1

প্রাচীন কথাঃ সুবীর দাস

Posted in


প্রাচীন কথা 


রাক্ষসনামা
সুবীর দাস





প্রথমেই বলে নিই ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য নিবেদন; আমার কাছে ধর্ম নয়। ধর্ম বলতে জীবনের ধর্মই বুঝি, যেখানে সমস্ত বিপরীত গুণ সমাহারে থাকা সত্ত্বেও শুভবোধের উত্তরণ সুস্থ, সুন্দর, ভেদহীন সমাজের দিকে মানব মননকে চালিত করে, সেই আমার ধর্ম। কাজেই মহাভারতের কাহিনী আমার কাছে ততটাই ধর্ম যতটা জীবনের ধর্মের কথা বলা হয়েছে। অন্যায় করে কেউই পার পাননি। একমাত্র যুধিষ্ঠির বাদে সবাইকেই মনুষ্য যন্ত্রণাতেই মরতে হয়েছে। কৃষ্ণের মৃত্যুও অপঘাতে, গান্ধারীর অভিশাপ এখানে যতটা না বাস্তব তার চেয়ে ঢের বেশি রূপক, কারণ রচয়িতা ব্যাসদেবের কলম বড় নির্মোহ। তাঁর সৃষ্ট জীবন গুলিতে তিনি ন্যায়-অন্যায় সমস্ত দেখিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন অন্যায়ের পথে অভীষ্ট সিদ্ধ হলেও, শেষ পর্যন্ত অন্যায়কারী বান্ধবহীন। কুরুক্ষেত্রের পর একমাত্র পরীক্ষিৎ ছাড়া ওই বংশে আর উত্তরাধিকার ছিলনা। যাইহোক, সাহায্য নিয়েছি রাজশেখরবসু, কালীপ্রসন্নসিংহ, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, সুকুমারী ভট্টাচার্য্য, বঙ্কিমচন্দ্র, সুখময় ভট্টাচার্য্য প্রমুখ যশস্বী লেখক আলোচকদের। আফশোষ, অশোক রুদ্র, বিমল কৃষ্ণ মতিলাল এঁদের লেখা এখনও পাঠ করার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি।

পুরাণের কথা লিখতে গিয়ে উৎসাহিত করেছে প্রায় প্রত্যেক বন্ধুই, তাই আলাদা করে উল্লেখ করছিনা। আমার বহু কলহের সঙ্গী জয়িতা, তার কথা বলতেই হয়। কারণ সে যদি তার কল্পরূপ মিশিয়ে মহাকাব্যের নতুন কাব্যিক দিক তুলে ধরতে পারে তার অর্জিত ও সহজাত দক্ষতায়, আমি কেবল সামান্য অর্জিত সঞ্চয় সম্বল করে এবং অগ্রজ সনৎদা-র পরামর্শেই নিজের বোধের দ্বারা পরিচালিত হয়ে কেবল তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে চেষ্টা করব। আমার বন্ধুরা, আমার ভুলগুলিতে সতর্ক করলে ও সঠিক দিশা দেখালে এই ফেসবুকীয় প্রয়াস সার্থক বলে মনে করব।

ঘটোৎকচ, পাণ্ডব কুলের সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র। তৎকালীন সমাজে সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল, ক্ষেত্রজ সন্তান সমাজে ব্রাত্য ছিলেন না। অর্থাৎ কানীন পুত্র সমাজে অসম্মানিত হন' নি। কুন্তী, সত্যবতী কুমারী অবস্থায় কর্ণ এবং রচনাকার ব্যাসদেবের জন্ম দিয়েছিলেন। যেহেতু ব্যাসদেব থেকেই ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের জন্ম এবং সত্যবতীর সাহস এবং অসঙ্কোচের কাছে কুন্তী ঠিক ততখানি জড়তাগ্রস্ত ছিলেন বলে মহাভারতের আখ্যান অন্যভাবেই রচিত হয়েছে। অথবা, বলা ভাল ব্যাসদেব যে মহান দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে রচনা করেছেন, সেই 'জীবনের ধর্মের' পাঠ দিতে গিয়ে কর্ণকে অপ্রকাশ্য রেখেছেন যুদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি। কারণ, কৃষ্ণের কাছে যদি যুধিষ্ঠির জেনে যেতেন যে কর্ণই তাঁর অগ্রজ, তাহলে এই যুদ্ধই হত না।

এর স্বপক্ষেই দেখি যখন ঘটোৎকচ মারা যান, তখন কৃষ্ণ যে যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন সেখানে তিনি কৃষ্ণের ওপর সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এখন দেখা যাক কৃষ্ণ কি কি যুক্তি দেখিয়েছেন।

এক, একাঘ্নী অস্ত্রতে পঞ্চপাণ্ডবের যে কোন একজন মারা যেতেনই। সেক্ষেত্রে এই অস্ত্র অর্জুনের ওপর প্রয়োগ এক স্বাভাবিক বিষয়। তাই যুদ্ধের মূল সেনা অর্জুনকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব দরকার। দুই, ঘটোৎকচের দেবদ্বিজে ভক্তি ছিলনা এবং যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিলেন।

এই দ্বিতীয় বিষয়ের মধ্যেই সামাজিক প্রেক্ষিত কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও রয়েছে। সে বিষয় কেবল ছুঁয়ে যাব শেষে। ঘটোৎকচ কিন্তু কৌরব পক্ষীয় রাক্ষস অলায়ুধকে হত্যা করেছিলেন। অর্থাৎ, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলে বাকি কাঁটাকেও কার্যসিদ্ধি শেষে ছেঁটে ফেলা। খাণ্ডব দহন শেষে কেবল মাত্র ছয়জনই বেঁচেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, রাক্ষস এমন এক অরণ্যচারী জনজাতি, যারা ব্রাহ্মণদের প্রতি অনুকুল ছিলেননা কিম্বা বলা ভালো ভক্তিশ্রদ্ধা ছিলনা। তাহলে এই রাক্ষস টিকিয়ে রাখা মানে এক, ব্রাহ্মণদের অধিকার খর্ব হতে থাকা এবং দুই, বংশের নিয়ম অনুযায়ী ঘটোৎকচ জ্যেষ্ঠ্পুত্র হিসাবেই পাণ্ডবদের সিংহাসনে বসার অধিকারী। আর তা যদি হয়, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের যে পরস্পরের গা ঘেঁষাঘেঁষি থাকা সেটি কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ত। আবার অন্যভাবে ভাবলে রচয়িতা নিজে ব্রাহ্মণ বলেই ব্রাহ্মণ দের প্রতি অবজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু জীবনের ধর্ম যদি বলি, তাহলে বেদজ্ঞ মানুষের মহিমাই ছিল সেই ধর্মের মুখ। বিষয়ান্তরে যাবনা। যে প্রসঙ্গে আসতে চাইছিলাম সামাজিক অবস্থান।

তিন হাজার বছর আগে হোমোস্যাপিয়েন্স ছিল অভিব্যক্তির চূড়ান্ত। তাই রাক্ষস মানে বীভৎস চেহারার মনুষ্যেতর অস্বাভাবিক জীব, একথা মনে করার কোন যৌক্তিকতা নেই। বলা যেতে পারে অরণ্যে বসবাসের ফলে সেই মানুষদের অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য নগর জীবনের থেকে আলাদা হবার দরুণ অস্বাভাবিক মনে করা হত। আজও যেমন প্রান্তিক, অন্ত্যজ মানুষরা উপেক্ষিত হয়েই থাকেন। ট্র্যাডিশন কোথায় যাবে! রাজশেখর বসু তাই মজা করে হিড়িম্বার মুখ দিয়ে 'পুনর্মিলন' গল্পে বলিয়েছেন যে, ভালো করে সাঁতলে নিলে ঋষি আর অন্য মানুষের স্বাদে তফাৎ কোথায়! তাহলে অনুমেয়, রাক্ষসদের কাছে ও তেমনি ব্রাহ্মণ কিম্বা ক্ষত্রিয়ের আলাদা মর্যাদা ছিলনা। সমদৃষ্টি কেবল নয়,এক বিপরীত তাচ্ছিল্যও রাক্ষসদের নিকট হতে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়েরা পেতেন। ঠিক আজকের দিনেও সামাজিক অবস্থানের কথা ভেবে দেখুন।

হিড়িম্বা সেজেগুজে সূক্ষ্ম বসন পরে মধ্যম পান্ডবের মনে যে মিলনের ইচ্ছা জাগিয়ে দেননি এমনতো নয়। কিন্তু কর্তব্যবোধে ভীম তাঁর ইচ্ছাকে অবদমন করতে পারছেন। কিন্তু হিড়িম্বা পারছেননা। সভ্য ও অ-সভ্যের তফাৎ দেখানো হচ্ছে। দেখুন, বিধবা উলুপী(নাগকন্যা), অনার্যা হিড়িম্বা, এঁরা ইচ্ছা প্রকাশে অ-সভ্য হয়ে যান কিন্তু পরাশর থেকে শান্তনু, এঁরা কামেচ্ছা প্রকাশেও মহান থাকেন। একমাত্র ব্যতিক্রম উর্বশী। অর্জুনের প্রত্যাখানে অর্জুনকে ক্লীব হবার অভিশাপ দিচ্ছেন। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, উর্বশী কিন্তু স্বর্গের অপ্সরী। তাঁর জাত হিড়িম্বা তুল্য নয়। বিচক্ষণ কুন্তী। অরণ্যে বাস করে শত্রুর চেয়ে মিত্র ভাবে থাকাই বিবেচ্য মনে করলেন। হিড়িম্ব কিন্তু নিহত। এখন যদি হিড়িম্বাকেও নিহত বা প্রত্যাখাত হতে হয় তাহলে হিড়িম্বা যদি রেগে গিয়ে সমস্ত রাক্ষসদের একত্রিত করে আক্রমণ করে কিম্বা দুর্যোধন কে খবর করে দেয়। তার চেয়ে হিড়িম্বার সাথে থাকাই ভালো। এখানে মনে রাখতে হবে, শর্ত ছিল হিড়িম্বার সন্তান হলেই ভীম ফিরে আসবে। অনার্যদের অবস্থান আরও স্পষ্ট।

একটু ইতিহাস ছুঁয়ে যাই। যদি এই যুগকে বৈদিক যুগ বলি, তাহলে ঋগ্বেদের ভাষা কাদের ভাষা বা কোন অঞ্চলের সঙ্গে সাযুজ্য, তার উপর একটু আলোকপাত প্রয়োজন। প্রথমত ভাষাবিজ্ঞান বিচারে ঋগবেদের সঙ্গে ইরানীয় ধর্মগ্রন্থ "আবেস্তা"র বেশ আত্মীয়তার সম্পর্ক। অর্থাৎ ইন্দো- ইরানীয়(আর্য) এবং যাদের ধর্ম গ্রন্থে গৃহপালিত এবং ঘোড়ায় টানা রথের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেখানে অশ্ব এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্কেত এবং এই খুরের চিহ্ন ধরেই, উত্তর পশ্চিমের খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০-১৪০০ সোয়াটের ঘালিঘাই এবং উত্তর- পূর্ব বেলুচিস্তানে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০-১৪০০ এবং তৃতীয় দশায় খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০-৮০০ সিন্ধুনদের পশ্চিমে উপস্থিত হয়ে সেই অঞ্চল থেকে এই ভারতভূমির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল।

কে না বলতে পারে এই ছড়িয়ে পড়া এবং ছড়িয়ে পড়তে গেলে অধিকার করা – এরই মূল কারণ ছিল 'মহাভারতের যুদ্ধ' (কেবল এটিই একমাত্র নয়)। কারণ এর আগেও উত্তর পশ্চিমে নগর সভ্যতা ছাড়াও পূর্বে এবং দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে একেবারে সম্পর্কহীন না হলেও এক প্রাগার্য সভ্যতা গড়ে উঠেছিল যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল 'মগধ' এবং যার রাজা ছিলেন জরাসন্ধ। এর মিত্র বা অনুগত শক্তি ছিলেন শিশুপাল যিনি চেদি বংশীয় এবং পুন্ড্রবর্ধনের রাজা পৌন্ড্রবাসুদেব। জরাসন্ধের জামাই কৃষ্ণের মামা কংস, যিনি মথুরায় জরাসন্ধেরই প্রতিনিধি। আর জরাসন্ধের জন্মবৃত্তান্ত থেকে জানা যায় কোন এক রাক্ষসি(জরা) তাঁকে জন্মকালীন বিকলাঙ্গতা থেকে মুক্ত করেছিলেন। তাহলে অনুমেয় রাক্ষসদের সঙ্গে এদের সু-সম্পর্কই ছিল। তাহলে রাক্ষস সহ এই ত্রয়ীকে নিকেশ করতে না পারলে ভারতবর্ষ আর্যাবর্ত হবে কি করে! অন্যদিকে মুনিঋষিরাও অরণ্যচারী (বেদ থেকেই জানা যায়)।

অপর দিকে, রাক্ষসদের অত্যাচারে মুনিঋষিরা অতিষ্ঠ। তাহলে দেখা যাচ্ছে আর্যদের স্বাভাবিক মিত্র অবশ্যই অরণ্যের এই ব্রাহ্মণ। তাহলে রাক্ষস নিধন যেমন স্বাভাবিক তেমন স্বাভাবিক রাক্ষসদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কৌশলও।
যদি উপরিচরের আখ্যান থেকে মহাভারতের শুরু ধরে নিই সমগ্র কাহিনীতে প্রথম ক্ষত্রিয়-রাক্ষস সমন্বয়ে এই সন্তান - ঘটোৎকচ। যিনি কেবল এই বংশের প্রথম সন্তান নয়, রাক্ষস ও আর্যদের প্রতিভূ। যাকে খুব প্রয়োজনমত ব্যবহার করে শেষে মেরে ফেলা হয়েছে কর্ণের সামনে লেলিয়ে দিয়ে। আর্যদের কলঙ্কের ভাগীদার হতে হলনা। কারণ কুন্তীর জ্যেষ্ঠ্য সন্তান যাকে তখন অন্তজ সম্প্রদায়ের অর্থাৎ সূত পুত্রের হাতেই সেই বংশেরই দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রথম সন্তান ঘটোৎকচের হত্যা। এ ভারি মজার বিষয়।

সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি এক বিশাল রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে দাঁড়িয়ে গেছি। কৃষ্ণের শত্রুদমন করতে হলে পাণ্ডবদের সঙ্গে এবং ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মিত্রতা জরুরী। খাল কেটে কুমীর আনার মত উত্তর-পশ্চিমের আধিপত্য বিস্তার, সেই সাথে আধিপত্য বিস্তারে পূর্ণ নিয়ামক কৃষ্ণ, সঙ্গে ক্ষমতাহীন দায়িত্বে যুধিষ্ঠির এবং প্রবল পরাক্রমী অর্জুনের ড্রাইভার (সারথি) তিনি নিজেই (আমরা যখন গাড়ি চড়ি জানি ড্রাইভারের হাতেই আমাদের জীবন থাকে)।

আধুনিক ভারতে এই কিংমেকার যাকে বলা হয়, মহাভারতে সেই কিংমেকার হলেন কৃষ্ণ। এই রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই দাঁড়িয়ে সামাজিক অবস্থানও ঘটোৎকচকে যে ভাবে সামাজিক- রাজনৈতিক ব্যবহার করা হয়েছিল একবার দেখে নেব।

মহাভারত লেখা হয়েছে খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে (রেফঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য – মহাকাব্য মহাভারত) এবং যদি কখনও যুদ্ধ হয়ে থাকে পণ্ডিতদের অনুমান খ্রীস্টপূর্ব নবম শতকে। সুতরাং রচনাকালে প্রায় পাঁচশো' বছর পূর্বের কাহিনী প্রত্যক্ষ যে করেননি এ বলাই বাহুল্য। রচয়িতা "জীবনের ধর্ম" বোঝাতে গিয়েই এ মহাকাব্য রচনা করেন যা কালক্রমে "ধর্ম" হয়ে ওঠে। আমার আলোচনা কেবল কাব্যে উল্লেখিত ঘটোৎকচের সময়ে সামাজিক পটভূমি উল্লেখ করা, যেটুকু আমার মনে হয়েছে। এও আমার কল্পনা মাত্র।

ঘটোৎকচকে আমরা দেখতে পাই "আদিপর্বে, বনপর্বে, ভীষ্মপর্ব এবং দ্রোণপর্বে।" ফলে এর মধ্যে কি ঘটেছে বা ঘটতে পারে সে কাব্য-কল্পনা কিম্বা পণ্ডিত, গবেষকরা ক্রোনোলজি ধরে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেন। যেটুকু জায়গায় এই কুরুবংশের জ্যেষ্ঠ উত্তরাধিকারকে দেখতে পেয়েছি কেবল সেই অংশটুকুই তুলে ধরব।

মোহিনী হিড়িম্বাকে দেখে ভীম আকৃষ্ট। ভীম সদ্য বয়োঃপ্রাপ্ত (১৪বছরে তাঁরা প্রথম ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এসেছিলেন কুন্তীর সঙ্গে; পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর। তার কিছুকাল পরেই বারাণবতে জতুগৃহ এবং সেইসময় বনে অবস্থানকালে এইঘটনা)। যখন এই বরবর্ণিনী, সুরকন্যাতুল্য, সুক্ষ্ম বসনে সালংকারা হয়ে এসে আপন ইচ্ছা অকপটে জানাতে পারে তখন আকৃষ্ট হয়ে পড়া বিচিত্র কিছু নয়। কারণ, হিড়িম্বের সাথে যুদ্ধের প্রারম্ভে ভীম হিড়িম্বকে বলছেন, 'তোমার ভগিনীর দোষ কি, ইনি নিজের বশে নেই, শরীরের ভিতর যে অনঙ্গদেব আছেন তাঁরই প্রেরণায় ইনি আমার প্রতি আসক্ত হয়েছেন।' অর্থাৎ, আসক্তি ভীমেরও এসেছিল কিন্তু শিক্ষা ও কর্তব্যবোধ তাঁকে সংযত রেখেছিল (এখনও এই বিষয় ঘটতে দেখা যায়)। যাই হোক, শর্ত সাপেক্ষে ভীম স্নান আহ্নিক শেষে হিড়িম্বার সঙ্গে মিলিত হবেন এবং সন্ধ্যার পূর্বেই ভাই-মায়ের কাছে ফিরে আসবেন। কূটনৈতিক ভাবে রাতের প্রহরাতে ভীম এবং দিনের আলোতে যা পারো কর। আমার বাবা ছাত্রজীবনে বলতেন, সারা দিন যা পারো করো কিন্তু সন্ধ্যের আগে ফিরে এসো। দুটোকে মেলাচ্ছি না, তবুও কথাটার মধ্যে কোথাও যেন এক নাগরিক সুর আছে। ধরে নেওয়াই যায়, ভীম ও হিড়িম্বা কাছে পিঠেই থাকতেন। কবি কিন্তু বলেছেন, আকাশ পথে নিয়ে গেলেন কিম্বা কিছুকাল পরেই এক ভীষণ বলবান পুত্র হল, পুত্র জন্মাবার পরেই যৌবন প্রাপ্ত হয়ে সর্ব প্রকার অস্ত্র প্রয়োগে দক্ষ হল – আমার মনে হয় কবির লক্ষ্য যেহেতু যুদ্ধের কাহিনীতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া, তাই এদিকে অধিক মন দেননি। আমার মতে, হিড়িম্বা-পুত্র ঘটোৎকচকে নিয়ে পাণ্ডবদের থেকে খুব দূরে ছিলেননা। এমন সন্দেহ হবার কারণ একটি কথায় হয়েছে, আর কথাটা হল এই, 'আমাকে মনে মনে ভাবলেই উপস্থিত হব কিম্বা প্রয়োজন হলেই উপস্থিত হব' । এখানেই অতি মানবীয়তা, সুরিয়েলিসটিক ভাবনার সৃষ্টি। নচেৎ, ওই শিক্ষা দীক্ষা পাণ্ডবদের তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। কিন্তু সামনে কখনও আনতোনা। যেহেতু, তিনি অনার্যা নারীর পুত্র। এমন সন্দেহের আরও কারণ আছে এই যে, যুদ্ধ পর্বে উল্লেখ আছে পাণ্ডব পক্ষের তিনবীর, অর্জুন, ভীম/সাত্যকি(সাত্যকি উল্লেখ করার কারণ যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণ যখন বন্দী করতে চাইছেন তখন অর্জুন সংসপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার সময় সাত্যকিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাই সাত্যকিকে সংযোজন করেছি ভীমের সাথে) এবং ঘটোৎকচ। সাত্যকি যদি অর্জুন-শিষ্য হতে পারে তাহলে ঘটোৎকচ বা নয় কেন? এছাড়া ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির যেভাবে ব্যাকুল হয়ে কৌরবদের মধ্যে দ্রোণ ও কর্ণকে প্রধান শত্রু রূপে চিহ্নিত করে তেড়ে গিয়েছিলেন, বোঝা যায় এই জ্যেষ্ঠ্য সন্তানের প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ অপরিসীম অথচ কৃষ্ণের ঠিক তার বিপরীত। এই জায়গাতেই যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণের চেয়ে নিষ্কলুষ ও মহান। অবশ্য সে আলোচনা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এরপর দেখি, বনপর্বে যেখানে গন্ধমাদন পর্বতে প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে দ্রৌপদীসহ সবাই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন ভীমের স্মরণ মাত্রেই অনুচরসহ পুত্র ঘটোৎকচ হাজির। তার আগে, ঘটোৎকচ শিক্ষান্তে উত্তরদিকে চলে গেছেন। সে জায়গায় কি দেখলাম মাতা দ্রৌপদী কিন্তু পুত্র ঘটোৎকচের কাঁধে। আর বাকিরা, অনুচরদের। কিন্তু লোমশ মুনি আপন বলে সিদ্ধমার্গে আগে আগে চললেন। ব্রাহ্মণ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের এক চরম নিদর্শন। অথচ মিশ্র রক্তের ঘটোৎকচ কিন্তু তার পরিবারের কাছে ব্রাত্য তো নয়ই বরঞ্চ অমিশ্ররক্তদের (অনুচরদের) নিয়ে ত্রাতার ন্যায় উপস্থিত। দেখবেন, রাস্তা ঘাটের সংস্কারে অন্ত্যজ লোকেরাই কাজ করে। ব্রিটিশ আমলে যখন এই রেললাইনের কাজ শুরু হয় তখন অরণ্য ধ্বংস এবং এই রাস্তার কাজ করানোর জন্যে বিদ্রোহ পর্যন্ত হয়েছিল। তাহলে দেখতে পাই, কায়িক পরিশ্রমের এবং কঠিন কাজ গুলোতেই এই অন্ত্যজ কিম্বা অরণ্যচারীদের কথাই তথা কথিত সভ্যদের স্মরণে আসে।।

বন পর্বের পর ঘটোৎকচের কোনও খবর নেই। তবে পাণ্ডব দের সঙ্গে যে নিবিড় না হলেও যোগাযোগ ছিল এ বোঝা যায়। কারণ ভীষ্মের সৈন্যাপত্যে চতুর্থদিনেই যখন ভীম ভগদত্তের আঘাতে মূর্ছিত হলেন তখন তিনি অন্তর্হিত হয়ে মায়া রূপ ধারণ করে কৌরব সৈন্যদের সংহার করতে শুরু করলেন। সেই সময় তাঁর অনুচর রাক্ষসগণও (অঞ্জন, যামন ও মহাপদ্ম) হাজির হলেন। এখানে দুটি বিষয় পরিস্কার। এক, যুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি ছিলেন পিতা ভীমের কাছাকাছি। দুই, প্রথমেই অনুচরদের আনেননি। পিতা আক্রান্ত হতে তিনি তাঁর অনুচরদের হাজির করেছেন। তাহলে বোঝা যায় অত্যন্ত পিতাভক্ত এই সুসন্তান ভীষ্মের শত তাচ্ছিল্য, গঞ্জনা সত্ত্বেও তিনি পিতাসহ পাণ্ডবদের তার সাধ্য মত আগলে রেখেছেন। এবং কোথাও তাঁর মুখ দিয়ে কোনও কথা শোনা যায়নি। এর মানেই, নীরবে পিতৃকুলের সেবা তার জীবন দিয়ে করে যেতে চেয়েছেন। যেখানে ভীষ্ম বলছেন, "দুরাত্মা হিড়িম্বা-পুত্রের সঙ্গে আমি এখন যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করিনা.... ।" লক্ষ্য করুন, "দুরাত্মা" শব্দের ব্যবহার কিভাবে ভীষ্ম করছেন। তিনি জানতেন এ তাঁরই বংশধর। কিন্তু, অনার্য রাক্ষস মায়ের জন্যে সে দুরাত্মা। অদ্ভুত, ভীমের বীর্যও সেখানে অবহেলিত।

এরপর, দেখি অষ্টম দিনের যুদ্ধ। তখনও ভীষ্ম কৌরব পক্ষের সেনাপতি। ইরাবানের মৃত্যু দেখে ঘটোৎকচ ক্ষিপ্ত হয়ে দ্রোণসহ কৌরবপক্ষকে প্রায় পরাস্ত করে ফেললেন। কে এই ইরাবান! অর্জুন-উলূপীপুত্র। ইনিও অন্ত্যজ। নাগকন্যা উলূপী। নাগ, নিঃসন্দেহে অনার্য গোষ্ঠী ভুক্ত হবেনই। আমার মতে বেদে সম্প্রদায়ভুক্ত হলেও হতে পারে। ইরাবান, তার ভাই এবং অনার্য মাতার পুত্র। এখানেও দুটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। ভ্রাতৃপ্রেম, স্ব-জাত্যাভিমান এবং দুজনেই মহান বংশের দ্বারা উপেক্ষিত। সুতরাং, ঘটোৎকচ বিক্রম ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে কৌরবদের সামনে উপস্থিত।

এরপর দেখতে পাই চতুর্দশ দিবসে। ঘটোৎকচ-পুত্র অঞ্জনপর্বা নিহত অশ্বত্থামার হাতে। বাবা ঘটোৎকচ আক্রমণ করছেন তাঁর পুত্রহন্তারককে। কিন্তু অশ্বত্থামা বললেন, 'বৎস, আমি তোমার পিতার তুল্য, তোমার উপর আমার অধিক ক্রোধ নেই।" অশ্বত্থামা কিন্তু ব্রাহ্মণ। কিন্তু কোথাও যেন এক ক্ষীণ অনুকম্পা। আসলে অশ্বত্থামার চরিত্র বিশ্লেষণে বোঝা যায় তিনি প্রচ্ছন্ন ভাবে পাণ্ডবদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। একদম শেষ অংশটুকু বাদ দিলে। না হলে সেই বিরাট পর্ব থেকে তিনি ন্যায়ের পক্ষেই কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে ঘটোৎকচকে পুত্রতুল্য মনে করায় অশ্বত্থামার উদারতাই প্রমাণিত হয়, যদিও তা বিক্ষিপ্ত। এখনও তো কেউ কেউ তেমনই হন।

এই চতুর্দশদিনেই কিন্তু যুদ্ধ শর্ত লঙ্ঘিত হয়ে অন্ধকার নেমে আসার পরেও যুদ্ধ চলেছিল। জয়দ্রথবধের পর কৌরবেরাই এই শর্ত উপেক্ষা করেন। কর্ণ সেদিন অপরাজেয়ের মত পাণ্ডব সৈন্যহত্যা করে চলেছে। যুধিষ্ঠির ভয়ার্ত হয়ে কৃষ্ণকে কর্ণবধের জন্যে অনুরোধ জানালে, অর্জুন কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইলেন। তখন কৃষ্ণ বললেন, "তুমি অথবা রাক্ষস ঘটোৎকচ ভিন্ন আর কেউ কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে না।" এখানেও কৃষ্ণ "রাক্ষস" কথা ব্যবহার করলেন। কেন? পাণ্ডু পৌত্র সম্পর্কে তাঁর এই হীন মন্তব্য কেন? সেই ছোট থেকেই দেখি ইনি রাক্ষসদের প্রতি বিরূপ। তাহলে, তাঁর মনে এই রাক্ষস তথা অনার্যদের পরাস্ত কিম্বা নিশ্চিহ্ন করার স্পৃহা ছিল? যাক সেকথা। এটা স্বীকারে তিনি বাধ্য হলেন যে, ঘটোৎকচ অর্জুন-তুল্য যোদ্ধা। কিন্তু কি নিষ্ঠুর তার সঙ্গে এও জানাচ্ছেন যে অর্জুনকে মারবার জন্যেই ইন্দ্র-দত্ত শক্তি কর্ণ সব সময়েই কাছে রাখেন। আবার এও স্তোক দিচ্ছেন ঘটোৎকচের কাছে যে অস্ত্র-শস্ত্র আছে কর্ণকে পরাজিত করবেই। অর্থাৎ সুকৌশলে কর্ণের সামনে এগিয়ে দেওয়া। আর সেদিন যেন সংহারক হয়ে পাণ্ডব পক্ষের ত্রাতার ভূমিকায় নেমেছেন ঘটোৎকচ। অনন্যোপায় কর্ণ।

এরপরের ঘটনাতো জানা সবার। মরতে মরতেও কৌরবদের সেনা তিনি সংহার করে চলেছেন। শেষ নিঃশ্বাস ফেলা পর্যন্ত পিতার কুল রক্ষা করে চলেছেন চির লাঞ্ছিতা মায়ের চির লাঞ্ছিত রাক্ষস পুত্র ঘটোৎকচ। রথ থামিয়ে কৃষ্ণের নৃত্যে যে গাথা সেদিন রচিত হয়েছিল তার ধারা আজও বহমান।

হে বীর, হে নিঃস্বার্থ, হে চিরবঞ্চিত, লাঞ্ছিত, মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে সংগ্রামের বীজ সেদিন পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলে সেই সংগ্রাম আজও চলছে। অন্ত্যজের, প্রান্তিকের অধিকারের দাবীতে, অনার্য এই শব্দের ঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সময়ের সাথে একদিন তোমরা স্বীয় আসনে প্রতিষ্ঠা পাবেই, সেদিন অন্য এক মহাকাব্য রচিত হবে অন্য এক ব্যাসদেবের কলমে।।

হে বীর, প্রণাম তোমায়।।


(আমার এই বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ ভাবে আমার। কৃতজ্ঞতা পূর্বেই স্বীকার করেছি, রাজশেখর বসু, নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ি, সুকুমারী ভট্টাচার্য, সুখময় ভট্টাচার্য, ইরফান হাবিব এবং আমার এই হাবিজাবিকে সমর্থন, সমালোচনা ও উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, সেই বন্ধুদের।)

1 comment: