3

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in

ধারাবাহিক 



আমার বারুদ বেলা -৩
স্বপন দেব




১৯৬৬ সাল। সমস্ত দুনিয়াই যেন বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে ! ফ্রান্স কিংবা অ্যামেরিকা, ভিয়েতনাম কিংবা বর্মা----সর্বত্রই তরুণেরা উদ্বেল হয়ে উঠেছে পুরাতন কে ভাঙার নেশায়। ফ্রান্সে যে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে পুলিশের সঙ্গে খন্ড যুদ্ধ করে; অ্যামেরিকায় তার লড়াই অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে। সেখানে সে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আবেদনপত্র পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানায়। সেই আবার শত্রু দখলীকৃত ভিয়েতনামে লড়ে ইয়াঙ্কিদের আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে, আবার জাপানের ওয়াকিনাওয়ার মাটিতে মার্কিন হাওয়াই আড্ডা বন্ধের জন্যে সে মিছিল করে। পশ্চিমবঙ্গে সেই যৌবন আত্মপ্রকাশ করে খাদ্যের দাবীতে; জনতার মিছিলে বুক চিতিয়ে গুলি খাওয়া আনন্দ হাইত আর নুরুল ইসলাম হয়ে।

সময়টা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন প্রফুল্লচন্দ্র সেন। দেশে প্রচন্ড খাদ্য সংকটের সমাধান হিসেবে সরকারি খাদ্য সংগ্রহের মজুত ভান্ডার গড়তে সরকারি লক্ষ্যমাত্রা ছিল পনেরো লক্ষ টন চাল সংগ্রহের। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে মার্কিন দান পি. এল. ৪৮০ র গম আর এই সংগৃহীত চাল দিয়েই হয়তো খাদ্য-সংকটের মোকাবেলা করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলনা। গ্রামাঞ্চলের বড় বড় জোতদারেরা সরকারি লেভির চাল ফাঁকি দিয়ে তা মজুত ও অধিক দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুটতে লাগলো আর অন্যদিকে সাধারণ মানুষ রইল অর্ধাহারে, অনাহারে। 

লক্ষ্যমাত্রার এক তৃতীয়াংশ মাত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হল সরকার। খাদ্যের দাবীতে রাস্তায় নামলো জনতা। ১৬ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৬ তে বসিরহাটে মুখোমুখি সঙ্ঘর্ষ হল জনতা-পুলিশের। গুলিতে আহত হলেন ছ’জন। পরেরদিন, অর্থাৎ ১৭ ই ফেব্রুয়ারী বসিরহাট মহকুমার স্বরুপগঞ্জে বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হলেন এলাকার ছাত্র-যুবকেরা। বিক্ষোভ চলাকালীন হঠাৎ পুলিশ গুলি চালাতে লাগলো। নিহত হলেন তেঁতুলিয়া মাল্টিপার্পাস হাইস্কুলের ছাত্র নুরুল ইসলাম আর গুরুতর আহত হলেন এক ই স্কুলের ছাত্র মণীন্দ্র বিশ্বাস। ১৮ ই ফেব্রুয়ারী এ খবর প্রকাশ পেতেই বাংলা জুড়ে উত্তাল হয়ে উঠল ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ। গণ-শিল্পীরা গান বাঁধলেন, “শপথ নিলাম শপথ নিলাম প্রাণ দেব বলিদান। বাংলা মায়ের প্রথম শহীদ নুরুল ইসলাম”। রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির গেটে গর্জে উঠল বাংলার ছাত্র-সমাজ।

ভারত জুড়েই তখন সি.পি.এম এর মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতায় রাজ্য কমিটির পত্রিকা ‘দেশহিতৈষী’র সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুশীতল রায়চৌধুরী, সরোজ দত্ত সহ পরিমল দাশগুপ্ত, অসিত সেন প্রমুখ তৈরি করলেন, ‘সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কমিটি’ । প্রমোদ দাশগুপ্তর মতে এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল, ‘র‍্যাডিক্যাল কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করা’ [ দেশহিতৈষী, শারদীয়া ১৯৬৭ ]। ১৯৬৬ সালের খাদ্য আন্দোলনের পর থেকেই ছাত্রফ্রন্টে রক্ষণশীল ও Radical ছাত্রদের মধ্যে মতাদর্শগত বিরোধ চলছিল। আমরা, মানে Radical রা প্রশ্ন তুলেছিলাম –ছাত্র আন্দোলনকে কেবলমাত্র ছাত্রদের দাবীদাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়। সচেতন ছাত্রসমাজকে সমাজ-পরিবর্তনের কথাও ভাবতে হবে। রক্ষণশীলরা প্রাদেশিক নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকলেও কলকাতা সমেত বিভিন্ন জেলা কমিটির কর্তৃত্ব ছিল Radical দের হাতে। 

কলকাতা জেলা পার্টির নেতৃত্বে তখন ছিলেন সুধাংশু পালিত। তিনি রক্ষণশীলদের নেতা ছিলেন। জেলা কমিটির এক সভায় রক্ষণশীল নেতৃত্ব তাঁদের পছন্দমত সভাপতি ও সম্পাদক পদে যে দু’টি নাম প্রস্তাব করলেন, Radical ছাত্র-নেতারা তা বাতিল করে তাঁদের পক্ষ থেকে দিলীপ পাইন আর অসিত সেন এর নাম প্রস্তাব করলেন এবং বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে নাম দু’টি মনোনীত হল। বিদায়ী জেলা কমিটির নেতা হিসেবে বিমান বসুর ওপর দায়িত্ব থাকল কলকাতা জেলা সন্মেলনের জন্যে স্টুডেন্টস হল ভাড়া নেওয়া। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে জেলা সন্মেলনের মাত্র কয়েকদিন আগে জানা গেল যে হল ভাড়া নেওয়া হয়নি !! ফলে সন্মেলন বাতিল হয়ে গেল। 

এরপরেই পার্টির নির্দেশে রক্ষণশীল ছাত্রনেতারা ছাত্র-ফেডারেশন থেকে আমাকে (স্বপন দেব), নির্মল ব্রহ্মচারী, আজিজুল হক, শৈবাল মিত্র, দিলিপ পাইন, নবারুণ ভট্টাচার্য, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত এবং আরো পনেরো জন Radical ছাত্রনেতাদের তাড়িয়ে মতাদর্শগত সংগ্রামকে সাংগঠনিক ভাবে মোকাবেলা করতে চাইলেন। কিন্তু এতে খুব বেশি কিছু লাভ হলনা। কারণ এর পরেই বিভিন্ন কলেজেছাত্র-সংসদের নির্বাচনে Radical রাই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ছাত্র সংসদ গড়লেন। বিদ্যাসাগর কলেজে আমি V.C.S.F নাম দিয়ে বিপুল ভোটে B.P.S.F এর প্রার্থীদের হারিয়ে ছাত্রসংসদ নিজেদের দখলে রাখলাম। প্রায় এই সময় থেকেই ছাত্রফেডারেশনের Radical পন্থীরা মতাদর্শগত লড়াইয়ের পথ ধরে প্রকাশ করে ‘ছাত্র-ফৌজ’ পত্রিকা। অপরদিকে রক্ষণশীল অংশ প্রকাশ করে ‘ছাত্র-সংগ্রাম’। রক্ষণশীল নেতৃত্ব ছাত্র-আন্দোলনকে স্কুল কলেজের চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখতে চাইছিল আর আমরা চাইছিলাম ছাত্রস্বার্থে জনগণের, মানে শ্রমিক কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হতে। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু শ্রমিক-কৃষকের নয়, ছাত্রদেরও লক্ষ্য। তাই মাওয়ের ‘ইয়ুথ মুভমেন্ট’ বই টি থেকে আমরা প্রেরণা পেয়েছিলাম। 

ছাত্রফেডারেশনের রক্ষণশীল নেতৃত্বের বিপ্লবাতঙ্ক রোগ অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। তারা আমাদের ‘হঠকারী’ বলতে শুরু করলেন। ছাত্র-ফেডারেশনের জন্ম থেকে পতাকায় লেখা হত ‘স্বাধীনতা, শান্তি, প্রগতি’, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত এটাই চালু ছিল। আমরা বললাম, ‘জনগণতন্ত্র, শান্তি, প্রগতি’ লেখা হোক। কিন্তু আমাদের প্রস্তাব নাকচ করা হল। আমরা একটি বিকল্প প্রস্তাব হাজির করেছিলাম। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের সপক্ষে ছাত্রদের নির্ধারিত কর্মসুচি। আমাদের প্রস্তাব ও কর্মসূচি ছাত্ররা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। রক্ষণশীল নেতাদের পায়ের তলায় জমি ছিলনা। তবু, রক্ষণশীল প্রাদেশিক নেতৃত্ব ও তাদের মুষ্টিমেয় অনুগামীরা ছাত্র ফেডারেশনের বেলঘরিয়া সন্মেলনে আমাদের ‘হঠকারী, সঙ্কীর্ণতাবাদী’ বলে একঘরে করতে চাইছিল। আমরা নাকি ছাত্র-বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন দেখছি !! 

ছাত্র ফেডারেশনকে পার্টিতে পরিণত করার মত নির্বুদ্ধিতা আমাদের ছিলনা। বরং, আমরা জোর দিয়েছিলাম শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর। উত্তরবাংলার ছাত্রনেতা অশোক ঘোষ উক্ত সভায় উত্তরবাংলায় যে ছাত্ররা কৃষকের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন সে কথা জানিয়েছিলেন মিটিং এ। পার্টি সম্মতি ছাড়া দলিল ও প্রস্তাব পেশ করার জন্যে আমাদের বিরুদ্ধে নিন্দা-প্রস্তাব এনেছিল প্রাদেশিক নেতৃত্ব। কিন্তু তা ধোপে টেঁকেনি। কারণ বাংলার বেশীরভাগ কলেজে নেতৃত্ব ছিল আমাদেরই। প্রাদেশিক নেতৃত্ব যাঁরা ছাত্র ফেডারেশনের পতাকায় ‘জনগণতন্ত্র’ লেখার প্রস্তাব দেওয়ার জন্যে আমাদের হঠকারী বলেছিলেন, দশবছর পরে তাঁরাই কিন্তু ছাত্র ফেডারেশনের পতাকায় ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটা যোগ করলেন !! সবাই জানেন, সমাজতন্ত্র জনগণতন্ত্রের পরের স্তর। 

পৃথিবী জুড়ে ষাটের দশকে ছাত্র অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তি-যুদ্ধ, ভিয়েতনামের ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ ও চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে ছাত্র ও যুবদের অসীম সাহসিক কান্ডারীর ভূমিকা --- এ সব ই আমাদের প্রচন্ডভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, বেলজিয়াম ও খোদ আমেরিকায় প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের ছাত্ররা তখন লন্ডন, স্টকহোম, অসলো, আমস্টারডামের ছাত্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সাম্রাজ্যবাদের পীঠস্থান আমেরিকান দূতাবাসে ভিয়েতনামে নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। চিনের মহান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সমর্থনে আমরা সভা করে, মিছিল করে, পোস্টারে প্ল্যাকার্ডে ভরে দিয়েছিলাম। রেডবুক ও মাওব্যাজ আমাদের সেদিন যে প্রেরণা দিয়েছিল তার তুলনা নেই। এসবই প্রমাণ করে আমরা তখন সঠিক পথেই অগ্রসর হতে পেরেছিলাম। অভীষ্ট ছিল জনগণতান্ত্রিক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সমসাময়িক সময়ে ছাত্র আন্দোলনে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল। পরের পর্ব শুরুই হবে প্রেসিডেন্সি কলেজের ভূমিকা দিয়ে। ( চলবে )

3 comments:

  1. আপনি সত্যিই বারুদের স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছেন। যে সময়ের কথা লিখছেন,সেটা উপলব্ধি করার মত বয়ঃসন্ধি আমার তখন হয়ে এসেছিল। অজয় মুখার্জিকে আমি দেখেছি। আমি খুব ভালোভাবে আপনার লেখাটার সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারছি, যদিও নক্সাল আন্দোলন নিয়ে আমার হয়তো একটু নেগেটিভ অ্যাটিট্যুড আছে।

    ReplyDelete
  2. ৬৬ এর খাদ্য আন্দোলন পড়েছি অনেক পরিণত বয়সে । ছাত্র আন্দোলন পড়েছি শ্যামল চক্রবর্তী মহাশয়ের লেখায়।

    ঠিক পরের বছরই জন্মেছি। ফলে আমার কাছে সবটাই ইতিহাস।

    আপনার লেখার শৈলীতে ইতিহাসকে প্রত্যক্ষ করতে পারছি।

    ReplyDelete
  3. শ্যামল দা'র সাথে আমার লেখার তথ্যগত ফারাক থাকবে অনেকটাই। যদিও শ্যামল চক্রবর্তী ই ছিলেন আমার রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু এবং তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক এখন ও ভীষণ মধুর !

    ReplyDelete