স্মৃতির সরণীঃ স্বপন দেব
Posted in স্মৃতির সরণী
সত্যকাম
স্বপন দেব
কাহিনীটা আমি শুনেছিলাম চল্লিশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল। ভাবতেই কেমন লাগে, আমরা কেমন দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে গেলাম! সে যাই হোক, কতদিন আর আছি নিজেই জানিন। এই সুযোগ। গল্পটা বরং বলেই ফেলি...
গল্পটা বলেছিলেন বাংলার সাহিত্য জগতের সর্বকালীন সেরাদের অন্যতম লেখক নারায়ণ সান্যাল। বলেছিলেন তার এক সহপাঠির বাড়িতে বসে। তাঁর সেই সহপাঠিটি আবার আমার এক সহপাঠির নিজের কাকা। তারা দুজনেই আর ইহজগতে নেই। তিনি কোথাও লিখে গেছেন কিনা জানিনা, যদি লিখে থাকেন আগেভাগেই মার্জনা চেয়ে রাখছি। নারায়ণ সান্যাল মহানুভব মানুষ।তিনি আমার মত চুনো পুঁটিকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। ওনার বয়ানেই বলছি -
চৌষট্টি পঁয়ষট্টি সাল হবে। তখন আমরা চক্রবেরিয়া রোডের বাড়িতে থাকতাম। আমি তখন পি ডাব্লু ডির ইঞ্জিনিয়ার। দু একটা বই লিখে বন্ধু মহলে একটু আধটু নামডাক হয়েছে। বেশ লাগে নিজেকে সাহিত্যিক ভাবতে। কাজে কর্মে এখানে সেখানে যেতে হয়। মাঝে মাঝে কলকাতার বাইরে। কেউ অচেনা কোনো লোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে মাঝে মাঝে শুনতে পাই, আরে আপনিই সেই, আপনার কত নাম শুনেছি...মনের মধ্যে একটা খুশি খুশি ভাব হয়। তাও সন্তর্পনে জিগ্যেস করি, পড়েছেন নাকি আমার লেখা? ঝটপট উত্তর আসে, আরে পড়ব না কেন? আমার ছেলে মেয়েরা তো আপনার ফ্যান। আগে জানলে ওদের নিয়ে আসতাম।
এবার একটু গোলমেলে ঠেকে। তাও ভয়ে ভয়ে আবার চেষ্টা করি, কোনটা পড়েছেন? আরে আপনার টেনিদা কে না পড়েছে, যা একখানা ক্যারেক্টার বানিয়েছেন, আর হাবুল-ক্যাবলা, হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় মশাই। আমারও দম বন্ধ হয়ে আসে, হাসিতে নয় কান্নায়। কোনো রকমে কান্না চেপে বোঝাতে যাই, আরে আমি নই - উনি প্রথিতযশা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়....কে শোনে কার কথা। ততক্ষণে সাহিত্য প্রেমী বাঙালি হাওয়া। যাবার আগে পিঠ চাপড়ে বলে গেলেন, আরো লিখুন মশাই। নিজের জন্য কষ্ট হয়। আরো বেশি কষ্ট হয় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্যে। মোটামুটি ভাবে এটাই আমার সাহিত্যিক জীবনের অবস্থা তখন।
রবিবার দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে সামনের ঘরে বসে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছি, হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে একটা শব্দ। জানলার ফুলকাটা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখলাম, বাড়ির সামনে একটা সাদা অ্যামবাসেডার গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।কালো কাঁচ লাগানো। সিনেমার হিরো আর দেশের ভিলেনরা ছাড়া কালো কাঁচওয়ালা গাড়ি তখন খুব একটা দেখা যেত না, তাও আবার আমাদের এই গলিতে। ভাবলাম ড্রাইভার সাহেব বোধ হয় কোনো মহাজনকে নামিয়ে দিয়ে এখানে এসে জিরিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু না, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।
বিরক্ত হলেও উঠতে হলো। বোধহয় কোনো ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি আবার পাড়ার কারো নাম ধাম জানিনা। খুলেই দেখি, রীতিমতো উর্দি পরা ড্রাইভার দাড়িয়ে, ইয়ে নারায়ণ সান্যাল কা কোঠী? নাম পদবি সব মিলে যাচ্ছে। ভুল হওয়ার কোনো চান্স নেই। বললাম, হ্যাঁ এটাই, কিন্তু... কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম - আমার কথার পরোয়া না করে ড্রাইভার সাহেব কালো কাঁচওয়ালা গাড়ির দিকে মাথা ঘোরালেন।
কালো কাঁচ অল্প একটু নামানো, এহি হায় সাব...দরজা খুলে বেরিয়ে এলো সুদর্শন এক যুবক। চোখে কালো সান গ্লাস, সুঠাম চেহারা। পেছনে গাট্টা গোট্টা স্যুট বুট পরা আরো দুজন। বাঙালি নয় এটুকু বোঝা যাচ্ছে। কাছে এসে হাত জোর করে নমস্কার করে নাম জানিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
আমিও থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এরা কে ? আমার বাড়িতেই বা কেন? ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে নামটাও ভালো করে শোনা হলোনা। ধরম দেওল না কি যেন - আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভদ্রলোক কালো চশমা খুলে আবার বিনীত ভাবে জানালেন, হৃষিকেশ মুখার্জী নামে কোনো এক বাঙালি তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। হিন্দি সিনেমা একটা দুটো দেখেছি বটে। কিন্তু কে তার পরিচালক ইত্যাদি নিয়ে কোনদিন মাথা ঘামায়নি। গুরু দত্ত, বিমল রয় - ব্যাস। আমার দৌড় ওই অব্দি। তাই এই নামটাও মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে গেল।
পেছনের দরজায় গিন্নির খট খট - আহা, একটু পরে ডাকাডাকি না করলে হত না? বোঝাতে যাচ্ছিলাম, আমি কোনো হৃষিকেশ মুখার্জী কে চিনিনা। বোধহয় কোনো গন্ডগোল হয়ে গেছে - কিন্তু খট খট শব্দটা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। বুঝলাম জরুরি অবস্থা। বললাম দাড়ান একটু।ভিতরে ঢুকতেই দেখি সবিতার মুখ চোখ বিস্ফোরিত, তুমি একটা কি...তুমি ধর্মেন্দ্রকেও চেন না!
কে ধর্মেন্দ্র? ঐ যে লোকটা আমাদের দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন? সেই বম্বের ধর্মেন্দ্র! কি মুশকিল, আমি চিনব কি করে? আমি কি হিন্দি সিনেমা দেখি? আর আমার বাড়িতে ভরদুপুরে ধর্মেন্দ্র এসে হাজির হবে তাই বা কি করে বুঝব? সে আমি কি জানি? তাড়াতাড়ি যাও ভেতরে নিয়ে এস - গিন্নি ঠেলা মেরে টেনিস বলের মত ফেরত পাঠিয়ে দিল।
ফিরে এসে বললাম, আসুন আসুন, ভুল হয়ে গেছে, চিনতে পারিনি, আমার বাড়িতে কি হেতু আগমন? দেখলাম ধর্মেন্দ্র লোকটি খুব অমায়িক। বলল, ভেতরে আসার সময় নেই।আপনাকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।
কি কথা? আমি যুগপৎ কৌতুহলী এবং বিস্মিত। আপনার লেখা সত্যকাম বইটা আমি পরেছি। ঘাবড়ে গিয়ে বোকার মত প্রশ্ন করলাম...আপনি বাংলা বই পড়েন? আরে না না, ধর্মেন্দ্রর মুখে স্মিত হাসি। হামি নই, হৃষিকেশ বাবু আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন। পুরোটা নয়, সামারি বলতে পারেন। আমি ওটার ওপর একটা সিনেমা প্রোডাকশন করতে চাই। হৃষিকেশ বাবু ডাইরেক্ট করবেন।কলকাতায় আমি অন্য কাজে এসেছিলাম। আপনার সাথে দেখাও হলো। আপনি যদি রাজি থাকেন - তাহলে আপনাকে একবার বম্বে আসতে হবে।
বলে কি লোকটা? কে এই হৃষিকেশ মুখার্জী? আহা এত মেঘ না চাইতেই জল! সেই সময় বোম্বেতে চৌপাট্টি থেকে লোক ধরে এনে স্ক্রিপ্ট লিখিয়ে নেওয়ার চল খুব একটা ছিল না। শরৎচন্দ্র, জরাসন্ধ নিদেন পক্ষে বিমল মিত্রের মত কালজয়ী বাঙালি লেখকদের কাহিনী নিয়ে সিনেমা হত। বললাম, কবে যেতে হবে? আবার হাসলেন ধর্মেন্দ্র, আমার ছেলেমানুষী দেখে। আপনাকে সব ডিটেলস ফোনে জানিয়ে দেব বম্বে পৌঁছে। বললাম তাহলে আমার অফিসের নাম্বারটা... সব কুছ হায় - কালো চশমার ফাঁক দিয়ে রহস্যময় হাসি হেসে করমর্দন করে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন অনুপমার নায়ক...।
গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে... আমাদের বাড়িতে ধর্মেন্দ্র এসেছিল।অনেক অচেনা লোক বাজারে আমাকে দেখলে দাড়িয়ে গল্প সল্প করে। হাঁ করে বসে আছি... দিন যায়...সপ্তাহ যায়...মাস যায়...ফোন আর আসেনা। অফিস থেকে বেরোবার আগে আব্দুলকে বলে যাই, বম্বে থেকে ফোন এলে নাম ঠিকানা ঠিক ঠাক লিখে রেখো কিন্তু...
এমনি করে মাস খানেক যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব সবাই আমাকে সান্তনা দিতে শুরু করলো...আরে এরকম অনেক হয়...কেউ কেউ গাইতে শুরু করলো, গুল সবই গুল...তখন অতল জলের আহ্বান সিনেমার ওই গানটা খুব হিট ছিল....
ঠিক তখনই শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে একদিন বাড়িতে একটা মোটা খাম এলো। বম্বের গন্ধ মাখা খাম। ভিতরে একটা প্লেনের টিকিট। তাজ হোটেলের রুম নম্বর আর কনফার্মেশন। সঙ্গে একটা চিঠি, লিখেছেন পন্ছী আর্ট নাম কোনো এক কোম্পানি, তার সেক্রেটারি - অমুক তারিখে সন্ধ্যে সাতটায় আপনার সাথে দেখা করবেন ধর্মেন্দ্র আর হৃষিকেশ মুখার্জী, বিষয় - সত্যকাম কাহিনী নিয়ে আলোচনা। পাদটিকা দিয়ে লেখা, আপনার কাহিনীর একটা আনুমানিক মূল্য অবশ্যই ভেবে রাখবেন। বিস্তারিত কথা ঐদিন হবে।
আমি লাফিয়ে উঠলাম। কিন্তু মূল্য? সেটা তো কোনদিন ভাবিনি... গল্প লিখি। পাবলিশার্স মূল্য ঠিক করেন। হঠাৎ এক বন্ধুর কথা মনে পড়ল। ওর একটা গল্প নিয়ে বাংলা সিনেমা হয়েছে। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সে আমাকে বলল, আমাকে তো দু হাজার টাকা দিয়েছিল। কিন্তু তোর তো বম্বের মামলা। দশ হাজার চাইবি। পাঁচ হাজারের এক পয়সা কমে রাজি হবি না কিন্তু... আমি মহানন্দে ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে যথাসময়ে বম্বে যাত্রা করলাম।
বম্বের তাজমহল হোটেলে নিজের রুমে বসে আছি। এটার নাম বোধহয় প্যালেস উইং। সন্ধ্যে হয় হয়। পায়ের নিচে পারস্যের গালিচায় পা ডুবে যাচ্ছে। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আরব সাগরের জল। সেখানে সূর্যাস্তের রঙের খেলা। ডুবে যাচ্ছে মন। সামনের টেবিলে রাখা অ্যানটিক ফুলদানির সোনালী ফিলিগ্রীর ওপর অস্তরাগের আভা। কোথা থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ। পি ডাব্লু ডির চাকরি করে তো আর এখানে ঢোকা যায় না! তাই এই মুহূর্তটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি। সব মিলিয়ে বেশ একটা বাদশাহী মেজাজ। এখানে টেবিল চেয়ার জানলার পর্দা। কাপ প্লেট সবেতেই তাজের ছোঁয়া। দুদিন ধরে আবার সত্যকাম পরলাম। নিজের লেখাই আবার পরলাম, অনেক নোট নিলাম। নায়ক সত্যপ্রিয়। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আমার মতই। যদি পরিচালকের কোনো কাজে লেগে যায়।
ঘড়ি ধরে ঠিক সাতটায় ফোন বাজলো। বোম্বেতে মানুষের সময়ের দাম আছে। ভিসিটর। দরজা খুলে দেখি কোট প্যান্ট মাথায় লাল পাগড়ি এক শিখ যুবক।সুদর্শন চেহারা। নাম বলল, মোহন সিং। এক কালে নাকি কলকাতায় ছিল। একটু একটু বাংলা জানে। হাতে ব্রিফকেস। কিন্তু হৃষিকেশ মুখার্জী কই! আর ধর্মেন্দ্রই বা কোথায়?
ওরা আসতে পারবেন না, সবিনয়ে জানালো ছেলেটি। তাহলে কি হবে? আমি উৎকন্ঠিত! জরুরি কামপে ফাঁস গেয়ে হোগা, ঘাবরাইয়ে মত সানিয়ালজী, মেরা পাশ ক্যাশ হ্যাঁয়...ক্যাশ।
শুধু ক্যাশ নিতে আমি ভিখিরির মত ছুটে এসেছি এই তাজমহলে! গলাটা একটু জ্বালা করে উঠলো। সিংজী নিজেই ফোন করে চা আনলেন। গুম মেরে বসে আছি। টাকার গরম দেখাচ্ছে? বাংলায় বিড়বিড় করলাম নিজের মনেই। মোহন সিং নিরুত্তাপ। কিছুই বোঝেনি। ফিনফিনে চায়নার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, বলুন স্যার, কত দাম ভেবেছেন?
চুপ করে রইলাম। আত্মশ্লাঘা না মূল্যবোধ কোনটায় আটকাচ্ছে কে জানে। কিন্তু আপাতত আত্মবিশ্লেষণ মুলতুবি রেখে সামনে ব্রিফকেস নিয়ে বসে থাকা এই ছেলেটিকে কিছু একটা বলতে হয়। সত্যপ্রিয় ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য তিলে তিলে নিঃশেষিত হয়ে গেছে - তাও নিজেকে বিকিয়ে দেয় নি। সেসব এ কি বুঝবে? কি বলব একে? সত্যপ্রিয় ইস নট ফর সেল।
কিছু তো একটা বলতেই হবে। ভাবনা চিন্তা না করে এত দূরে এসে এদের পয়সা ধ্বংশ করে তাজ হোটেলে মস্তি করছি। দুম করে সেটাই বা কি করে বলি?
কুছভি বলিয়ে সানিয়ালজী, সরমাইয়ে মত - আবার মোহন সিং এর আশ্বাস বাণী।
মনে মনে বললাম, একটাই রাস্তা লোকটাকে বিদেয় করার। একটু নির্লজ্জ হতে হবে। চোখ বুজে দাঁতে দাঁত চেপে দর হাঁকলাম পঞ্চাশ হাজার। একটা বিদ্রুপের হাসির জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম।
সেরকম কিছুই হলনা। খুট করে ব্রিফকেস খোলার শব্দ হলো। চোখ খুললাম। ব্রিফকেসের মধ্যে থাক থাক করে রাখা অনেকগুলো হাজারটা একশ টাকার বান্ডিল। এত টাকা একসাথে আমি কখনো দেখিনি। ঠিক যেমন হিন্দি সিনেমাতে দেখা যায় আজকাল। মোহন সিং পাঁচটা একশ টাকার বান্ডিল তুলে নিয়ে আমার টেবিলের ওপর সযত্নে রেখে মিষ্টি হাসলো। তার সাথে এক দিস্তে কাগজ পত্র।
তো মিস্টার সানিয়াল, মেরা কাম খতম। একটা ফোন করতে হবে - রিসেপশনে ফোন করতেই আর এক ভদ্রলোক উপস্থিত হলেন। নিচেই ছিলেন বোধহয়।পরিচয় করিয়ে দিলেন মোহন সিং, আমাদের উকিল। দিব্বি ভালো ছেলের মত উকিল মহাশয়ের কথা মেনে যেখানে যেখানে বললেন সই করে দিলাম। লেখা আছে আমার কাহিনীর সমস্ত স্বত্ব আজ থেকে পন্ছি আর্টস কোম্পানির। মোহন সিং বললেন, এতগুলো টাকা নিয়ে কলকাতা ফিরবেন। নিচে বলে রেখেছি আপনার জন্য এয়ারপোর্ট অব্দি গাড়ি বুক করা আছে...
ধন্যবাদ দিয়ে পরদিন কলকাতায় ফিরে এলাম। পরে শুনেছিলাম ব্রিফকেসটায় দু লাখ টাকা ছিল। একটু হাত কামড়ে ছিলাম বৈকি। আরো একটু নির্লজ্জ হতে পারলাম না! সেই যে...রেখেছ বাঙালি করে...আহা
সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়...বাড়ি ফিরে এসে কাজে কর্মে ভুলেই গেছিলাম সত্যকামের কথা। হঠাৎ একদিন অফিসে ফোন এলো। সত্যকামের প্রিমিয়ার শো, বম্বের সঙ্গম টকিস না কোথায় যেন। ফোনের অন্যদিকের মেয়েটি দিনক্ষণ জানালো, সপরিবারে আমন্ত্রণ। নাম ধাম লিখে নিলেন পরিবারের সবার। প্লেনের টিকিট আমন্ত্রণ পত্র যথাসময়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাড়িতে খুশির ফোয়ারা। মেয়ের ইস্কুল, পাড়ার মহিলা মহলে সবাই জেনে গেল, সান্যাল মহাশয় যাবেন সাগর সঙ্গমে - তাও আবার সপরিবারে! খুশিটা বেশিদিন টিঁকল না। যাওয়ার সপ্তা দুয়েক আগে বাড়িতে টেলিগ্রাম এলো, অনিবার্য কারণে প্রিমিয়ার শো বাতিল হয়েছে, আবার কবে হবে জানিয়ে দেওয়া হবে।
গিন্নির মুখ ভার। মেয়ের প্রেস্টিজ পাঙ্কচার। কেন জানিনা আমার মনে হলো, ভালই হয়েছে। সেই নেমন্তন্ন আর এলোনা। তার বদলে এলো অ্যাপলোজি লেটার। প্রিমিয়ার শো করা হয়েছিল ছোট করে কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে বম্বের বাইরের অতিথিদের জানানো যায়নি...
একদিন শুনলাম সত্যকাম নাকি সুপার হিট হয়েছে। ইতিমধ্যে ধর্মেন্দ্র, হৃষিকেশ বাবু এবং আরো অনেকে বহুবার বোম্বেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। অথবা হয়ত ইচ্ছে করেই যাইনি। কাজের অজুহাত দিয়েছি। বলেছি, কলকাতায় এলে দেখে নেবো। হয়ত অভিমান। ক্ষোভ। মনের মধ্যে কোনটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে বসবাস করে কে জানে! কিন্তু ভবিতব্য কে আটকাবে?
একদিন সেই সত্যকাম কলকাতায় এসে পৌঁছল। তাও আমার বাড়ির কাছে পাড়ার বসুশ্রী সিনেমায়। রোজই সবিতা বলে, চল দেখে আসি। রোজই এটা ওটা বলে এড়িয়ে যাই। বেশিদিন আর ঠেকানো গেল না। গিন্নি টেনে হিঁচড়ে বের করেই ছাড়ল একদিন।
রবিবারের শীতের দুপুরে সিনেমা হলে এসে দেখি লোকে লোকারন্য। যথারীতি হাউস ফুল। একটা রোগা পটকা টেরি কাটা ছেলে এসে জানালো, চাই নাকি দাদা, ব্যালকনি আছে..পাঁচ টাকা...
প্রায় কিনেই ফেলেছিলাম। পকেটে হাত ঢোকাতেই আচমকা হলের ওপরে বিরাট পোস্টারটার দিকে নজর পড়ল। নির্ভিক সেই যুবকের ছবি...সত্যপ্রিয়... আমারই সৃষ্টি...সেকি শুধুই গল্প..শুধুই মিথ্যে...তাহলে সাহিত্যিক আর চালিয়াতের তফাৎ কি...কে যেন বলেছিল...চালিয়াত মিথ্যে বলে সত্যকে চাপা দিতে ...সাহিত্যিক মিথ্যে বলে সত্যকে উদঘাটন করতে...
পোস্টারের সত্যপ্রিয় নিষ্পলক তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ছিঃ ছিঃ কি করছি আমি এখানে! যে সত্যপ্রিয় কোনদিন মিথ্যের সাথে আপোষ করেনি তাকে বিক্রি করে দিয়েছি টাকার বিনিময়ে! আর আজকে সং সেজে তাই দেখতে যাচ্ছি কালোবাজারে টিকিট কিনে! কি যেন একটা হলো। নাটুকেপানা আমার আসে না। আজ ঠিক তাই করলাম। পকেট থেকে হাত বের করে সবিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, চল...
কোথায়? বাড়িতে... সবিতা অবাক। একটু সন্ত্রস্তও। মেয়ে বৌএর হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে বললাম, দেখবো না এই সিনেমা।
কেন? কি হলো? শরীর খারাপ?...আমার মাথায় তখন আগুন জ্বলছে। বাড়ি চল বলছি। এক গাদা লোকের সামনে সবাইকে টানতে টানতে রিক্সায় উঠিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পেছন থেকে ব্ল্যাকার ছেলেটা তখনও বলে চলেছে, আরে দাদা কত দেবেন বলবেন তো? যত্ত সব পাবলিক মাইরি...
গল্পটা শেষ হতেই আমরা যারা শুনছিলাম হা হা করে উঠেছিলাম। তাহলে আর সত্যকাম দেখলেন না আপনি? নারায়ণ সান্যাল মুচকি হেসে বলেছিলেন, না না দেখেছি। কিছুদিন পরেই। বসুশ্রী সিনেমা হলের মালিককে কে যেন জানিয়েছিল, আমি এ পাড়ার বাসিন্দা। সেই অতি সজ্জন মানুষটি আমার বাড়ি এসে অনেকবার ক্ষমা টমা চেয়ে আমাদের সবাইকে সাদরে নিয়ে গেলেন সিনেমা হলে। অনেক অনুরোধ সত্যেও টাকা পয়সা কিছুতেই নিলেন না। ধর্মেন্দ্র অসাধারণ অভিনয় করেছিল...
( আমার এক সহপাঠির কাকা ছিলেন নারায়ণ সান্যালের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সহপাঠী। তাঁর ভবানীপুরের বাড়িতে বসেই এটি আমার নারায়ণ সান্যালের মুখে শোনা। এর কোন লেখ্য-রূপ আমার কাছে নেই। কোনকালেও ছিলনা। কারো কাছে আছে কিনা বা নারায়ণ সান্যাল কোথাও এটি এইভাবে উল্লেখ করেছিলেন কিনা, তাও আমার জানা নেই। গল্পটি বলার সময়ে নারায়ণ সান্যালের গল্প বলার বা লেখার ভঙ্গির অক্ষম অনুসরণ করেছি মাত্র। আমি সত্যিই জানিনা, নারায়ণ সান্যাল কোথাও এই বিষয়ে কোন গল্প লিখেছিলেন কিনা। )
দারুণ লাগলো! অসম্ভব ভালো! অন্যরকম লেখা!
ReplyDeleteঅসাধারণ! খুব ভালো লাগলো!
ReplyDeleteতুলনাহীন! চমৎকার! এটা কি সত্য ঘটনা?
ReplyDeleteজাস্ট ভাবা যায়না!!
ReplyDeleteDarun likhechen!
ReplyDeleteBhalo laglo1
ReplyDeleteসবাইকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা নিরন্তর...
ReplyDeleteএটা কি সত্যি ঘটনা? নাকি নিছক ই এক গল্প ?
ReplyDeleteসুন্দর লেখার ভঙ্গী। এক নিটোল গল্পের আস্বাদ পেলাম!
ReplyDeleteনারায়ন বাবু ছিলেন আমার অতন্ত্য প্রিয় এক লেখক। কিন্তু আমি কোথাও এই ঘটনাটি পড়িনি!! তবে লেখাটি নিঃসন্দেহে অতীব মনোরম!
ReplyDeleteতাই জিজ্ঞাসা করছি, এটা কি সত্যি ? না বানানো গল্প?
ReplyDelete