক। ঝিনুকের যোগ্য হিসাবে আমরা প্রতীককে ঠিকই নির্বাচন করেছি। ওদিকে ঝিনুকের মনে তোলপাড় চলছে, বুঝতে পারছে না সে কেন এমন হলো! শিক্ষিতা, রুচিশীল, ঝিনুক বারবার কেন আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে সাগরের প্রতিটি ব্যাবহারে! প্রতীকের সাথে এক বছরের আলাপ আর মেলামেশায় যা পায়নি, আজ কেন সে সাগরের সাথে মাত্র এই কদিনে তা উপলব্ধি করতে পারছে! তার মনের ফাঁকটুকু কি সাগরই ভরে দিচ্ছে আসতে আসতে! 

একটা দিনের স্মৃতি নিয়ে ওরা ফিরে এল। এখানে টাওয়ার না থাকার জন্য এতক্ষণ কোন মেসেজ বা ফোন আসতে পারেনি। গাড়ি গ্যাংটকে ঢুকতেই ঝিনুকের মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে উঠলো। প্রথমেই চোখে পড়লো প্রতীকের কয়েকটা মিস কল আর মেসেজ, সব কটাই প্রতীকের। সে আজ সকালেই গ্যাংটকে এসেছে কোম্পানীর কাজে, ঝিনুককে সারপ্রাইজ দেবে বলে কালও কিছু জানায়নি। 

---তাই নাকি! বাঃ! প্রিয়বাবু খুশীতে বলে উঠলেন, বেশ ভালই হল, ওর সাথে কদিন আনন্দ করা যাবে। 

--- ও তো মাত্র দুদিনের জন্য এসেছে, সঙ্গে কোম্পানীর লোকজনও আছে, ঝিনুক জানাল, এও শহরেরই পাঁচতারা একটা হোটেলে উঠেছে, কাল আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে লিখেছে। 

হবু জামাই আসছে শুনে সঞ্চিতা ব্যাস্ত হয়ে স্বামীকে বললেন, 

---তুমি একবার ফোন করে কাল দুপুরে নিমন্ত্রণ কর। 

--- কাল থেকে আপনারাও ব্যাস্ত থাকবেন, তবে কোন দরকার পড়লে অবশ্যই জানাবেন বলে সাগরও বাড়ি যাবার জন্য উঠে পড়ল। সাগর যেতে যেতে ঝিনুককে বলে গেল, আমি এবার আসি মিসেস ঝিনুক প্রতীক রায়, কাল থেকে তো তুমি ব্যাস্ত থাকবে! 

--- এরকম কথা বলো না সাগর, তোমার মুখে এরকম কথা শুনতে একটুও ভালো লাগেনা আমার, ঝিনুক থমথমে গলায় বলল, তোমার কাছে আমি শুধু ঝিনুক হয়েই থাকতে চাই, প্রতীকের আইডেনটিটি নিয়ে নয়। মনে মনে ভাবলো, তাহলে যে ফারাকটা বড় বেশী চোখে পড়ে সাগর! নিজেদের মত করে সাবলীল থাকা যায় না। 


পরের দিন বেলা এগারটা নাগদ প্রতীক এল। একটা ঝাঁ চকচকে বিশাল গড়ি নিয়ে সোজা শিলিগুড়ি থেকেই চলে এসেছে। প্রতীকের সুদর্শন, লম্বা, গাম্ভীর্যে পরিপুর্ণ পুরুশালী চেহারা, ঝকঝকে চোখ, চেহারায় একটা দম্ভও ঝরে পড়ছে। প্রতীক গাড়ি থেকে নেমেই চারিদিক দেখে একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, আপনাদের তো এখানে বেশ কষ্ট হচ্ছে মনে হচ্ছে, সব রকম সুবিধা তো নেই। আমি বরং যে ফাইভ স্টার হোটেলটায় আছি সেখানে আপনাদের জন্য ---। 


--- নাআআ! আমি এখানেই থাকব, প্রতীকের কথার মাঝেই বলে উঠল ঝিনুক। 

প্রতীক একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালো, ঝিনুকের প্রতিবাদে যেন বিরক্ত। 

সহজ সরল মানুষ প্রিয়বাবু বলেলেন, জায়গাটা তো একটু শহর-বাজার থেকে দূরে অনেকটা উঁচুতে, একটু মানিয়ে চলতে হয় ঠিকই, তবে বেশ নিরিবিলি আর কেয়ারটেকাররাও খুব ভাল, খুব একটা অসুবিধা তো হচ্ছে না বাবা! আর বেড়াতে এসে অত খুঁতখুঁত করলে চলবে কেন! আমাদের তো বেশ ভালই লাগছে। কথাটা যদিও প্রতীকের খুব একটা পছন্দ হলো না। 

ওদের কথার মাঝেই হঠাৎ সাগর আসরে হাজির। ওকে দেখে প্রিয়বাবু বলে উঠলেন, এস সাগর, তোমাকে আলাপ করিয়ে দিই, এই হচ্ছে প্রতীক, আমাদের হবু জামাই, আর প্রতীক এ হল সাগর, এই শহরেরই থাকে, একটি মিশনারী স্কুলের শিক্ষক, আমাদের খুব বন্ধু হয়ে গেছে, একেবারে আপনজন বলতে পারো। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অতি সাধারণ সাগরকে এক নজর দেখে একটা তাচ্ছিল্লের হাসি হেসে নিজের আইপ্যাডে মগ্ন হয়ে গেল প্রতীক। সামান্য একটা স্কুল মাস্টারের ব্যাপারে ওর কোন আগ্রহই যেন নেই। সাগরেরও প্রতীকের এই নিরাসক্ত ভাবটা চোখ এড়ায়নি। ঝিনুকও সব কিছু লক্ষ্য করেছে, সে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য বলল, চল না আজ লাঞ্চের পর সবাই মিলে একটু শহরটা ঘুরে আসি। ঐ পাহাড়ের ওপর বৌদ্ধ গুম্ফা, ক্যাকটাসের বাগান, পার্ক, আরো কত কি! তোমারও ভাল লাগবে। 

ঠিক যা ভাবা তাই! এক কথায় নাকচ করে দিয়ে প্রতীক বললো, শুধু শুধু আর কোথায় ঘুরে বেড়াবে? আজ সন্ধ্যায় গ্যাংটক ক্লাবে আমার একটা ডিনার পার্টি আছে, মেইনলি সেই জন্যই আমার এই আসা। কাপল পার্টি, তাই তোমাকেও যেতে হবে ঝিনুক। একটু হুকুমের সুরেই বলল প্রতীক। শুনেই ঝিনুক বিরক্ত হল, ওই ক্লাবে যাওয়া মানেই তো শুধু বড় বড় কথার ফুলঝুরি! আভিজাত্যের মুখোশ পরে পয়সাওলা কিছু লোক সেখানে শুধু নিজেদের জাহির করতেই ব্যস্ত, কোন মনের টান নেই। তার ওপর অঢেল সুরাপান তো আছেই। ঝিনুকের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে ঐ সব পরিবেশে, তবুও যেতে হয় প্রতীকের কথায়। 

--- আমি আজ বিকালে বেড়াতেই যাব, ঝিনুক গোঁ ধরে বসল, আমি যাব না তোমার ওই পার্টিতে। 

শেষ পর্যন্ত ঠিক হল, লাঞ্চের পরে ওরা বেরিয়ে পরবে, তারপর রাত্রে ঝিনুককে নিয়ে প্রতীক ক্লাবের ডিনার পার্টিতে যাবে। প্রিয়বাবু ও সঞ্চিতা সাগরকেও ওদের সঙ্গে যাবার জন্য বললেন, সাগর নানা কাজের ছুতো দেখিয়েও রেহাই পেলোনা। ঝিনুকের বারবার অনুরোধ ও অস্বীকার করতে পারলোনা। প্রতীক একটু অবাকই হলো, ঝিনুকের এতো কি বলার আছে, ও তো একজন বাইরের লোক, কদিনের আলাপে এত ঘনিষ্ঠতা! 

দুপুরে খাওয়ার পরই ওরা বেরিয়ে পড়ল, প্রিয়বাবুর কথায় সাগর আজ ওদের সাথেই লাঞ্চ করে নিয়েছে। গাড়িতে বসার পর প্রতীক বেশ অহংকারের ভাব দেখিয়ে ঝিনুককে শোনাল, দেখ এই গাড়ি তোমার পছন্দ তো? না হলে কোলকাতায় গিয়ে তোমায় আরও দামী গাড়ি কিনে দেব। 

প্রতীকের সব কথাতেই ওর কোম্পানীর কথা, বিলাস-বৈভবের কথা। সাগরের যেন নিজেকে ছোট না মনে ভাবে, ওর সম্মানে যেন কোন আঘাত না লাগে তাই যতটা সম্ভব প্রতীকের থেকে সাগরকে আড়াল করতে চায় ঝিনুক। 

অবশেষে ওরা এসে পৌঁছালো একটা পার্কে । বিরাট জায়গা জুড়ে এই পার্ক। খুব সুন্দর ফুলের রাশি অপুর্ব রঙ মিলিয়ে ধাপেধাপে নেমে গেছে নিচের দিকে। সবুজের মাঝে নানান রঙের কিছুটা প্রকৃতি কিছুটা মানুষের শিল্প সংযোজন। দেখে সকলেই মুগ্ধ। গাড়ি থেকে নেমে সকলে এগিয়ে গেলেও প্রতীক ইচ্ছে করেই একটু পিছিয়ে পড়লো। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়েছে সিগারেটের নেশায়। 

ঝিনুকের তাড়া যেন সবার আগে, ওর যেন তর সইছে না।, সাগর ওর সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না। সুন্দর ফুলে ফুলে ভরা চারিদিক, সাগর ও ঝিনুকের মনও আজ রঙীন। ভুলেই গেছে প্রতীক যে পিছিয়ে পড়েছে, দুজনে যেন দুজনের মধ্যে হারিয়ে যেত লাগলো। সাগরও এখানে বেশ সাবলীল ও সাচ্ছন্দ। কোথাও ছোট জলাশয়ে পদ্ম ফুটে আছে, কত রঙীন মাছ! কোথাও নকল পাহাড়, ঝর্ণা --- বেশ সাজিয়েছে পার্কটাকে। একদিকে ক্যাকটাসের কাঁচঢাকা সাজানো বাগান।

প্রতীক যে পিছিয়ে পড়েছে একবারও কি ওর না থাকা মনে পড়িয়ে দিচ্ছেনা ঝিনুক কে! প্রতীক দূর থেকে অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছে, ঝিনুক কত উচ্ছল, কত খুশী সাগরের সাথে এখানে। আমার সাথে তো এরকম প্রাণখোলা হাসি এত সাচ্ছন্দ্য থাকে না কখোনো ওর! সব সময় কেমন যেন আড়ষ্টতা একটা ভয় ভয় ভাব! তাহলে আমাকে কি ও চায় না! আমার পছন্দ- অপছন্দের সঙ্গে ওর কোন মিলই হয়না। 

অনেকখানি হাঁটার পর প্রিয়বাবু ও সঞ্চিতা রাস্তার পাশে একটা বেঞ্চে এসে বসলেন। প্রতীক একাই কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত ফোন করল ঝিনুককে।

ঝিনুক কাঁপা গলায় ফোন ধরলো, প্রতীক বেশ ঝাঁঝালো স্বরে জানালো, আমরা কি এখানে বসে শুধু নিশ্চল পাহাড় এই ফুল দেখে যাব? কতক্ষণ গেছ সে খেয়ালও নেই! কথাটা ঠিকই সাগর ও ঝিনুক এতদূর চলে গিয়েছিল যে সময়ের হিসাব ছিলনা। প্রতীকের ধমকে সম্বিৎ ফিরলে দ্রুতপায়ে ফিরে এলো ওরা। 

বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে উঠে প্রতীক একটা কথা বলল না। পরিবশটা যেন গুমোট হয়ে রইল। শুধু হোটেলে ফিরে যাবার আগে প্রতীক ঝিনুককে বলে গেল, --- ভালকরে সাজগোজ কোর, আজ পার্টিতে অনেক নামীদামী মানুষ আসবেন, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। আমি এক ঘন্টার মধ্যে তৈরী হয়ে আসছি। 

ঝিনুকের একটুও যেতে ইচ্ছে করছেনা। ওর এখন রঙীন ফুলের মাঝে ঝর্ণার ভিজে ভিজে স্মৃতি নিয়েই থাকতে বেশী ভাল লাগছে। কিন্তু উপায় নেই, প্রতীককে আর না বলা যাবেনা, এমনিই বেশ রেগে আছে। 


সন্ধেবেলা ঝিনুক পরেছে একটা মাখনরঙা সিল্কশাড়ী, তাতে আসমানী রঙের সুতো দিয়ে সারা গায়ে কাশ্মীরি কাজ, সঙ্গে নীল পাথরের লম্বা কানের দুল, হাতে নীল পাথরের রিস্টলেট। খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। সবার মাঝে ওকেই চোখে পড়বে বেশী করে। মনে কিন্তু শান্তি নেই, প্রতীকের সাথে যাওয়া মানেই তো ফেরার সময়ের কোন ঠিক নেই। এর আগেও কয়েকবার এমন পার্টিতে যেতে হয়েছে ওর অনুরোধে। প্রতীক যখন ড্রিঙ্ক করে কিছুই খেয়াল থাকে না। ঝিনুকের নিরাপত্তা, কি করে বাড়ি ফিরবে, সবই তখন ওর কাছে তুচ্ছ। দু-এক বার তো এত বেসামাল হয়ে পড়েছে যে ড্রাইভারের সাহায্যে ওকে নিয়ে কতবার ঝিনুককে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। সে যে কি লজ্জার! তবুও বাবা মার মুখ চেয়ে সে কিছু বলতে পারেনি। 


আজও ক্লাব থেকে ফিরতে বেশ রাত হলো ওদের। প্রতীক নামিয়ে দিয়ে গেল বাড়িতে, কাল থেকে ওর মিটিং, কাজের চাপ। ক্লান্ত ঝিনুক ফিরে এসে শুয়ে পড়ল নিজের ঘরে। তার মনের মধ্যে কথার তোলপাড় চলছে। প্রতীকের কত সম্মান! কত কদর! সকলেই ওকে নিয়ে হৈ চৈ করেছে। ওর সামনে এখন বিরাট ভবিষ্যৎ, আরও বড় হওয়ার স্বপ্ন। ভাবতে ভাবতে ঘুম নেমে এল ঝিনুকের চোখে। 

সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া, যেন মনের কোণে লুকিয়ে থাকা জমা দুঃখগুলো গুমরে আছে কুন্ডলী পাকিয়ে। একটু ভালবাসার টানেই জল গড়িয়ে পড়বে চোখ দিয়ে। শুধু একটু ইশারার অপেক্ষা --- বৃষ্টি নামলো বলে। বাবা মা দুজনেই পাশের একটা মন্দিরে পূজো দিতে গেছে, এখনি না আসলে ভিজে যাবে ঠিক। 

আজ তো প্রতীকের কলকাতা ফিরে যাবার কথা। বলেছিল সকালেই চলে আসবে, কিন্তু এত বেলা হল এখনও তো দেখা করতে এলোনা সে! ঝিনুকের মনটাও ছটফট করছে। কাল বোধহয় প্রতীককে ঠিক তার যোগ্য সম্মান দেওয়া হয়নি। সাগরের সাথে পার্কে রঙ-বেরঙের ফুলের মাঝে এমন মেতেছিল! প্রতীক বোধ হয় পছন্দ করেনি সেটা। পার্টিতেও ঠিক মন বসাতে পারে নি। এইসব সাত পাঁচ ভাবছে ঝিনুক, এমন সময় প্রতীকের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আপাদ মস্তক বিদেশী সাজ, সুট-টাই পরা প্রতীকের দিকে তাকিয়ে সত্যি চোখ ফেরানো যায়না, সত্যি সে সুপুরুষ। কিন্তু মনটা যে কিছুতেই মেলাতে পারছে না ও! এতবেশী কেরিয়ারিস্ট, এত প্র্যাকটিকাল যে ঝিনুকের মনটাই কোনদিন বুঝতে চেষ্টা করেনি। 

প্রতীক গাড়ী থেকে নেমে সোজা বারান্দায় ঝিনুকের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আজ ওকে যেন অন্যরকম লাগছে , ঠোটের কোণে একটা আলগা হাসি, একটু যেন ডিপ্লোমেটিক। বলল, --- কোম্পানীর এম.ডি-র সাথে ব্রেকফাস্ট করতে গিয়ে দেরি করে ফেললাম ঝিনুক, সরি। আশা করি গ্যাংটকের ছুটি তোমার জীবনে একটা বিশেষ দাগ কেটে রাখবে। তারপর সাগরের মত বন্ধু পেয়েছ, আরও সুন্দর হয়ে গেছে ট্রীপটা। আমি তো তোমাকে সেই আনন্দ দিতে পারিনা, বেশ বুঝতে পারছি তুমি আমার সাথে সাচ্ছন্দ্য বোধ করনা। আর একটা কথা জানিয়ে দিই আজ তোমাকে, আমার আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন, তোমাকে তার মধ্যে জরাতে চাই না। তোমাকে আমি বেঁধে রাখবনা। তোমার কল্পনার মন নিয়ে তুমি তোমার স্বপ্নের আকাশে উড়তে চাও, যা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ৷ আমি কিছুদিনের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কোম্পানীর অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে চলে যাচ্ছি তিন বছরের জন্য। এটা আমার জীবনের একটা গোল্ডেন ব্রেক বলতে পারো। আমাদের এম. ডি-র মেয়ের সাথে আমার কিছুদিনের মধ্যে এনগেজমেন্ট হবে। স্তব্ধ হয়ে শুনছে ঝিনুক, প্রতীকের কথা ওর কানে যেন গরম লাভা ঢেলে দিচ্ছে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, গলা দিয়ে স্বর বেরচ্ছে না। 

--- তুমি সাগরকে পেয়ে সুখী হবে ঝিনুক, তাই তোমার পথ থেকে আমি নিজেই সরে দাঁড়াচ্ছি, বলতে বলতেই পকেট থেকে একটা খাম বের করে ঝিনুকের হাতে দিয়ে বললো, এটা তোমাদের বিয়েতে আমার ছোট্ট উপহার, সুইজারল্যাণ্ডের দুটো টিকিট আর হোটেলের বুকিং, তোমাদের হনিমুন এর জন্য, সব পেমেন্ট করা আছে, আমি খুব খুশী হব। মাসীমা ও মেসোমশাই কে আমার প্রণাম জানিও, ওঁদের সামনে আমি আর যেতে চাই না আজ। ভালো থেকো, সুখী হও। 

স্বপ্ন না বাস্তব! একি শুনলো ঝিনুক! ওর চোখে জলে ভরে যাচ্ছে কেন এমন! একি সাগরকে পাওয়ার আনন্দ না প্রতীককে হারানোর বিষাদ! তোলপাড় করছে বুকের মধ্যে, চুপ করে বসে পড়ল একটা চেয়ার টেনে। যেমন এসেছিল, তেমনই ফিরে গেল প্রতীক,  আর একবারও ফিরেও তাকালো না। চোখের সামনে প্রতীকের গাড়িটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি পাকদণ্ডী পথে, একটা চেনা শব্দ কানে আসতেই মুখ তুলে তাকালো ঝিনুক। সাগরের বাইকটা উঠে আসছে একই পথ ধরে। ঝিনুক যেন হঠাৎ শান্ত হয়ে গেল, ওর চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে, তাতে মিশে আছে একরাশ আনন্দ ও বিষাদের মিলিত নোনাজল। 









1 comment:

  1. pink color makes reading difficult; please change it to black or some other color with better contrast.

    ReplyDelete